জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ৭২তম দিনে তথ্য আপারা -সংবাদ
অবশেষে দুই মাস বারো দিনের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে এলো প্রতিশ্রুতি। এবার তথ্য আপা প্রকল্প (২য় পর্যায়) এর জনবল রাজস্বে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মহিলা শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুর্শিদ।
আন্দোলনের কারণে কেটে নেয়া বেতন ফেরত দেয়া হবে
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দেয়া হবে না
নারী সমাজের জয়: আন্দোলনকারীরা
বৃহস্পতিবার,(৭ আগস্ট ২০২৫) তথ্য আপা প্রকল্পের প্রতিনিধিদের সাথে এক সভায় উপদেষ্টা জানান, আগামী সপ্তাহে রাজস্বের প্রস্তাব পাঠানো হবে। তিনি বলেন, “আমার মুখের কথাই শেষ কথা, আমি ডাবল স্ট্যান্ড করি না, আমার ক্যারেক্টার চেঞ্জ হয় না।” প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তিনি মহিলা শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব মমতাজ বেগমকে প্রস্তাবনা পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেন এবং অবস্থানরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অফিসে ফিরে গিয়ে কর্মে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি জানান, আন্দোলনের কারনে কেটে নেওয়া বেতন ফেরত দেওয়া হবে। আন্দোলনরত কর্মকর্তা কর্মচারী কাউকে কোন রকম শাস্তি দেয়া হবে না। ৭২ দিন আন্দোলন শেষে এই জয় সারা বাংলাদেশের নারী সমাজের জয় বলে আখ্যা দেন আন্দোলনরত তথ্য আপারা।
বিপর্যস্ত ‘তথ্য আপাদের ৭২ দিনের লাগাতার কর্মসূচি
রুমি, একজন তথ্য আপা। কর্মক্ষেত্র কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায়। সেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদেরকে নানা বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ করতেন, সচেতনতা বার্তা পৌঁছে দিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী করতেন। কিন্তু এখন নিজেই বেকার। করোনাকালে স্বামীর চাকরি চলে যায়। খন্ডকালীন কাজ করলেও এখন অসুস্থ। ৬ বছরের মেয়ে ও ১৮ মাসের অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে তার চলার একমাত্র অবলম্বন ছিল ওই চাকরিটি।
রুমি জানান, ‘২০১৮ সালে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বে যোগ দেই। ঘরে ঘরে নারীদের আপনজন হয়ে তাদের তথ্যসমৃদ্ধ করে, সাত বছর পরে এসে দেখছি আমার চাকরিটাই নেই। এখন আমার সরকারি চাকরির বয়স নেই।’
তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘ওই সময় যদি সরকার আমাদের রাজস্বখাতে যুক্ত করার আশ্বাস না দিতো তাহলে হয়তো অনেকেই এই চাকরিতে আসতাম না। তখন আমাদের প্রায় সবারই চাকরির অনেক পথ খোলা ছিলো। আমাদের এই নি:স্ব হওয়ার দায় কে নিবে?’
শুধু রুমি নয়, শিক্ষিত নারী খুশবীরও একই অবস্থা। তিনি বলেন,
‘প্রকল্পটি নিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্প কর্মকর্তার উদাসীনতা রয়েছে।’
তিনি বলছিলেন তার মত আঙ্কের কথা। প্রকল্প শেষে এর জনবল রাজস্ব খাতে যাবে, এটা জেনে তারা চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। তাদের বেশিরভাগ অনার্স-মাস্টার্স পাস। কারও কারও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিও হয়েছিল। সংসার নিয়ে প্রকল্প এলাকায় সুবিধা বোধ করায় এবং রাজস্ব খাতে যাবে আশায় চাকরি বদলাননি। এখন তাদের নতুন কোনো চাকরিতে আবেদন করার বয়সও নেই।
কিন্তু তাদের এই অবস্থার উত্তরণে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থার কোনো হেলদুল নেই। ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহায়কদের টানা ৬৪ দিন অবস্থান- অনশন চললেও কোনো সাড়া মেলেনি সংস্থার পক্ষ থেকে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গত ২৮ মে থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছিল ‘তথ্য আপারা’। অনশনের সময় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঊর্ধ্বতন কেউ তাদের সাথে যোগাযোগ করেননি বলে জানান তথ্য আপারা। প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা যমুনা অভিমুখে যাত্রাও করেন। কিন্তু পুলিশ তাদের কয়েক দফা বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। এতে কয়েকজন আহত হন। পরবর্তীতে তারা অনশন ভেঙে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি করছেন।
তাদের দাবি- তথ্য আপা প্রকল্পে কর্মরত জনবলের সমগ্রেডে পদ সৃজন করে রাজস্বখাতে স্থানান্তর এবং বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও তথ্যসেবা সহকারীরা নিয়োগ পান যথাক্রমে ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর এবং ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর (২য় পর্যায়)। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের ৪৯২টি উপজেলার প্রান্তিক নারীর উন্নয়নে প্রায় ৭ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তারা।
জানা গেছে, নারীর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক সেবা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নাগরিক অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি, আইন, কৃষি ও ব্যবসায় সুবিধা দিতে ১৪ বছর আগে শুরু হয়েছিল ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প। মেয়াদ শেষে প্রকল্পের জনবলকে সমগ্রেডে পদসৃজন রাজস্বখাতে স্থানান্তরের কথা থাকলেও, প্রকল্পটি সমাপ্ত করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রায় দুই হাজার জনবল বেকার হয়ে যাবে, যাদের মধ্যে প্রায় ১৫০০ জন নারী। একসাথে এতগুলো নারী জনবল বেকার হওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, প্রকল্প পরিচালকের প্রকল্প সমাপ্তির ছয় মাস আগে মন্ত্রণালয়ে পদসৃজনের চিঠি পাঠানোর কথা। কিন্তু তা না করে বরং ছয়মাস আগে অর্থাৎ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি হঠাৎ করে এক নোটিশে ৬০৩ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি ৩০ জুনে শেষ হবে জানিয়ে অফিস ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েন তারা।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে-‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)।
২০১১ সালে পাইলট আকারে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ৪৯০টি উপজেলায় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয় (পরে আরও দু’টি উপজেলায় অফিস বিস্তৃত করা হয়)। প্রকল্পে প্রতিটি উপজেলায় সরাসরি নিয়োগ পাওয়া একজন তথ্যসেবা কর্মকর্তা, দু’জন তথ্যসেবা সহকারী রয়েছেন। আরও আছেন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ৪৯৫ জন অফিস সহায়ক।
২০২২ সালের ৩০ মার্চপ্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। পরে তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে, ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের জনবল ২ হাজার ৪৮৪। তবে প্রকল্পের জনবল অবকাঠামোতে সিকিউরিটি গার্ড এর কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাই প্রকল্পে এখন জনবল ১ হাজার ৯৮৩ জন।
প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর প্রকল্প প্রধান কার্যালয় মাঠ পর্যায়ের জনবলের সাথে কোনও যোগাযোগ না রাখায় তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে তাদের জানানো হয়, প্রকল্পের অফিস গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্প চালু রাখার দাবিতে গত বছরের ১৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা ও ১৯ আগস্ট সচিবালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। এর প্রেক্ষিতে ঐ বছরই ১৮ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছরের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
মেয়েদের চাকরি ও দু:স্থ নারীদের সহায়তায় ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) কার্যক্রমে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করার ক্ষেত্রে কার্যালয়গুলোতে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়। নারীদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সুবিধা দিতে পরে প্রকল্পে ‘লাল সবুজ ডটকম’ নামের ই-কমার্স সেবার উদ্যোগ যুক্ত করা হয়। প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এবং বেতন কাটায় সবাই ‘অনেক কষ্টে’ আছেন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, এই প্রকল্পে সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে তিন ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে এবং তাদের রাজস্বকরণের আশা দেখিয়ে ‘প্রতারণা’ করে যাচ্ছে।
জাতীয় মহিলা সংস্থা ২ জানুয়ারি এক চিঠিতে জানিয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ায় মাঠপর্যায়ের ৪৯২টি উপজেলা তথ্যকেন্দ্রের অফিস ভাড়া নবায়ন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে বলে যেসব ইউএনও অফিস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ৩০ জুনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হলো।
আন্দোলন পরিচালনা কমিটির সভাপতি সংগীতা সরকার সংবাদকে বলেন, ‘এই সময়ে এসে নারীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য ৬৪ দিন রাস্তায় থাকতে হবে- এটা কতটা দুঃখজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার নারীদেরকে শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করে কিন্তু সেই সরকারই শিক্ষিত নারীদেরকে তাদের অধিকার আদায় করার জন্য দিনের পর দিন রাস্তায় ফেলে রাখবেন এটা ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা। সব রাজনৈতিক দল আমাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। আমাদের চাওয়া সরকার নারীদেরকে সহায়তা করবে। সাত বছর ধরে নারীরা যে দক্ষতা অর্জন করেছে তা দেশ এবং সমাজের উন্নতির জন্য কাজে লাগাবে।’
সংগীতা বলেন, ‘আমিই সাত বছরের মধ্যে হিসেবে ৫ বছরের বেতন-ভাতা পাই। বাকিদেরও একই অবস্থা’
প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) শাহনাজ বেগম নীনা বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত দুই বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও এক বছর বেড়েছে। ইতোমধ্যে ডিপিপি দুইবার সংশোধন হয়েছে। তৃতীয়বার সংশোধনের সম্ভাবনা কম। ফলে মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে ধরে নিয়েছি। নতুন প্রকল্প নিয়ে এই জনবলের বিষয়ে কিছু করা যায় কি না দেখতে হবে।’
তবে কোন প্রকল্প নতুন পর্যায় আসলে তা আউটসোর্সিংয়ে হবে। আর আউটসোর্সিং নীতিমালা-২০২৫ অনুসারে পূর্বের প্রকল্প থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ জনবলকে নতুন পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া যাবে এবং বাকি ৭০ শতাংশ বাদ পড়বে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ৭২তম দিনে তথ্য আপারা -সংবাদ
বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫
অবশেষে দুই মাস বারো দিনের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে এলো প্রতিশ্রুতি। এবার তথ্য আপা প্রকল্প (২য় পর্যায়) এর জনবল রাজস্বে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মহিলা শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুর্শিদ।
আন্দোলনের কারণে কেটে নেয়া বেতন ফেরত দেয়া হবে
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দেয়া হবে না
নারী সমাজের জয়: আন্দোলনকারীরা
বৃহস্পতিবার,(৭ আগস্ট ২০২৫) তথ্য আপা প্রকল্পের প্রতিনিধিদের সাথে এক সভায় উপদেষ্টা জানান, আগামী সপ্তাহে রাজস্বের প্রস্তাব পাঠানো হবে। তিনি বলেন, “আমার মুখের কথাই শেষ কথা, আমি ডাবল স্ট্যান্ড করি না, আমার ক্যারেক্টার চেঞ্জ হয় না।” প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে তিনি মহিলা শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব মমতাজ বেগমকে প্রস্তাবনা পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেন এবং অবস্থানরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অফিসে ফিরে গিয়ে কর্মে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি জানান, আন্দোলনের কারনে কেটে নেওয়া বেতন ফেরত দেওয়া হবে। আন্দোলনরত কর্মকর্তা কর্মচারী কাউকে কোন রকম শাস্তি দেয়া হবে না। ৭২ দিন আন্দোলন শেষে এই জয় সারা বাংলাদেশের নারী সমাজের জয় বলে আখ্যা দেন আন্দোলনরত তথ্য আপারা।
বিপর্যস্ত ‘তথ্য আপাদের ৭২ দিনের লাগাতার কর্মসূচি
রুমি, একজন তথ্য আপা। কর্মক্ষেত্র কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায়। সেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদেরকে নানা বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ করতেন, সচেতনতা বার্তা পৌঁছে দিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী করতেন। কিন্তু এখন নিজেই বেকার। করোনাকালে স্বামীর চাকরি চলে যায়। খন্ডকালীন কাজ করলেও এখন অসুস্থ। ৬ বছরের মেয়ে ও ১৮ মাসের অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে তার চলার একমাত্র অবলম্বন ছিল ওই চাকরিটি।
রুমি জানান, ‘২০১৮ সালে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বে যোগ দেই। ঘরে ঘরে নারীদের আপনজন হয়ে তাদের তথ্যসমৃদ্ধ করে, সাত বছর পরে এসে দেখছি আমার চাকরিটাই নেই। এখন আমার সরকারি চাকরির বয়স নেই।’
তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘ওই সময় যদি সরকার আমাদের রাজস্বখাতে যুক্ত করার আশ্বাস না দিতো তাহলে হয়তো অনেকেই এই চাকরিতে আসতাম না। তখন আমাদের প্রায় সবারই চাকরির অনেক পথ খোলা ছিলো। আমাদের এই নি:স্ব হওয়ার দায় কে নিবে?’
শুধু রুমি নয়, শিক্ষিত নারী খুশবীরও একই অবস্থা। তিনি বলেন,
‘প্রকল্পটি নিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্প কর্মকর্তার উদাসীনতা রয়েছে।’
তিনি বলছিলেন তার মত আঙ্কের কথা। প্রকল্প শেষে এর জনবল রাজস্ব খাতে যাবে, এটা জেনে তারা চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। তাদের বেশিরভাগ অনার্স-মাস্টার্স পাস। কারও কারও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিও হয়েছিল। সংসার নিয়ে প্রকল্প এলাকায় সুবিধা বোধ করায় এবং রাজস্ব খাতে যাবে আশায় চাকরি বদলাননি। এখন তাদের নতুন কোনো চাকরিতে আবেদন করার বয়সও নেই।
কিন্তু তাদের এই অবস্থার উত্তরণে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থার কোনো হেলদুল নেই। ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহায়কদের টানা ৬৪ দিন অবস্থান- অনশন চললেও কোনো সাড়া মেলেনি সংস্থার পক্ষ থেকে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গত ২৮ মে থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছিল ‘তথ্য আপারা’। অনশনের সময় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঊর্ধ্বতন কেউ তাদের সাথে যোগাযোগ করেননি বলে জানান তথ্য আপারা। প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা যমুনা অভিমুখে যাত্রাও করেন। কিন্তু পুলিশ তাদের কয়েক দফা বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। এতে কয়েকজন আহত হন। পরবর্তীতে তারা অনশন ভেঙে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি করছেন।
তাদের দাবি- তথ্য আপা প্রকল্পে কর্মরত জনবলের সমগ্রেডে পদ সৃজন করে রাজস্বখাতে স্থানান্তর এবং বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও তথ্যসেবা সহকারীরা নিয়োগ পান যথাক্রমে ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর এবং ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর (২য় পর্যায়)। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের ৪৯২টি উপজেলার প্রান্তিক নারীর উন্নয়নে প্রায় ৭ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তারা।
জানা গেছে, নারীর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক সেবা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নাগরিক অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি, আইন, কৃষি ও ব্যবসায় সুবিধা দিতে ১৪ বছর আগে শুরু হয়েছিল ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প। মেয়াদ শেষে প্রকল্পের জনবলকে সমগ্রেডে পদসৃজন রাজস্বখাতে স্থানান্তরের কথা থাকলেও, প্রকল্পটি সমাপ্ত করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রায় দুই হাজার জনবল বেকার হয়ে যাবে, যাদের মধ্যে প্রায় ১৫০০ জন নারী। একসাথে এতগুলো নারী জনবল বেকার হওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, প্রকল্প পরিচালকের প্রকল্প সমাপ্তির ছয় মাস আগে মন্ত্রণালয়ে পদসৃজনের চিঠি পাঠানোর কথা। কিন্তু তা না করে বরং ছয়মাস আগে অর্থাৎ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি হঠাৎ করে এক নোটিশে ৬০৩ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি ৩০ জুনে শেষ হবে জানিয়ে অফিস ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েন তারা।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে-‘তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)।
২০১১ সালে পাইলট আকারে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ৪৯০টি উপজেলায় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয় (পরে আরও দু’টি উপজেলায় অফিস বিস্তৃত করা হয়)। প্রকল্পে প্রতিটি উপজেলায় সরাসরি নিয়োগ পাওয়া একজন তথ্যসেবা কর্মকর্তা, দু’জন তথ্যসেবা সহকারী রয়েছেন। আরও আছেন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ৪৯৫ জন অফিস সহায়ক।
২০২২ সালের ৩০ মার্চপ্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। পরে তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে, ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের জনবল ২ হাজার ৪৮৪। তবে প্রকল্পের জনবল অবকাঠামোতে সিকিউরিটি গার্ড এর কথা উল্লেখ থাকলেও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাই প্রকল্পে এখন জনবল ১ হাজার ৯৮৩ জন।
প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর প্রকল্প প্রধান কার্যালয় মাঠ পর্যায়ের জনবলের সাথে কোনও যোগাযোগ না রাখায় তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে তাদের জানানো হয়, প্রকল্পের অফিস গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্প চালু রাখার দাবিতে গত বছরের ১৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা ও ১৯ আগস্ট সচিবালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। এর প্রেক্ষিতে ঐ বছরই ১৮ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছরের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
মেয়েদের চাকরি ও দু:স্থ নারীদের সহায়তায় ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) কার্যক্রমে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করার ক্ষেত্রে কার্যালয়গুলোতে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়। নারীদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সুবিধা দিতে পরে প্রকল্পে ‘লাল সবুজ ডটকম’ নামের ই-কমার্স সেবার উদ্যোগ যুক্ত করা হয়। প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এবং বেতন কাটায় সবাই ‘অনেক কষ্টে’ আছেন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, এই প্রকল্পে সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে তিন ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছে এবং তাদের রাজস্বকরণের আশা দেখিয়ে ‘প্রতারণা’ করে যাচ্ছে।
জাতীয় মহিলা সংস্থা ২ জানুয়ারি এক চিঠিতে জানিয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ায় মাঠপর্যায়ের ৪৯২টি উপজেলা তথ্যকেন্দ্রের অফিস ভাড়া নবায়ন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে বলে যেসব ইউএনও অফিস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ৩০ জুনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হলো।
আন্দোলন পরিচালনা কমিটির সভাপতি সংগীতা সরকার সংবাদকে বলেন, ‘এই সময়ে এসে নারীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য ৬৪ দিন রাস্তায় থাকতে হবে- এটা কতটা দুঃখজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার নারীদেরকে শিক্ষার জন্য উৎসাহিত করে কিন্তু সেই সরকারই শিক্ষিত নারীদেরকে তাদের অধিকার আদায় করার জন্য দিনের পর দিন রাস্তায় ফেলে রাখবেন এটা ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা। সব রাজনৈতিক দল আমাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। আমাদের চাওয়া সরকার নারীদেরকে সহায়তা করবে। সাত বছর ধরে নারীরা যে দক্ষতা অর্জন করেছে তা দেশ এবং সমাজের উন্নতির জন্য কাজে লাগাবে।’
সংগীতা বলেন, ‘আমিই সাত বছরের মধ্যে হিসেবে ৫ বছরের বেতন-ভাতা পাই। বাকিদেরও একই অবস্থা’
প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) শাহনাজ বেগম নীনা বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত দুই বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও এক বছর বেড়েছে। ইতোমধ্যে ডিপিপি দুইবার সংশোধন হয়েছে। তৃতীয়বার সংশোধনের সম্ভাবনা কম। ফলে মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে ধরে নিয়েছি। নতুন প্রকল্প নিয়ে এই জনবলের বিষয়ে কিছু করা যায় কি না দেখতে হবে।’
তবে কোন প্রকল্প নতুন পর্যায় আসলে তা আউটসোর্সিংয়ে হবে। আর আউটসোর্সিং নীতিমালা-২০২৫ অনুসারে পূর্বের প্রকল্প থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ জনবলকে নতুন পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া যাবে এবং বাকি ৭০ শতাংশ বাদ পড়বে।