ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান এবং উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সরকারি সফরে ঢাকায় আসবেন। এর আগে ২০১০ সালের ১ নভেম্বর ইসলামাবাদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। ২০১২ সালে সর্বশেষ পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন হিনা রব্বানি খার। মূলত উন্নয়নশীল আট মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে সে সময় ঢাকা সফর করেছিলেন তিনি।
এবার প্রভাবশালী এই দুই মন্ত্রীর ঢাকা সফরের মূল লক্ষ্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার সময় পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে যতটা আন্তরিকতা ও গুরুত্ব দিয়ে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ততটাই দূরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দ্রুত উন্নতির দিকে এগোচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর অত্যন্ত গুরুত্বে সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আগামী ২১ আগস্ট ঢাকা সফরে আসছেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান এবং ২৩ আগস্ট ঢাকায় আসবেন উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী সফরকালে আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়গুলো নিয়ে এখন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিক বাণিজ্য এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় নিয়ে এবারে দুই মন্ত্রী সফরকালে আলোচনা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। এর মধ্যে আছে একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন এবং স্বাধীনতার আগে বিদেশ থেকে পাওয়া সম্পদের ন্যায্য হিস্যা পাওয়া। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হচ্ছিল।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তান। গত মাসে কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালোচ ঢাকা সফর করেন। এর আগে, গত মার্চে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এছাড়াও গত বছরের ডিসেম্বরে মিসরের কায়রোতে একটি সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে আলোচনায় শাহবাজ শরিফকে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘বিষয়গুলো বারবার আসছে। আসুন, আমরা সামনে এগিয়ে যেতে এই বিষয়গুলোর ফয়সালা করি।’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিষয়গুলো চিরতরে সুরাহা করে ফেলা ভালো হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
গত ফেব্রুয়ারিতে দীর্ঘ বিরতির পর দুই দেশের মধ্যে সরকার-থেকে-সরকার সরাসরি বাণিজ্য শুরু হয়, যেখানে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। গত জানুয়ারিতে দুই দেশের সেনাবাহিনী বাইরের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য ‘টেকসই অংশীদারত্ব’ বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে। ইতোমধ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বরে এই প্রথম করাচি থেকে বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে জাহাজ চট্টগ্রামে আসার মধ্য দিয়ে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য শুরু হয়েছে। একটি কন্টেইনার জাহাজ এসে পৌঁছায়, যা কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল ছিল।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ২১ আগস্ট চার দিনের সফরে ঢাকায় আসবেন। এর দু’দিন পর ২৩ আগস্ট উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসবেন। ইতোমধ্যে তাদের সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের সফরের পর পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেবের ঢাকা সফরে আসার কথাও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠকে অংশ নিতে আওরঙ্গজেব ঢাকায় আসতে পারেন। ২০০৫ সালে দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ জেইসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় সফরে আসার মূল কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্পর্ক আরও উন্নত পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া। এর মধ্যে গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।
সফরকালে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথবাণিজ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত করার নতুন বার্তা দেবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টাকে। দুই দেশের বাণিজ্য বাড়ানোর বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে দুই দেশের বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে।
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ২৩ আগস্ট ঢাকায় এসে ২৪ আগস্ট পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন। সে বৈঠকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং এসব ক্ষেত্রে কতটা যৌথ উদ্যোগ ও সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা গড়াতে পারে। এছাড়াও দুই মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে। এ নিয়ে দুইপক্ষই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সমঝোতা স্মারকের মধ্যে দুই দেশের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হওয়া ও সাংস্কৃতিক বিনিময়বিষয়ক হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে দুই দেশের কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসাবিলোপ চুক্তির খসড়া বিনিময় করেছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলে ইসহাক দারের সফরের সময়ই এই চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। এছাড়াও অন অ্যাড়াইভাল ভিসাবিষয়ক চুক্তিও হতে পারে। গত মাসে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন রাজা নাকভি ঢাকায় এসেছিলেন। তখন এ বিষয়ে কথাবর্তা অনেকটা এগিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সমঝোতা স্মারকও সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে বাইরে সম্প্রতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে চীন যে তৃতীয় একটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যবিষয়ক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সে বিষয়েও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ এ জাতীয় কোনো জোটে অংশ নেবে না।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার তার সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন। এছাড়াও ইসহাক দার বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিকরা মনে করেন, বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক কূটনীতিকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক- সবধরনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আমাদের ভালোর জন্যই প্রয়োজন। আর পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরকালে এ বিষয়টিই প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ূন কবিরের কাছে পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর নিয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার,(১৪ আগস্ট ২০২৫) সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কিছু অমীমাংসিত বিষয় আছে। এবারের সফরে সে বিষয়গুলোর সমাধান করা সুযোগ পাওয়া যাবে- এটা ভালোই হবে।
তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারলে সবাই উপকৃত হবে। এ সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। তবে কোনোভাবেই আমাদের স্বার্থকে ছেড়ে দিয়ে নয়।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান এবং উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সরকারি সফরে ঢাকায় আসবেন। এর আগে ২০১০ সালের ১ নভেম্বর ইসলামাবাদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। ২০১২ সালে সর্বশেষ পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন হিনা রব্বানি খার। মূলত উন্নয়নশীল আট মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে সে সময় ঢাকা সফর করেছিলেন তিনি।
এবার প্রভাবশালী এই দুই মন্ত্রীর ঢাকা সফরের মূল লক্ষ্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার সময় পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে যতটা আন্তরিকতা ও গুরুত্ব দিয়ে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ততটাই দূরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দ্রুত উন্নতির দিকে এগোচ্ছে।
এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর অত্যন্ত গুরুত্বে সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আগামী ২১ আগস্ট ঢাকা সফরে আসছেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান এবং ২৩ আগস্ট ঢাকায় আসবেন উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী সফরকালে আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়গুলো নিয়ে এখন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিক বাণিজ্য এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় নিয়ে এবারে দুই মন্ত্রী সফরকালে আলোচনা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। এর মধ্যে আছে একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন এবং স্বাধীনতার আগে বিদেশ থেকে পাওয়া সম্পদের ন্যায্য হিস্যা পাওয়া। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলা হচ্ছিল।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তান। গত মাসে কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত প্রবেশে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালোচ ঢাকা সফর করেন। এর আগে, গত মার্চে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এছাড়াও গত বছরের ডিসেম্বরে মিসরের কায়রোতে একটি সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে আলোচনায় শাহবাজ শরিফকে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘বিষয়গুলো বারবার আসছে। আসুন, আমরা সামনে এগিয়ে যেতে এই বিষয়গুলোর ফয়সালা করি।’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিষয়গুলো চিরতরে সুরাহা করে ফেলা ভালো হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
গত ফেব্রুয়ারিতে দীর্ঘ বিরতির পর দুই দেশের মধ্যে সরকার-থেকে-সরকার সরাসরি বাণিজ্য শুরু হয়, যেখানে পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। গত জানুয়ারিতে দুই দেশের সেনাবাহিনী বাইরের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য ‘টেকসই অংশীদারত্ব’ বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে। ইতোমধ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বরে এই প্রথম করাচি থেকে বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে জাহাজ চট্টগ্রামে আসার মধ্য দিয়ে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য শুরু হয়েছে। একটি কন্টেইনার জাহাজ এসে পৌঁছায়, যা কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল ছিল।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ২১ আগস্ট চার দিনের সফরে ঢাকায় আসবেন। এর দু’দিন পর ২৩ আগস্ট উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসবেন। ইতোমধ্যে তাদের সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের সফরের পর পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেবের ঢাকা সফরে আসার কথাও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠকে অংশ নিতে আওরঙ্গজেব ঢাকায় আসতে পারেন। ২০০৫ সালে দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ জেইসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় সফরে আসার মূল কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সম্পর্ক আরও উন্নত পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া। এর মধ্যে গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।
সফরকালে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথবাণিজ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত করার নতুন বার্তা দেবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টাকে। দুই দেশের বাণিজ্য বাড়ানোর বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে দুই দেশের বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে।
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ২৩ আগস্ট ঢাকায় এসে ২৪ আগস্ট পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন। সে বৈঠকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং এসব ক্ষেত্রে কতটা যৌথ উদ্যোগ ও সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা গড়াতে পারে। এছাড়াও দুই মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে। এ নিয়ে দুইপক্ষই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সমঝোতা স্মারকের মধ্যে দুই দেশের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হওয়া ও সাংস্কৃতিক বিনিময়বিষয়ক হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে দুই দেশের কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসাবিলোপ চুক্তির খসড়া বিনিময় করেছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলে ইসহাক দারের সফরের সময়ই এই চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। এছাড়াও অন অ্যাড়াইভাল ভিসাবিষয়ক চুক্তিও হতে পারে। গত মাসে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন রাজা নাকভি ঢাকায় এসেছিলেন। তখন এ বিষয়ে কথাবর্তা অনেকটা এগিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সমঝোতা স্মারকও সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে বাইরে সম্প্রতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে চীন যে তৃতীয় একটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যবিষয়ক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সে বিষয়েও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ এ জাতীয় কোনো জোটে অংশ নেবে না।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার তার সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন। এছাড়াও ইসহাক দার বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিকরা মনে করেন, বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক কূটনীতিকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়া হয়। এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক- সবধরনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আমাদের ভালোর জন্যই প্রয়োজন। আর পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরকালে এ বিষয়টিই প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ূন কবিরের কাছে পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর নিয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার,(১৪ আগস্ট ২০২৫) সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কিছু অমীমাংসিত বিষয় আছে। এবারের সফরে সে বিষয়গুলোর সমাধান করা সুযোগ পাওয়া যাবে- এটা ভালোই হবে।
তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারলে সবাই উপকৃত হবে। এ সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। তবে কোনোভাবেই আমাদের স্বার্থকে ছেড়ে দিয়ে নয়।