ধরা পড়ছে না রাঘববোয়ালরা, সাধারণ পাঁচজন গ্রেপ্তার, আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
সিলেটে সাদা পাথর লুটপাটকাণ্ডে অজ্ঞাতনামা দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ন্যক্কারজনক এই লুটপাটে হাতেগোনা কয়েকজন প্রভাবশালী বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা জড়িত থাকলেও এজাহারে তাদের নাম না দিয়ে অজ্ঞাত দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করায় সাধারণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন আইওয়াশ অভিযান চালাচ্ছে। প্রশ্ন তুলেছেন, তারা কার বা কাদের পাথর জব্দ করছেন? বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও স্টোন ক্রাশার মালিকরা জানিয়েছেন, বারকি শ্রমিকরা সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রয় করেন স্টোন ক্রাশার মালিকগণ। এরপর পর্যায়ক্রমে ক্রাশার মেশিন দিয়ে পাথর ভাঙিয়ে তা বিক্রি করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন ক্রেতার কাছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা তো কোনোভাবেই অবগত নন যে, এসব পাথর চুরি বা লুটপাটকৃত। এমনও ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা অনেকের জায়গা ভাড়া নিয়ে সেই পাথর স্তূপ করে রেখেছিলেন। আর এসব পাথরই জব্দ করে অভিযানের নামে বাহবা নেয়ার চেষ্টা করছে
প্রশাসন। শনিবার,(১৬ আগস্ট ২০২৫) পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আড়াই লাখ ঘনফুট পাথর উত্তোলনের তথ্য দিয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ব্যবসায়ীর দাবি, শুধু তাই নয়, মূল রাঘববোয়ালদের আটক বা গ্রেপ্তার না করে সাধারণ পাঁচ ব্যক্তিকে এ সংক্রান্ত দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়ীরা জানান, পাথর লুটের কথা উঠলেই যাদের নাম আসছে সবার আগে তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করছে না প্রশাসন। কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় জনগণ, রাজনৈতিক কর্মী, গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়াকর্মী, পরিবেশকর্মী, সবাই জানেন এই লুটপাটে জড়িত রয়েছেন প্রভাবশালীরা। মিডিয়াতেও এসেছে তাদের নাম। কিন্তু প্রশাসনের অভিযানে তাদের কেউই ধরা পড়ছে না।
মিডিয়াও ব্যস্ত প্রশাসনের ‘মহাভারত উদ্ধারের’ সফলতার গল্প প্রচার নিয়ে। লুট ঠেকাতে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা আর বলছে না গণমাধ্যম। ‘অমুকের রান্নাঘর’, ‘তমুকের বৈঠকখানায়’ পাথর পাওয়া গেছে এই নিয়েই গণমাধ্যমে শোরগোল পড়ে গেছে।
পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসন আলাদা আলাদাভাবে সাদা পাথর চোরদের অনুসন্ধান শুরু করেছে। হাইকোর্টও ৭ দিনের মধ্যে লুটেরাদের তালিকা দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছেন।
এদিকে পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় দুই হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. আনোয়ারুল হাবীব। গতকাল শুক্রবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়েরের পর এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছে পুলিশ।
এরা হলেন- মোহাম্মদ কামাল মিয়া (পিচ্চি কামাল), মো. আবু সাঈদ (২১), মো. আবুল কালাম (৩২), ইমান আলী (২৮) জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)। এরা প্রভাবশালীদের অধীনস্থ মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থক বা সাধারণ নাগরিক হিসেবে পরিচিত। এর আগের দিন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে আওয়ামী লীগের আমলে দায়ের করা পুরনো এক মামলায় গ্রেপ্তার করলেও তাকে পাথর লুটের অভিযোগে আটক করে ব্যাপক প্রচার করে। অভিযোগ উঠেছে ধলাই সেতু রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তাকে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
প্রভাবশালীদের রেখে এসব চুনোপুঁটিদের গ্রেপ্তারকে পুলিশের ‘আইওয়াশ’ অভিযান বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সিলেটের এক ভ্রমণপিয়াসু পুস্তক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘ রুই-কাতলাদের’ কেউই গ্রেপ্তার হননি। অথচ মিডিয়া এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছে না। মিডিয়া প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দেখাচ্ছে না। লোক দেখানো অভিযানকে হাইলাইটস করা নিয়েই ব্যস্ত মিডিয়া।
সাদা পাথর, শাহআরফিন টিলা, রেলওয়ের বাংকার, ধলাই সেতুর নিচের বালুমহাল লুটপাটের প্রধান হিসেবে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ, জেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, আবুল বশর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তেলিখাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আপ্তাব আলী কালা মিয়া, তেলিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, আলফুর চেয়ারম্যানের ভাই আকদ্দস আলী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা উত্তর কলাবাড়ির আব্দুল বারির পুত্র সাহাব উদ্দিন, মনির মিয়া (অন্য মামলায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার), হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান জড়িত।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের মদদে প্রকাশ্যে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে পাথর ও বালু লুট করা হতো। প্রশাসন ও মিডিয়ার এক শ্রেণীর লোককে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই তারা ব্যবসা করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সিলেটের সব কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। তাদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়।
পাথর লুট চলাকালে স্থানীয় প্রশাসন কিছু কিছু অভিযান চালিয়েছে। সেসব অভিযানে বাধা দেয়া এবং হামলার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অভিযোগ আছে যে, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পাথর লুটপাটকারীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে বিজিবি সদস্যরা আহতও হন।
সাদা পাথরে পাথর লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন (বর্তমানে পদ স্থগিত জড়িত)। তার অন্তত ১০ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও স্বজন সরাসরি লুটপাটে জড়িত। এ ঘটনায় বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও স্থানীয় প্রশাসন সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। সাদা পাথর এলাকায় লুটপাটে উপজেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা জড়িত। গত ১৪ জুলাই ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় বিএনপি ও অন্যান্য সূত্র বলছে, লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সভাপতি সাহাব উদ্দিনের বোনের জামাই ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন এবং তার ভাই সাজন মিয়া, ছাত্রদলের কর্মী জাকির হোসেন, মোজাফর আলী, বিএনপির অন্তত ১৫ জনের নাম এসেছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশও জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বালু ও পাথর লুটপাটের ঘটনায় ১৯টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬০ জন। এ ছাড়া টাস্কফোর্সের অভিযানে গ্রেপ্তার হন আরও ৫২ জন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, গত বছরের ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের অভিযোগে তারা ১২টি মামলা করেছে। এসব মামলার আসামি ১৯১ জন। গ্রেপ্তার একজন।
সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘সবাই সার্ভিলেন্সের মধ্যে রয়েছে। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
এদিকে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো এখন নিজেরা কী কী করেছে, সেটার সাফাই তুলে ধরছে। আসল কথা হলো- সমস্ত পাথর লুট হয়ে গেছে এবং তারা তা ঠেকাতে পারেনি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট দল বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছে। গত বুধবার বেলা দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল সাদা পাথর সরেজমিনে পরিদর্শন করে দোষীদের শনাক্তের কাজ করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস্ সাদাৎ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, লুটপাটে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী লোক, পাথর-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। এদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো নিষ্ক্রিয় ছিল অথবা তারা বাধা দেয়নি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়েও লুট ঠেকানো যায়নি। এখন সাদা পাথরে যা অবশিষ্ট আছে, সেটা কীভাবে রক্ষা করা যায় এবং পাথর পুনরুদ্ধার করা যায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে।
পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশি কার্যক্রমের ঘাটতির সুযোগে জেলার প্রতিটি কোয়ারিতে পাথর লুট শুরু হয়। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছানাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাংকার (রেলওয়ের পুরনো স্থাপনা) এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন শুরু হয়। এক বছর ধরে লুটপাটের কারণে এসব এলাকা এখন অনেকটাই পাথরহীন।
অন্য সব জায়গায় পাথর বেশিরভাগ লুট করার পর নজর পড়ে পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথর এলাকায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে সেখানে লুটপাট শুরু হয়। তবে সেখানে বেশি লুটপাট হয়েছে বিগত এক মাসে।
ধরা পড়ছে না রাঘববোয়ালরা, সাধারণ পাঁচজন গ্রেপ্তার, আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ১৭ আগস্ট ২০২৫
সিলেটে সাদা পাথর লুটপাটকাণ্ডে অজ্ঞাতনামা দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ন্যক্কারজনক এই লুটপাটে হাতেগোনা কয়েকজন প্রভাবশালী বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা জড়িত থাকলেও এজাহারে তাদের নাম না দিয়ে অজ্ঞাত দুই হাজার ব্যক্তিকে আসামি করায় সাধারণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন আইওয়াশ অভিযান চালাচ্ছে। প্রশ্ন তুলেছেন, তারা কার বা কাদের পাথর জব্দ করছেন? বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও স্টোন ক্রাশার মালিকরা জানিয়েছেন, বারকি শ্রমিকরা সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রয় করেন স্টোন ক্রাশার মালিকগণ। এরপর পর্যায়ক্রমে ক্রাশার মেশিন দিয়ে পাথর ভাঙিয়ে তা বিক্রি করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন ক্রেতার কাছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা তো কোনোভাবেই অবগত নন যে, এসব পাথর চুরি বা লুটপাটকৃত। এমনও ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা অনেকের জায়গা ভাড়া নিয়ে সেই পাথর স্তূপ করে রেখেছিলেন। আর এসব পাথরই জব্দ করে অভিযানের নামে বাহবা নেয়ার চেষ্টা করছে
প্রশাসন। শনিবার,(১৬ আগস্ট ২০২৫) পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আড়াই লাখ ঘনফুট পাথর উত্তোলনের তথ্য দিয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব ব্যবসায়ীর দাবি, শুধু তাই নয়, মূল রাঘববোয়ালদের আটক বা গ্রেপ্তার না করে সাধারণ পাঁচ ব্যক্তিকে এ সংক্রান্ত দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়ীরা জানান, পাথর লুটের কথা উঠলেই যাদের নাম আসছে সবার আগে তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করছে না প্রশাসন। কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় জনগণ, রাজনৈতিক কর্মী, গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়াকর্মী, পরিবেশকর্মী, সবাই জানেন এই লুটপাটে জড়িত রয়েছেন প্রভাবশালীরা। মিডিয়াতেও এসেছে তাদের নাম। কিন্তু প্রশাসনের অভিযানে তাদের কেউই ধরা পড়ছে না।
মিডিয়াও ব্যস্ত প্রশাসনের ‘মহাভারত উদ্ধারের’ সফলতার গল্প প্রচার নিয়ে। লুট ঠেকাতে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা আর বলছে না গণমাধ্যম। ‘অমুকের রান্নাঘর’, ‘তমুকের বৈঠকখানায়’ পাথর পাওয়া গেছে এই নিয়েই গণমাধ্যমে শোরগোল পড়ে গেছে।
পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসন আলাদা আলাদাভাবে সাদা পাথর চোরদের অনুসন্ধান শুরু করেছে। হাইকোর্টও ৭ দিনের মধ্যে লুটেরাদের তালিকা দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছেন।
এদিকে পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় দুই হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. আনোয়ারুল হাবীব। গতকাল শুক্রবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়েরের পর এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছে পুলিশ।
এরা হলেন- মোহাম্মদ কামাল মিয়া (পিচ্চি কামাল), মো. আবু সাঈদ (২১), মো. আবুল কালাম (৩২), ইমান আলী (২৮) জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)। এরা প্রভাবশালীদের অধীনস্থ মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থক বা সাধারণ নাগরিক হিসেবে পরিচিত। এর আগের দিন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে আওয়ামী লীগের আমলে দায়ের করা পুরনো এক মামলায় গ্রেপ্তার করলেও তাকে পাথর লুটের অভিযোগে আটক করে ব্যাপক প্রচার করে। অভিযোগ উঠেছে ধলাই সেতু রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক হয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তাকে পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
প্রভাবশালীদের রেখে এসব চুনোপুঁটিদের গ্রেপ্তারকে পুলিশের ‘আইওয়াশ’ অভিযান বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সিলেটের এক ভ্রমণপিয়াসু পুস্তক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘ রুই-কাতলাদের’ কেউই গ্রেপ্তার হননি। অথচ মিডিয়া এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছে না। মিডিয়া প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দেখাচ্ছে না। লোক দেখানো অভিযানকে হাইলাইটস করা নিয়েই ব্যস্ত মিডিয়া।
সাদা পাথর, শাহআরফিন টিলা, রেলওয়ের বাংকার, ধলাই সেতুর নিচের বালুমহাল লুটপাটের প্রধান হিসেবে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ, জেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, আবুল বশর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তেলিখাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আপ্তাব আলী কালা মিয়া, তেলিখাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, আলফুর চেয়ারম্যানের ভাই আকদ্দস আলী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা উত্তর কলাবাড়ির আব্দুল বারির পুত্র সাহাব উদ্দিন, মনির মিয়া (অন্য মামলায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার), হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান জড়িত।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের মদদে প্রকাশ্যে রাতের আঁধারে অবৈধভাবে পাথর ও বালু লুট করা হতো। প্রশাসন ও মিডিয়ার এক শ্রেণীর লোককে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই তারা ব্যবসা করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সিলেটের সব কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। তাদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়।
পাথর লুট চলাকালে স্থানীয় প্রশাসন কিছু কিছু অভিযান চালিয়েছে। সেসব অভিযানে বাধা দেয়া এবং হামলার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অভিযোগ আছে যে, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পাথর লুটপাটকারীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণে বিজিবি সদস্যরা আহতও হন।
সাদা পাথরে পাথর লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন (বর্তমানে পদ স্থগিত জড়িত)। তার অন্তত ১০ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও স্বজন সরাসরি লুটপাটে জড়িত। এ ঘটনায় বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও স্থানীয় প্রশাসন সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। সাদা পাথর এলাকায় লুটপাটে উপজেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা জড়িত। গত ১৪ জুলাই ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
স্থানীয় বিএনপি ও অন্যান্য সূত্র বলছে, লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সভাপতি সাহাব উদ্দিনের বোনের জামাই ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন এবং তার ভাই সাজন মিয়া, ছাত্রদলের কর্মী জাকির হোসেন, মোজাফর আলী, বিএনপির অন্তত ১৫ জনের নাম এসেছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশও জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বালু ও পাথর লুটপাটের ঘটনায় ১৯টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬০ জন। এ ছাড়া টাস্কফোর্সের অভিযানে গ্রেপ্তার হন আরও ৫২ জন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, গত বছরের ৫ আগস্টের পর এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের অভিযোগে তারা ১২টি মামলা করেছে। এসব মামলার আসামি ১৯১ জন। গ্রেপ্তার একজন।
সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘সবাই সার্ভিলেন্সের মধ্যে রয়েছে। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
এদিকে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো এখন নিজেরা কী কী করেছে, সেটার সাফাই তুলে ধরছে। আসল কথা হলো- সমস্ত পাথর লুট হয়ে গেছে এবং তারা তা ঠেকাতে পারেনি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট দল বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছে। গত বুধবার বেলা দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল সাদা পাথর সরেজমিনে পরিদর্শন করে দোষীদের শনাক্তের কাজ করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস্ সাদাৎ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, লুটপাটে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী লোক, পাথর-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। এদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো নিষ্ক্রিয় ছিল অথবা তারা বাধা দেয়নি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়েও লুট ঠেকানো যায়নি। এখন সাদা পাথরে যা অবশিষ্ট আছে, সেটা কীভাবে রক্ষা করা যায় এবং পাথর পুনরুদ্ধার করা যায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে।
পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর পুলিশি কার্যক্রমের ঘাটতির সুযোগে জেলার প্রতিটি কোয়ারিতে পাথর লুট শুরু হয়। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছানাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাংকার (রেলওয়ের পুরনো স্থাপনা) এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন শুরু হয়। এক বছর ধরে লুটপাটের কারণে এসব এলাকা এখন অনেকটাই পাথরহীন।
অন্য সব জায়গায় পাথর বেশিরভাগ লুট করার পর নজর পড়ে পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথর এলাকায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে সেখানে লুটপাট শুরু হয়। তবে সেখানে বেশি লুটপাট হয়েছে বিগত এক মাসে।