বাণিজ্যিক উৎপাদন ও ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা, এর আগেও ৩ দফা দরপত্র বাতিল নিয়ে প্রশ্ন
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি করতে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল) যে দরপত্র আহ্বান করেছিল সেটি বাতিল করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দরপত্র আহ্বানে ‘অনিয়ম হয়েছে’ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ওই কমিটির সুপারিশে এই দরপত্র বাতিল করা হয়েছে বলে আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কয়লা আমদানির জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে চিঠিতে।
এর আগে, নানা কারণে তিন দফা দরপত্র বাতিলের ঘটনা ঘটে। এবার, চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিলের কারণে পূর্ণ মাত্রায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে বাধার মুখে পড়বে আরএনপিএলের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে কেন্দ্রটি বড় অংকের আর্থিক সংকটে পড়বে, এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বার বার টেন্ডার বাতিল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। আলোচনা আছে, পূর্বে দরপত্রে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানি যোগ্য বিবেচিত হয়। তখন বাদ পড়া ঠিকাদারদের ‘একটি সিন্ডিকেট’ দরপত্রের বিভিন্ন ধাপে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পুনঃদরপত্র আহ্বানে ‘চাপ তৈরি করে’।
মেয়াদ ২ বছর
এবার পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে আরএনপিএলকে বিদ্যুৎ বিভাগ যে চিঠি দিয়েছে তাতে বলা হয়, কয়লার জন্য আহ্বানকৃত দীর্ঘমেয়াদে দরপত্রে বিভিন্ন ধাপে ত্রুটি ও অনিয়ম পাওয়া গেছে। ফলে কয়লা আমদানিতে আহ্বানকৃত এ দরপত্র বাতিল করে দ্রুত নতুন দরপত্র আহ্বান করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে কয়লা ক্রয়ে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন- বিশেষ করে কয়লার ক্যালোরিফিক ভেল্যু (জিএআর), অ্যাশ ফিউশন টেম্পারেচার, কয়লার সাইজ দরপত্রের শর্তে এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেন দরপত্র প্রক্রিয়ায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক করা যায়। আগামীতে কয়লা ক্রয়ের চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে দুই বছর করার নির্দেশ দেয়া হয় চিঠিতে।
আরএনপিএল
রাষ্ট্রীয় রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নরিনকো’র যৌথ উদ্যোগে গঠিত আরপিসিএল-নরিনকো পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল) পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। গত এপ্রিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও এখন ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে; জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিচ্ছে ৩০০ মেগাওয়াটের মতো।
চীনের ঋণ
মোট ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে চীনের ঋণ ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৫ বছর মেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণচুক্তি হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়, প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে।
চুক্তি অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। অথচ এখনও কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। এতে ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নরিনকোর লোকসানে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না দিয়ে বসিয়ে রাখা হলে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে গিয়ে লোকসান হবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)।
৩ দফা দরপত্র বাতিল
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি করতে ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করে আরএনপিএল। তখন একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়, যাতে সরবরাহকারী ৭ কোম্পানিকে রাখা হয়। তবে দরপত্রে কিছু পরিবর্তন আনার ফলে তা বাতিল করা হয়। গত বছর ১৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ‘ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড’ কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়। কিন্তু ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দরপত্র
বাতিল করা হয়। গত বছর ৬ নভেম্বর তৃতীয় দফায় আহ্বান করা দরপত্রে দেশি-বিদেশি অন্তত ২৫টি কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শিডিউল কেনে। ওই দরপত্রে কোম্পানির আর্থিক যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কয়লাখনি, কয়লার মানসংক্রান্ত শর্ত নিয়ে আরএনপিএলের রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ওইবারও শুধু কাগজপত্র জমায় দেয় ইয়াংথাই এনার্জি। তখন দরপত্রে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে কয়েক দফা শর্ত শিথিলসহ তৃতীয় দফার দরপত্রও বাতিল করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ অনুসারে তৃতীয় দফায় ইয়াংথাই এনার্জির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ ছিল। এরপর বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পিডিবির তত্ত্বাবধানে শর্ত শিথিলের পর চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়, যা গত ৭ আগস্ট চিঠি দিয়ে বাতিল করলো বিদ্যুৎ বিভাগ।
বাণিজ্যিক উৎপাদন ও ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা, এর আগেও ৩ দফা দরপত্র বাতিল নিয়ে প্রশ্ন
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫
পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি করতে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল) যে দরপত্র আহ্বান করেছিল সেটি বাতিল করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দরপত্র আহ্বানে ‘অনিয়ম হয়েছে’ এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ওই কমিটির সুপারিশে এই দরপত্র বাতিল করা হয়েছে বলে আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কয়লা আমদানির জন্য পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে চিঠিতে।
এর আগে, নানা কারণে তিন দফা দরপত্র বাতিলের ঘটনা ঘটে। এবার, চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিলের কারণে পূর্ণ মাত্রায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে বাধার মুখে পড়বে আরএনপিএলের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে কেন্দ্রটি বড় অংকের আর্থিক সংকটে পড়বে, এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বার বার টেন্ডার বাতিল নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। আলোচনা আছে, পূর্বে দরপত্রে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানি যোগ্য বিবেচিত হয়। তখন বাদ পড়া ঠিকাদারদের ‘একটি সিন্ডিকেট’ দরপত্রের বিভিন্ন ধাপে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পুনঃদরপত্র আহ্বানে ‘চাপ তৈরি করে’।
মেয়াদ ২ বছর
এবার পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে আরএনপিএলকে বিদ্যুৎ বিভাগ যে চিঠি দিয়েছে তাতে বলা হয়, কয়লার জন্য আহ্বানকৃত দীর্ঘমেয়াদে দরপত্রে বিভিন্ন ধাপে ত্রুটি ও অনিয়ম পাওয়া গেছে। ফলে কয়লা আমদানিতে আহ্বানকৃত এ দরপত্র বাতিল করে দ্রুত নতুন দরপত্র আহ্বান করতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে কয়লা ক্রয়ে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন- বিশেষ করে কয়লার ক্যালোরিফিক ভেল্যু (জিএআর), অ্যাশ ফিউশন টেম্পারেচার, কয়লার সাইজ দরপত্রের শর্তে এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেন দরপত্র প্রক্রিয়ায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক করা যায়। আগামীতে কয়লা ক্রয়ের চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে দুই বছর করার নির্দেশ দেয়া হয় চিঠিতে।
আরএনপিএল
রাষ্ট্রীয় রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নরিনকো’র যৌথ উদ্যোগে গঠিত আরপিসিএল-নরিনকো পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল) পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। গত এপ্রিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও এখন ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে; জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিচ্ছে ৩০০ মেগাওয়াটের মতো।
চীনের ঋণ
মোট ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে চীনের ঋণ ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৫ বছর মেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণচুক্তি হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়, প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে।
চুক্তি অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। অথচ এখনও কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। এতে ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নরিনকোর লোকসানে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না দিয়ে বসিয়ে রাখা হলে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে গিয়ে লোকসান হবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)।
৩ দফা দরপত্র বাতিল
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি করতে ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করে আরএনপিএল। তখন একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়, যাতে সরবরাহকারী ৭ কোম্পানিকে রাখা হয়। তবে দরপত্রে কিছু পরিবর্তন আনার ফলে তা বাতিল করা হয়। গত বছর ১৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ‘ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড’ কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়। কিন্তু ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দরপত্র
বাতিল করা হয়। গত বছর ৬ নভেম্বর তৃতীয় দফায় আহ্বান করা দরপত্রে দেশি-বিদেশি অন্তত ২৫টি কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শিডিউল কেনে। ওই দরপত্রে কোম্পানির আর্থিক যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কয়লাখনি, কয়লার মানসংক্রান্ত শর্ত নিয়ে আরএনপিএলের রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ওইবারও শুধু কাগজপত্র জমায় দেয় ইয়াংথাই এনার্জি। তখন দরপত্রে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে কয়েক দফা শর্ত শিথিলসহ তৃতীয় দফার দরপত্রও বাতিল করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ অনুসারে তৃতীয় দফায় ইয়াংথাই এনার্জির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ ছিল। এরপর বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পিডিবির তত্ত্বাবধানে শর্ত শিথিলের পর চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়, যা গত ৭ আগস্ট চিঠি দিয়ে বাতিল করলো বিদ্যুৎ বিভাগ।