সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন জুনায়েদের মা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইয়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী দিয়েছেন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমান।
ডা. মাহফুজুর রহমান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের নিউরো ট্রমা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। বুধবার,(২০ আগস্ট ২০২৫) গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন এই চিকিৎসক।
আদালতে এই চিকিৎসকের জবানবন্দী থেকে জানা যায়, গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় যাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়।
অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমানের জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হাসপাতালে ভর্তি ১৬৭ আহত যাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের ৪০ জন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেলেও বাকি ১২৭ জনের সর্বশেষ অবস্থা বিস্তারিত উল্লেখ করেননি তিনি। আহতদের প্রায় ৩৩টি অস্ত্রোপচার নিজে করেছেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ তালিকামূলে দুটি পিলেট এবং একটি বড় বুলেট ও আরও একটি গোলাকার বুলেট জব্দ করেছে। জব্দ তালিকার সেই বুলেট ও পিলেট আদালতে প্রদর্শন করা হয়।
গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় বুধবার ১৩তম সাক্ষী হিসেবে মাহফুজুর রহমান এই জবানবন্দী দেন। শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার অন্য দুই আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
জবানবন্দীতে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।’
১৮ জুলাই থেকে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগীদের মাথা, হাত, পা, পিঠ, মুখ ও গলায় গুলি ও পিলেট বিদ্ধ ছিল। গুলিগুলো ছিল বড় আকারের। ৪/৫ আগস্ট যেসব রোগী আসে তাদের অধিকাংশের মাথা, বুক, মুখ ও গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল। বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না।
গণঅভ্যুত্থানে আহতদের প্রায় ৩৩টি অস্ত্রোপচার নিজে করেছেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছি। যদিও অনেকগুলো গুলি ও পিলেট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য ডিবি চাপ দেন উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দীতে বলেন, ‘ডিবি বলে, আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন। তারা আরও বলে, যাদের ভর্তি করেছেন, তাদের রিলিজ করবেন না। এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্ট্রারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি।’
শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের ফাঁসি দাবি করে এই চিকিৎসক তার জবানবন্দীতে আরও বলেন, উপরিউক্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। তার নির্দেশ কার্যকরকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইনজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এদিন আরও তিনজন সাক্ষ্য দেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইয়েন্স সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমানের পাশাপাশি আরও সাক্ষ্য দেন একই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন, রাজধানীর শ্যামলী এলাকার ইবনেসিনা হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসানুল বান্না ও গত বছর শেখ হাসিনার পতনের দিন চানখাঁরপুলে নিহত মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
কাঁদলেন জুনায়েদের মা
গত বছর শেখ হাসিনার পতনের দিন চানখাঁরপুলে নিহত মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে ছেলের জন্য কেঁদেছেন। তার কান্নায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ সবাই ।
বুধবার গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা সোনিয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইনজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এদিন তিনিসহ আরও তিনজন সাক্ষ্য দেন।
সোনিয়া তার সাক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালে বলেন, গত বছরের ৫ অগাস্ট চানখাঁরপুলে তার ছেলে জুনায়েদ (১৪) নিহত হয়। সে গেন্ডারিয়া উইল পাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তবে জুনায়েদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও তিনি জানতেন না বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান সোনিয়া।
‘নিহত জুনায়েদের বাম চোখের বাম পাশে গুলি লেগে মাথার পিছন দিয়ে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে গেছে’ এমন বর্ননা দিয়ে আদালতে তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। এ সময় কিছুক্ষণের জন্য ট্রাইব্যুনালের বিচারকসহ সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণ পর সোনিয়া আবার বলতে শুরু করেন, “আমি জানতে পারি, ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের অপর পাশে ফুটপাতের উপর জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার বন্ধু সিয়াম ও আব্দুর রউফ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তারা আমার ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসে। পরে ধূপখোলা মাঠে জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। একই কবরস্থানে আরেক শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসকেও দাফন হয় বলে যোগ করেন তিনি ।
এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর নির্দেশে চানখাঁরপুল এলাকার নবাব কাটরা সংলগ্ন এলাকায় এডিসি আক্তারুল ইসলামের নির্দেশে পুলিশ কনস্টেবল সুজন, ইমাজ, নাসিরুল বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে মেহেদী হাসান জুনায়েদ, শাহরিয়ার খান আনাস, ইয়াকুব, রাকিব হাওলাদার, ইমতিয়াজ ও মানিককে হত্যা করে।
তার দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এ পর্যায়ে সোনিয়া বলেন, “ভিডিওতে দেখা গেছে একজন পুলিশ গুলি করার ভিডিও স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেখাচ্ছেন এবং বলছেন, স্যার গুলি করি, মরে একজন, বাকিরা যায় না।”
এ সময় সাক্ষী আবারও কাঁদতে থাকেন। তিনি একটি ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ জমা দেন, যেটা ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। সেখানে তিনি জুনায়েদের লাশ শনাক্ত করেন।
এদিন সকালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তিনি দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছেন। তিন আসামির মধ্যে একমাত্র তিনিই কারাগারে আটক আছেন, বাকি দুজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। এ মামলায় ৮১ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৫ জন।
সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন জুনায়েদের মা
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইয়েন্স অ্যান্ড হসপিটালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী দিয়েছেন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমান।
ডা. মাহফুজুর রহমান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের নিউরো ট্রমা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। বুধবার,(২০ আগস্ট ২০২৫) গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন এই চিকিৎসক।
আদালতে এই চিকিৎসকের জবানবন্দী থেকে জানা যায়, গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় যাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়।
অধ্যাপক মো. মাহফুজুর রহমানের জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হাসপাতালে ভর্তি ১৬৭ আহত যাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের ৪০ জন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেলেও বাকি ১২৭ জনের সর্বশেষ অবস্থা বিস্তারিত উল্লেখ করেননি তিনি। আহতদের প্রায় ৩৩টি অস্ত্রোপচার নিজে করেছেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা জব্দ তালিকামূলে দুটি পিলেট এবং একটি বড় বুলেট ও আরও একটি গোলাকার বুলেট জব্দ করেছে। জব্দ তালিকার সেই বুলেট ও পিলেট আদালতে প্রদর্শন করা হয়।
গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় বুধবার ১৩তম সাক্ষী হিসেবে মাহফুজুর রহমান এই জবানবন্দী দেন। শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার অন্য দুই আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
জবানবন্দীতে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।’
১৮ জুলাই থেকে হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগীদের মাথা, হাত, পা, পিঠ, মুখ ও গলায় গুলি ও পিলেট বিদ্ধ ছিল। গুলিগুলো ছিল বড় আকারের। ৪/৫ আগস্ট যেসব রোগী আসে তাদের অধিকাংশের মাথা, বুক, মুখ ও গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল। বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না।
গণঅভ্যুত্থানে আহতদের প্রায় ৩৩টি অস্ত্রোপচার নিজে করেছেন বলে জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছি। যদিও অনেকগুলো গুলি ও পিলেট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়।
গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য ডিবি চাপ দেন উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দীতে বলেন, ‘ডিবি বলে, আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন। তারা আরও বলে, যাদের ভর্তি করেছেন, তাদের রিলিজ করবেন না। এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্ট্রারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি।’
শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের ফাঁসি দাবি করে এই চিকিৎসক তার জবানবন্দীতে আরও বলেন, উপরিউক্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা। তার নির্দেশ কার্যকরকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইনজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এদিন আরও তিনজন সাক্ষ্য দেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইয়েন্স সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমানের পাশাপাশি আরও সাক্ষ্য দেন একই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন, রাজধানীর শ্যামলী এলাকার ইবনেসিনা হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসানুল বান্না ও গত বছর শেখ হাসিনার পতনের দিন চানখাঁরপুলে নিহত মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসেবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
কাঁদলেন জুনায়েদের মা
গত বছর শেখ হাসিনার পতনের দিন চানখাঁরপুলে নিহত মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে ছেলের জন্য কেঁদেছেন। তার কান্নায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী ও সাংবাদিকসহ সবাই ।
বুধবার গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা সোনিয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইনজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এদিন তিনিসহ আরও তিনজন সাক্ষ্য দেন।
সোনিয়া তার সাক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালে বলেন, গত বছরের ৫ অগাস্ট চানখাঁরপুলে তার ছেলে জুনায়েদ (১৪) নিহত হয়। সে গেন্ডারিয়া উইল পাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তবে জুনায়েদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও তিনি জানতেন না বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান সোনিয়া।
‘নিহত জুনায়েদের বাম চোখের বাম পাশে গুলি লেগে মাথার পিছন দিয়ে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে গেছে’ এমন বর্ননা দিয়ে আদালতে তিনি অঝোরে কাঁদতে থাকেন। এ সময় কিছুক্ষণের জন্য ট্রাইব্যুনালের বিচারকসহ সবাই স্তব্ধ হয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণ পর সোনিয়া আবার বলতে শুরু করেন, “আমি জানতে পারি, ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের অপর পাশে ফুটপাতের উপর জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার বন্ধু সিয়াম ও আব্দুর রউফ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তারা আমার ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসে। পরে ধূপখোলা মাঠে জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। একই কবরস্থানে আরেক শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসকেও দাফন হয় বলে যোগ করেন তিনি ।
এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর নির্দেশে চানখাঁরপুল এলাকার নবাব কাটরা সংলগ্ন এলাকায় এডিসি আক্তারুল ইসলামের নির্দেশে পুলিশ কনস্টেবল সুজন, ইমাজ, নাসিরুল বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে মেহেদী হাসান জুনায়েদ, শাহরিয়ার খান আনাস, ইয়াকুব, রাকিব হাওলাদার, ইমতিয়াজ ও মানিককে হত্যা করে।
তার দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এ পর্যায়ে সোনিয়া বলেন, “ভিডিওতে দেখা গেছে একজন পুলিশ গুলি করার ভিডিও স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেখাচ্ছেন এবং বলছেন, স্যার গুলি করি, মরে একজন, বাকিরা যায় না।”
এ সময় সাক্ষী আবারও কাঁদতে থাকেন। তিনি একটি ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ জমা দেন, যেটা ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। সেখানে তিনি জুনায়েদের লাশ শনাক্ত করেন।
এদিন সকালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তিনি দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছেন। তিন আসামির মধ্যে একমাত্র তিনিই কারাগারে আটক আছেন, বাকি দুজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। এ মামলায় ৮১ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৫ জন।