জুনের মধ্যে
প্রথম পর্যায়ে করোনার ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ স্বস্তিতে থাকলেও ‘গ্যাভি’ এবং ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় স্বল্প মূল্যের ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তায় পড়েছে সরকার। জানুয়ারির শেষের দিকে অথবা ফেব্রুয়ারিতে আসছে ৫০ লাখ ডোজ (মোট ৩ কোটি ডোজ দেবে) অক্সফোর্ডের করোনা টিকা যা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট দেবে। এই টিকা (ভ্যাকসিন) সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুঃচিন্তা নেই স্বাস্থ্য প্রশাসনের। তবে জুনের মধ্যে আরও ছয় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসছে, যার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এই ভ্যাকসিন সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করা হবে।
আগামী জুনের মধ্যে আরও ছয় কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা (ভ্যাকসিন) দেশে আসছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সোমবার (২১ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘মাইনাস ১৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় করোনাভাইরাসের টিকা সংরক্ষণ হবে। গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত গিয়ে টিকা দেয়ার স্ট্র্যাকচারই আমাদের নেই। একমাত্র কোল্ডস্টোরেজে রাখতে পারবেন, তারপর যখন বের করবে মাইনাস ১৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা...টেকনিক্যাল কমিটি উনারা এটা দেখবে।’
ওই ছয় কোটি ডোজ টিকা আসার আগে জানুয়ারির শেষের দিকে ‘অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা’র তৈরি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) আসছে। এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, যা দেশের জেলা পর্যায়ে বিদ্যমান সংরক্ষণ সক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিকাদান কর্মসূচি ‘এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন’র (ইপিআই) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এসএম আলমগীর সংবাদকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে দেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ভ্যাকসিন (২৫ লাখ মানুষকে দেয়া যাবে) পাচ্ছি, এই ভ্যাকসিন ২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে।’
কিন্তু ‘ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না’র ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) এই মুহূর্তে দেশে নেই- জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে, একই সঙ্গে ফাইজার-মডার্নার ভ্যাকসিন আনারও চেষ্টা করছে, এগুলো মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস দিয়ে শুরু। এই দুটি ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারকরা সংরক্ষণ সক্ষমতা নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।’
ইউনিসেফের ‘কোল্ড চেইন’ (টিকা সংরক্ষণ) বিশেষজ্ঞ হামিদুল ইসলাম ২০ ডিসেম্বর এক ভার্চুয়াল আলোচনায় জানান, ‘দেশব্যাপী ইপিআই’র ৬৯২টি টিকা সংরক্ষণাগার রয়েছে। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য এগুলোই যথেষ্ঠ। এ কারণে সরকারের ধীরস্থীর এবং ভালোভাবে ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া উচিত। তবে আমরা যদি একসঙ্গে বেশি বেশি করে বিভিন্ন কোম্পানির ভ্যাকসিন আমদানি করি সেক্ষেত্রে সংরক্ষণ কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।’
টিকা পেতে অনলাইনে আবেদন ও এনআইডি
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস ২০ ডিসেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ওই বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘টিকা দিতে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) লাগবে। প্রত্যেকের এনআইডি কার্ডের সঙ্গে তথ্য হালনাগাদ রাখতে হবে। কেউ যদি নিজে অ্যাপসের মাধ্যমে টিকা গ্রহণে অসুবিধা মনে করেন বা না পারেন, তবে সেক্ষেত্রে অন্য কারো কিংবা সরকারের নির্দিষ্ট কর্মীরা তাদের সহায়তা করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভাকে জানিয়েছেন, তিনি আশা করছেন জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ভ্যাকসিন পেয়ে যাব। এজন্য গ্রাসরুট লেভেন পর্যন্ত সবাইকে ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়েছে। ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য যেসব জিনিস ব্যবহার করা হবে সেগুলো কীভাবে ডিসপোজাল করা হবে সেই ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইপিআইয়ের যে ব্যাপক কার্যক্রম আছে, (করোনার টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন) সেটিকে বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন, প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।’
আরও ছয় কোটি ভ্যাকসিন কোভেক্সের মাধ্যমে মে-জুন মাসের মধ্যে আসবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘ওনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) মন্ত্রিসভাকে বললেন, আরও এক মাস আগে-পরে হতে পারে। প্রথম দফায় যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসার কথা, তার মধ্যে দেড় কোটি ডোজ আসছে। দুটি ডোজ ভ্যাকসিন মিলে একটি টিকা হবে।’
দ্বিতীয় দফায় আরও তিন কোটি মানুষের জন্য টিকা আসবে জানিয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘২০ শতাংশ মানুষকে এই টিকা দেয়া যাবে। সাড়ে চার কোটি মানুষকে টিকা দেয়া যাবে।’
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আওতায় অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০০ সালে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) গঠিত হয়। এর আলোকেই সবার জন্য টিকা নিশ্চিতকরণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে গৃহীত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’ (কোভ্যাক্স) উদ্যোগে সহযোগিতা করছে ইউরোপিয়ান কমিশন। দরিদ্র দেশগুলোকে করোনার টিকা সাহায্য হিসেবে ৮ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকার দাম ৪০ কোটি ইউরো দেবে সংস্থাটি।
বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ
বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে টিকা দেয়া যায় কিনা, তা নিয়েও সরকার আলোচনা করছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু সময় পাচ্ছি আমরা, আপাতত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে চিন্তা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যদি অন্য কেউ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাপ্রুভালসহ (অনুমোদন) প্রস্তাব নিয়ে আসে, সরকার কাউকেই মানা করবে না। আমাদের যে কমিটি আছে তারা অ্যাপ্রুভ করবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থায়ও ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে দুটি শর্ত দেয়া হচ্ছে। একটি হলো- যে ভ্যাকসিনই আনা হবে, সেটা হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ), যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কিংবা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) যেকোন এক বা একাধিক সংস্থা থেকে অনুমোদিত। দ্বিতীয় শর্ত হলোÑ বাংলাদেশের ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নির্দিষ্ট কমিটি থেকে ওই ভ্যাকসিনের অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি এবং মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেছেন, করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য, বাণিজ্য, হয়রানি ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপরও বিষয়টি শুধু সরকারের হাতে আটকে রাখা ঠিক হবে না। এটি উন্মুক্ত করে দিলে সরকারের ওপর বিত্তবান শ্রেণীর আগ্রহী মানুষের চাপ কমবে। বিত্তবানরা তখন গরিবের ভ্যাকসিনে ভাগ বসাতে আসবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সরকারের হাতে রাখতে হবে।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করোনার টিকা ব্যবস্থাপনায় জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রথমটি কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি, যেটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয়টি হলো- টিকা ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং গ্রুপ, যার নেতৃত্বে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। অপর কমিটির নাম কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুত কমিটি। এ কমিটির নেতৃত্বে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)।
এছাড়া টিকাবিষয়ক জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন জেলা সিভিল সার্জন। এ কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন জেলা সদর আসনের সংসদ সদস্য। উপজেলা কমিটির সভাপতি হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা। উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকবেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
করোনার টিকাবিষয়ক খসড়া জাতীয় পরিকল্পনাতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেসব কমিটির প্রধান হবেন জেলা সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এ কমিটিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রাখা হয়নি।
উপজেলা কমিটির চার দফা কাজের কথা বলা হয়েছে। প্রথম কাজ করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, সম্মুখসারির কর্মী, রোগ প্রতিরোধক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করা।
জুনের মধ্যে
সোমবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২০
প্রথম পর্যায়ে করোনার ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ স্বস্তিতে থাকলেও ‘গ্যাভি’ এবং ‘কোভ্যাক্স’ সুবিধার আওতায় স্বল্প মূল্যের ভ্যাকসিনের সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তায় পড়েছে সরকার। জানুয়ারির শেষের দিকে অথবা ফেব্রুয়ারিতে আসছে ৫০ লাখ ডোজ (মোট ৩ কোটি ডোজ দেবে) অক্সফোর্ডের করোনা টিকা যা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট দেবে। এই টিকা (ভ্যাকসিন) সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুঃচিন্তা নেই স্বাস্থ্য প্রশাসনের। তবে জুনের মধ্যে আরও ছয় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসছে, যার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এই ভ্যাকসিন সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করা হবে।
আগামী জুনের মধ্যে আরও ছয় কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা (ভ্যাকসিন) দেশে আসছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সোমবার (২১ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘মাইনাস ১৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় করোনাভাইরাসের টিকা সংরক্ষণ হবে। গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত গিয়ে টিকা দেয়ার স্ট্র্যাকচারই আমাদের নেই। একমাত্র কোল্ডস্টোরেজে রাখতে পারবেন, তারপর যখন বের করবে মাইনাস ১৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা...টেকনিক্যাল কমিটি উনারা এটা দেখবে।’
ওই ছয় কোটি ডোজ টিকা আসার আগে জানুয়ারির শেষের দিকে ‘অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা’র তৈরি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) আসছে। এই ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, যা দেশের জেলা পর্যায়ে বিদ্যমান সংরক্ষণ সক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিকাদান কর্মসূচি ‘এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন’র (ইপিআই) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এসএম আলমগীর সংবাদকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে দেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ভ্যাকসিন (২৫ লাখ মানুষকে দেয়া যাবে) পাচ্ছি, এই ভ্যাকসিন ২ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে।’
কিন্তু ‘ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না’র ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) এই মুহূর্তে দেশে নেই- জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে, একই সঙ্গে ফাইজার-মডার্নার ভ্যাকসিন আনারও চেষ্টা করছে, এগুলো মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস দিয়ে শুরু। এই দুটি ভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারকরা সংরক্ষণ সক্ষমতা নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।’
ইউনিসেফের ‘কোল্ড চেইন’ (টিকা সংরক্ষণ) বিশেষজ্ঞ হামিদুল ইসলাম ২০ ডিসেম্বর এক ভার্চুয়াল আলোচনায় জানান, ‘দেশব্যাপী ইপিআই’র ৬৯২টি টিকা সংরক্ষণাগার রয়েছে। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য এগুলোই যথেষ্ঠ। এ কারণে সরকারের ধীরস্থীর এবং ভালোভাবে ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া উচিত। তবে আমরা যদি একসঙ্গে বেশি বেশি করে বিভিন্ন কোম্পানির ভ্যাকসিন আমদানি করি সেক্ষেত্রে সংরক্ষণ কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।’
টিকা পেতে অনলাইনে আবেদন ও এনআইডি
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস ২০ ডিসেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ওই বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘টিকা দিতে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) লাগবে। প্রত্যেকের এনআইডি কার্ডের সঙ্গে তথ্য হালনাগাদ রাখতে হবে। কেউ যদি নিজে অ্যাপসের মাধ্যমে টিকা গ্রহণে অসুবিধা মনে করেন বা না পারেন, তবে সেক্ষেত্রে অন্য কারো কিংবা সরকারের নির্দিষ্ট কর্মীরা তাদের সহায়তা করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভাকে জানিয়েছেন, তিনি আশা করছেন জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ভ্যাকসিন পেয়ে যাব। এজন্য গ্রাসরুট লেভেন পর্যন্ত সবাইকে ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়েছে। ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য যেসব জিনিস ব্যবহার করা হবে সেগুলো কীভাবে ডিসপোজাল করা হবে সেই ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইপিআইয়ের যে ব্যাপক কার্যক্রম আছে, (করোনার টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন) সেটিকে বিভিন্ন হাসপাতালে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন, প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।’
আরও ছয় কোটি ভ্যাকসিন কোভেক্সের মাধ্যমে মে-জুন মাসের মধ্যে আসবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘ওনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) মন্ত্রিসভাকে বললেন, আরও এক মাস আগে-পরে হতে পারে। প্রথম দফায় যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসার কথা, তার মধ্যে দেড় কোটি ডোজ আসছে। দুটি ডোজ ভ্যাকসিন মিলে একটি টিকা হবে।’
দ্বিতীয় দফায় আরও তিন কোটি মানুষের জন্য টিকা আসবে জানিয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘২০ শতাংশ মানুষকে এই টিকা দেয়া যাবে। সাড়ে চার কোটি মানুষকে টিকা দেয়া যাবে।’
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আওতায় অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০০ সালে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) গঠিত হয়। এর আলোকেই সবার জন্য টিকা নিশ্চিতকরণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে গৃহীত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’ (কোভ্যাক্স) উদ্যোগে সহযোগিতা করছে ইউরোপিয়ান কমিশন। দরিদ্র দেশগুলোকে করোনার টিকা সাহায্য হিসেবে ৮ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকার দাম ৪০ কোটি ইউরো দেবে সংস্থাটি।
বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ
বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে টিকা দেয়া যায় কিনা, তা নিয়েও সরকার আলোচনা করছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু সময় পাচ্ছি আমরা, আপাতত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নিয়ে চিন্তা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যদি অন্য কেউ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাপ্রুভালসহ (অনুমোদন) প্রস্তাব নিয়ে আসে, সরকার কাউকেই মানা করবে না। আমাদের যে কমিটি আছে তারা অ্যাপ্রুভ করবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থায়ও ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে দুটি শর্ত দেয়া হচ্ছে। একটি হলো- যে ভ্যাকসিনই আনা হবে, সেটা হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ), যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট সংস্থা কিংবা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) যেকোন এক বা একাধিক সংস্থা থেকে অনুমোদিত। দ্বিতীয় শর্ত হলোÑ বাংলাদেশের ঔষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নির্দিষ্ট কমিটি থেকে ওই ভ্যাকসিনের অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি এবং মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেছেন, করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য, বাণিজ্য, হয়রানি ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপরও বিষয়টি শুধু সরকারের হাতে আটকে রাখা ঠিক হবে না। এটি উন্মুক্ত করে দিলে সরকারের ওপর বিত্তবান শ্রেণীর আগ্রহী মানুষের চাপ কমবে। বিত্তবানরা তখন গরিবের ভ্যাকসিনে ভাগ বসাতে আসবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সরকারের হাতে রাখতে হবে।
জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করোনার টিকা ব্যবস্থাপনায় জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রথমটি কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি, যেটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয়টি হলো- টিকা ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং গ্রুপ, যার নেতৃত্বে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। অপর কমিটির নাম কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুত কমিটি। এ কমিটির নেতৃত্বে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)।
এছাড়া টিকাবিষয়ক জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন জেলা সিভিল সার্জন। এ কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন জেলা সদর আসনের সংসদ সদস্য। উপজেলা কমিটির সভাপতি হলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা। উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকবেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
করোনার টিকাবিষয়ক খসড়া জাতীয় পরিকল্পনাতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেসব কমিটির প্রধান হবেন জেলা সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এ কমিটিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রাখা হয়নি।
উপজেলা কমিটির চার দফা কাজের কথা বলা হয়েছে। প্রথম কাজ করোনা মোকাবিলায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী, সম্মুখসারির কর্মী, রোগ প্রতিরোধক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করা।