ভারত এদিন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। সেদিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা। সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের সৈন্যবাহিনীর জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদের নির্মূল করার জন্য আজ যুদ্ধ করে চলেছে।’ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে একই দিনে অর্থাৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয় ভুটানও। প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বীকৃতিরও কয়েক ঘণ্টা আগে তারবার্তার মাধ্যমে ভুটান স্বীকৃত দিয়েছিল বাংলাদেশকে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে ভুটানই কোন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিল।
ভারত না ভুটান কে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল, এ নিয়ে প্রথমদিকে বিতর্ক থাকলেও সব ধরনের বিভ্রান্তির অবসান ঘটে ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভুটান ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছিল। একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের ওই তারবার্তায় দেশটির তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা— সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’
পরাজয় প্রায় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। একাত্তরের রণাঙ্গনের অবস্থা আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী আকাশ থেকে অবাধ গতিতে বিমান আক্রমণ চালানো হয়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী সৃষ্টি করে নৌ-অবরোধ। দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন। মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগর হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে সেদিন বীরগঞ্জ ও খানসামার পাক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। এদিকে লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। আর যৌথবাহিনী হেঁটে ঝিনাইদহ পৌঁছে এবং শহরটি মুক্ত করে।
চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ১০ দিন আগে এই দিনে- দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে বিজয় নিশ্চিত করে দেশের ৬ জেলার দুর্বার মুক্তিবাহিনী। বিজয়ের চূড়ান্ত লগ্ন না হলেও ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ছয়টি জেলায় ওড়ানো হয় লাল সবুজের বিজয় নিশান। একাত্তরের এই দিনে হানাদারমুক্ত হয় ফেনী, হবিগঞ্জ, যশোর, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর জেলা এবং শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা। চূড়ান্ত বিজয় না হলেও সেদিন এই জেলাগুলোয় ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে বিজয়ের নিশান উড়িয়ে উল্লাস করে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা।
মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি মহান মুক্তিযুদ্ধকে নতুন মাত্রা দেয়। এর মধ্যে ভুটানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলে। তখন থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় শুধুই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
রোববার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২১
ভারত এদিন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। সেদিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়েন তারা। সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের সৈন্যবাহিনীর জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদের নির্মূল করার জন্য আজ যুদ্ধ করে চলেছে।’ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে একই দিনে অর্থাৎ বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয় ভুটানও। প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বীকৃতিরও কয়েক ঘণ্টা আগে তারবার্তার মাধ্যমে ভুটান স্বীকৃত দিয়েছিল বাংলাদেশকে। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে ভুটানই কোন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছিল।
ভারত না ভুটান কে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল, এ নিয়ে প্রথমদিকে বিতর্ক থাকলেও সব ধরনের বিভ্রান্তির অবসান ঘটে ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভুটান ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়েছিল। একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভুটানের ওই তারবার্তায় দেশটির তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা— সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’
পরাজয় প্রায় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। একাত্তরের রণাঙ্গনের অবস্থা আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী আকাশ থেকে অবাধ গতিতে বিমান আক্রমণ চালানো হয়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী সৃষ্টি করে নৌ-অবরোধ। দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কর্নেল জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী মুক্ত করেন। মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঝিনাইগাতির আহম্মদ নগর হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন কোম্পানি কমান্ডার মো. রহমতুল্লাহ। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে সেদিন বীরগঞ্জ ও খানসামার পাক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। এদিকে লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। আর যৌথবাহিনী হেঁটে ঝিনাইদহ পৌঁছে এবং শহরটি মুক্ত করে।
চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ১০ দিন আগে এই দিনে- দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে বিজয় নিশ্চিত করে দেশের ৬ জেলার দুর্বার মুক্তিবাহিনী। বিজয়ের চূড়ান্ত লগ্ন না হলেও ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ছয়টি জেলায় ওড়ানো হয় লাল সবুজের বিজয় নিশান। একাত্তরের এই দিনে হানাদারমুক্ত হয় ফেনী, হবিগঞ্জ, যশোর, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর জেলা এবং শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা। চূড়ান্ত বিজয় না হলেও সেদিন এই জেলাগুলোয় ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে বিজয়ের নিশান উড়িয়ে উল্লাস করে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা।
মিত্রবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হানাদার বাহিনী সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি থেকে পালাতে থাকে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি মহান মুক্তিযুদ্ধকে নতুন মাত্রা দেয়। এর মধ্যে ভুটানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলে। তখন থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয় শুধুই সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।