কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন সরকার। কর্মকর্তারা বলছেন ক্যাম্পগুলোতে সহজে মাদকদ্রব্য মিলছে এবং ক্যাম্পে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক শিশুর জন্ম হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে প্রতিবছর প্রায় ৪৩ হাজার শিশুর জন্ম হয়।
এ পরিস্থিতিতে ‘ক্যাম্পসমূহের অভ্যন্তরে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও সহজলভ্যতা রোধের লক্ষ্যে মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিকতর কঠোর’ হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কক্সবাজারের খাবার দোকান ও বিভিন্ন দোকানে অন্য পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ‘মাদকদ্রব্য বিক্রি’ হচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কাজ না থাকায়’ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করছে; এতে স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় বিঘ্ন ঘটছে।
ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে-রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাড়ছে শিশু জন্মের হার। স্থানীয় কেন্দ্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক শিশুর জন্ম হচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে প্রতি বছর প্রায় ৪৩ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার ৩৪টি ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক অবস্থান করছে। মায়ানমার সামরিক জান্তার নির্যাতনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে গত ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৮ হাজার ৬০০ জনকে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে নির্মিত ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্প থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল; তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওইসব রোহিঙ্গাকে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক তৎপরতা ঠেকাতে ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে ‘নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ সম্পন্ন করা প্রয়োজন’ বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
‘বলপ্রয়োগে বাস্তচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সর্ম্পকিত জাতীয় কমিটি’র ৩য় সভার কার্যবিবরণী গত ১৯ ডিসেম্বর সরকারের বিভিন্ন অধিদফতর ও সংস্থায় বিতরণ করা হয়। সভাটি গত ২১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বরাত দিয়ে কার্যবিবরণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কক্সবাজারে অনেক দোকানপাট রয়েছে সেখানে খাবার ও পণ্য বিক্রির পাশাপাশি মাদকদ্রব্যও বিক্রি করা হয়।’
মন্ত্রী বলেন, ‘ভাসানচর ক্যাম্প এলাকায় নিরাপত্তার জন্য লজিস্টিক এবং প্রটেকশন বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। ক্যাম্প এলাকায় নির্ধারিত নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ কাজ শেষ করা দরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিশেষ করে ভাসানচরে ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। ভাসানচরে থানা স্থাপন করা হয়েছে এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।’
তিনি ভাসানচরে ‘আইসোলেশন সেন্টার’ স্থাপনের প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে ‘ক্যাম্পের ভিতরে মাদক সেবন ও বিক্রির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির’ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন মুখ্য সচিব।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের বরাত দিয়ে কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে- ‘টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থিত ক্যাম্পসমূহের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজের অগ্রগতি খুব ভালো। পূর্বে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে জননিরাপত্তা বিভাগ হতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আরো ৯৭ কোটি টাকা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু অর্থ মন্ত্রনালয় কর্তৃক অর্থ ছাড় করানি। এই অর্থ ছাড় করা হলে অবশিষ্ট নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পাদন করা হবে।’
নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ব্যয় হয় ১০০ কোটি টাকা। বাকি ১৬৫ কোটি টাকার মধ্যে চলতি অর্থবছরে ৯৭ কোটি টাকা ছাড় করার কথা রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ‘ইউএনএইচসিআর’ এর সাথে পরামর্শ করে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিজ’ বেশি। ‘কতিপয় রোহিঙ্গা নাগরিক লোহা-লক্করসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী চুরি করে ক্ষতিসাধন করছে। পর্যায়ক্রমে কক্সবাজার থেকে ভাসান চরে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হলে তখন অপরাধমূলক কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এ কারণে এখানে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন হলে তা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে।’
অপর একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় কিছু মৌলিক কাজ করা প্রয়োজন। ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে এবং টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা কমাতে হবে। রোহিঙ্গারা যখন দেবখে ভাসানচরে কক্সবাজার ক্যাম্পের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বেশি তখন তারা কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হবে। এছাড়া ক্যাম্প থেকে যে সব রোহিঙ্গা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের সংশোধনের জন্য আইসোলেশন ক্যাম্পে রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পালানোর প্রবণতা কমে আসবে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচর থেকে পালিয়ে যেতে স্থানীয় সহায়তাকারী ও দালালদেরও আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশানের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সদস্য একসাথে ভাসানচরে স্থানান্তর করতে হবে। একটি পরিবারের একটা অংশ রেখে আংশিক ভাসানচরে স্থানান্তরিত করলে অন্য সদস্যরা পুনরায় কক্সবাজার ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাইবে।
তিনি আরও বলেন, ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি নিয়ে ইউএনের (জাতিসংঘ) আপত্তি রয়েছে। দুই সন্তানের অধিক হলে রেশন না দেওয়ার বিধান রাখা দরকার। তবে ছোট-অল্প স্থানে অধিক সংখ্যক জনবসতি হওয়ায় এবং মানুষের কোন কাজ না থাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে প্রায় সাড়ে সাতশ’ মামলা হয়েছে। এদের অপরাধের মধ্যে আছে- মাদক, অস্ত্র, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি ও মানবপাচার ইত্যাদি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের জাতিগত নিপীড়নের মুখে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে বাংলাদেশ সরকার। এদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৭৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলাদেশে।
দেশে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে। ওই বছর প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এর আগে ২০১৬ সালে আরও প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এরও আগে বিভিন্ন সময়ে মায়ানমারে নির্যাতনের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা, যা দশকের পর দশক ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করছে। এদের অনেকেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ও মায়ানমার সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে এরই মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুই করেনি।
শুক্রবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২২
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন সরকার। কর্মকর্তারা বলছেন ক্যাম্পগুলোতে সহজে মাদকদ্রব্য মিলছে এবং ক্যাম্পে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক শিশুর জন্ম হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে প্রতিবছর প্রায় ৪৩ হাজার শিশুর জন্ম হয়।
এ পরিস্থিতিতে ‘ক্যাম্পসমূহের অভ্যন্তরে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও সহজলভ্যতা রোধের লক্ষ্যে মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিকতর কঠোর’ হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কক্সবাজারের খাবার দোকান ও বিভিন্ন দোকানে অন্য পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ‘মাদকদ্রব্য বিক্রি’ হচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কাজ না থাকায়’ অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করছে; এতে স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় বিঘ্ন ঘটছে।
ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে-রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাড়ছে শিশু জন্মের হার। স্থানীয় কেন্দ্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক শিশুর জন্ম হচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে প্রতি বছর প্রায় ৪৩ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার ৩৪টি ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক অবস্থান করছে। মায়ানমার সামরিক জান্তার নির্যাতনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে গত ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ১৮ হাজার ৬০০ জনকে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে নির্মিত ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ক্যাম্প থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল; তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওইসব রোহিঙ্গাকে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক তৎপরতা ঠেকাতে ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে ‘নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ সম্পন্ন করা প্রয়োজন’ বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
‘বলপ্রয়োগে বাস্তচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সর্ম্পকিত জাতীয় কমিটি’র ৩য় সভার কার্যবিবরণী গত ১৯ ডিসেম্বর সরকারের বিভিন্ন অধিদফতর ও সংস্থায় বিতরণ করা হয়। সভাটি গত ২১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বরাত দিয়ে কার্যবিবরণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কক্সবাজারে অনেক দোকানপাট রয়েছে সেখানে খাবার ও পণ্য বিক্রির পাশাপাশি মাদকদ্রব্যও বিক্রি করা হয়।’
মন্ত্রী বলেন, ‘ভাসানচর ক্যাম্প এলাকায় নিরাপত্তার জন্য লজিস্টিক এবং প্রটেকশন বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। ক্যাম্প এলাকায় নির্ধারিত নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ কাজ শেষ করা দরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিশেষ করে ভাসানচরে ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। ভাসানচরে থানা স্থাপন করা হয়েছে এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।’
তিনি ভাসানচরে ‘আইসোলেশন সেন্টার’ স্থাপনের প্রস্তাব করেন। একই সঙ্গে ‘ক্যাম্পের ভিতরে মাদক সেবন ও বিক্রির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির’ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন মুখ্য সচিব।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের বরাত দিয়ে কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে- ‘টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থিত ক্যাম্পসমূহের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজের অগ্রগতি খুব ভালো। পূর্বে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে জননিরাপত্তা বিভাগ হতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আরো ৯৭ কোটি টাকা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু অর্থ মন্ত্রনালয় কর্তৃক অর্থ ছাড় করানি। এই অর্থ ছাড় করা হলে অবশিষ্ট নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পাদন করা হবে।’
নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ব্যয় হয় ১০০ কোটি টাকা। বাকি ১৬৫ কোটি টাকার মধ্যে চলতি অর্থবছরে ৯৭ কোটি টাকা ছাড় করার কথা রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ‘ইউএনএইচসিআর’ এর সাথে পরামর্শ করে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিজ’ বেশি। ‘কতিপয় রোহিঙ্গা নাগরিক লোহা-লক্করসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী চুরি করে ক্ষতিসাধন করছে। পর্যায়ক্রমে কক্সবাজার থেকে ভাসান চরে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হলে তখন অপরাধমূলক কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এ কারণে এখানে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন হলে তা নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে।’
অপর একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বলেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় কিছু মৌলিক কাজ করা প্রয়োজন। ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে এবং টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা কমাতে হবে। রোহিঙ্গারা যখন দেবখে ভাসানচরে কক্সবাজার ক্যাম্পের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বেশি তখন তারা কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হবে। এছাড়া ক্যাম্প থেকে যে সব রোহিঙ্গা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের সংশোধনের জন্য আইসোলেশন ক্যাম্পে রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পালানোর প্রবণতা কমে আসবে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচর থেকে পালিয়ে যেতে স্থানীয় সহায়তাকারী ও দালালদেরও আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশানের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সদস্য একসাথে ভাসানচরে স্থানান্তর করতে হবে। একটি পরিবারের একটা অংশ রেখে আংশিক ভাসানচরে স্থানান্তরিত করলে অন্য সদস্যরা পুনরায় কক্সবাজার ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাইবে।
তিনি আরও বলেন, ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি নিয়ে ইউএনের (জাতিসংঘ) আপত্তি রয়েছে। দুই সন্তানের অধিক হলে রেশন না দেওয়ার বিধান রাখা দরকার। তবে ছোট-অল্প স্থানে অধিক সংখ্যক জনবসতি হওয়ায় এবং মানুষের কোন কাজ না থাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে প্রায় সাড়ে সাতশ’ মামলা হয়েছে। এদের অপরাধের মধ্যে আছে- মাদক, অস্ত্র, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি ও মানবপাচার ইত্যাদি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের জাতিগত নিপীড়নের মুখে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে বাংলাদেশ সরকার। এদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৭৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলাদেশে।
দেশে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে। ওই বছর প্রায় সাত লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এর আগে ২০১৬ সালে আরও প্রায় ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এরও আগে বিভিন্ন সময়ে মায়ানমারে নির্যাতনের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা, যা দশকের পর দশক ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করছে। এদের অনেকেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ও মায়ানমার সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে এরই মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুই করেনি।