জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমাননায় সংকটে পড়ছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ প্রক্রিয়া। সরকারের প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ‘অস্বাভাবিক’ কম খরচে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দরপত্র জমা দিয়েছিল মুদ্রাকররা। এরপর কাগজ, কালি, গ্লু, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জমা দেয়া দরপত্রে বই ছাপতে অনীহা দেখাচ্ছেন মুদ্রাকররা। এতে বেকায়দায় পড়ছে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)।
সম্প্রতি অন্তত পাঁচটি ছাপাখানার পক্ষ থেকে এনসিটিবিকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে, বর্তমানে কাগজ, কালিসহ পাঠ্যপুস্তক ছাপার উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে কারো পক্ষেই মানসম্মত বই ছাপা সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, ‘মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক পেতে হলে বাজারের সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে কাজ দেয়া উচিত’।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০/৩৫ শতাংশ কমে দরপত্রে অংশ নেয়ার কারণে এই জটিলতা হচ্ছে। আমরা তো তাদের টাকা কম দিতে চাইনি। তারাই কম দামে কাজ করতে চেয়েছে। এখন বাস্তবতা একটু ভিন্ন; বই ছাপার উপকরণের দাম আরও কিছুটা বেড়েছে। এতে যারা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তারা কিছুটা বিপদে পড়েছে।’ পাঠ্যপুস্তক ছাপার উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের কাছে গত ৬ আগস্ট পাঁচটি ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী চিঠি দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নয়ন মনি প্রিন্টার্স, মুছা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস, তায়েবা প্রিন্টার্স, বর্ণমালা প্রেস ও দোহার প্রিন্টিং প্রেস। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের চিঠির ভাষা প্রায় একই রকম।
‘২০২৩ শিক্ষাবর্ষের কাজের কাগজ, আর্ট কার্ড, কালি, গ্লুর দাম ঊর্ধ্বগতি বিষয়ে অবগতকরণ’ প্রসঙ্গে দোহার প্রিন্টিং প্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দরপত্র জমা দেয়ার আগে ৬০ গ্রামের (জিএসএম বা গ্রাম/স্কয়ার মিটার) প্রতি টন কাগজের মূল্য ছিল ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা; আর প্রতি রিমের দাম ছিল ৯০১ টাকা। বর্তমানে এই মানের এক টন কাগজের দাম ন্যূনতম এক লাখ ১০ হাজার; আর প্রতি রিমের দাম হয় এক হাজার ২৭৯ টাকা।
আগে প্রতি টন আর্ট কার্ডের (বইয়ের কভার ছাপার মোটা কাগজ) দাম ছিল ন্যূনতম এক লাখ ১০ হাজার টাকা; বর্তমানে প্রতি টন আর্ট কার্ডের মূল্য এক লাখ ৪০ হাজার। এছাড়া আগে বই ছাপার প্রতি পাউন্ড কালির দাম ছিল ২৫০ টাকা; বর্তমানে তা ৩৫০ টাকা এবং আগে প্রতি কেজি গ্লুর দাম ছিল ৩৬০ টাকা; বর্তমানে এক কেজি গ্লুর দাম ৫২০ টাকা।
এই পাঁচ ছাপাখানার পক্ষ থেকেই ‘পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে বর্তমানে প্রতি রিমের খরচ’ ন্যূনতম এক হাজার ৭০৯ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি রিম কাগজের দাম এক হাজার ২৭৯ টাকা এবং প্রতি রিম কাগজে ১৪০ টাকার আর্ট কার্ড, ছাপার খরচ ৬০ টাকা, বাঁধাই খরচ ১০০ টাকা পরিবহন (সরবরাহ) ব্যয় ৩০ টাকা এবং প্রতি রিম কাগজের আয়কর কর্তন হিসেবে ১০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
দোহার প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধীকারী আনোয়ার হোসেন পত্তন দার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সর্বনিম্ন বাজার দর বিবেচনায় নিয়ে দরপত্রে অংশ নিয়েছিলাম। এরপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এ কারণে কাগজ, কালি, লেভার কস্ট, পরিবহন ব্যয়সহ সবকিছুর খরচ আরও বেড়েছে। এখন আগের দামে মানসম্মত কাগজে বই ছাপা সম্ভব নয়। বাজারের সবকিছুর ব্যয় যাচাই-বাছাই করে কাজ দেয়া উচিত’। এসব বিষয় এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান আনোয়ার হোসেন।
ঢাকার বাইরের অন্য একটি ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘এখন দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গত বছর এই সময়ে কোন লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছিল না। কিন্তু হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই ব্যয় কীভাবে মেটাবো?’
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেছেন, ‘কয়েকজন ব্যবসায়ী বাজারমূল্য বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের পিপিআর বা সরকারি ক্রয় আইন অনুযায়ী কাজ করতে হয়।’ ব্যবসায়ীরা বই ছাপার কাজ না করলে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কারণ আমরা চাইলেই দরপত্রের বাইরে গিয়ে কাউকে সুবিধা দিতে পারব না, টাকা বাড়াতে পারব না। আবার কাগজসহ প্রায় সব উপকরণের দাম কিছুটা বেড়েছে; এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরাই বা কীভাবে কাজ করবেন সেটিও ভাবতে হচ্ছে।’
এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরের প্রায় ১০ কোটি কপি পাঠ্যবই ছাপতে ৯৮টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ১৩ জুন এই দরপত্র উন্মুক্ত করে এনসিটিবি।
প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কমে দরপত্র :
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, এবার প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপতে প্রতি ফর্মার (৮ পৃষ্টায় এক ফর্মা) প্রাক্কলিত ব্যয় দুই টাকা ৯০ পয়সা ধরা হয়েছিল। অথচ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি ফর্মা বই মুদ্রণের ব্যয় মাত্র এক টাকা ৯০ পয়সা দেখিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়; যা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি ফর্মা বই মুদ্রণ খরচ দুই টাকা ৩০/৩২ পয়সা দেখিয়েই সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছেন।
মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপাতেও দুই টাকা ৭০/৯০ পয়সা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল। এই বই ছাপার কাজও প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০/৪০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দেয়া হয়েছে। ‘অস্বাভাবিক’ কম দরে কীভাবে বই ছাপার কাজ করবেন তা জানতে সম্প্রতি সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল এনসিটিবি। এই পরিস্থিতিতেই সম্প্রতি ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটে; সরকারও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, ‘কাগজের পাল্প বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমরা যখন দরপত্র জমা দেয় তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯২ টাকা; এখন তা ১১৩/১১৪ টাকা। এখন বাড়তি টাকাটা কে দেবে? তাছাড়া জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন ব্যয় অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। এটা আমরা বাড়াইনি, সরকার বাড়িয়েছে। তাহলে এই বাড়তি ব্যয়ও সরকারকে দিতে হবে। অন্যতায় পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে হবে।’
প্রাক্কলিত দরের চেয়ে সর্বোচ্চ ‘১০ শতাংশ কমে’ দরপত্রে অংশ নিলে সেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল দাবি করে তোফায়েল খান বলেন, ‘গত বছর ২০/৩০ শতাংশ কমেও কাজ দেয়া হয়েছিল। পরে এসব প্রতিষ্ঠান নিউজ প্রিন্টে বই ছেপে দিয়েছে; অথচ তাদের কোন শাস্তি হয়নি। কিন্তু যারা একটু দেরিতে ভালোমানের কাগজে বই ছেপে দিয়েছে তাদের জরিমানা করা হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই কারণে আমরা চাই, সরকার নিউজপ্রিন্ট কাগজেই বই ছাপুক। এতে সরকারের টাকা যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি বিদেশ থেকে পাল্পও আমদানি করতে হবে না।’
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দরপত্রের শর্তানুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বই ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা পাল্প থাকতে হয়। এই মাপের প্রতি টন কাগজের দাম বর্তমানে এক লাখ থেকে এক লাখ ১৮ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। অথচ বর্তমানে ৬০ জিএসএম কাগজের দামই এর সমান। আর বইয়ের কভারে ২৩০ জিএসএমের আর্ট কার্ড (মোটা কাগজ) ব্যবহার করতে হয়; যার প্রতি টনের দাম এক লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো।
বুধবার, ১০ আগস্ট ২০২২
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমাননায় সংকটে পড়ছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ প্রক্রিয়া। সরকারের প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ‘অস্বাভাবিক’ কম খরচে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দরপত্র জমা দিয়েছিল মুদ্রাকররা। এরপর কাগজ, কালি, গ্লু, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জমা দেয়া দরপত্রে বই ছাপতে অনীহা দেখাচ্ছেন মুদ্রাকররা। এতে বেকায়দায় পড়ছে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ (এনসিটিবি)।
সম্প্রতি অন্তত পাঁচটি ছাপাখানার পক্ষ থেকে এনসিটিবিকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে, বর্তমানে কাগজ, কালিসহ পাঠ্যপুস্তক ছাপার উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে কারো পক্ষেই মানসম্মত বই ছাপা সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, ‘মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক পেতে হলে বাজারের সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে কাজ দেয়া উচিত’।
জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০/৩৫ শতাংশ কমে দরপত্রে অংশ নেয়ার কারণে এই জটিলতা হচ্ছে। আমরা তো তাদের টাকা কম দিতে চাইনি। তারাই কম দামে কাজ করতে চেয়েছে। এখন বাস্তবতা একটু ভিন্ন; বই ছাপার উপকরণের দাম আরও কিছুটা বেড়েছে। এতে যারা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তারা কিছুটা বিপদে পড়েছে।’ পাঠ্যপুস্তক ছাপার উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যানের কাছে গত ৬ আগস্ট পাঁচটি ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী চিঠি দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো নয়ন মনি প্রিন্টার্স, মুছা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস, তায়েবা প্রিন্টার্স, বর্ণমালা প্রেস ও দোহার প্রিন্টিং প্রেস। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের চিঠির ভাষা প্রায় একই রকম।
‘২০২৩ শিক্ষাবর্ষের কাজের কাগজ, আর্ট কার্ড, কালি, গ্লুর দাম ঊর্ধ্বগতি বিষয়ে অবগতকরণ’ প্রসঙ্গে দোহার প্রিন্টিং প্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দরপত্র জমা দেয়ার আগে ৬০ গ্রামের (জিএসএম বা গ্রাম/স্কয়ার মিটার) প্রতি টন কাগজের মূল্য ছিল ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা; আর প্রতি রিমের দাম ছিল ৯০১ টাকা। বর্তমানে এই মানের এক টন কাগজের দাম ন্যূনতম এক লাখ ১০ হাজার; আর প্রতি রিমের দাম হয় এক হাজার ২৭৯ টাকা।
আগে প্রতি টন আর্ট কার্ডের (বইয়ের কভার ছাপার মোটা কাগজ) দাম ছিল ন্যূনতম এক লাখ ১০ হাজার টাকা; বর্তমানে প্রতি টন আর্ট কার্ডের মূল্য এক লাখ ৪০ হাজার। এছাড়া আগে বই ছাপার প্রতি পাউন্ড কালির দাম ছিল ২৫০ টাকা; বর্তমানে তা ৩৫০ টাকা এবং আগে প্রতি কেজি গ্লুর দাম ছিল ৩৬০ টাকা; বর্তমানে এক কেজি গ্লুর দাম ৫২০ টাকা।
এই পাঁচ ছাপাখানার পক্ষ থেকেই ‘পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে বর্তমানে প্রতি রিমের খরচ’ ন্যূনতম এক হাজার ৭০৯ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি রিম কাগজের দাম এক হাজার ২৭৯ টাকা এবং প্রতি রিম কাগজে ১৪০ টাকার আর্ট কার্ড, ছাপার খরচ ৬০ টাকা, বাঁধাই খরচ ১০০ টাকা পরিবহন (সরবরাহ) ব্যয় ৩০ টাকা এবং প্রতি রিম কাগজের আয়কর কর্তন হিসেবে ১০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
দোহার প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধীকারী আনোয়ার হোসেন পত্তন দার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সর্বনিম্ন বাজার দর বিবেচনায় নিয়ে দরপত্রে অংশ নিয়েছিলাম। এরপর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এ কারণে কাগজ, কালি, লেভার কস্ট, পরিবহন ব্যয়সহ সবকিছুর খরচ আরও বেড়েছে। এখন আগের দামে মানসম্মত কাগজে বই ছাপা সম্ভব নয়। বাজারের সবকিছুর ব্যয় যাচাই-বাছাই করে কাজ দেয়া উচিত’। এসব বিষয় এনসিটিবি চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান আনোয়ার হোসেন।
ঢাকার বাইরের অন্য একটি ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘এখন দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গত বছর এই সময়ে কোন লোডশেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছিল না। কিন্তু হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই ব্যয় কীভাবে মেটাবো?’
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেছেন, ‘কয়েকজন ব্যবসায়ী বাজারমূল্য বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের পিপিআর বা সরকারি ক্রয় আইন অনুযায়ী কাজ করতে হয়।’ ব্যবসায়ীরা বই ছাপার কাজ না করলে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কারণ আমরা চাইলেই দরপত্রের বাইরে গিয়ে কাউকে সুবিধা দিতে পারব না, টাকা বাড়াতে পারব না। আবার কাগজসহ প্রায় সব উপকরণের দাম কিছুটা বেড়েছে; এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরাই বা কীভাবে কাজ করবেন সেটিও ভাবতে হচ্ছে।’
এনসিটিবি থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রায় ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য মোট ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরের প্রায় ১০ কোটি কপি পাঠ্যবই ছাপতে ৯৮টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ১৩ জুন এই দরপত্র উন্মুক্ত করে এনসিটিবি।
প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কমে দরপত্র :
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, এবার প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপতে প্রতি ফর্মার (৮ পৃষ্টায় এক ফর্মা) প্রাক্কলিত ব্যয় দুই টাকা ৯০ পয়সা ধরা হয়েছিল। অথচ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি ফর্মা বই মুদ্রণের ব্যয় মাত্র এক টাকা ৯০ পয়সা দেখিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়; যা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতি ফর্মা বই মুদ্রণ খরচ দুই টাকা ৩০/৩২ পয়সা দেখিয়েই সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছেন।
মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপাতেও দুই টাকা ৭০/৯০ পয়সা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল। এই বই ছাপার কাজও প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০/৪০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দেয়া হয়েছে। ‘অস্বাভাবিক’ কম দরে কীভাবে বই ছাপার কাজ করবেন তা জানতে সম্প্রতি সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল এনসিটিবি। এই পরিস্থিতিতেই সম্প্রতি ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটে; সরকারও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, ‘কাগজের পাল্প বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমরা যখন দরপত্র জমা দেয় তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯২ টাকা; এখন তা ১১৩/১১৪ টাকা। এখন বাড়তি টাকাটা কে দেবে? তাছাড়া জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন ব্যয় অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। এটা আমরা বাড়াইনি, সরকার বাড়িয়েছে। তাহলে এই বাড়তি ব্যয়ও সরকারকে দিতে হবে। অন্যতায় পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে হবে।’
প্রাক্কলিত দরের চেয়ে সর্বোচ্চ ‘১০ শতাংশ কমে’ দরপত্রে অংশ নিলে সেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল দাবি করে তোফায়েল খান বলেন, ‘গত বছর ২০/৩০ শতাংশ কমেও কাজ দেয়া হয়েছিল। পরে এসব প্রতিষ্ঠান নিউজ প্রিন্টে বই ছেপে দিয়েছে; অথচ তাদের কোন শাস্তি হয়নি। কিন্তু যারা একটু দেরিতে ভালোমানের কাগজে বই ছেপে দিয়েছে তাদের জরিমানা করা হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই কারণে আমরা চাই, সরকার নিউজপ্রিন্ট কাগজেই বই ছাপুক। এতে সরকারের টাকা যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি বিদেশ থেকে পাল্পও আমদানি করতে হবে না।’
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দরপত্রের শর্তানুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বই ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা পাল্প থাকতে হয়। এই মাপের প্রতি টন কাগজের দাম বর্তমানে এক লাখ থেকে এক লাখ ১৮ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। অথচ বর্তমানে ৬০ জিএসএম কাগজের দামই এর সমান। আর বইয়ের কভারে ২৩০ জিএসএমের আর্ট কার্ড (মোটা কাগজ) ব্যবহার করতে হয়; যার প্রতি টনের দাম এক লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো।