জাতিসংঘে শেখ হাসিনা
এতে মানবজাতিকে শাস্তি দেয়া হয়
সারাবিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ বন্ধ করুন। তিনি বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সব মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।’
বিশ্বনেতাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার আকুল আবেদন যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা কখনো কোন জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আলাপ-আলোচনাই সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়।
গত শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
জাতিসংঘে ভাষণে তিনি একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ সংকট নিয়ে যেমন কথা বলেছেন তেমনি বাংলাদেশের সামনে কঠোর সমস্যা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়েও কথা বলেছেন।
গত মাসে রোহিঙ্গাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাদের মায়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনার পরও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের বলেন, ‘মায়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে। আশা করি এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিরূপ প্রভাবের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানব পাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে।‘ এ সংকট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা পুরো উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আবারও সতর্ক করেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম আর খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলেছে। বিশ্বকে ফেলে দিয়েছে নতুন এক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায়। সেই বিপদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা জাতিসংঘে তার ভাষণে বলেন, ‘বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।’
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর দেয়া প্রথম ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারবো এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সব সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব।
‘সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেইসব প্রচেষ্টাকে, যার লক্ষ্য বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করা, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতি জোরদার করা।’ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে মানবজাতির জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঝুঁকিতে থাকা অন্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারী হতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলোÑ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়।’
মহামারীর সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে বলেন, সংক্রমণের বিস্তার রোধে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতা প্রসারিত করা হয়েছে, প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকার সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, আর টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসেবে ৪১তম। বিগত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে। মাথাপিছু আয় এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মহামারীর মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।
‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের মতো অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।’ সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে বাংলাদেশের ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির কথা জাতিসংঘে আবারও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী সাইবার-অপরাধ এবং সাইবার সহিংসতা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নে একসঙ্গে কাজ করার জন্য সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব এবং সংহতি বাড়াতে হবে।’
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সংকটে প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে জানিয়ে সেজন্য উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে ‘বর্ধিত এবং কার্যকর’ সহযোগিতার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং আর্থিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের মতো বৈশ্বিক প্রতিকূলতাগুলোর রূপান্তরমূলক সমাধান খুঁজতে আগ্রহী। ‘তবে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ব্যতীত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে নিজের জীবনের এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার কথা বিশ্বনেতাদের বলেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে আমার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, আমার ছোট তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তার নবপরিণীতা স্ত্রী পারভিন রোজী, আমার দশ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
‘আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ফুফা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার কন্যা ১৩ বছরের বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের আরিফ সেরনিয়াবাত এবং ৪ বছরের সুকান্ত, আমার ফুফাত ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ব্রিগেডিয়ার জামিল, পুলিশ অফিসার সিদ্দিকুর রহমানসহ ঘাতকেরা ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন জার্মানিতে ছিলেন বলে তিনি এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। তারপর ছয়টি বছর তাদের বিদেশে কেটেছে নির্বাসনে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ওই বন্দীখানায় জন্মগ্রহণ করে। আমাদের ঘরে কোন ফার্নিচার দেয়া হয়নি। সুচিকিৎসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। দৈনন্দিন খাবার পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত।
‘কাজেই যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যাকান্ড-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই।’
বিশ্বসভায় সব দেশের প্রতিনিধিকে তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বÑ যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।’
জাতিসংঘে শেখ হাসিনা
এতে মানবজাতিকে শাস্তি দেয়া হয়
শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
সারাবিশ্বে যুদ্ধ-বিগ্রহে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ বন্ধ করুন। তিনি বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সব মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসংকটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।’
বিশ্বনেতাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার আকুল আবেদন যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরীপন্থা কখনো কোন জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আলাপ-আলোচনাই সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়।
গত শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
জাতিসংঘে ভাষণে তিনি একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ সংকট নিয়ে যেমন কথা বলেছেন তেমনি বাংলাদেশের সামনে কঠোর সমস্যা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়েও কথা বলেছেন।
গত মাসে রোহিঙ্গাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাদের মায়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনার পরও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের বলেন, ‘মায়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে। আশা করি এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিরূপ প্রভাবের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানব পাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে।‘ এ সংকট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা পুরো উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আবারও সতর্ক করেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম আর খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলেছে। বিশ্বকে ফেলে দিয়েছে নতুন এক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায়। সেই বিপদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা জাতিসংঘে তার ভাষণে বলেন, ‘বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।’
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর দেয়া প্রথম ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারবো এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সব সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব।
‘সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেইসব প্রচেষ্টাকে, যার লক্ষ্য বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করা, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতি জোরদার করা।’ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে মানবজাতির জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঝুঁকিতে থাকা অন্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারী হতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হলোÑ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়।’
মহামারীর সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছে উল্লেখ করে বলেন, সংক্রমণের বিস্তার রোধে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতা প্রসারিত করা হয়েছে, প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকার সুরক্ষা দেয়া হয়েছে, আর টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসেবে ৪১তম। বিগত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে। মাথাপিছু আয় এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মহামারীর মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।
‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের মতো অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।’ সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে বাংলাদেশের ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির কথা জাতিসংঘে আবারও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী সাইবার-অপরাধ এবং সাইবার সহিংসতা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নে একসঙ্গে কাজ করার জন্য সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব এবং সংহতি বাড়াতে হবে।’
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সংকটে প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে জানিয়ে সেজন্য উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে ‘বর্ধিত এবং কার্যকর’ সহযোগিতার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং আর্থিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের মতো বৈশ্বিক প্রতিকূলতাগুলোর রূপান্তরমূলক সমাধান খুঁজতে আগ্রহী। ‘তবে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ব্যতীত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে নিজের জীবনের এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার কথা বিশ্বনেতাদের বলেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে আমার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, আমার ছোট তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তার নবপরিণীতা স্ত্রী পারভিন রোজী, আমার দশ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
‘আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ফুফা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার কন্যা ১৩ বছরের বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের আরিফ সেরনিয়াবাত এবং ৪ বছরের সুকান্ত, আমার ফুফাত ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ব্রিগেডিয়ার জামিল, পুলিশ অফিসার সিদ্দিকুর রহমানসহ ঘাতকেরা ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন জার্মানিতে ছিলেন বলে তিনি এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। তারপর ছয়টি বছর তাদের বিদেশে কেটেছে নির্বাসনে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ওই বন্দীখানায় জন্মগ্রহণ করে। আমাদের ঘরে কোন ফার্নিচার দেয়া হয়নি। সুচিকিৎসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। দৈনন্দিন খাবার পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত।
‘কাজেই যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যাকান্ড-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই।’
বিশ্বসভায় সব দেশের প্রতিনিধিকে তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বÑ যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।’