alt

জাতীয়

আহমদুল কবির : শ্রদ্ধাঞ্জলি

আনিসুজ্জামান

: শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

আহমদুল কবিরের সৌজন্য ও সদাশয়তার তুলনা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আমার বিশ্বাস, তার উৎস ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাসে। তিনি যে সুশিক্ষিত ছিলেন, তা তিনি জানতেন। সকল মেধাবী ছাত্র পরীক্ষার ফল ভালো করেন না। তার একটা কারণ, অধীত বিষয়ের বাইরে নানা বিষয়ে তাঁদের ঔৎসুক্য ও কৌতূহল। এই অনুসন্ধিৎসা তাঁদেরকে একটা বিষয়ে গভীর পা-িত্য অর্জনে বাধা দেয়, কিন্তু দশটা বিষয়ে জ্ঞানলাভে সাহায্য করে। আহমদুল কবির এই পর্যায়ের মানুষ। চল্লিশের দশকে তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বদানের জন্যে নির্বাচিত হয়েছিলেন, এ-নিয়েও তাঁর সূক্ষ্ম গর্ববোধ ছিল, যদিও তা সহজে প্রকাশ পেতো না। তিনি ভালো চাকরি করেছেন। যেমন আয় করেছেন, তেমনি ব্যয় করেছেন। বাড়িতে বিষয়-আশয় যথেষ্ট ছিল, সুতরাং ব্যয়কুণ্ঠ হয়ে সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হননি। তারপর চাকরি ছেড়ে ‘সংবাদের হাল ধরেছেন, সফলও হয়েছেন। চাইলে পত্রিকাটিকে আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারতেন, কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেননি। যা হয়েছে, তাই যথেষ্ট মনে করেছেন। একটা রাজনৈতিক দল গড়েছিলেন, কিন্তু জননেতা হওয়ার চেষ্টা করেননি। জানতেন, ওই আসন তাঁর জন্যে নয়। কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে, ভিন্ন কণ্ঠস্বর ব্যক্ত করতে যে-মঞ্চটি দরকার, ছোটোখাটো দলটি তাঁকে তা দিয়েছিল। শেষকালে রোগগ্রস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। নিয়মিত ঘি-ডিম খেয়েও শরীরে মেদ জমতে দেননি। সতর্কবাণী মেনে নিয়ে জীবনযাপন-প্রণালি বদলাতে রাজি ছিলেন না। নিজের জগতে তিনি স্বরাট।

স্বরাট বলেই তিনি জানতেন যে, অন্যকে সম্মানজ্ঞাপন করলে ছোটো হতে হয় না। অতএব, ছোটো-বড়ো সবাইকেই- শেষদিকে তাঁর বড়ো যাঁরা তাঁদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল, সুতরাং প্রায় ক্ষেত্রে যাঁরা তাঁর ছোটো, তাঁদেরকে বুকের ওপর যুক্ত করে- কখনো কখনো পা দুটো জোড় করেও- প্রীতি, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাতেন। প্রায় একই কারণে তাঁর চলাফেরার মধ্যেও একটা রাজসিক ভাব ছিল। একবার আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগ দিতে আমরা একসঙ্গে দিল্লিতে গেলাম। বড়ো হোটেলেই থাকবার ব্যবস্থা। প্রত্যেককে একটা ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে।

মনু ভাই বললেন, ঘর হলে হবে না, তাঁর লাগবে সুয়িট। হোটেল-কর্তৃপক্ষ বলল, অমন নির্দেশ তো তারা পায়নি। মনু ভাই বললেন, বাড়তি খরচ যা লাগবে, তা তিনি দিয়ে দেবেন। আমি বাধা দিতে গেলাম, বললাম, কী হবে সুয়িট দিয়ে? মনু ভাই পালটা প্রশ্ন করলেন, দলের সবাই একসঙ্গে বসবে কোথায়? অন্য দেশের প্রতিনিধিদের কাউকে আলাপ করতে ডাকলে তাকে কি শোয়ার ঘরে বসানো হবে? ইত্যাদ ইত্যাদি । তিনি সুয়িটেই উঠলেন। আমন্ত্রণকর্তাদের বলা হলো বিষয়টা। চলে আসার সময়ে হোটেল তাঁর কাছে পুরো সুয়িটের ভাড়া দাবি করলো। আমরা বললাম, ওঁর জন্যে যে ঘর বরাদ্দ করা হয়েছিল, সে-ঘরভাড়ার টাকাটা অন্তত তারা ভাড়া থেকে বাদ দিতে পারে। তারা রাজি হলো না। মনু ভাই পুরো ভাড়াই চুকিয়ে দিলেন। তাঁর ইচ্ছাশক্তি প্রবল ছিল। কিন্তু অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেও তিনি মূল্য দিতেন। কারো ওপরে জোর খাটাতে তাঁকে দেখিনি। ফলে, অনেক সভা-সমিতিতে তাঁকে বক্তৃতা করতে বললে তিনি যখন রাজি হতে চাইতেন না, তখন তাঁর ওপরে জোর খাটাতে পারতাম না আমাদের ছোটোখাটো কাজ তাঁর মনঃপূত হলে তিনি এমন উচ্ছ্বসিত হতেন যে, লজ্জা না পেয়ে উপায় থাকত না। অথচ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। ২০০২ সালে আমি যখন বাংলা একাডেমির সভাপতির পদ ত্যাগ করলাম, তখন তিনি শুধু আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে ক্ষান্ত হলেন না, ওই কারণে আমাকে খাওয়াবেন বলে ঘোষণা করলেন এবং আমার সুবিধেজনক তারিখে ঢাকা ক্লাবে আমাকে দুপুরবেলায় আপ্যায়িত করলেন । অনেক সময়ে তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্নে মতপার্থক্য হয়েছে।

তিনি মনে করতেন, সততা আছে, প্রজ্ঞা আছে, সাহস আছে, এমন এক প্রজন্মই বাংলাদেশকে বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে

সংসদ সদস্য থাকতে তিনি কেন এটা করলেন, কেন ওটা করলেন না, এসব প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করেছি। কখনো তিনি অসহিষ্ণু হননি। হয় তাঁর দিক থেকে কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, নয়তো বলেছেন এ বিষয়ে আমরা একমত হবো না। আমি তাঁর কথা মেনে নিয়ে মতানৈক্য পোষণ করতে একমত হয়েছি। তবে মনে মনে স্বীকার করেছি, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ কারো চেয়ে তাঁর কম নেই। সৌভাগ্যক্রমে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারতাম। ১৯৯২ সালে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলো, তখন মইনুল হোসেন ও আমি সর্বাগ্রে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম- ১৯৬৫ সালের দাঙ্গার সময়ের মতো—সব পত্রিকায় দাঙ্গাবিরোধী অভিন্ন সম্পাদকীয় লেখার প্রস্তাব নিয়ে। তিনি সুস্থ ছিলেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সকালবেলায় আমাদের সঙ্গে কথা বললেন, সম্মতি দিতে এক মুহূর্ত দেরি করলেন না, তিনি যে এই উদ্যোগোর শরিক- সেকথাও সবাইকে জানাবার অনুমতি দিলেন।

আহমদুল কবির খুব বেশি লেখেননি। ড. অশোক মিত্র-সম্পাদিত ‘অধ্যাপক অমিয়কুমার দাশগুপ্ত : শতবার্ষিকী শ্রদ্ধার্ঘ্য’ সংকলনে তাঁর এই শিক্ষক সম্পর্কে শ্রদ্ধানিবেদনসূচক একটি রচনা সংকলিত হয়েছে। ওই লেখাটিতে যেমন অমিয় দাশগুপ্তের অনেক গুণের কথা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি আহমদুল কবিরেরও অনেক গুণের পরিচয় তাতে ধরা পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর অন্তরের কতটা জুড়ে ছিল, সেকথা অনেকে হয়তো জানেন না। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কেও তাঁকে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা নিশ্চয় আরো প্রগাঢ় ছিল। দেশ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা অনেক সময়ে তিনি লুকিয়ে রাখতেন তির্যক মন্তব্যের আড়ালে। কিন্তু সৎ মানুষের মতোই তাঁর উদ্বেগ নানাভাবে প্রকাশ পেতো। তিনি মনে করতেন, সততা আছে, প্রজ্ঞা আছে, সাহস আছে, এমন এক প্রজন্মই বাংলাদেশকে বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে। সেই প্রজন্ম গড়তে যদি আমরা সহায়তা করতে পারি, তবেই নিজেদের কর্তব্য পালন করেছি বলে মনে করতে পারি। যাঁরা তাঁর সমকালীন, এমনকি আমাদের সমসাময়িক, তাঁদের যে আর বেশি কিছু করার আছে, তা তিনি মনে করেননি । ভবিষ্যৎ বলতে পারবে, তাঁর এই ভাবনা কতটুকু সত্যাশ্রয়ী।

আহমদুল কবির হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। আমি আবার বলব, সৌজন্য ও সদাশয়তার উদাহরণ তিনি নিজেকে দিয়ে তৈরি করেছেন। এ গুণ দুর্লভ, বিশেষত আমাদের সমাজে, আমাদের কালে। সেকথা স্মরণ করেই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

ছবি

ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি

ছবি

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যু

ছবি

ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু, তিনজনেই ঢাকার বাইরে

ছবি

৪৮ ঘণ্টা গণঅনশনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

ছবি

বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার গল্প বিশ্বের মানুষ শুনতে চায়: প্রতিমন্ত্রী

ছবি

বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী ভিয়েতনাম

ছবি

আগুন লাগেনি, তবুও বেজে উঠলো বালাদেশ ব্যাংকের ‘অ্যালার্ম’

ছবি

আবারো ‘অবাধ-সুষ্ঠু’ নির্বাচনে জোর দিলেন মার্কিন কর্মকর্তা উজরা জেয়া

ছবি

কাজের ভিসায় অস্ট্রেলিয়া যেতে আগ্রহীদের জন্য সতর্কবার্তা

ছবি

আজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

ছবি

বাংলাদেশের নির্বাচনে নজর থাকবে, হস্তক্ষেপ নয় : মার্কিন রাষ্ট্রদূত

ছবি

প্রতিদিন ৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাতারবাড়িতে, ডিসেম্বর থেকে পুরোদমে

ছবি

জলবায়ু সংকট এড়াতে ধনী দেশগুলোকে সৎ হতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

ছবি

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতা পুরস্কার যথার্থ ও এর গুরুত্ব অপরিসীম: স্পিকার

ছবি

পুনাক নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত হতে সক্ষম : আইজিপি

ছবি

৭ অক্টোবর বাংলাদেশে আসবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন দল

ছবি

ইইউ পর্যবেক্ষক না এলে নির্বাচনে প্রভাব পড়বে না : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

ছবি

চালক অসুস্থ হয়ে পড়ায় মেট্রোরেল বন্ধ ছিল ৪০ মিনিট

ছবি

দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রথম চালানে ভারত গেলো ৪৫ হাজার ৮০০ কেজি ইলিশ

ছবি

সরকার সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এসডিজি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : প্রধানমন্ত্রী

ছবি

সাগর-নদীর পরিবেশ রক্ষায় বিবিএনজে চুক্তিতে সই করলেন প্রধানমন্ত্রী

ছবি

নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির শপথ ২৬ সেপ্টেম্বর

ছবি

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বিদায়ী সাক্ষাৎ

ছবি

বাস স্টপেজ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে : ডিএমপি

ছবি

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের আবশ্যকতা পুনর্ব্যক্ত করলেন আইনমন্ত্রী

ছবি

আরও ৬ প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি

ছবি

জলবায়ু সংকট এড়াতে প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে সৎ থাকতে হবে

ছবি

নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না ইইউ

ছবি

এনটিআরসিএর চূড়ান্ত সুপারিশ পেলেন ২৭ হাজারের বেশি প্রার্থী

ছবি

নারীদের নেতৃত্বে এনে জাতিসংঘকে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

ছবি

এক হাজার কোটি টাকা টোলের মাইলফলকে পদ্মা সেতু

এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্রে যেতে আরও সময় লাগবে : ইসি সচিব

১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে সংকটে বাংলাদেশ

ছবি

কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির সম্মাননা

ছবি

গুগলকে বাংলাদেশে অফিস-ডাটা সেন্টার স্থাপনের আহ্বান

tab

জাতীয়

আহমদুল কবির : শ্রদ্ধাঞ্জলি

আনিসুজ্জামান

শুক্রবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

আহমদুল কবিরের সৌজন্য ও সদাশয়তার তুলনা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আমার বিশ্বাস, তার উৎস ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাসে। তিনি যে সুশিক্ষিত ছিলেন, তা তিনি জানতেন। সকল মেধাবী ছাত্র পরীক্ষার ফল ভালো করেন না। তার একটা কারণ, অধীত বিষয়ের বাইরে নানা বিষয়ে তাঁদের ঔৎসুক্য ও কৌতূহল। এই অনুসন্ধিৎসা তাঁদেরকে একটা বিষয়ে গভীর পা-িত্য অর্জনে বাধা দেয়, কিন্তু দশটা বিষয়ে জ্ঞানলাভে সাহায্য করে। আহমদুল কবির এই পর্যায়ের মানুষ। চল্লিশের দশকে তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বদানের জন্যে নির্বাচিত হয়েছিলেন, এ-নিয়েও তাঁর সূক্ষ্ম গর্ববোধ ছিল, যদিও তা সহজে প্রকাশ পেতো না। তিনি ভালো চাকরি করেছেন। যেমন আয় করেছেন, তেমনি ব্যয় করেছেন। বাড়িতে বিষয়-আশয় যথেষ্ট ছিল, সুতরাং ব্যয়কুণ্ঠ হয়ে সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হননি। তারপর চাকরি ছেড়ে ‘সংবাদের হাল ধরেছেন, সফলও হয়েছেন। চাইলে পত্রিকাটিকে আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারতেন, কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেননি। যা হয়েছে, তাই যথেষ্ট মনে করেছেন। একটা রাজনৈতিক দল গড়েছিলেন, কিন্তু জননেতা হওয়ার চেষ্টা করেননি। জানতেন, ওই আসন তাঁর জন্যে নয়। কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে, ভিন্ন কণ্ঠস্বর ব্যক্ত করতে যে-মঞ্চটি দরকার, ছোটোখাটো দলটি তাঁকে তা দিয়েছিল। শেষকালে রোগগ্রস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল। নিয়মিত ঘি-ডিম খেয়েও শরীরে মেদ জমতে দেননি। সতর্কবাণী মেনে নিয়ে জীবনযাপন-প্রণালি বদলাতে রাজি ছিলেন না। নিজের জগতে তিনি স্বরাট।

স্বরাট বলেই তিনি জানতেন যে, অন্যকে সম্মানজ্ঞাপন করলে ছোটো হতে হয় না। অতএব, ছোটো-বড়ো সবাইকেই- শেষদিকে তাঁর বড়ো যাঁরা তাঁদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল, সুতরাং প্রায় ক্ষেত্রে যাঁরা তাঁর ছোটো, তাঁদেরকে বুকের ওপর যুক্ত করে- কখনো কখনো পা দুটো জোড় করেও- প্রীতি, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাতেন। প্রায় একই কারণে তাঁর চলাফেরার মধ্যেও একটা রাজসিক ভাব ছিল। একবার আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগ দিতে আমরা একসঙ্গে দিল্লিতে গেলাম। বড়ো হোটেলেই থাকবার ব্যবস্থা। প্রত্যেককে একটা ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে।

মনু ভাই বললেন, ঘর হলে হবে না, তাঁর লাগবে সুয়িট। হোটেল-কর্তৃপক্ষ বলল, অমন নির্দেশ তো তারা পায়নি। মনু ভাই বললেন, বাড়তি খরচ যা লাগবে, তা তিনি দিয়ে দেবেন। আমি বাধা দিতে গেলাম, বললাম, কী হবে সুয়িট দিয়ে? মনু ভাই পালটা প্রশ্ন করলেন, দলের সবাই একসঙ্গে বসবে কোথায়? অন্য দেশের প্রতিনিধিদের কাউকে আলাপ করতে ডাকলে তাকে কি শোয়ার ঘরে বসানো হবে? ইত্যাদ ইত্যাদি । তিনি সুয়িটেই উঠলেন। আমন্ত্রণকর্তাদের বলা হলো বিষয়টা। চলে আসার সময়ে হোটেল তাঁর কাছে পুরো সুয়িটের ভাড়া দাবি করলো। আমরা বললাম, ওঁর জন্যে যে ঘর বরাদ্দ করা হয়েছিল, সে-ঘরভাড়ার টাকাটা অন্তত তারা ভাড়া থেকে বাদ দিতে পারে। তারা রাজি হলো না। মনু ভাই পুরো ভাড়াই চুকিয়ে দিলেন। তাঁর ইচ্ছাশক্তি প্রবল ছিল। কিন্তু অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেও তিনি মূল্য দিতেন। কারো ওপরে জোর খাটাতে তাঁকে দেখিনি। ফলে, অনেক সভা-সমিতিতে তাঁকে বক্তৃতা করতে বললে তিনি যখন রাজি হতে চাইতেন না, তখন তাঁর ওপরে জোর খাটাতে পারতাম না আমাদের ছোটোখাটো কাজ তাঁর মনঃপূত হলে তিনি এমন উচ্ছ্বসিত হতেন যে, লজ্জা না পেয়ে উপায় থাকত না। অথচ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। ২০০২ সালে আমি যখন বাংলা একাডেমির সভাপতির পদ ত্যাগ করলাম, তখন তিনি শুধু আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে ক্ষান্ত হলেন না, ওই কারণে আমাকে খাওয়াবেন বলে ঘোষণা করলেন এবং আমার সুবিধেজনক তারিখে ঢাকা ক্লাবে আমাকে দুপুরবেলায় আপ্যায়িত করলেন । অনেক সময়ে তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্নে মতপার্থক্য হয়েছে।

তিনি মনে করতেন, সততা আছে, প্রজ্ঞা আছে, সাহস আছে, এমন এক প্রজন্মই বাংলাদেশকে বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে

সংসদ সদস্য থাকতে তিনি কেন এটা করলেন, কেন ওটা করলেন না, এসব প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করেছি। কখনো তিনি অসহিষ্ণু হননি। হয় তাঁর দিক থেকে কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, নয়তো বলেছেন এ বিষয়ে আমরা একমত হবো না। আমি তাঁর কথা মেনে নিয়ে মতানৈক্য পোষণ করতে একমত হয়েছি। তবে মনে মনে স্বীকার করেছি, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ কারো চেয়ে তাঁর কম নেই। সৌভাগ্যক্রমে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারতাম। ১৯৯২ সালে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলো, তখন মইনুল হোসেন ও আমি সর্বাগ্রে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম- ১৯৬৫ সালের দাঙ্গার সময়ের মতো—সব পত্রিকায় দাঙ্গাবিরোধী অভিন্ন সম্পাদকীয় লেখার প্রস্তাব নিয়ে। তিনি সুস্থ ছিলেন না। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সকালবেলায় আমাদের সঙ্গে কথা বললেন, সম্মতি দিতে এক মুহূর্ত দেরি করলেন না, তিনি যে এই উদ্যোগোর শরিক- সেকথাও সবাইকে জানাবার অনুমতি দিলেন।

আহমদুল কবির খুব বেশি লেখেননি। ড. অশোক মিত্র-সম্পাদিত ‘অধ্যাপক অমিয়কুমার দাশগুপ্ত : শতবার্ষিকী শ্রদ্ধার্ঘ্য’ সংকলনে তাঁর এই শিক্ষক সম্পর্কে শ্রদ্ধানিবেদনসূচক একটি রচনা সংকলিত হয়েছে। ওই লেখাটিতে যেমন অমিয় দাশগুপ্তের অনেক গুণের কথা প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি আহমদুল কবিরেরও অনেক গুণের পরিচয় তাতে ধরা পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর অন্তরের কতটা জুড়ে ছিল, সেকথা অনেকে হয়তো জানেন না। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কেও তাঁকে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা নিশ্চয় আরো প্রগাঢ় ছিল। দেশ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা অনেক সময়ে তিনি লুকিয়ে রাখতেন তির্যক মন্তব্যের আড়ালে। কিন্তু সৎ মানুষের মতোই তাঁর উদ্বেগ নানাভাবে প্রকাশ পেতো। তিনি মনে করতেন, সততা আছে, প্রজ্ঞা আছে, সাহস আছে, এমন এক প্রজন্মই বাংলাদেশকে বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে। সেই প্রজন্ম গড়তে যদি আমরা সহায়তা করতে পারি, তবেই নিজেদের কর্তব্য পালন করেছি বলে মনে করতে পারি। যাঁরা তাঁর সমকালীন, এমনকি আমাদের সমসাময়িক, তাঁদের যে আর বেশি কিছু করার আছে, তা তিনি মনে করেননি । ভবিষ্যৎ বলতে পারবে, তাঁর এই ভাবনা কতটুকু সত্যাশ্রয়ী।

আহমদুল কবির হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। আমি আবার বলব, সৌজন্য ও সদাশয়তার উদাহরণ তিনি নিজেকে দিয়ে তৈরি করেছেন। এ গুণ দুর্লভ, বিশেষত আমাদের সমাজে, আমাদের কালে। সেকথা স্মরণ করেই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

back to top