ডলার সংকটে সময়মতো কয়লা (জ্বালানি) আমদানি করতে না পারায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। জ্যৈষ্ঠের তীব্র গরমে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে এমনিতেই মানুষের বেহাল দশা। পায়রার দুটি ইউনিটই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিং আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
উৎপাদন বিবেচনায় পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার বিচারেও দেশের অন্যতম সফল বিদ্যুৎকেন্দ্র এটি। গড়ে দেশের দৈনিক মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ যোগান দেয় কেন্দ্রটি।
কয়লার (জ্বালানি) অভাবে গত ২৫ মে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি বন্ধ হয়ে যায়। বিসিপিসিএল সূত্র জানায়, সোমবার (৫ জুন) দুপুর ১২টার দিকে বন্ধ হয়ে যায় দ্বিতীয় ইউনিটটি। প্রতিটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট করে।
ক্যাপটিভ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও আমদানিসহ দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারে না বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ১৯ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৬৪ মেগাওয়াট।
গত রোববার দেশে আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের খবর দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। কয়লার অভাবে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট বন্ধ; দ্বিতীয় ইউনিটটিও ৫ জুন বন্ধ হয়ে যাবে বলে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান তিনি।
লোডশেডিং পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে এমন আশা প্রকাশ করে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ‘অসহনীয়’ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এজন্য বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশও করেন প্রতিমন্ত্রী।
বেশকিছু দিন থেকে ঢাকায় দিনে, রাতে কিংবা ভোরে বিদ্যুৎ যাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে; ঘড়ির কাঁটায় মেপে মেপে কোথাও আসছে এক ঘণ্টা কোথাওবা এরও বেশি সময় পর। গ্রামের অবস্থা আরও খারাপ। দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকায় বাসা ও অফিসে জেনারেটর চালাতে ডিজেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। দাবদাহের মধ্যে ভ্যাপসা এ গরমে লোডশেডিংয়ের কারণে সবচেয়ে কষ্টে আছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
পায়রা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশ তিন হাজার মেগাওয়াট বা তারও বেশি লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে বলে ধারণা করছেন বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা। এতে সাধারণ মানুষের কষ্টের পাশাপাশি বিদ্যুৎনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।
সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর জ্বালানি (কয়লা) দিয়ে চলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করে।
ডলার সংকটের কারণে আমদানি করা কয়লার বিল পরিশোধ করাতে পারছিল না প্রতিষ্ঠানটি। বিশাল অঙ্কের বকেয়া জমে যাওয়ায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে অনেক আগেই চিঠি দিয়েছিল সরবরাহকারী বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান।
এই কথা গত এপ্রিলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল বিসিপিসিএল; যার অনুলিপি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরকেও দেয়া হয়েছিল। চিঠিতে বিসিপিসিএল জানায়, ইতিপূর্বে বকেয়া পরিশোধের জন্য দফায় দফায় সোনালী ব্যাংক (বিসিপিসিএল-এর অ্যাকাউন্ট ব্যাংক) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চাওয়া হলেও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার যোগান না পাওয়ায় বকেয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘অন্যথায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গ্রীষ্মে ও সেচ মৌসুমে ব্যাপকভাবে লোডশেডিংয়ের কারণে জাতীয় অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হবে।’
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা-তাপভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মালিকানায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান (৫০:৫০) অংশীদারিত্ব রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার যে কোম্পানি পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করে সেই কোম্পানির কয়লার দাম পরিশোধ করে সিএমসি। কয়লা আমদানি সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী সিএমসি কয়লা ক্রয়ের ছয় মাস পরে বাংলাদেশ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। তবে ছয় মাস পার হয়ে গেলেও ডলার সংকটে বকেয়া পরিশোধ করেনি পায়রা কর্তৃপক্ষ। বড় অঙ্কের বকেয়া হওয়ায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কয়লা ক্রয়ে নতুন করে এলসি খুলতে সিএমসিকে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কারণে কয়লা আমদানিতে জটিলতায় পরে বিসিপিসিএল।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো ব্যবস্থা না নেয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুতের মতো অতি জরুরি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে যথা সময়ে ডলারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। তাহলে কয়লা আমদানিতে সংকট তৈরি হতো না; পায়রার উৎপাদনও বন্ধ হতো না।
জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে...সরকারও এক ধরনের চাপে আছে। পরিস্থিতিটা আমাদেরও বুঝতে হবে। বিপিসি ডলার চায়। সার, খাদ্য এসবেও ডলার... সরকার আমাদের ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর মধ্যে আমরা ৫৮ মিলিয়ন কিছুদিন আগে সিএমসিকে দিয়েছি, সম্প্রতি বাকিটা দিয়ে এলসি খোলা হয়েছে।’
এখন ২০-২৫ দিনের মধ্যে কয়লা এনে উৎপাদন আবার শুরু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জ্বালানি খাতের বিষেশজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম প্রতি টন সর্বোচ্চ ৩৫০ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ২০০ ডলারে নিচে নেমে এসেছে । ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দাম প্রতিটন ১৫০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ক্রুড ওয়েলের দাম পৌঁছেছিল ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারে, এখন মূল্য প্রায় ৭০ ডলার। আর তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম উঠেছিল প্রতি এমএম বিটিইউ সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে, যা এখন ১৩-১৪ ডলারে নেমে এসেছে।
সারাদেশে চলমান ঘনঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবনে যখন অতিষ্ঠ, তখন এ পরিস্থিতিকে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ উল্লেখ করে সোমবার ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তীব্র গরম এবং সেই সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে সবার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে’ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি কারোরই কাম্য নয়। অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং এর পেছনে বেশকিছু কারণ আছে, যা সবারই জানা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের অজানা নয়, করোনা মহামারীর ধাক্কা, পরবর্তীতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস অয়েলসহ সকল প্রকার জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যে সংকট এখনও চলমান।’
‘অন্যদিকে, টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানিতে অনেকটা প্রভাব পড়েছে। ফলে বর্তমানের এই অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং।’
ফেইসবুক পোস্টে নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুতই জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। আশা করি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘অনেকের মনে থাকবার কথা ২০০৮ সালের আগে সারাদেশে দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আশা করি আপনাদের সেই আস্থা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সবাই মিলে আমরা দ্রুততম সময়ে এই ভোগান্তি পাড়ি দিতে সমর্থ হব।’
সোমবার, ০৫ জুন ২০২৩
ডলার সংকটে সময়মতো কয়লা (জ্বালানি) আমদানি করতে না পারায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন। জ্যৈষ্ঠের তীব্র গরমে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে এমনিতেই মানুষের বেহাল দশা। পায়রার দুটি ইউনিটই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিং আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
উৎপাদন বিবেচনায় পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতার বিচারেও দেশের অন্যতম সফল বিদ্যুৎকেন্দ্র এটি। গড়ে দেশের দৈনিক মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ যোগান দেয় কেন্দ্রটি।
কয়লার (জ্বালানি) অভাবে গত ২৫ মে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি বন্ধ হয়ে যায়। বিসিপিসিএল সূত্র জানায়, সোমবার (৫ জুন) দুপুর ১২টার দিকে বন্ধ হয়ে যায় দ্বিতীয় ইউনিটটি। প্রতিটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট করে।
ক্যাপটিভ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও আমদানিসহ দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারে না বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ১৯ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৬৪ মেগাওয়াট।
গত রোববার দেশে আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের খবর দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। কয়লার অভাবে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট বন্ধ; দ্বিতীয় ইউনিটটিও ৫ জুন বন্ধ হয়ে যাবে বলে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান তিনি।
লোডশেডিং পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে এমন আশা প্রকাশ করে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ‘অসহনীয়’ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এজন্য বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশও করেন প্রতিমন্ত্রী।
বেশকিছু দিন থেকে ঢাকায় দিনে, রাতে কিংবা ভোরে বিদ্যুৎ যাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে; ঘড়ির কাঁটায় মেপে মেপে কোথাও আসছে এক ঘণ্টা কোথাওবা এরও বেশি সময় পর। গ্রামের অবস্থা আরও খারাপ। দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকায় বাসা ও অফিসে জেনারেটর চালাতে ডিজেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। দাবদাহের মধ্যে ভ্যাপসা এ গরমে লোডশেডিংয়ের কারণে সবচেয়ে কষ্টে আছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
পায়রা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশ তিন হাজার মেগাওয়াট বা তারও বেশি লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বে বলে ধারণা করছেন বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্টরা। এতে সাধারণ মানুষের কষ্টের পাশাপাশি বিদ্যুৎনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।
সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর জ্বালানি (কয়লা) দিয়ে চলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করে।
ডলার সংকটের কারণে আমদানি করা কয়লার বিল পরিশোধ করাতে পারছিল না প্রতিষ্ঠানটি। বিশাল অঙ্কের বকেয়া জমে যাওয়ায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে অনেক আগেই চিঠি দিয়েছিল সরবরাহকারী বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান।
এই কথা গত এপ্রিলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল বিসিপিসিএল; যার অনুলিপি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরকেও দেয়া হয়েছিল। চিঠিতে বিসিপিসিএল জানায়, ইতিপূর্বে বকেয়া পরিশোধের জন্য দফায় দফায় সোনালী ব্যাংক (বিসিপিসিএল-এর অ্যাকাউন্ট ব্যাংক) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চাওয়া হলেও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার যোগান না পাওয়ায় বকেয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘অন্যথায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গ্রীষ্মে ও সেচ মৌসুমে ব্যাপকভাবে লোডশেডিংয়ের কারণে জাতীয় অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হবে।’
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা-তাপভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মালিকানায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান (৫০:৫০) অংশীদারিত্ব রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার যে কোম্পানি পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করে সেই কোম্পানির কয়লার দাম পরিশোধ করে সিএমসি। কয়লা আমদানি সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী সিএমসি কয়লা ক্রয়ের ছয় মাস পরে বাংলাদেশ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। তবে ছয় মাস পার হয়ে গেলেও ডলার সংকটে বকেয়া পরিশোধ করেনি পায়রা কর্তৃপক্ষ। বড় অঙ্কের বকেয়া হওয়ায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কয়লা ক্রয়ে নতুন করে এলসি খুলতে সিএমসিকে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কারণে কয়লা আমদানিতে জটিলতায় পরে বিসিপিসিএল।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো ব্যবস্থা না নেয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুতের মতো অতি জরুরি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে যথা সময়ে ডলারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। তাহলে কয়লা আমদানিতে সংকট তৈরি হতো না; পায়রার উৎপাদনও বন্ধ হতো না।
জানতে চাইলে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম সংবাদকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে...সরকারও এক ধরনের চাপে আছে। পরিস্থিতিটা আমাদেরও বুঝতে হবে। বিপিসি ডলার চায়। সার, খাদ্য এসবেও ডলার... সরকার আমাদের ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর মধ্যে আমরা ৫৮ মিলিয়ন কিছুদিন আগে সিএমসিকে দিয়েছি, সম্প্রতি বাকিটা দিয়ে এলসি খোলা হয়েছে।’
এখন ২০-২৫ দিনের মধ্যে কয়লা এনে উৎপাদন আবার শুরু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জ্বালানি খাতের বিষেশজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম প্রতি টন সর্বোচ্চ ৩৫০ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ২০০ ডলারে নিচে নেমে এসেছে । ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দাম প্রতিটন ১৫০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ক্রুড ওয়েলের দাম পৌঁছেছিল ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারে, এখন মূল্য প্রায় ৭০ ডলার। আর তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম উঠেছিল প্রতি এমএম বিটিইউ সর্বোচ্চ ৭০ ডলারে, যা এখন ১৩-১৪ ডলারে নেমে এসেছে।
সারাদেশে চলমান ঘনঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবনে যখন অতিষ্ঠ, তখন এ পরিস্থিতিকে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ উল্লেখ করে সোমবার ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তীব্র গরম এবং সেই সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কারণে সবার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে’ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি কারোরই কাম্য নয়। অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং এর পেছনে বেশকিছু কারণ আছে, যা সবারই জানা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের অজানা নয়, করোনা মহামারীর ধাক্কা, পরবর্তীতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস অয়েলসহ সকল প্রকার জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যে সংকট এখনও চলমান।’
‘অন্যদিকে, টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানিতে অনেকটা প্রভাব পড়েছে। ফলে বর্তমানের এই অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিং।’
ফেইসবুক পোস্টে নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুতই জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। আশা করি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘অনেকের মনে থাকবার কথা ২০০৮ সালের আগে সারাদেশে দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আশা করি আপনাদের সেই আস্থা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে। সবাই মিলে আমরা দ্রুততম সময়ে এই ভোগান্তি পাড়ি দিতে সমর্থ হব।’