নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকা এবং সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকা-’ চালানোর অভিযোগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ক্ষমতাবলে নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গেজেটে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের? এক রিট পিটিশনের রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রেখেছে বলে গেজেটে উল্লেখ করা হয়।
গেজেটে বলা হয়েছে, ‘সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, জামায়াত ও শিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।’
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব জাহাঙ্গীর আলমের সই করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮(১) এ দেয়া ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এ আইনের তফসিল-২ এ জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করলো।’ সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩১ আগস্ট বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলে এর আগে ৩০ জুলাই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একদিন দেরিতে গেজেট প্রকাশ হয়েছে।
গেজেট প্রকাশের আগে আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব তার মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের’ মামলায় জামায়াতের সাবেক বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর দলটির নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকর হয়।
জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন (ক্রিমিনাল সংগঠন)। একাত্তরে দলটির ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থি।
আগেও নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি :
১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল দলটি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াত-শিবির রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়।
এরপর থেকেই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল। প্রায় চার দশক পর সেই দাবি পূরণ হল। তবে দল হিসেবে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিচারের দাবি এখনও রয়েছে।
নানা পট পরিবর্তনের পর রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হয় জামায়াত। দলটি ১৯৮৬ সালে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারে জামায়াতের দুই নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পায়। এ নিয়ে তৎকালীন সময় ব্যাপক সমালোচনাও হয়।
পরর্তীতে ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়। ২০০৯ সালে দলটির নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকে। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
জামায়াত ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ গেলে সরকারের প্রস্তুতি আছে
গেজেট প্রকাশের আগে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এ সময় নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ (গোপনে কার্যক্রম চালানো) চলে যাবে কিনা-জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
নিষিদ্ধ করার পর দলটির সম্পদের কী হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘সেগুলোরও ব্যবস্থা হবে। সেটা আইনে আছে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না।’
গণহারে জামায়াতকর্মীদের বিচার হবে না
জামায়াতের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা-জানতে চাইলে মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এই দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াত ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১ এর পরে যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের বিচার করা হবে এরকম গণহারে বিচার করা হবে না।’
সন্ত্রসবিরোধী আইনে যা আছে
সরকার ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারার ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।’ সন্ত্রাস বিরোধী আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে।
সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞার বিষয়ে সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশি নাগরিক দেশের অখ-তা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোনো সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, এ ধরনের কাজের জন্য অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা করে; অথবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বা নিজ দখলে রাখে, কোনো সশস্ত্র সংঘাতময় দ্বন্ধের বৈরি পরিস্থিতিতে অংশ নেয়, তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে।
কোটা আন্দোলনে জামায়াত-শিবির
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। এরপর গত জুনের শেষে হাইকোর্ট ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করলে ফের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। জুলাইয়ে তা সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতায় গড়ায়।
সহিংসতার এক পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকায় সরকারি স্থাপনায় ব্যাপক হামলা-তা-ব চালানো হয়। রামপুরায় বিটিভি ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মেট্রোরেলের দুইটি স্টেশন, যাত্রবাড়ী ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালীর টোল প্লাজা ভাঙচুর করে আগুন দেয়া হয়। কোটা সংস্কারে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় এক সপ্তাহে সরকারি হিসেবে ১৫০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর গণমাধ্যমের খবরে সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে জামায়াত-শিবির ‘ক্যাডাররা’ নাশকতা করেছে। তাতে মদদ দিয়েছে বিএনপি।
গত সোমবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠে। এ দাবির বিষয়ে সবাই ঐকমত্য হয়। পরদিন মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং কোন আইনি প্রক্রিয়ায় তা করা হবে, তা বুধবারের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে।
এরপর ৩১ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই সবকিছু (সংঘাত-সহিংসতা) তো ছাত্ররা করেনি। ছাত্রদের পেছনে রেখে পেছন থেকে যারা করেছে সেগুলো জামায়াত-শিবির-বিএনপি। অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এটাই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেজন্য অনেক দিনের যে চাহিদা ছিল যে, জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার, আজকে সেই প্রক্রিয়াটি চলছে।’
বৃহস্পতিবার, ০১ আগস্ট ২০২৪
নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকা এবং সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকা-’ চালানোর অভিযোগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ক্ষমতাবলে নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গেজেটে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া কয়েকটি মামলার রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (পূর্বনাম জামায়াত-ই- ইসলামী/জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ) এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির (পূর্বনাম ইসলামী ছাত্রসংঘ)-কে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের? এক রিট পিটিশনের রায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে দিয়েছে। আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগের ওই রায়কে বহাল রেখেছে বলে গেজেটে উল্লেখ করা হয়।
গেজেটে বলা হয়েছে, ‘সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, জামায়াত ও শিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।’
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব জাহাঙ্গীর আলমের সই করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮(১) এ দেয়া ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এ আইনের তফসিল-২ এ জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করলো।’ সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩১ আগস্ট বুধবারের মধ্যে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলে এর আগে ৩০ জুলাই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একদিন দেরিতে গেজেট প্রকাশ হয়েছে।
গেজেট প্রকাশের আগে আইনমন্ত্রী বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব তার মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ ভেটিং (আইনি মতামত) করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের’ মামলায় জামায়াতের সাবেক বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পর দলটির নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকর হয়।
জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন (ক্রিমিনাল সংগঠন)। একাত্তরে দলটির ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থি।
আগেও নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি :
১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল দলটি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াত-শিবির রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়।
এরপর থেকেই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল। প্রায় চার দশক পর সেই দাবি পূরণ হল। তবে দল হিসেবে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিচারের দাবি এখনও রয়েছে।
নানা পট পরিবর্তনের পর রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হয় জামায়াত। দলটি ১৯৮৬ সালে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারে জামায়াতের দুই নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পায়। এ নিয়ে তৎকালীন সময় ব্যাপক সমালোচনাও হয়।
পরর্তীতে ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়। ২০০৯ সালে দলটির নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকে। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
জামায়াত ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ গেলে সরকারের প্রস্তুতি আছে
গেজেট প্রকাশের আগে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এ সময় নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াত-শিবির ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ (গোপনে কার্যক্রম চালানো) চলে যাবে কিনা-জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে। আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক দল গেছে, অনেক দলের কী হয়েছে, সেটা আপনারা জানেন। তবে সেটাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
নিষিদ্ধ করার পর দলটির সম্পদের কী হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘সেগুলোরও ব্যবস্থা হবে। সেটা আইনে আছে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনও আমরা সংশোধন করার ব্যবস্থা করেছি। নিষিদ্ধ করার পরেও তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না এমনটি নয়। হয়তো নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আর সাজার মধ্যে আসবে না।’
গণহারে জামায়াতকর্মীদের বিচার হবে না
জামায়াতের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা-জানতে চাইলে মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এই দলের অধীনে তারা রাজনীতি করতে পারবে না। বাংলাদেশের কোনো আইনে তারা অপরাধ করলে সেটার বিচার হবে। আপনারা যদি বলেন গণহারে যারা জামায়াত ইসলামীর নতুন কর্মী রয়েছেন, ১৯৭১ এর পরে যারা জন্ম নিয়েছেন তাদের বিচার করা হবে এরকম গণহারে বিচার করা হবে না।’
সন্ত্রসবিরোধী আইনে যা আছে
সরকার ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারার ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।’ সন্ত্রাস বিরোধী আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে।
সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞার বিষয়ে সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশি নাগরিক দেশের অখ-তা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোনো সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, এ ধরনের কাজের জন্য অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা করে; অথবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বা নিজ দখলে রাখে, কোনো সশস্ত্র সংঘাতময় দ্বন্ধের বৈরি পরিস্থিতিতে অংশ নেয়, তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে।
কোটা আন্দোলনে জামায়াত-শিবির
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। এরপর গত জুনের শেষে হাইকোর্ট ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করলে ফের আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। জুলাইয়ে তা সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতায় গড়ায়।
সহিংসতার এক পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকায় সরকারি স্থাপনায় ব্যাপক হামলা-তা-ব চালানো হয়। রামপুরায় বিটিভি ভবন, মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, বনানীতে সেতু ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মেট্রোরেলের দুইটি স্টেশন, যাত্রবাড়ী ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালীর টোল প্লাজা ভাঙচুর করে আগুন দেয়া হয়। কোটা সংস্কারে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় এক সপ্তাহে সরকারি হিসেবে ১৫০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর গণমাধ্যমের খবরে সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে জামায়াত-শিবির ‘ক্যাডাররা’ নাশকতা করেছে। তাতে মদদ দিয়েছে বিএনপি।
গত সোমবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠে। এ দাবির বিষয়ে সবাই ঐকমত্য হয়। পরদিন মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং কোন আইনি প্রক্রিয়ায় তা করা হবে, তা বুধবারের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে।
এরপর ৩১ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই সবকিছু (সংঘাত-সহিংসতা) তো ছাত্ররা করেনি। ছাত্রদের পেছনে রেখে পেছন থেকে যারা করেছে সেগুলো জামায়াত-শিবির-বিএনপি। অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এটাই আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। সেজন্য অনেক দিনের যে চাহিদা ছিল যে, জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার, আজকে সেই প্রক্রিয়াটি চলছে।’