শেখর ভট্টাচার্য
গ্রাম-বাংলার মানুষের হৃদয়ে বর্ষা যতটুকু নাড়া দিয়ে যায়, শহুরে জীবনে কি ঠিক ততটুকু প্রভাব ফেলতে পারে
হাত দিয়ে মেঘ ছুঁয়ে দেখা, সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। আকাশে হেলান দিয়ে যেখানে পাহাড় ঘুমায়, সেই পাহাড়ের বুকের উপর দিয়ে এগিয়ে গেলেই থোকা থোকা মেঘ। সিলেট থেকে জাফলংয়ের পথে দূর আকাশের নিচে নীল পাহাড়। যতদূর এগোনো যায় মনে হয় পাহাড়ও যেন ততদূর চলে যায়। তারপর এক সময় নীল পাহাড় খুব কাছে চলে আসে। তখন আর পাহাড়ের ঢেউকে নীল মনে হয় না। নীল রঙ সবুজে পরিণত হয়। পাহাড়কে সযতনে নানারকম বৃক্ষ সবুজের ঢেউ দিয়ে ঢেকে রাখে। সবুজের মধ্যে এঁকেবেঁকে নেমে গেছে অনিন্দ্য সুন্দর স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা। একটি ঝর্ণা নয়। কিছু দূর পরপর ঝর্ণা মেঘ পাহাড়ের দেশ থেকে নেমে আসে।
তামাবিল থেকে মেঘালয় পাহাড়ের দিকে তাকালে পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, মেঘ যেন এক অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রপট। তামাবিল বর্ডার পার হয়ে বাসে করে চেরাপুঞ্জি হয়ে যে কোন ঋতুতে শিলং গেলে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করা সহজ। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে পাহাড়কে সাত পাক নয় অজস্র পাক দিয়ে দিয়ে পথটি এগিয়ে গেছে শিলংয়ের দিকে। তামাবিল বর্ডার পার হওয়ার পর ডাওকি থেকে যে গাড়িতে করে শিলংয়ের দিকে যাবেন সেই গাড়িটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের বুক চিরে মেঘের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবে মেঘালয়ে। নিচ থেকে গাড়িটি যত উপরে উঠবে ধীরে ধীরে ডুব দেবে ভেসে বেড়ানো মেঘের কুয়াশার ভেতর। উপরের দিকে ওঠার পথে মেঘ ঘিরে ধরার চেষ্টা করে যানবাহনকে। একসময় চলন্ত বাহন এবং পথ দুটোই মেঘের কোলের ভেতর ঢুকে যাবে। চলার পথে কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। ঝকঝকে রোদের পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
মেঘালয়ের এই অনিন্দ্য সুন্দর রূপের কথা যখন মনে এলো, তখন ঢাকার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। কিছুক্ষণ পরপর অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। ভরা বর্ষা। বর্ষা মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। বর্ষাকে নিয়ে তাই বাঙালি কবিদের এত উন্মাদনা। এ সময় মনে বসত করেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালি না চাইলেও রবীন্দ্রনাথের গান বেজে চলে কানে-মনে- ‘বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে/ কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝড় ঝরো বরিষনে/’। কি এক অতিন্দ্রীয় পরিবেশ। মনে হয় বহু যুগের ওপার হতে আসা আষাঢ় দার্শনিক মনকে কেমন জানি নাড়া দিয়ে যায়।
ঋতু-বৈচিত্র্যের মাঝে বর্ষাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায় খুব সহজে। যুগে যুগে কবি-লেখকরা বর্ষাকে প্রেম-বিরহ ও সৃজনক্রিয়ার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বর্ষা এলে স্বভাবতই মানুষের মনে বিরহ দানা বাঁধতে থাকে। প্রিয়জনের অনুপস্থিতি আবেগাপ্লুত করে তোলে। প্রিয়জনের শূন্যতাকে বর্ষা দ্বিগুণ করে তুলে। এ কারণেই বর্ষাকাল আমাদের এই বাংলায় পৃথক এক উপাখ্যানের জন্ম দিয়ে যায়। বর্ষা নিয়ে এ যাবৎকালে কম সাহিত্য রচিত হয়নি। সাহিত্যের সবগুলো শাখার মধ্যে কবিতা ও গানে বর্ষার অনুষঙ্গ এসেছে অসংখ্যবার। কোনো কোনো কবির হাতে রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কাব্য, যার আদ্যোপান্ত বর্ষায় সিক্ত।
মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’ সম্পূর্ণ বর্ষাকে আশ্রয় করে রচনা করা হয়েছে। মেঘকে কালিদাস তার প্রেমের দূত হিসেবে কল্পনা করেছেন। মেঘকে তিনি বলেছেন যক্ষের বন্ধু। প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে সংবাদ পাঠাতেন। কী করে একখন্ড মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠছে বিরহীর বার্তাবাহক প্রাণবন্ত-জীবন্ত দূত! কল্পনায় মেঘখন্ডকে ইন্দ্রিয়ানুভব প্রদান করে মেঘের স্তুতি করে যক্ষ বলছে- ‘ওগো মেঘ, আমি জানি তুমি পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তুমি ইন্দ্রের প্রধান সহচর, তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী রূপগ্রহণ করতে পার! অদৃষ্টবশে আমার প্রিয়া আজ দূরবর্তী, তাই তোমার কাছে আমি প্রার্থী হয়ে এসেছি; গুণবান ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা যদি ব্যর্থ হয় তবে তাও ভালো, অধম ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা বরণীয় হতে পারে না।’ কর্তব্যে অবহেলার দায়ে এক বছরের জন্য নির্বাসিত যক্ষ মেঘকে অনুরোধ করেছে তার প্রিয়ার কাছে খবরটুকু পৌঁছে দিতে।
মধ্যযুগের কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহ পর্বে ‘প্রেমের আগুনে ঘিয়ের ছিটা’ হিসেবে কল্পনা করেছেন। একই ধারায় চন্ডীদাস তার প্রেম-বিরহ-কাতরতার কথা প্রকাশ করেন তার কবিতায়। আঙিনায় বর্ষাসিক্ত রমণী দেখে কবিমনে প্রেমাবেগ জাগ্রত হয়েছে। রমণীর ভেজা শরীরের স্পর্শ পেতে উতলা হয়ে উঠেছে মন। তবে ছুঁতে না পারার আকাক্সক্ষায় প্রাণ যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যাপতির কবিতায়ও বর্ষার বিরহ কাতরতা কোনো অংশে কম নয়। কবিদের সব বিরহ যেন এখানেই এসে সিক্ত হয়ে ওঠে। বর্ষায় মাঠ-ঘাট ভিজে একাকার। মানুষগুলো অনিচ্ছাকৃত বন্দিদশা বরণ করে। শূন্যতা দানা বেঁধে ওঠে বুকের ভেতর। বর্ষার এ আলস্যে প্রিয়তমার সান্নিধ্যই তার পরম আরাধ্য। আধুনিক এবং উত্তর আধুনিককালে বর্ষা যতটুকু রোমান্টিক ততটুকু বাস্তবানুগ। আধুনিক সাহিত্যে টিনের চালে যেমন কবিতার ছন্দ বেজে ওঠে একইভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবনের রোদনও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও গানে বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে বর্ষা পূর্ণতা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বাদ দিলেও বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তার ‘আষাঢ়’, সোনার তরী’, ‘বাঁশি’সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘শ্রাবণরাত’ কবিতায় দেখি- শ্রাবণের গভীর রাতে কবির ঘুম ভেঙে যায়। সাগরের গর্জন শুনতে পান তিনি। বৃষ্টি থেমে গেলেও নিস্তব্ধ হয়ে উপসাগরের ধ্বনি শুনতে পান। মনে হয় কারা যেন বড় বড় কপাট খুলছে, আবার বন্ধ করছে। শ্রাবণরাতের এমন দৃশ্যকল্পই কবির চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। তার মতো পল্লীকবি জসীম উদদীনও বাদ পড়েননি বর্ষা থেকে। পল্লীকবির কবিতায় স্বভাবতই গ্রামীণ দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। বর্ষার প্রিয় অনুষঙ্গ কদম ফুল ধরা দেয় কবিতায়। এমনকি বর্ষা এলেই হিজল ফুলের মালা গেঁথে সময় কাটায় বালিকারা। গ্রামের কৃষকরা মোড়লের বৈঠকখানায় গল্প-গানে মাতিয়ে তোলে। গাঁয়ের বধূরা অন্দরে বসে রঙিন কাঁথা সেলাই করেন। নকশার ভেতরে যেন তার মনের অব্যক্ত কথাগুলোই ফুটে ওঠে। এছাড়াও কবি আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, হাসান হাফিজরা বর্ষা-বিবরণে হাজির করেছেন মানুষ-সভ্যতা আর সমাজগতির ধারাপাত। বলতে গেলে কবিদের কল্পনাজুড়ে কেবল বৃষ্টির আনাগোনা। স্মৃতির জানালায় বৃষ্টির টোকা। গানের আসর বসে, গরম চায়ে ঠোঁট লাগিয়ে খোঁজে উত্তাপ।
গ্রাম-বাংলার মানুষের হৃদয়ে বর্ষা যতটুকু নাড়া দিয়ে যায়, শহুরে জীবনে কি ঠিক ততটুকু প্রভাব ফেলতে পারে। ভরা বর্ষায় বাংলার প্রকৃতি সিক্ত হয়ে এক অপরূপ রূপের আভা ছড়িয়ে দেয় দিগন্তে। শহুরে জীবনে নদী-নালা খাল-বিলের অপার সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ নেই। মরা নদীতে জোয়ার নিয়ে আসে বর্ষা। বিলের জলে শাপলার উজ্জ্বল হাসি। নাও ভাসিয়ে অচিনপুরে হারিয়ে যাওয়ার অপার সুযোগ পেয়ে যায় গ্রাম বাংলার মানুষ ভরা বর্ষার জলে। ঢেউয়ের তালে তালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নেচে ওঠে মন। কখনো আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটা। আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে। বৃষ্টির জলে অবগাহনে মনে অফুরান আনন্দের শিহরণ জেগে ওঠে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দ মানুষের দার্শনিক মনকে জাগিয়ে তুলে।
মেঘালয়ের পথে হাত দিয়ে মেঘকে স্পর্শ করার অনুভূতি আর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে গ্রাম-বাংলার সতেজ প্রকৃতিকে উপভোগ করার অনুভূতি ভিন্ন। মেঘালয়ের পথের মেঘ হাতকে স্পর্শ করে, সে স্পর্শের অনুভূতি ছড়িয়ে যায় মনে আর গ্রাম-বাংলার বর্ষ সরাসরি মনকে স্পর্শ করে। মন পুলকিত হয়। ময়ূরের মতো নাচতে ইচ্ছে করে। সে এক অনন্য অনুভব। বর্ষা হলো মলিনতা দূর করার ঋতু। বর্ষার বৃষ্টি বৃক্ষের পত্র-পল্লবকে সজীবতা দেয়। মলিন ঘাসের গায়ে ঝকঝকে সজীব রূপের দেখা পাওয়া যায় বর্ষায়। গ্রীষ্মের খরতাপের পর আসে স্বস্তির বর্ষা। মেঘ ভেসে যায় সারাবেলা, তার ফাঁকে ফাঁকে রোদের খেলা, সে এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ। বর্ষায় বাংলার আদিরূপ মূর্ত হয়ে ওঠে, যে রূপের প্রেমের পড়ে জীবনানন্দ বাংলা ছেড়ে পৃথিবীর কোথাও যেতে চান না। বর্ষার সজীবতা, অমলিন রূপ বাঙালিকে যেভাবে অমলিন করে তুলে, সেই বিশুদ্ধ অমলিনতা আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে পারি।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
গ্রাম-বাংলার মানুষের হৃদয়ে বর্ষা যতটুকু নাড়া দিয়ে যায়, শহুরে জীবনে কি ঠিক ততটুকু প্রভাব ফেলতে পারে
বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই ২০২৩
হাত দিয়ে মেঘ ছুঁয়ে দেখা, সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। আকাশে হেলান দিয়ে যেখানে পাহাড় ঘুমায়, সেই পাহাড়ের বুকের উপর দিয়ে এগিয়ে গেলেই থোকা থোকা মেঘ। সিলেট থেকে জাফলংয়ের পথে দূর আকাশের নিচে নীল পাহাড়। যতদূর এগোনো যায় মনে হয় পাহাড়ও যেন ততদূর চলে যায়। তারপর এক সময় নীল পাহাড় খুব কাছে চলে আসে। তখন আর পাহাড়ের ঢেউকে নীল মনে হয় না। নীল রঙ সবুজে পরিণত হয়। পাহাড়কে সযতনে নানারকম বৃক্ষ সবুজের ঢেউ দিয়ে ঢেকে রাখে। সবুজের মধ্যে এঁকেবেঁকে নেমে গেছে অনিন্দ্য সুন্দর স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা। একটি ঝর্ণা নয়। কিছু দূর পরপর ঝর্ণা মেঘ পাহাড়ের দেশ থেকে নেমে আসে।
তামাবিল থেকে মেঘালয় পাহাড়ের দিকে তাকালে পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, মেঘ যেন এক অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রপট। তামাবিল বর্ডার পার হয়ে বাসে করে চেরাপুঞ্জি হয়ে যে কোন ঋতুতে শিলং গেলে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করা সহজ। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে পাহাড়কে সাত পাক নয় অজস্র পাক দিয়ে দিয়ে পথটি এগিয়ে গেছে শিলংয়ের দিকে। তামাবিল বর্ডার পার হওয়ার পর ডাওকি থেকে যে গাড়িতে করে শিলংয়ের দিকে যাবেন সেই গাড়িটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের বুক চিরে মেঘের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবে মেঘালয়ে। নিচ থেকে গাড়িটি যত উপরে উঠবে ধীরে ধীরে ডুব দেবে ভেসে বেড়ানো মেঘের কুয়াশার ভেতর। উপরের দিকে ওঠার পথে মেঘ ঘিরে ধরার চেষ্টা করে যানবাহনকে। একসময় চলন্ত বাহন এবং পথ দুটোই মেঘের কোলের ভেতর ঢুকে যাবে। চলার পথে কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি। ঝকঝকে রোদের পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
মেঘালয়ের এই অনিন্দ্য সুন্দর রূপের কথা যখন মনে এলো, তখন ঢাকার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। কিছুক্ষণ পরপর অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। ভরা বর্ষা। বর্ষা মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। বর্ষাকে নিয়ে তাই বাঙালি কবিদের এত উন্মাদনা। এ সময় মনে বসত করেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালি না চাইলেও রবীন্দ্রনাথের গান বেজে চলে কানে-মনে- ‘বহু যুগের ও পার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে/ কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝড় ঝরো বরিষনে/’। কি এক অতিন্দ্রীয় পরিবেশ। মনে হয় বহু যুগের ওপার হতে আসা আষাঢ় দার্শনিক মনকে কেমন জানি নাড়া দিয়ে যায়।
ঋতু-বৈচিত্র্যের মাঝে বর্ষাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায় খুব সহজে। যুগে যুগে কবি-লেখকরা বর্ষাকে প্রেম-বিরহ ও সৃজনক্রিয়ার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বর্ষা এলে স্বভাবতই মানুষের মনে বিরহ দানা বাঁধতে থাকে। প্রিয়জনের অনুপস্থিতি আবেগাপ্লুত করে তোলে। প্রিয়জনের শূন্যতাকে বর্ষা দ্বিগুণ করে তুলে। এ কারণেই বর্ষাকাল আমাদের এই বাংলায় পৃথক এক উপাখ্যানের জন্ম দিয়ে যায়। বর্ষা নিয়ে এ যাবৎকালে কম সাহিত্য রচিত হয়নি। সাহিত্যের সবগুলো শাখার মধ্যে কবিতা ও গানে বর্ষার অনুষঙ্গ এসেছে অসংখ্যবার। কোনো কোনো কবির হাতে রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কাব্য, যার আদ্যোপান্ত বর্ষায় সিক্ত।
মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’ সম্পূর্ণ বর্ষাকে আশ্রয় করে রচনা করা হয়েছে। মেঘকে কালিদাস তার প্রেমের দূত হিসেবে কল্পনা করেছেন। মেঘকে তিনি বলেছেন যক্ষের বন্ধু। প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে সংবাদ পাঠাতেন। কী করে একখন্ড মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠছে বিরহীর বার্তাবাহক প্রাণবন্ত-জীবন্ত দূত! কল্পনায় মেঘখন্ডকে ইন্দ্রিয়ানুভব প্রদান করে মেঘের স্তুতি করে যক্ষ বলছে- ‘ওগো মেঘ, আমি জানি তুমি পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তুমি ইন্দ্রের প্রধান সহচর, তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী রূপগ্রহণ করতে পার! অদৃষ্টবশে আমার প্রিয়া আজ দূরবর্তী, তাই তোমার কাছে আমি প্রার্থী হয়ে এসেছি; গুণবান ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা যদি ব্যর্থ হয় তবে তাও ভালো, অধম ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা বরণীয় হতে পারে না।’ কর্তব্যে অবহেলার দায়ে এক বছরের জন্য নির্বাসিত যক্ষ মেঘকে অনুরোধ করেছে তার প্রিয়ার কাছে খবরটুকু পৌঁছে দিতে।
মধ্যযুগের কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহ পর্বে ‘প্রেমের আগুনে ঘিয়ের ছিটা’ হিসেবে কল্পনা করেছেন। একই ধারায় চন্ডীদাস তার প্রেম-বিরহ-কাতরতার কথা প্রকাশ করেন তার কবিতায়। আঙিনায় বর্ষাসিক্ত রমণী দেখে কবিমনে প্রেমাবেগ জাগ্রত হয়েছে। রমণীর ভেজা শরীরের স্পর্শ পেতে উতলা হয়ে উঠেছে মন। তবে ছুঁতে না পারার আকাক্সক্ষায় প্রাণ যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যাপতির কবিতায়ও বর্ষার বিরহ কাতরতা কোনো অংশে কম নয়। কবিদের সব বিরহ যেন এখানেই এসে সিক্ত হয়ে ওঠে। বর্ষায় মাঠ-ঘাট ভিজে একাকার। মানুষগুলো অনিচ্ছাকৃত বন্দিদশা বরণ করে। শূন্যতা দানা বেঁধে ওঠে বুকের ভেতর। বর্ষার এ আলস্যে প্রিয়তমার সান্নিধ্যই তার পরম আরাধ্য। আধুনিক এবং উত্তর আধুনিককালে বর্ষা যতটুকু রোমান্টিক ততটুকু বাস্তবানুগ। আধুনিক সাহিত্যে টিনের চালে যেমন কবিতার ছন্দ বেজে ওঠে একইভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবনের রোদনও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও গানে বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে বর্ষা পূর্ণতা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বাদ দিলেও বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তার ‘আষাঢ়’, সোনার তরী’, ‘বাঁশি’সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘শ্রাবণরাত’ কবিতায় দেখি- শ্রাবণের গভীর রাতে কবির ঘুম ভেঙে যায়। সাগরের গর্জন শুনতে পান তিনি। বৃষ্টি থেমে গেলেও নিস্তব্ধ হয়ে উপসাগরের ধ্বনি শুনতে পান। মনে হয় কারা যেন বড় বড় কপাট খুলছে, আবার বন্ধ করছে। শ্রাবণরাতের এমন দৃশ্যকল্পই কবির চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। তার মতো পল্লীকবি জসীম উদদীনও বাদ পড়েননি বর্ষা থেকে। পল্লীকবির কবিতায় স্বভাবতই গ্রামীণ দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। বর্ষার প্রিয় অনুষঙ্গ কদম ফুল ধরা দেয় কবিতায়। এমনকি বর্ষা এলেই হিজল ফুলের মালা গেঁথে সময় কাটায় বালিকারা। গ্রামের কৃষকরা মোড়লের বৈঠকখানায় গল্প-গানে মাতিয়ে তোলে। গাঁয়ের বধূরা অন্দরে বসে রঙিন কাঁথা সেলাই করেন। নকশার ভেতরে যেন তার মনের অব্যক্ত কথাগুলোই ফুটে ওঠে। এছাড়াও কবি আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, হাসান হাফিজরা বর্ষা-বিবরণে হাজির করেছেন মানুষ-সভ্যতা আর সমাজগতির ধারাপাত। বলতে গেলে কবিদের কল্পনাজুড়ে কেবল বৃষ্টির আনাগোনা। স্মৃতির জানালায় বৃষ্টির টোকা। গানের আসর বসে, গরম চায়ে ঠোঁট লাগিয়ে খোঁজে উত্তাপ।
গ্রাম-বাংলার মানুষের হৃদয়ে বর্ষা যতটুকু নাড়া দিয়ে যায়, শহুরে জীবনে কি ঠিক ততটুকু প্রভাব ফেলতে পারে। ভরা বর্ষায় বাংলার প্রকৃতি সিক্ত হয়ে এক অপরূপ রূপের আভা ছড়িয়ে দেয় দিগন্তে। শহুরে জীবনে নদী-নালা খাল-বিলের অপার সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ নেই। মরা নদীতে জোয়ার নিয়ে আসে বর্ষা। বিলের জলে শাপলার উজ্জ্বল হাসি। নাও ভাসিয়ে অচিনপুরে হারিয়ে যাওয়ার অপার সুযোগ পেয়ে যায় গ্রাম বাংলার মানুষ ভরা বর্ষার জলে। ঢেউয়ের তালে তালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নেচে ওঠে মন। কখনো আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটা। আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে। বৃষ্টির জলে অবগাহনে মনে অফুরান আনন্দের শিহরণ জেগে ওঠে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দ মানুষের দার্শনিক মনকে জাগিয়ে তুলে।
মেঘালয়ের পথে হাত দিয়ে মেঘকে স্পর্শ করার অনুভূতি আর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে গ্রাম-বাংলার সতেজ প্রকৃতিকে উপভোগ করার অনুভূতি ভিন্ন। মেঘালয়ের পথের মেঘ হাতকে স্পর্শ করে, সে স্পর্শের অনুভূতি ছড়িয়ে যায় মনে আর গ্রাম-বাংলার বর্ষ সরাসরি মনকে স্পর্শ করে। মন পুলকিত হয়। ময়ূরের মতো নাচতে ইচ্ছে করে। সে এক অনন্য অনুভব। বর্ষা হলো মলিনতা দূর করার ঋতু। বর্ষার বৃষ্টি বৃক্ষের পত্র-পল্লবকে সজীবতা দেয়। মলিন ঘাসের গায়ে ঝকঝকে সজীব রূপের দেখা পাওয়া যায় বর্ষায়। গ্রীষ্মের খরতাপের পর আসে স্বস্তির বর্ষা। মেঘ ভেসে যায় সারাবেলা, তার ফাঁকে ফাঁকে রোদের খেলা, সে এক অনিন্দ্য সুন্দর রূপ। বর্ষায় বাংলার আদিরূপ মূর্ত হয়ে ওঠে, যে রূপের প্রেমের পড়ে জীবনানন্দ বাংলা ছেড়ে পৃথিবীর কোথাও যেতে চান না। বর্ষার সজীবতা, অমলিন রূপ বাঙালিকে যেভাবে অমলিন করে তুলে, সেই বিশুদ্ধ অমলিনতা আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে পারি।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]