alt

উপ-সম্পাদকীয়

মানুষের ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ হয়ে ওঠা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: সোমবার, ১৪ আগস্ট ২০২৩
image

দেশের সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। লাখো মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে মহান নেতা শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’

বঙ্গবন্ধুর এ বলিষ্ঠ ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে। জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ইতোমধ্যে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসী এক দেশপ্রেমিক প্রবল পুরুষ।

বঙ্গবন্ধু এ দেশের সাধারণ জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে উজ্জীবিত এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বোধে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব। তার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে বারবার শুধু একই সত্য প্রমাণিত হয়, তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার কারিগর, সে কারণেই বঙ্গবন্ধু অনন্য ও অতুলনীয় উচ্চারণ, অবহেলিত জনগণের মুক্তি প্রতিষ্ঠার অবিস্মরণীয় এক অবলম্বন। যার অনুপস্থিতি একটি বিকাশমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে জনমনকে অস্থির ও অনিশ্চিত করে দিল, যার শূন্যতায় বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মুক্তির ইতিবাচক ধারা চরমভাবে বিঘিœত হলো। সেই খুন জাতির অভিশপ্ত কালিমা, সেই খুন রাষ্ট্রহননের শামিল।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। আজ দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না।’ দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। দুর্নীতি বাংলার কৃষক করে না। দুর্নীতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ করে না। এ দেশে দুর্নীতি করে সাধারণ মানুষের টাকা দিয়ে শিক্ষিত হওয়া সমাজ। আজ আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন আছে। আমাদের শ্রমিকরা খারাপ নয়। তারা কাজ করতে চায়। তারা উৎপাদন বাড়াতে চায়; কিন্তু কেউ কেউ আমরা তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করি। আমরা অনেকেই ষড়যন্ত্র করি। আমরা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেই। তাদের সম্পদাদি লুটপাট করি। যারা বাংলার মাটি থেকে বিদেশে মালামাল চালান দিয়ে চোরাকারবারির মাধ্যমে দুর্নীতি করে তাদের এভাবে চলতে দেয়া যায় না। তাই মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আবশ্যক। আমাদের নতুন জীবনবোধ সৃষ্টি করতে হবে। উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে মোবিলাইজড করতে হবে।’

তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ খুবই ভালো। বাংলার মানুষের মতো মানুষ কোথাও নাই। বাংলায় যত গোলমাল ও অনাসৃষ্টি তা শুধু তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেরই। যত অঘটনের মূলে তারাই।’ তাই তিনি পরিবার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন এবং সমবায়ের প্রতি জোর দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি-ঘুষ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরির বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাঙালি জাতি যে প্রাণ, যে অনুপ্রেরণা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল; সে প্রাণ, সে অনুপ্রেরণা, সে আদর্শ, সে মতবাদ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। চার স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের সংবিধান রচনা করতে হবে। যেখানে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে এবং এ সংবিধানে ভর করে দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতির লক্ষ্য হবে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করা। তেলের মাথায় তেল দেয়া নয়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’

তাই বঙ্গবন্ধুও বলেছেন, ‘গ্রামে আমরা বেশি কাজ করব’। অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু করে বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট ও কর্মসংস্থানের কথা তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন এবং উন্নয়ন কৌশলপত্রে সেটিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। শেখ মুজিব দেশের বহু আকাক্সিক্ষত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে চলে গেছেন। চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুতা করা সত্ত্বেও বেইজিংয়ের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শেখ মুজিবুরের টি-ডিপ্লোম্যাসি নামে খ্যাত মৈত্রীর হাত বাড়ানোর নীতি বেশির ভাগ আরব দেশকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিল যে, তিনি সংগ্রামী আরব স্বার্থের বন্ধু পাকিস্তানের ভুট্টোকেও তিনি বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শুধু ওই দেশটির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তখনকার দিল্লি-মস্কোর জোটের সমর্থন ও সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মার্কিন নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের আরো বৈরিতা সৃষ্টির মতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ভারতের ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে তিনি যে মৈত্রী গড়ে তুলেছিলেন তা ছিল কিংবদন্তির মতো। একটি বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশীর দ্বারা তিন দিক থেকে পরিবেষ্টিত থাকা অবস্থায় কিভাবে একটি ছোট দেশ তার আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে বড় দেশটির সঙ্গে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তার মুখের এক কথায় স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তিন মাস না হতেই ভারতীয় সেনা বাংলার মাটি ছেড়ে চলে গেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু তার প্রথম ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ স্বাধীনতার সংগ্রাম কখনো শেষ হয় না। নতুন নতুন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ বা হুমকি মোকাবিলা করার জন্য নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করতে হয়। তাই সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রতিহত করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। শোকের মাসে এটাই হোক আমাদের একমাত্র অঙ্গীকার।

মুজিব লোকান্তরিত, কিন্তু তার কর্ম ও আদর্শের মৃত্যু হয়নি। কাজেই এ আদর্শ ও চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে নিতে হবে দেশকে। শেখ মুজিবের আদর্শের নামে কোন নোংরামিকে জনগণ কখনই মেনে নেবে না। মুজিবের আদর্শের নাম এক চুম্বকীয় শক্তি। এ শক্তির কাছে যে কোন অন্যায়, জুলুম, হঠকারিতা, গুম, হত্যা ও সহিংসতার পতন হবে। সে বিশ্বাসে বলিয়ান হলেই দেশ নৌরাজ্য মুক্ত হবে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাগত ও সামাজিক সমস্যা

ট্রেড ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

সব অর্জনে কৃতিত্ব নিতে নেই

নাগাসাকি দিবস : পারমাণবিক বোমার অপপ্রয়োগ বন্ধ হোক

আদিবাসী অধিকার : দায় ঘোচানোর সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে হবে রাষ্ট্রকেই

অদৃশ্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই : উষ্ণ বাংলাদেশে জলবায়ু-প্রসূত স্বাস্থ্য সংকট

নেতানিয়াহুর এক ভ্রান্ত কৌশলের মুখোমুখি ইসরায়েল

আসিয়ানে বাংলাদেশের অভিযাত্রা : সম্ভাবনার পথে কূটনৈতিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ভাঙছে নদী, গড়ছে দুঃখের গ্রাম

ছবি

গণঅভ্যুত্থান ও গণআকাক্সক্ষা : এক বছরে অর্জনটা কী?

ছবি

ভিন্নমত, ভিন্নপথ এবং প্রান্তজনের স্বপ্ন

আচরণগত অর্থনীতির আয়নায় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা

গরিবের ইলিশ শুধুই স্বপ্ন কেন?

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

শারীরিক শিক্ষা : সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ার সম্ভাবনা

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : মেঘ থম থম করে

অলৌকিকতা, লৌকিকতা ও বিশ্বাসের বিভ্রান্তি

বিচারপতি গ্রেফতার, শুনানিতে পুলিশের অসহযোগিতা ও কিছু আইনি জিজ্ঞাসা

অপেক্ষার রাজনীতি ও সময়গত বৈষম্য : ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপট

বৃক্ষরোপণ হোক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন

আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল

বিভীষিকাময় দুর্ঘটনা ও করুণ মৃত্যু

কেন এত তরুণ দেশ ছাড়তে চাচ্ছে

রেলওয়ে পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাব

রম্যগদ্য : ‘গোপালগঞ্জ, বাংলার গোপালগঞ্জ...’

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মানুষের ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ হয়ে ওঠা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

দেশের সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা

সোমবার, ১৪ আগস্ট ২০২৩

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। লাখো মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে মহান নেতা শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’

বঙ্গবন্ধুর এ বলিষ্ঠ ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে। জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ইতোমধ্যে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসী এক দেশপ্রেমিক প্রবল পুরুষ।

বঙ্গবন্ধু এ দেশের সাধারণ জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে উজ্জীবিত এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বোধে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব। তার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে বারবার শুধু একই সত্য প্রমাণিত হয়, তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার কারিগর, সে কারণেই বঙ্গবন্ধু অনন্য ও অতুলনীয় উচ্চারণ, অবহেলিত জনগণের মুক্তি প্রতিষ্ঠার অবিস্মরণীয় এক অবলম্বন। যার অনুপস্থিতি একটি বিকাশমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে জনমনকে অস্থির ও অনিশ্চিত করে দিল, যার শূন্যতায় বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মুক্তির ইতিবাচক ধারা চরমভাবে বিঘিœত হলো। সেই খুন জাতির অভিশপ্ত কালিমা, সেই খুন রাষ্ট্রহননের শামিল।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। আজ দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না।’ দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। দুর্নীতি বাংলার কৃষক করে না। দুর্নীতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ করে না। এ দেশে দুর্নীতি করে সাধারণ মানুষের টাকা দিয়ে শিক্ষিত হওয়া সমাজ। আজ আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন আছে। আমাদের শ্রমিকরা খারাপ নয়। তারা কাজ করতে চায়। তারা উৎপাদন বাড়াতে চায়; কিন্তু কেউ কেউ আমরা তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করি। আমরা অনেকেই ষড়যন্ত্র করি। আমরা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেই। তাদের সম্পদাদি লুটপাট করি। যারা বাংলার মাটি থেকে বিদেশে মালামাল চালান দিয়ে চোরাকারবারির মাধ্যমে দুর্নীতি করে তাদের এভাবে চলতে দেয়া যায় না। তাই মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আবশ্যক। আমাদের নতুন জীবনবোধ সৃষ্টি করতে হবে। উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে মোবিলাইজড করতে হবে।’

তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ খুবই ভালো। বাংলার মানুষের মতো মানুষ কোথাও নাই। বাংলায় যত গোলমাল ও অনাসৃষ্টি তা শুধু তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেরই। যত অঘটনের মূলে তারাই।’ তাই তিনি পরিবার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন এবং সমবায়ের প্রতি জোর দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি-ঘুষ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরির বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাঙালি জাতি যে প্রাণ, যে অনুপ্রেরণা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল; সে প্রাণ, সে অনুপ্রেরণা, সে আদর্শ, সে মতবাদ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। চার স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের সংবিধান রচনা করতে হবে। যেখানে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে এবং এ সংবিধানে ভর করে দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতির লক্ষ্য হবে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করা। তেলের মাথায় তেল দেয়া নয়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’

তাই বঙ্গবন্ধুও বলেছেন, ‘গ্রামে আমরা বেশি কাজ করব’। অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু করে বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট ও কর্মসংস্থানের কথা তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন এবং উন্নয়ন কৌশলপত্রে সেটিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন। শেখ মুজিব দেশের বহু আকাক্সিক্ষত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে চলে গেছেন। চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুতা করা সত্ত্বেও বেইজিংয়ের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শেখ মুজিবুরের টি-ডিপ্লোম্যাসি নামে খ্যাত মৈত্রীর হাত বাড়ানোর নীতি বেশির ভাগ আরব দেশকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিল যে, তিনি সংগ্রামী আরব স্বার্থের বন্ধু পাকিস্তানের ভুট্টোকেও তিনি বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শুধু ওই দেশটির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তখনকার দিল্লি-মস্কোর জোটের সমর্থন ও সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মার্কিন নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের আরো বৈরিতা সৃষ্টির মতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ভারতের ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে তিনি যে মৈত্রী গড়ে তুলেছিলেন তা ছিল কিংবদন্তির মতো। একটি বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশীর দ্বারা তিন দিক থেকে পরিবেষ্টিত থাকা অবস্থায় কিভাবে একটি ছোট দেশ তার আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে বড় দেশটির সঙ্গে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তার মুখের এক কথায় স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তিন মাস না হতেই ভারতীয় সেনা বাংলার মাটি ছেড়ে চলে গেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছার পর বঙ্গবন্ধু তার প্রথম ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ স্বাধীনতার সংগ্রাম কখনো শেষ হয় না। নতুন নতুন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ বা হুমকি মোকাবিলা করার জন্য নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করতে হয়। তাই সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রতিহত করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। শোকের মাসে এটাই হোক আমাদের একমাত্র অঙ্গীকার।

মুজিব লোকান্তরিত, কিন্তু তার কর্ম ও আদর্শের মৃত্যু হয়নি। কাজেই এ আদর্শ ও চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে নিতে হবে দেশকে। শেখ মুজিবের আদর্শের নামে কোন নোংরামিকে জনগণ কখনই মেনে নেবে না। মুজিবের আদর্শের নাম এক চুম্বকীয় শক্তি। এ শক্তির কাছে যে কোন অন্যায়, জুলুম, হঠকারিতা, গুম, হত্যা ও সহিংসতার পতন হবে। সে বিশ্বাসে বলিয়ান হলেই দেশ নৌরাজ্য মুক্ত হবে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top