পাভেল পার্থ
(গতকালের পর)
পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য দেখেই স্থানীয় আদিবাসীরা পাহাড়ে উৎপাদন করেন। এ নিয়ে প্রায় প্রতিটি সমাজেই আছে নানা সামাজিক বিধি নিষেধ। যেমন- চাকমারা ‘নামাচুলগাত’ বৈশিষ্ট্যের পাহাড়ে জুমআবাদ করে না। মানে যে পাহাড়ে গর্ত থাকে এবং বৃষ্টির পানি তলদেশ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে। দুই পাহাড়ের ভেতর, মানুষের মতো দেখতে বা যে পাহাড়ে বানর ও গুইসাপের মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখানে তারা জুম আবাদ করে না। চাকমা, ত্রিপুরা কি ম্রো সমাজে জুম আবাদের আগে কোনো একটি পাহাড়ে এলাকা নির্বাচন করে সেখানে জুমআবাদ করলে মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে কিনা এটি জানতে স্বপ্নে আদেশ চাওয়া হয়। প্রতিটি সমাজেই উৎপাদনে যাওয়ার আগে এরকম সামাজিক পরিবেশগত যাচাই গুলো করে নেয়।
জুম চাষ শব্দটি চাকমা ভাষার, ত্রিপুরারা একে বলে হইক, ম্রোদের ভাষায় ওয়াহ ল্যুপ, মিজোদের ভাষায় লউতুয়া এবং বম ভাষায় ল্যওত্যুয়া। ঐতিহবাহী পদ্ধতিগত জুম আবাদ মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য চাহিদা যেমন মেটায় তেমনি এটি পাহাড়ের প্রতিবেশ ও পানির উৎসধারা সচল রাখে; কিন্তু বর্তমানে জুমের চাষের জমি, জুমচক্র এবং জুমের চাষপদ্ধতির ধরণ ও ফসলের বৈচিত্র্য কমে গেছে। পাহাড় জুড়ে পাহাড়ি বনভূমির পরিমাণ কমেছে। ছড়া, ঝর্ণা, ঝিরি, প্রপাতসহ পাহাড়ের পানির উৎস উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে পাহাড় দখল ও ব্যবহার হচ্ছে। এলোপাতাড়ি পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।
পাহাড়ি জুমেও এখন উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড নানা বীজ ব্যবহৃত হচ্ছে। রাসায়নিক পদ্ধতির করপোরেট কৃষির প্রচলন শুরু হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের সমতল উর্বর জমির প্রায়টাই যেহেতু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে ডুবে গেছে, বদলে গেছে পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতির ধারা। এখন পাহাড়ের সমতল ও উপত্যকার জমির প্রায়টাই বাঙালিদের দখলে এবং তা প্রতিবেশগত উৎপাদন চর্চার বাইরে। এছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে এককভাবে সেগুন, একাশিয়ার মতো আগ্রাসি গাছের বাগানের ফলে পাহাড়ি ভূমির বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা বড় অংশজুড়ে বাণিজ্যিক তামাক চাষও এখানকার ভূগোল উপযোগী নয়। এভাবে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ে কেবলমাত্র মানুষের অভিবাসন কী উচ্ছেদই ঘটছে না, বরং সামগ্রিকভাবে পাহাড় সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। নিদারুণভাবে পাহাড় ধসে পড়ছে। এ অবস্থা কোনোভাবেই পাহাড়ের ভৌগোলিক অর্থনীতি বিকাশে সহায়ক নয়।
উপকূলের আদিবাসী অর্থনীতি : কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর রাখাইন আদিবাসীরা সামুদ্রিক শুঁটকি ও নাপ্পি নামের একধরনের প্রক্রিয়াজাত শুঁটকি উৎপাদন করেন। লবণ উৎপাদনেও জড়িত আছেন রাখাইন ও কিছু তঞ্চংগ্যা পরিবার। নাপ্পি ও সামুদ্রিক শুঁটকি জোগান দিয়ে চলেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ, যার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেশের বাইরে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যে রপ্তানিও হয়। একক আয়তনে দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন থেকে মৌয়াল ও বাওয়ালিদের পাশাপাশি সুন্দরবন অঞ্চলের মুন্ডা ও মাহাতোরাও মধু-মোম-গোলপাতা-গরান সংগ্রহ করেন। সমুদ্র উপকূলের আদিবাসীরা দেশের পর্যটন উন্নয়ন খাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে কক্সবাজার, পটুয়াখালী অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী উৎপাদনের ভেতর দিয়ে দেশের পর্যটন খাতে এনেছেন যুগান্তকারী সাফল্য। কারণ প্রতিটি পর্যটন অঞ্চলেই আদিবাসী হস্তশিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। পাশাপাশি পাহাড় ও উপকূলের আদিবাসী জনগণ দেশকে উপহার দিয়েছেন অবিস্মরণীয় তাঁতশিল্প।
পাহাড় কী উপকূল থেকে দেশজুড়ে : আজ পাহাড় কী উপকূলের আদিবাসী জনগণের উৎপাদিত এবং সংগৃহীত নানাকিছু ছড়িয়ে গেছে দেশের নানাপ্রান্তে। জাতীয় জীবনে এসবের গুরুত্ব ও চাহিদা সীমাহীন। এসব ফসল, উৎপাদন, তৈজস কী পাহাড়ি বস্তু আজ দেশজুড়ে একটা প্রাকৃতিক পণ্য গ্রহণের নাগরিক অভ্যাসও তৈরি করছে। সুন্দরবনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক মধু আহরণ ও সংগ্রহ করা হয়। আর এই মধুর এক ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে অকাঠামোগত বাজার। আবার এমনকিছু বস্তু আছে যা খুবই একেবারেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য; যা শুধুমাত্র পাহাড় নয়, বাংলাদেশওর পরিচয় মেলে ধরে। যেমন- বান্দরবানের পাহাড়ি ছড়ার পাথর থেকে ক্র্যকা নামের এক বুনো শ্যাওলা সংগৃহীত হয়, যা স্থানীয় আদিবাসীদের চাহিদা মিটিয়ে মশলা হিসেবে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও বিক্রি করা হয়।
কুইচ্যা প্রায় আদিবাসী সমাজেরই এক অন্যতম প্রিয় খাদ্য। আদিবাসীরাই দেশের নানাপ্রান্ত থেকে কুইচ্যা শিকার করেন। কেবলমাত্র আদিবাসী খাদ্য চাহিদা মেটানোই নয়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক চিংড়ি ও কাঁকড়া ঘেরেও আজ কুইচ্যা ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। পাশপাশি দেশ থেকে কুইচ্যা রপ্তানিও হচ্ছে বিদেশে। আদিবাসী সমাজে শূকর পালনের পাশাপাশি অনেক আদিবাসী সমাজে বিশেষ জাতের মুরগি, হাঁস, কবুতর, গয়াল, কুকুর লালনপালন করতে দেখা যায়। দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন ও বিকাশে আদিবাসী সমাজের শূকর পালন নীরবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আদিবাসী সমাজের মাধ্যমে মাশরুম, বনজ ফল ও সব্জি, খরগোশ, কোয়েল চাষ আজ আদিবাসী সমাজের গন্ডি পেরিয়ে দেশের বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থানের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। প্রায় আদিবাসী সমাজই প্রাকৃতিক ভেষজ চর্চার ধারাকে টিকিয়ে রেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক আদিবাসী বৈদ্য ও কবিরাজ আজ নিজ জাতির পাশাপাশি বাঙালিসহ অপরাপর সব জাতির চিকিৎসাসেবা দিয়ে চলেছেন। আদিবাসী চিকিৎসায় ব্যবহৃত ভেষজের মূল জোগানটা আসে স্থানীয় বনভূমি ও পাহাড় থেকে; যা করপোরেট উন্নয়নের মাতবরিতে আজ ক্রমেই বিলীন হতে চলেছে। কুইচ্যার পাশাপাশি কোনো কোনো আদিবাসী অঞ্চলে কাঁকড়া, শামুক, কচ্ছপ, ব্যাঙও অর্থনৈতিক গতিকে চাঙ্গা রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এ অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ আজ দেশের হলুদ, আদা, লেবু, কমলা, বিন্নি ধান, দেশি ভুট্টা, বাঁশ উৎপাদনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছেন। দেশের গুঁড়া হলুদের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসস্থল পাহাড়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণ এবং এখানকার ভৌগোলিক অর্থনীতিকে বিকশিত করতে হলে প্রথমেই এ অঞ্চল এবং অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের জীবনদর্শন বুঝতে হবে। স্থানীয় প্রতিবেশের সঙ্গে আদিবাসী জনগণের সম্পর্ক ও সীমানাকে বুঝতে হবে। তা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব উন্নয়ই ‘কাপ্তাই বাঁধ’ হয়ে যাবে।
[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]
পাভেল পার্থ
শুক্রবার, ২৫ আগস্ট ২০২৩
(গতকালের পর)
পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য দেখেই স্থানীয় আদিবাসীরা পাহাড়ে উৎপাদন করেন। এ নিয়ে প্রায় প্রতিটি সমাজেই আছে নানা সামাজিক বিধি নিষেধ। যেমন- চাকমারা ‘নামাচুলগাত’ বৈশিষ্ট্যের পাহাড়ে জুমআবাদ করে না। মানে যে পাহাড়ে গর্ত থাকে এবং বৃষ্টির পানি তলদেশ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে। দুই পাহাড়ের ভেতর, মানুষের মতো দেখতে বা যে পাহাড়ে বানর ও গুইসাপের মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখানে তারা জুম আবাদ করে না। চাকমা, ত্রিপুরা কি ম্রো সমাজে জুম আবাদের আগে কোনো একটি পাহাড়ে এলাকা নির্বাচন করে সেখানে জুমআবাদ করলে মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে কিনা এটি জানতে স্বপ্নে আদেশ চাওয়া হয়। প্রতিটি সমাজেই উৎপাদনে যাওয়ার আগে এরকম সামাজিক পরিবেশগত যাচাই গুলো করে নেয়।
জুম চাষ শব্দটি চাকমা ভাষার, ত্রিপুরারা একে বলে হইক, ম্রোদের ভাষায় ওয়াহ ল্যুপ, মিজোদের ভাষায় লউতুয়া এবং বম ভাষায় ল্যওত্যুয়া। ঐতিহবাহী পদ্ধতিগত জুম আবাদ মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য চাহিদা যেমন মেটায় তেমনি এটি পাহাড়ের প্রতিবেশ ও পানির উৎসধারা সচল রাখে; কিন্তু বর্তমানে জুমের চাষের জমি, জুমচক্র এবং জুমের চাষপদ্ধতির ধরণ ও ফসলের বৈচিত্র্য কমে গেছে। পাহাড় জুড়ে পাহাড়ি বনভূমির পরিমাণ কমেছে। ছড়া, ঝর্ণা, ঝিরি, প্রপাতসহ পাহাড়ের পানির উৎস উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে পাহাড় দখল ও ব্যবহার হচ্ছে। এলোপাতাড়ি পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।
পাহাড়ি জুমেও এখন উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড নানা বীজ ব্যবহৃত হচ্ছে। রাসায়নিক পদ্ধতির করপোরেট কৃষির প্রচলন শুরু হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের সমতল উর্বর জমির প্রায়টাই যেহেতু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে ডুবে গেছে, বদলে গেছে পাহাড়ের কৃষি অর্থনীতির ধারা। এখন পাহাড়ের সমতল ও উপত্যকার জমির প্রায়টাই বাঙালিদের দখলে এবং তা প্রতিবেশগত উৎপাদন চর্চার বাইরে। এছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে এককভাবে সেগুন, একাশিয়ার মতো আগ্রাসি গাছের বাগানের ফলে পাহাড়ি ভূমির বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা বড় অংশজুড়ে বাণিজ্যিক তামাক চাষও এখানকার ভূগোল উপযোগী নয়। এভাবে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ে কেবলমাত্র মানুষের অভিবাসন কী উচ্ছেদই ঘটছে না, বরং সামগ্রিকভাবে পাহাড় সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। নিদারুণভাবে পাহাড় ধসে পড়ছে। এ অবস্থা কোনোভাবেই পাহাড়ের ভৌগোলিক অর্থনীতি বিকাশে সহায়ক নয়।
উপকূলের আদিবাসী অর্থনীতি : কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর রাখাইন আদিবাসীরা সামুদ্রিক শুঁটকি ও নাপ্পি নামের একধরনের প্রক্রিয়াজাত শুঁটকি উৎপাদন করেন। লবণ উৎপাদনেও জড়িত আছেন রাখাইন ও কিছু তঞ্চংগ্যা পরিবার। নাপ্পি ও সামুদ্রিক শুঁটকি জোগান দিয়ে চলেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ, যার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেশের বাইরে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যে রপ্তানিও হয়। একক আয়তনে দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন থেকে মৌয়াল ও বাওয়ালিদের পাশাপাশি সুন্দরবন অঞ্চলের মুন্ডা ও মাহাতোরাও মধু-মোম-গোলপাতা-গরান সংগ্রহ করেন। সমুদ্র উপকূলের আদিবাসীরা দেশের পর্যটন উন্নয়ন খাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে কক্সবাজার, পটুয়াখালী অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী উৎপাদনের ভেতর দিয়ে দেশের পর্যটন খাতে এনেছেন যুগান্তকারী সাফল্য। কারণ প্রতিটি পর্যটন অঞ্চলেই আদিবাসী হস্তশিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। পাশাপাশি পাহাড় ও উপকূলের আদিবাসী জনগণ দেশকে উপহার দিয়েছেন অবিস্মরণীয় তাঁতশিল্প।
পাহাড় কী উপকূল থেকে দেশজুড়ে : আজ পাহাড় কী উপকূলের আদিবাসী জনগণের উৎপাদিত এবং সংগৃহীত নানাকিছু ছড়িয়ে গেছে দেশের নানাপ্রান্তে। জাতীয় জীবনে এসবের গুরুত্ব ও চাহিদা সীমাহীন। এসব ফসল, উৎপাদন, তৈজস কী পাহাড়ি বস্তু আজ দেশজুড়ে একটা প্রাকৃতিক পণ্য গ্রহণের নাগরিক অভ্যাসও তৈরি করছে। সুন্দরবনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক মধু আহরণ ও সংগ্রহ করা হয়। আর এই মধুর এক ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে অকাঠামোগত বাজার। আবার এমনকিছু বস্তু আছে যা খুবই একেবারেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য; যা শুধুমাত্র পাহাড় নয়, বাংলাদেশওর পরিচয় মেলে ধরে। যেমন- বান্দরবানের পাহাড়ি ছড়ার পাথর থেকে ক্র্যকা নামের এক বুনো শ্যাওলা সংগৃহীত হয়, যা স্থানীয় আদিবাসীদের চাহিদা মিটিয়ে মশলা হিসেবে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও বিক্রি করা হয়।
কুইচ্যা প্রায় আদিবাসী সমাজেরই এক অন্যতম প্রিয় খাদ্য। আদিবাসীরাই দেশের নানাপ্রান্ত থেকে কুইচ্যা শিকার করেন। কেবলমাত্র আদিবাসী খাদ্য চাহিদা মেটানোই নয়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক চিংড়ি ও কাঁকড়া ঘেরেও আজ কুইচ্যা ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। পাশপাশি দেশ থেকে কুইচ্যা রপ্তানিও হচ্ছে বিদেশে। আদিবাসী সমাজে শূকর পালনের পাশাপাশি অনেক আদিবাসী সমাজে বিশেষ জাতের মুরগি, হাঁস, কবুতর, গয়াল, কুকুর লালনপালন করতে দেখা যায়। দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন ও বিকাশে আদিবাসী সমাজের শূকর পালন নীরবে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আদিবাসী সমাজের মাধ্যমে মাশরুম, বনজ ফল ও সব্জি, খরগোশ, কোয়েল চাষ আজ আদিবাসী সমাজের গন্ডি পেরিয়ে দেশের বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থানের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। প্রায় আদিবাসী সমাজই প্রাকৃতিক ভেষজ চর্চার ধারাকে টিকিয়ে রেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক আদিবাসী বৈদ্য ও কবিরাজ আজ নিজ জাতির পাশাপাশি বাঙালিসহ অপরাপর সব জাতির চিকিৎসাসেবা দিয়ে চলেছেন। আদিবাসী চিকিৎসায় ব্যবহৃত ভেষজের মূল জোগানটা আসে স্থানীয় বনভূমি ও পাহাড় থেকে; যা করপোরেট উন্নয়নের মাতবরিতে আজ ক্রমেই বিলীন হতে চলেছে। কুইচ্যার পাশাপাশি কোনো কোনো আদিবাসী অঞ্চলে কাঁকড়া, শামুক, কচ্ছপ, ব্যাঙও অর্থনৈতিক গতিকে চাঙ্গা রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এ অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ আজ দেশের হলুদ, আদা, লেবু, কমলা, বিন্নি ধান, দেশি ভুট্টা, বাঁশ উৎপাদনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছেন। দেশের গুঁড়া হলুদের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসস্থল পাহাড়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণ এবং এখানকার ভৌগোলিক অর্থনীতিকে বিকশিত করতে হলে প্রথমেই এ অঞ্চল এবং অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের জীবনদর্শন বুঝতে হবে। স্থানীয় প্রতিবেশের সঙ্গে আদিবাসী জনগণের সম্পর্ক ও সীমানাকে বুঝতে হবে। তা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব উন্নয়ই ‘কাপ্তাই বাঁধ’ হয়ে যাবে।
[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]