মোহাম্মদ আবু নোমান
সোনার বাংলাদেশটি যেন মধুমাখা কাঁঠাল! গোগ্রাসে যার কোষগুলো খাচ্ছে বড় বড় নেতারা! কাঁঠালের বিচি খাচ্ছে আমলারা, কাঁঠালের ভোতা খাচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীরা, বাকিটা খাচ্ছে নেতা-পাতি নেতারা। তাই বলে জনগণ যে কিছুই পাচ্ছেন না তা কিন্তু নয়? অবশ্যই পাচ্ছেন, তা হলো কাঁঠালের আঠা, যা দিয়ে জনগণকে বিলকুল বোবা বানানো হচ্ছে।
আমারা আর কতটুকু, কি-ই বলবো বা লিখবো। বঙ্গবন্ধু কম দুঃখে বলেননি- ‘দেশ স্বাধীন করলে সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে চোর, পেছনে চোর, চোর আর চোর। আমি বিদেশ থেকে যা কিছু আনি এই চোর চাটার দল সব খাইয়া ফেলায়। সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনছি, অথচ আমি আমারটাও পেলাম না।’
বাংলাদেশ যখন ছোট অর্থনীতির দেশ ছিল তখন হয়েছে ‘কম্বল চুরি।’ বাংলাদেশ এখন বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, তাই রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক চুরি, আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে সোনা চুরি, শেয়ার মার্কেট চুরি, জাতীয় সার্ভার থেকে নাগরিকদের তথ্য চুরি, রডের বদলে বাঁশ- বাহ! আমাদের কত উন্নয়ন। কোথায় নিরাপত্তা? দেশের এ অপ্রতিরোধ্য (চুরির) অগ্রযাত্রা কে থামাবে? সর্বশেষ এ খবর শোনাও অসম্ভব নয় যে, ইহা একটা মহাগুজব! এয়ারপোর্টের লকার ঠিক! সব ঠিক! সোনা চুরির খবরটি বেঠিক!
বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন কিন্তু রয়ে গেছে চোরগুলো। সেই চোর আর তাদের নাতিপুতিদের দখলে এখন বাংলাদেশ। ডালে ডালে হুতুম পেঁচাগুলো (চোর) বসে আছে, তাই তো দেশের এ অবস্থা। এই চোরের দেশে সোনা কি কোথাও নিরাপদ থাকতে পারে?
আসল ঘটনা তাহলে এই। গুদাম কর্মকর্তা বলেছেন- ‘...এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে। আমি গুদামে অটোমেশনের কাজ শুরু করি। এর মধ্যে এ ধরনের ঘটনায় আমি লজ্জিত ও বিব্রত।’ এই কর্মকর্তা জানান, আট দিন আগে গুদামটি অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এ কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনার কাজ শুরু হয়। তার ধারণা, সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজির বেশি সোনা চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি যাওয়া সোনার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। সোনা চুরির এ ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে গত ২ সেপ্টেম্বর। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর রোববার।
গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা শুল্ক বিভাগের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার গুদামের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা দেখেন। গুদামের পূর্ব পাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস যে অংশ দিয়ে বের হয়, সেখানকার টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান। পরে গুদাম কর্মকর্তারা আটকের রসিদ (ডিএম) মোতাবেক দেখতে পান ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আটক ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম সোনা চুরি হয়েছে।
দীর্ঘসময় ধরে এত পরিমাণ সোনা বিমানবন্দরের গুদামে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের দায়িত্বরতরা হয়তো ভেবেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভল্টে স্বর্ণ পাঠিয়ে লাভ কী? সেখানেও তো ভল্ট থেকে স্বর্ণ, টাকা চুরি হয়। তাই তারা গত ৩-৪ বছর স্বর্ণ জমিয়ে নিজেরাই গায়েব করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল- এই আর কী! সুরক্ষিত স্থানে চুরির কত্তা সুরক্ষিত চোররাই। ইতোমধ্যে অতজন ততজন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত-ফদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে যেহেতু, তখন এটা অচিরেই ধামাচাপা পড়বে কিনা, তা হয়তো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এস্ট্রোলোজারও বলতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।
বিমানবন্দরে কেউ পেটের মধ্যে ভরে সোনা আনলেও ধরা পড়ে যায়। অথচ নিরাপদ স্থান থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হয়ে গেল! আজব দেশ! এ যে চুরির মহোৎসব! বিমানবন্দর এ দেশের চোর-বাটপাড়দের স্বর্গরাজ্য; যা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। যাক, বড় বাঁচা গেছে। মাত্র ৫৫ কেজি সোনা, তাও আবার মূল্য মাত্র ৪৫ কোটি! কবে না জানি শুনতে হয় বিমান বহর থেকে বিমান গায়েব! ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’। সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল-এর সেই ভুতুড়ে কান্ড বাস্তবেও ঘটে। জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের সোনার চাকতি ও আংটি, তা হয়ে আছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট সোনা, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। আর তা ইতোপূর্বে ঘটেছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেই। বাকি আছে শুধু দেশের মাটি... সেটাও হয়তো দেখব কোন একদিন হয়ে গেছে বালি! ওদের কি দোষ, কবি বলেছেন- ‘সোনা নয় তত খাঁটি, যত খাঁটি আমার দেশের মাটি।’ যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়, সে দেশে ৪৫ কোটি টাকা নস্যি! কত অসৎ সরকারি হর্তা-কর্তাদের নিয়ে সরকারের বসবাস, ভাবতেও অবাক লাগে।
বিমানবন্দরের ভেতরের সব জায়গা সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। পুরো বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। একেই বলে রিয়েল ‘ডিজিটাল’ এমন ‘হাই সিকিউরেড’ জায়গায়ও চুরির ঘটনা। সবখানেই কালো বিড়াল! বিমানবন্দর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই)। এমন একটি জায়গা থেকে কিছু চুরি হলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
বর্তমানে দেশের জনগণের আমানত বলতে কোনকিছুই নিরাপদ নয়। ব্যাংকের ভল্ট হোক আর সরকারি সংস্থার লকার হোক, সবই এখন ভাগবাটোয়ারা ও লুটপাটের লক্ষ্যবস্তু! কয়েক দিন পরে এই লকার আর ভল্টও চুরি হয়ে গেলে বা গায়েব হয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! আর ইতোমধ্যে তা শুরুও হয়ে গেছে। এখনতো দেশের ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক ছাতার গৃহপালিতরা নিজেদের পকেট ও বাড়িতে পরিণত করেছে। ব্যাংক ডাকাতি এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে। সরকার উদারভাবে কিছু ব্যাংক লুটেরাদের প্রশ্রয় দিয়ে ব্যাংক লুট করার সুযোগ দিচ্ছে। ব্যাংক মানে লুটপাট। টাকা হবে হাওয়া, সোনা হবে মাটি। এই চোরদের পেট এত বড় হয়েছে যে, দুনিয়ার সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও এদের পেট ভরবে না, আরতো ব্যাংকে রাখা স্বর্ণ!
ইতোপূর্বে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দৈবচয়ন ভিত্তিতে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে অকল্পনীয় ভয়ংকর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছিল। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হয়, শেয়ার মার্কেট চুরি হয়, এমএলএম কোম্পানির টাকা চুরি, ই-কর্মাস কোম্পানির টাকা মারি, সেখানে সোনা পড়ে থাকবে, অথচ কেউ নেবে না- এটা ভাবা যায়?
বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, ব্যাংকের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, তাহলে কোথায় নিরাপত্তা দেয়া হবে জানতে পারি? আমার বলার কিছু ছিল না চেয়ে চেয়ে (ছি.ছি. ক্যামেরা) দেখলাম সে যে নিয়ে গেল, সব নিয়ে গেল চেয়ে চেয়ে (ছি.ছি. ক্যামেরা) দেখলাম।
বিমানবন্দরে কেউ পেটের মধ্যে ভরে সোনা আনলেও ধরা পড়ে যায়। অথচ নিরাপদ স্থান থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হয়ে গেল!
রিজার্ভ থেকে ভল্ট, এ ব্যাপারে মাথা তাদের খুবই কোল্ড! হীরক রাজা বেঁচে থাকলে এ সময় ঠিকই লজ্জা পেত। ছাত্র ও গণমানুষের মনের ভেতরে শাসকদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল, সে ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের এক জায়গায় হীরক রাজাকে বলতে শোনা যায়- ‘এরা যত পড়ে, তত বেশি জানে আর তত কম মানে।’
বাংলাদেশে দুর্নীতির সুযোগ বিবেচনায় প্রমোশন, বদলি পোস্টিংয়ে বিনিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। এসবের শিকড় এখন অনেক গভীরে। বিষয়টা একেবারে ওপেন সিক্রেট, মানে সবার জানা। বাংলাদেশে দুর্নীতির সুযোগ নিতেও বিনিয়োগ করতে হয়। এ দেশের হাওয়া, মাটি, পানি, জলীয়বাষ্প, ইটের কণা, সব হা করে চেয়ে থাকে ঘুষের জন্য। টাকা নেই, সেবা নেই। কে না বোঝে এসব বড় দাগের চুরির কাজটা একা কেউ করে না। এখন রাঘববোয়ালদের বাঁচানোর জন্য দুয়েকটা চুনোপুঁটি বলি দেয়া, খেলে যা খেলারাম...। এরকম হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মাটির নিচে অনেক প্রক্রিয়ার পর সোনা তৈরি হয়। মাটির উপরে অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে তারা আবার অন্য ধাতু (চুরি) হয়ে যাবে! এটাই স্বাভাবিক।
ইতোপূর্বে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৮০০ কোটি টাকা লাপাত্তা হয়েছে। ৮০০ টাকা নয় কিন্তু! এ ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর আমাদের বিরাট মন্ত্রী বললেন, ‘আমি তো জানতাম না। বিষয়টি পত্রিকা থেকে জানলাম।’ ঠিক এ কথার জন্যই তাকে পদচ্যুত বা পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজেই পদত্যাগ করতেন; কিন্তু পোড়া কপাল আমাদের, কারণ এ দেশে নেতার খুব অভাব। তারা পদত্যাগ করলে দেশ চালাবে কে?
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
মোহাম্মদ আবু নোমান
রোববার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সোনার বাংলাদেশটি যেন মধুমাখা কাঁঠাল! গোগ্রাসে যার কোষগুলো খাচ্ছে বড় বড় নেতারা! কাঁঠালের বিচি খাচ্ছে আমলারা, কাঁঠালের ভোতা খাচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীরা, বাকিটা খাচ্ছে নেতা-পাতি নেতারা। তাই বলে জনগণ যে কিছুই পাচ্ছেন না তা কিন্তু নয়? অবশ্যই পাচ্ছেন, তা হলো কাঁঠালের আঠা, যা দিয়ে জনগণকে বিলকুল বোবা বানানো হচ্ছে।
আমারা আর কতটুকু, কি-ই বলবো বা লিখবো। বঙ্গবন্ধু কম দুঃখে বলেননি- ‘দেশ স্বাধীন করলে সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে চোর, পেছনে চোর, চোর আর চোর। আমি বিদেশ থেকে যা কিছু আনি এই চোর চাটার দল সব খাইয়া ফেলায়। সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনছি, অথচ আমি আমারটাও পেলাম না।’
বাংলাদেশ যখন ছোট অর্থনীতির দেশ ছিল তখন হয়েছে ‘কম্বল চুরি।’ বাংলাদেশ এখন বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, তাই রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক চুরি, আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে সোনা চুরি, শেয়ার মার্কেট চুরি, জাতীয় সার্ভার থেকে নাগরিকদের তথ্য চুরি, রডের বদলে বাঁশ- বাহ! আমাদের কত উন্নয়ন। কোথায় নিরাপত্তা? দেশের এ অপ্রতিরোধ্য (চুরির) অগ্রযাত্রা কে থামাবে? সর্বশেষ এ খবর শোনাও অসম্ভব নয় যে, ইহা একটা মহাগুজব! এয়ারপোর্টের লকার ঠিক! সব ঠিক! সোনা চুরির খবরটি বেঠিক!
বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন কিন্তু রয়ে গেছে চোরগুলো। সেই চোর আর তাদের নাতিপুতিদের দখলে এখন বাংলাদেশ। ডালে ডালে হুতুম পেঁচাগুলো (চোর) বসে আছে, তাই তো দেশের এ অবস্থা। এই চোরের দেশে সোনা কি কোথাও নিরাপদ থাকতে পারে?
আসল ঘটনা তাহলে এই। গুদাম কর্মকর্তা বলেছেন- ‘...এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে। আমি গুদামে অটোমেশনের কাজ শুরু করি। এর মধ্যে এ ধরনের ঘটনায় আমি লজ্জিত ও বিব্রত।’ এই কর্মকর্তা জানান, আট দিন আগে গুদামটি অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এ কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনার কাজ শুরু হয়। তার ধারণা, সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।
রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজির বেশি সোনা চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি যাওয়া সোনার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। সোনা চুরির এ ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে গত ২ সেপ্টেম্বর। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর রোববার।
গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা শুল্ক বিভাগের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার গুদামের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা দেখেন। গুদামের পূর্ব পাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস যে অংশ দিয়ে বের হয়, সেখানকার টিনের কিছু অংশ কাটা দেখতে পান। পরে গুদাম কর্মকর্তারা আটকের রসিদ (ডিএম) মোতাবেক দেখতে পান ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আটক ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম সোনা চুরি হয়েছে।
দীর্ঘসময় ধরে এত পরিমাণ সোনা বিমানবন্দরের গুদামে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের দায়িত্বরতরা হয়তো ভেবেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভল্টে স্বর্ণ পাঠিয়ে লাভ কী? সেখানেও তো ভল্ট থেকে স্বর্ণ, টাকা চুরি হয়। তাই তারা গত ৩-৪ বছর স্বর্ণ জমিয়ে নিজেরাই গায়েব করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল- এই আর কী! সুরক্ষিত স্থানে চুরির কত্তা সুরক্ষিত চোররাই। ইতোমধ্যে অতজন ততজন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত-ফদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে যেহেতু, তখন এটা অচিরেই ধামাচাপা পড়বে কিনা, তা হয়তো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এস্ট্রোলোজারও বলতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না।
বিমানবন্দরে কেউ পেটের মধ্যে ভরে সোনা আনলেও ধরা পড়ে যায়। অথচ নিরাপদ স্থান থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হয়ে গেল! আজব দেশ! এ যে চুরির মহোৎসব! বিমানবন্দর এ দেশের চোর-বাটপাড়দের স্বর্গরাজ্য; যা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। যাক, বড় বাঁচা গেছে। মাত্র ৫৫ কেজি সোনা, তাও আবার মূল্য মাত্র ৪৫ কোটি! কবে না জানি শুনতে হয় বিমান বহর থেকে বিমান গায়েব! ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’। সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল-এর সেই ভুতুড়ে কান্ড বাস্তবেও ঘটে। জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের সোনার চাকতি ও আংটি, তা হয়ে আছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট সোনা, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। আর তা ইতোপূর্বে ঘটেছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেই। বাকি আছে শুধু দেশের মাটি... সেটাও হয়তো দেখব কোন একদিন হয়ে গেছে বালি! ওদের কি দোষ, কবি বলেছেন- ‘সোনা নয় তত খাঁটি, যত খাঁটি আমার দেশের মাটি।’ যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়, সে দেশে ৪৫ কোটি টাকা নস্যি! কত অসৎ সরকারি হর্তা-কর্তাদের নিয়ে সরকারের বসবাস, ভাবতেও অবাক লাগে।
বিমানবন্দরের ভেতরের সব জায়গা সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। পুরো বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। একেই বলে রিয়েল ‘ডিজিটাল’ এমন ‘হাই সিকিউরেড’ জায়গায়ও চুরির ঘটনা। সবখানেই কালো বিড়াল! বিমানবন্দর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই)। এমন একটি জায়গা থেকে কিছু চুরি হলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
বর্তমানে দেশের জনগণের আমানত বলতে কোনকিছুই নিরাপদ নয়। ব্যাংকের ভল্ট হোক আর সরকারি সংস্থার লকার হোক, সবই এখন ভাগবাটোয়ারা ও লুটপাটের লক্ষ্যবস্তু! কয়েক দিন পরে এই লকার আর ভল্টও চুরি হয়ে গেলে বা গায়েব হয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! আর ইতোমধ্যে তা শুরুও হয়ে গেছে। এখনতো দেশের ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক ছাতার গৃহপালিতরা নিজেদের পকেট ও বাড়িতে পরিণত করেছে। ব্যাংক ডাকাতি এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে। সরকার উদারভাবে কিছু ব্যাংক লুটেরাদের প্রশ্রয় দিয়ে ব্যাংক লুট করার সুযোগ দিচ্ছে। ব্যাংক মানে লুটপাট। টাকা হবে হাওয়া, সোনা হবে মাটি। এই চোরদের পেট এত বড় হয়েছে যে, দুনিয়ার সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও এদের পেট ভরবে না, আরতো ব্যাংকে রাখা স্বর্ণ!
ইতোপূর্বে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দৈবচয়ন ভিত্তিতে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে অকল্পনীয় ভয়ংকর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছিল। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হয়, শেয়ার মার্কেট চুরি হয়, এমএলএম কোম্পানির টাকা চুরি, ই-কর্মাস কোম্পানির টাকা মারি, সেখানে সোনা পড়ে থাকবে, অথচ কেউ নেবে না- এটা ভাবা যায়?
বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, ব্যাংকের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, তাহলে কোথায় নিরাপত্তা দেয়া হবে জানতে পারি? আমার বলার কিছু ছিল না চেয়ে চেয়ে (ছি.ছি. ক্যামেরা) দেখলাম সে যে নিয়ে গেল, সব নিয়ে গেল চেয়ে চেয়ে (ছি.ছি. ক্যামেরা) দেখলাম।
বিমানবন্দরে কেউ পেটের মধ্যে ভরে সোনা আনলেও ধরা পড়ে যায়। অথচ নিরাপদ স্থান থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব হয়ে গেল!
রিজার্ভ থেকে ভল্ট, এ ব্যাপারে মাথা তাদের খুবই কোল্ড! হীরক রাজা বেঁচে থাকলে এ সময় ঠিকই লজ্জা পেত। ছাত্র ও গণমানুষের মনের ভেতরে শাসকদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল, সে ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের এক জায়গায় হীরক রাজাকে বলতে শোনা যায়- ‘এরা যত পড়ে, তত বেশি জানে আর তত কম মানে।’
বাংলাদেশে দুর্নীতির সুযোগ বিবেচনায় প্রমোশন, বদলি পোস্টিংয়ে বিনিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। এসবের শিকড় এখন অনেক গভীরে। বিষয়টা একেবারে ওপেন সিক্রেট, মানে সবার জানা। বাংলাদেশে দুর্নীতির সুযোগ নিতেও বিনিয়োগ করতে হয়। এ দেশের হাওয়া, মাটি, পানি, জলীয়বাষ্প, ইটের কণা, সব হা করে চেয়ে থাকে ঘুষের জন্য। টাকা নেই, সেবা নেই। কে না বোঝে এসব বড় দাগের চুরির কাজটা একা কেউ করে না। এখন রাঘববোয়ালদের বাঁচানোর জন্য দুয়েকটা চুনোপুঁটি বলি দেয়া, খেলে যা খেলারাম...। এরকম হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। মাটির নিচে অনেক প্রক্রিয়ার পর সোনা তৈরি হয়। মাটির উপরে অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে তারা আবার অন্য ধাতু (চুরি) হয়ে যাবে! এটাই স্বাভাবিক।
ইতোপূর্বে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৮০০ কোটি টাকা লাপাত্তা হয়েছে। ৮০০ টাকা নয় কিন্তু! এ ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর আমাদের বিরাট মন্ত্রী বললেন, ‘আমি তো জানতাম না। বিষয়টি পত্রিকা থেকে জানলাম।’ ঠিক এ কথার জন্যই তাকে পদচ্যুত বা পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজেই পদত্যাগ করতেন; কিন্তু পোড়া কপাল আমাদের, কারণ এ দেশে নেতার খুব অভাব। তারা পদত্যাগ করলে দেশ চালাবে কে?
[লেখক : প্রাবন্ধিক]