মাহিউল কাদির
জলবায়ু সম্মেলন যা কপ (কনফারেন্স অব পার্টিস) নামে পরিচিত। কপ-২৮ অনুষ্ঠিত হবে ৩০ নভেম্বর হতে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে প্রতি বছর সারা পৃথিবী হতে রাষ্ট্রপ্রধান, গবেষক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও নানান স্তরের প্রতিনিধি সমাবেশে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কর্ম পন্থা নির্ধারণের জন্য যোগ দেন।
ইউনাইটেড ন্যাশন ফ্রেমওর্য়াক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেনজ (ইউএনএফসিসি) মূলত এই বাৎসরিক সমাবেশের আয়োজক। প্রথম সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে বার্লিনে। একটি কপের গৃহিত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন পরবর্তী কপে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মিশরের শারম-আল-শেখে এবং মোটা দাগে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্ত দেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে, তাদের উন্নয়নে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব গৃহিত হয়। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালেমুল হক এই কথাটি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। তিনি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের পক্ষ হতে এই প্রস্তাব প্রদান করেন।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণের জন্য ০ দশমিক ৪৭ শতাংশ দায়ী, কিন্তু জলবায়ুসংক্রান্ত বিপদাপন্ন দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। সমুদ্রের স্তর প্রতিনিয়ত উঁচু হচ্ছে, যা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। ধারণা করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্থল ভাগের এক-দশমাংশ পানির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। অর্থাৎ দেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল জলাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর হতে একটি সমীক্ষায় দেখা যায় গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ দশমিক ৮ হতে ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার হারে বাড়ছে এবং ১২ দশমিক ৩৪ হতে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হারে উপকূলীয় এলাকা জলমগ্ন হচ্ছে। উক্ত সমীক্ষায় দেশে ধান উৎপাদন ৫ দশমিক ৮ হতে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হারে কমছে। এ সমস্ত তথ্য হতে সহজে প্রতীয়মান যে, বাংলাদেশের জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলার জন্য আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন।
কপ-২৭ এর আরেকটি সিদ্ধান্ত ছিল জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় যৌথ অংশীদারিত্বে কৃষির আধুনিকীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। কৃষকরা এখন পর্যন্ত কৃষি কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সব জায়গায় পর্যাপ্ত ভূগর্ভস্থ পানির মজুত নেই। অন্য একটি সমস্যা হচ্ছে কৃষকরা জানে না জমিতে কী পরিমাণ পানি দিতে হবে। অর্থাৎ সেচব্যবস্থায় পানির অপচয় হচ্ছে। যদি কৃষকের হাতে প্রযুক্তি গত সেচ পাম্প থাকে তাহলে পানির অপচয় রোধ হবে। কত পরিমাণ জমিতে কী পরিমাণ পানি লাগবে তা সেচ মিটার দ্বারা নির্ধারিত থাকবে এবং সঠিক পরিমাণ পানি উত্তোলিত হলে সেচ পাম্প স্বয়ংক্রিয় ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। মেক্সিকোর কৃষকের উদাহরণ আমরা অনুসরণ করতে পারি।
আইপিসিসির (ইন্টারগর্ভমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) সভাপতি সম্প্রতি লন্ডনে এক ভাষণে বলেন, ‘আমাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন দৃশ্যমান। মানুষই এ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। দ্বীপরাষ্ট্র বার্বাডোজ এক জ্বলন্ত উদাহরণ। অধিবাসীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। আমাদের সমন্বিত উদ্যোগগুলোকে ক্লাইমেট জাস্টিসের দৃষ্টিকোণ হতে এগিয়ে নিতে হবে। দুর্যোগ প্রশমনে কাল বিলম্ব করা আমাদের জন্য বোকামি হবে।’
জাস্টিস শব্দটি দিয়ে অনেক অর্থ তিনি বুঝিয়েছেন। জাস্টিস অর্থাৎ ন্যায় বিচারের আলোকে উদ্যোগগুলোকে সমাধানের দিকে নিতে হবে। এখানে নৈতিকতার মানদন্ডে বিচার করতে হবে কাদের কারণে আজ কারা ভুক্তভোগী। গবেষণা বলছে, স্বল্পন্নোত দেশগুলো বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণে ৪ শতাংশ অবদান রাখছে। অথচ তাদের ৬৯ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে জলবায়ু প্রভাবজনিত সমস্যার কারণে। স্কটল্যান্ডের ফাস্ট মিনিস্টার নিকোলাস সার্জন বলেছিলেন উন্নত রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব আছে জলবায়ুর প্রভাবে সমস্যা জর্জরিত জাতিগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়া। পরবর্তীতে স্কটল্যান্ড জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিপূরণ তহবিলে (লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড) ১ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রদান করেছিল।
দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ সম্মেলনে আমরা দেখতে চাই পূর্বের প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অর্থ দরকার। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ জ্ঞান আমাদের চিন্তা শক্তিকে শাণিত করবে। উন্নত প্রযুক্তি আমাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ আমাদের প্রয়োজন। তবে, অর্থের ব্যবহারের স্বাধীনতা আমাদের থাকতে হবে। আমাদের কষ্ট এবং উত্তরণের উপায় অন্যদের চেয়ে আমরা ভালো জানি। জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিপূরণ তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতা যদি কোন দাতাগোষ্ঠীর হাতে থাকে, তাদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এরকম কোন ঘটনা যেন না হয়, এ সম্মেলনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
[লেখক: একটি বেসকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক]
মাহিউল কাদির
বুধবার, ২২ নভেম্বর ২০২৩
জলবায়ু সম্মেলন যা কপ (কনফারেন্স অব পার্টিস) নামে পরিচিত। কপ-২৮ অনুষ্ঠিত হবে ৩০ নভেম্বর হতে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে প্রতি বছর সারা পৃথিবী হতে রাষ্ট্রপ্রধান, গবেষক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও নানান স্তরের প্রতিনিধি সমাবেশে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কর্ম পন্থা নির্ধারণের জন্য যোগ দেন।
ইউনাইটেড ন্যাশন ফ্রেমওর্য়াক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেনজ (ইউএনএফসিসি) মূলত এই বাৎসরিক সমাবেশের আয়োজক। প্রথম সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে বার্লিনে। একটি কপের গৃহিত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন পরবর্তী কপে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মিশরের শারম-আল-শেখে এবং মোটা দাগে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। প্রথমবারের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্ত দেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে, তাদের উন্নয়নে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব গৃহিত হয়। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালেমুল হক এই কথাটি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। তিনি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের পক্ষ হতে এই প্রস্তাব প্রদান করেন।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণের জন্য ০ দশমিক ৪৭ শতাংশ দায়ী, কিন্তু জলবায়ুসংক্রান্ত বিপদাপন্ন দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। সমুদ্রের স্তর প্রতিনিয়ত উঁচু হচ্ছে, যা আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। ধারণা করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্থল ভাগের এক-দশমাংশ পানির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। অর্থাৎ দেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল জলাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তর হতে একটি সমীক্ষায় দেখা যায় গত ৩০ বছরের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ দশমিক ৮ হতে ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার হারে বাড়ছে এবং ১২ দশমিক ৩৪ হতে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হারে উপকূলীয় এলাকা জলমগ্ন হচ্ছে। উক্ত সমীক্ষায় দেশে ধান উৎপাদন ৫ দশমিক ৮ হতে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হারে কমছে। এ সমস্ত তথ্য হতে সহজে প্রতীয়মান যে, বাংলাদেশের জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলার জন্য আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন।
কপ-২৭ এর আরেকটি সিদ্ধান্ত ছিল জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় যৌথ অংশীদারিত্বে কৃষির আধুনিকীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। কৃষকরা এখন পর্যন্ত কৃষি কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সব জায়গায় পর্যাপ্ত ভূগর্ভস্থ পানির মজুত নেই। অন্য একটি সমস্যা হচ্ছে কৃষকরা জানে না জমিতে কী পরিমাণ পানি দিতে হবে। অর্থাৎ সেচব্যবস্থায় পানির অপচয় হচ্ছে। যদি কৃষকের হাতে প্রযুক্তি গত সেচ পাম্প থাকে তাহলে পানির অপচয় রোধ হবে। কত পরিমাণ জমিতে কী পরিমাণ পানি লাগবে তা সেচ মিটার দ্বারা নির্ধারিত থাকবে এবং সঠিক পরিমাণ পানি উত্তোলিত হলে সেচ পাম্প স্বয়ংক্রিয় ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। মেক্সিকোর কৃষকের উদাহরণ আমরা অনুসরণ করতে পারি।
আইপিসিসির (ইন্টারগর্ভমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) সভাপতি সম্প্রতি লন্ডনে এক ভাষণে বলেন, ‘আমাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন দৃশ্যমান। মানুষই এ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। দ্বীপরাষ্ট্র বার্বাডোজ এক জ্বলন্ত উদাহরণ। অধিবাসীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। আমাদের সমন্বিত উদ্যোগগুলোকে ক্লাইমেট জাস্টিসের দৃষ্টিকোণ হতে এগিয়ে নিতে হবে। দুর্যোগ প্রশমনে কাল বিলম্ব করা আমাদের জন্য বোকামি হবে।’
জাস্টিস শব্দটি দিয়ে অনেক অর্থ তিনি বুঝিয়েছেন। জাস্টিস অর্থাৎ ন্যায় বিচারের আলোকে উদ্যোগগুলোকে সমাধানের দিকে নিতে হবে। এখানে নৈতিকতার মানদন্ডে বিচার করতে হবে কাদের কারণে আজ কারা ভুক্তভোগী। গবেষণা বলছে, স্বল্পন্নোত দেশগুলো বৈশ্বিক কার্বন নির্গমণে ৪ শতাংশ অবদান রাখছে। অথচ তাদের ৬৯ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে জলবায়ু প্রভাবজনিত সমস্যার কারণে। স্কটল্যান্ডের ফাস্ট মিনিস্টার নিকোলাস সার্জন বলেছিলেন উন্নত রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব আছে জলবায়ুর প্রভাবে সমস্যা জর্জরিত জাতিগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়া। পরবর্তীতে স্কটল্যান্ড জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিপূরণ তহবিলে (লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড) ১ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রদান করেছিল।
দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮ সম্মেলনে আমরা দেখতে চাই পূর্বের প্রতিশ্রুতির যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অর্থ দরকার। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ জ্ঞান আমাদের চিন্তা শক্তিকে শাণিত করবে। উন্নত প্রযুক্তি আমাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ আমাদের প্রয়োজন। তবে, অর্থের ব্যবহারের স্বাধীনতা আমাদের থাকতে হবে। আমাদের কষ্ট এবং উত্তরণের উপায় অন্যদের চেয়ে আমরা ভালো জানি। জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিপূরণ তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতা যদি কোন দাতাগোষ্ঠীর হাতে থাকে, তাদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এরকম কোন ঘটনা যেন না হয়, এ সম্মেলনে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
[লেখক: একটি বেসকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক]