আরাফাত রহমান
বিংশ শতাব্দীতে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কীটনাশক ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। কীটনাশক অজৈব কিংবা জৈব পদার্থ হতে পারে এবং এগুলো তিনটি সাধারণ শ্রেণীতে বিভাজ্য- খাদ্যবিষ, স্পর্শবিষ ও ধোয়া বিষ। বাড়ি-ঘর, শস্যগুদাম বা গ্রিনহাউসের মতো আবদ্ধ স্থানে রক্ষিত পণ্যদ্রব্যের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে সাধারণত ধোয়া বিষ বা বিষগ্যাস সর্বাধিক কার্যকর। বিকর্ষক, আকর্ষক, রাসায়নিক বন্ধ্যাকরক, ফেরোমোন ইত্যাদি কিছু পদার্থও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতার ধরন ভিন্নতর। সাধারণত এসব রাসায়নিক পদার্থ বিষাক্ত নয়।
সাধারণভাবে অজৈব কীটনাশকগুলো কেবল খাদ্যবিষ হিসেবেই কার্যকর এবং বর্তমানে এগুলো প্রধানত টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ জৈব কীটনাশক সংশ্লেষিত বা উদ্ভিদজাত এবং স্পর্শবিষ, এবং কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ধোয়া বিষ হিসেবে কার্যকর। কীটনাশক আবির্ভাবের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। ঊনিশ শতকের ষাটের দশকে আমেরিকার মিসিসিপিতে আলুখেত কলোরাডো আলু-বিটল দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রথম কীটনাশকের সাধারণ ব্যবহার শুরু হয়। প্যারিস গ্রিন নামে আর্সেনিকঘটিত একটি পদার্থ উদ্ভিদ সংরক্ষক হিসেবে এতটাই ফলদায়ক হয়েছিল যে চাষিরা অতঃপর আপেলের ক্ষতিকর মথ ধ্বংসের জন্য সেটি ব্যবহার শুরু করে।
রাসায়নিক সংযুক্তির ভিত্তিতে কৃত্রিম জৈব-কীটনাশকগুলো বিভিন্নভাবে শ্রেণীবদ্ধ হতে পারে যেমন- ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন, সাইক্লোডাইন যৌগ, কার্বামেটস, অরগানোফসফেটস ইত্যাদি। ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বনের মধ্যে ডিডিটি, মিথোক্সিক্লোর ও লিনডেন বহু বছর ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ডিডিটি প্রয়োগের পর তার অবশিষ্টাংশ দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকায় বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এটির ব্যবহার এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সাইক্লোডাইন যৌগগুলো হলো অত্যধিক ক্লোরিনযুক্ত সাইক্লিক হাইড্রোকার্বন। এগুলোর মধ্যে আছে ক্লোরডেন, হেপ্টাক্লোর, অলড্রিন, ডাইয়েলড্রিন, এন্ড্রিন ইত্যাদি। এসব কীটনাশকের অধিকাংশই মাটির কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে অধিকতর কার্যকর। এন্ড্রিন মাছের জন্য অত্যধিক বিষাক্ত বিধায় ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশে এনড্রিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। পর্যাপ্ত প্রকারভেদসহ কার্বামেট কীটনাশকের একটি অনন্য শ্রেণী। সাধারণভাবে ব্যবহৃত কার্বামেটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেভিন ও বায়গন। আমাদের দেশে ব্যবহৃত সাধারণ দানাদার কীটনাশক সেভিডল হলো সেভিন ও লিনডেনের মিশ্রণ।
ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে অরগানোফসফরাস কীটনাশকগুলো প্রায় সব ধরনের কীটপতঙ্গ নিধনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে গবেষণার ফলে সব বৈশিষ্ট্যের হাজার হাজার কীটনাশক আবিষ্কৃত হয়েছে। ম্যালাথিয়ন, ডায়াজিনন, বাইড্রিন, ডাইমেক্রন, এজোড্রিন, নগোস, নেক্সিওন ইত্যাদি হলো সর্বাধিক পরিচিত কয়েকটি অরগানোফসফেট। এসব কীটনাশকের মধ্যে অধিকাংশরই একাধিক ট্রেডমার্ক সংবলিত নাম রয়েছে।
অধিকাংশ অরগানোফসফরাস কীটনাশকের ক্রিয়াই প্রণালীবদ্ধ। এটি এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য, কেননা তা উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে প্রাণঘাতী মাত্রায় শোষিত ও পরিবাহিত হয় এবং উদ্ভিদভুক কীটপতঙ্গ সেগুলো খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। কা--ছিদ্রকারী মাজরা পোকা এবং অভ্যন্তরীণ কোষকলাভুক ধরনের কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য উক্ত গুণাবলির এসব কীটনাশক এখন অত্যাবশ্যকীয়।
বাংলাদেশে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৬ সালের আগে তেমন কীটনাশক ব্যবহার হয়নি। ওই বছরই প্রথম সরকার কীটনাশক আমদানি করে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে কীটনাশক বিতরণ করত। ১৯৭৯ সালে কীটনাশক ব্যবসা বেসরকারি খাতে হস্তান্তরিত হয়। বিশ শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস পায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রধান কারণ উচ্চফলনশীল ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষকের মধ্যে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহ বৃদ্ধি এবং অজ্ঞতাবশত কৃষক কর্তৃক অতিরিক্ত পরিমাণে এবং মাঝেমধ্যে অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও কীটনাশক ব্যবহার।
জীবাণুঘটিত কীটনাশক হলো রোগজীবাণু ও সেগুলোর উপজাতের সাহায্যে রোগসংক্রমণ ঘটিয়ে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ। রাসায়নিক কীটনাশকের মতো এগুলোও কিছুকাল সংরক্ষণ, ড্রামবদ্ধ অবস্থায় বিপণন, পানি মিশিয়ে তরল করা ও স্প্রেয়িং মেশিনের সাহায্যে ছিটানো যায়। রাসায়নিক কীটনাশকের তুলনায় জীবাণুঘটিত কীটনাশকের কিছু লক্ষণীয় সুবিধা রয়েছে। এগুলো নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গের ওপর কার্যকর, নিরাপদ ও বিষাক্ত অবশেষমুক্ত।
তদুপরি জীবাণুঘটিত কীটনাশক ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের সাধারণ শত্রুদের বাঁচিয়ে রাখে ও ক্ষতিকর কীটদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে না। কিছু জীবাণুঘটিত কীটনাশক রাসায়নিক কীটনাশকের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহায়ক এবং প্রায়শ একত্রে ব্যবহার্য। তবে জীবাণুঘটিত কীটনাশকের কিছু অসুবিধাও আছে। অত্যধিক সুনির্দিষ্টতার দরুন এগুলোর উৎপাদন ও বিপণন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাপমাত্রা ও আলোর তীব্রতার নিরিখে এগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। এ জাতীয় রোগজীবাণু সাধারণত পোষক সংখ্যার অত্যধিক ঘনত্বেই কার্যকর, তাই প্রায়শই কৃষকদের কাছে ততা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না।
ছত্রাক হলো স্পর্শক জীবাণু যা পতঙ্গের ত্বকে অণুবীজ বা স্পোর মুক্ত করে এবং অঙ্কুরিত স্পোরের অনুসূত্র ত্বক ভেদ করে ভেতরে ঢোকে। Beuveria bassiana এবং Metarhizium anisopliae যথাক্রমে বাঁধাকপির শুঁয়োপোকা ও মাটিতে বসবাসকারী ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে খুবই ফলপ্রসূ। কয়েক জাতের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ও গুঁড়াকৃমি তাদের আহার্য জীবাণু ও পোষক পতঙ্গের পাকস্থলিতে ঢুকে কার্যকর সংক্রমণ ঘটায়। পতঙ্গদেহে স্পোর গঠনকারী সর্বোত্তম ব্যাকটেরিয়া হলো Bacillus popilliae ও B. thuringiensis। কতক মথের বিরুদ্ধে প্রোটোজোয়া, বিশেষত ঘড়ংবসধ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে জীবাণুঘটিত কীটনাশকের ব্যবহার খুবই সীমিত। ধানের শিষকাটা লেদাপোকার বিরুদ্ধে Bacillus thuringiensis কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ জাতীয় অনেক জীবাণু শনাক্ত এবং সেগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। সব কীটনাশক সব পোকার জন্য সমভাবে কার্যকরী নয়। বিশেষ বিশেষ ওষুধ অনেক সময় বিশেষ ধরনের পোকা দমনের জন্য উপযোগী। কীটপতঙ্গ দমনে কীটনাশক ওষুধের সাফল্য নির্ভর করে কতগুলো শর্তের ওপর। উপযুক্ত ওষুধ উপযুক্ত সময়ে সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলেই তবে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। তবে মনে রাখতে হবে যে, সব কীটনাশকই মারাত্মক বিষ। তাই সতর্কতা ও বিজ্ঞতার সঙ্গে এদের ব্যবহার করতে হবে।
আজকাল কেবল ওষুধের ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন দমন পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ ধরনের পদ্ধতিকে সমন্বিত দমন পদ্ধতি বলা হয়। যেহেতু কীটনাশকের ব্যবহার নিশ্চিতরূপে পরিবেশকে দূষিত করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে, সেহেতু এর ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা যায় ততই মানুষের জন্য মঙ্গলকর।
[লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়]
আরাফাত রহমান
শনিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৩
বিংশ শতাব্দীতে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কীটনাশক ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। কীটনাশক অজৈব কিংবা জৈব পদার্থ হতে পারে এবং এগুলো তিনটি সাধারণ শ্রেণীতে বিভাজ্য- খাদ্যবিষ, স্পর্শবিষ ও ধোয়া বিষ। বাড়ি-ঘর, শস্যগুদাম বা গ্রিনহাউসের মতো আবদ্ধ স্থানে রক্ষিত পণ্যদ্রব্যের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে সাধারণত ধোয়া বিষ বা বিষগ্যাস সর্বাধিক কার্যকর। বিকর্ষক, আকর্ষক, রাসায়নিক বন্ধ্যাকরক, ফেরোমোন ইত্যাদি কিছু পদার্থও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতার ধরন ভিন্নতর। সাধারণত এসব রাসায়নিক পদার্থ বিষাক্ত নয়।
সাধারণভাবে অজৈব কীটনাশকগুলো কেবল খাদ্যবিষ হিসেবেই কার্যকর এবং বর্তমানে এগুলো প্রধানত টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ জৈব কীটনাশক সংশ্লেষিত বা উদ্ভিদজাত এবং স্পর্শবিষ, এবং কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ধোয়া বিষ হিসেবে কার্যকর। কীটনাশক আবির্ভাবের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। ঊনিশ শতকের ষাটের দশকে আমেরিকার মিসিসিপিতে আলুখেত কলোরাডো আলু-বিটল দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রথম কীটনাশকের সাধারণ ব্যবহার শুরু হয়। প্যারিস গ্রিন নামে আর্সেনিকঘটিত একটি পদার্থ উদ্ভিদ সংরক্ষক হিসেবে এতটাই ফলদায়ক হয়েছিল যে চাষিরা অতঃপর আপেলের ক্ষতিকর মথ ধ্বংসের জন্য সেটি ব্যবহার শুরু করে।
রাসায়নিক সংযুক্তির ভিত্তিতে কৃত্রিম জৈব-কীটনাশকগুলো বিভিন্নভাবে শ্রেণীবদ্ধ হতে পারে যেমন- ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন, সাইক্লোডাইন যৌগ, কার্বামেটস, অরগানোফসফেটস ইত্যাদি। ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বনের মধ্যে ডিডিটি, মিথোক্সিক্লোর ও লিনডেন বহু বছর ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ডিডিটি প্রয়োগের পর তার অবশিষ্টাংশ দীর্ঘকাল সক্রিয় থাকায় বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এটির ব্যবহার এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সাইক্লোডাইন যৌগগুলো হলো অত্যধিক ক্লোরিনযুক্ত সাইক্লিক হাইড্রোকার্বন। এগুলোর মধ্যে আছে ক্লোরডেন, হেপ্টাক্লোর, অলড্রিন, ডাইয়েলড্রিন, এন্ড্রিন ইত্যাদি। এসব কীটনাশকের অধিকাংশই মাটির কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে অধিকতর কার্যকর। এন্ড্রিন মাছের জন্য অত্যধিক বিষাক্ত বিধায় ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশে এনড্রিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। পর্যাপ্ত প্রকারভেদসহ কার্বামেট কীটনাশকের একটি অনন্য শ্রেণী। সাধারণভাবে ব্যবহৃত কার্বামেটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সেভিন ও বায়গন। আমাদের দেশে ব্যবহৃত সাধারণ দানাদার কীটনাশক সেভিডল হলো সেভিন ও লিনডেনের মিশ্রণ।
ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে অরগানোফসফরাস কীটনাশকগুলো প্রায় সব ধরনের কীটপতঙ্গ নিধনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে গবেষণার ফলে সব বৈশিষ্ট্যের হাজার হাজার কীটনাশক আবিষ্কৃত হয়েছে। ম্যালাথিয়ন, ডায়াজিনন, বাইড্রিন, ডাইমেক্রন, এজোড্রিন, নগোস, নেক্সিওন ইত্যাদি হলো সর্বাধিক পরিচিত কয়েকটি অরগানোফসফেট। এসব কীটনাশকের মধ্যে অধিকাংশরই একাধিক ট্রেডমার্ক সংবলিত নাম রয়েছে।
অধিকাংশ অরগানোফসফরাস কীটনাশকের ক্রিয়াই প্রণালীবদ্ধ। এটি এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য, কেননা তা উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে প্রাণঘাতী মাত্রায় শোষিত ও পরিবাহিত হয় এবং উদ্ভিদভুক কীটপতঙ্গ সেগুলো খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। কা--ছিদ্রকারী মাজরা পোকা এবং অভ্যন্তরীণ কোষকলাভুক ধরনের কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য উক্ত গুণাবলির এসব কীটনাশক এখন অত্যাবশ্যকীয়।
বাংলাদেশে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৬ সালের আগে তেমন কীটনাশক ব্যবহার হয়নি। ওই বছরই প্রথম সরকার কীটনাশক আমদানি করে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে কীটনাশক বিতরণ করত। ১৯৭৯ সালে কীটনাশক ব্যবসা বেসরকারি খাতে হস্তান্তরিত হয়। বিশ শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস পায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রধান কারণ উচ্চফলনশীল ধান চাষের জন্য ব্যবহৃত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষকের মধ্যে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহ বৃদ্ধি এবং অজ্ঞতাবশত কৃষক কর্তৃক অতিরিক্ত পরিমাণে এবং মাঝেমধ্যে অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও কীটনাশক ব্যবহার।
জীবাণুঘটিত কীটনাশক হলো রোগজীবাণু ও সেগুলোর উপজাতের সাহায্যে রোগসংক্রমণ ঘটিয়ে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ। রাসায়নিক কীটনাশকের মতো এগুলোও কিছুকাল সংরক্ষণ, ড্রামবদ্ধ অবস্থায় বিপণন, পানি মিশিয়ে তরল করা ও স্প্রেয়িং মেশিনের সাহায্যে ছিটানো যায়। রাসায়নিক কীটনাশকের তুলনায় জীবাণুঘটিত কীটনাশকের কিছু লক্ষণীয় সুবিধা রয়েছে। এগুলো নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গের ওপর কার্যকর, নিরাপদ ও বিষাক্ত অবশেষমুক্ত।
তদুপরি জীবাণুঘটিত কীটনাশক ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের সাধারণ শত্রুদের বাঁচিয়ে রাখে ও ক্ষতিকর কীটদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে না। কিছু জীবাণুঘটিত কীটনাশক রাসায়নিক কীটনাশকের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহায়ক এবং প্রায়শ একত্রে ব্যবহার্য। তবে জীবাণুঘটিত কীটনাশকের কিছু অসুবিধাও আছে। অত্যধিক সুনির্দিষ্টতার দরুন এগুলোর উৎপাদন ও বিপণন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাপমাত্রা ও আলোর তীব্রতার নিরিখে এগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। এ জাতীয় রোগজীবাণু সাধারণত পোষক সংখ্যার অত্যধিক ঘনত্বেই কার্যকর, তাই প্রায়শই কৃষকদের কাছে ততা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে না।
ছত্রাক হলো স্পর্শক জীবাণু যা পতঙ্গের ত্বকে অণুবীজ বা স্পোর মুক্ত করে এবং অঙ্কুরিত স্পোরের অনুসূত্র ত্বক ভেদ করে ভেতরে ঢোকে। Beuveria bassiana এবং Metarhizium anisopliae যথাক্রমে বাঁধাকপির শুঁয়োপোকা ও মাটিতে বসবাসকারী ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে খুবই ফলপ্রসূ। কয়েক জাতের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ও গুঁড়াকৃমি তাদের আহার্য জীবাণু ও পোষক পতঙ্গের পাকস্থলিতে ঢুকে কার্যকর সংক্রমণ ঘটায়। পতঙ্গদেহে স্পোর গঠনকারী সর্বোত্তম ব্যাকটেরিয়া হলো Bacillus popilliae ও B. thuringiensis। কতক মথের বিরুদ্ধে প্রোটোজোয়া, বিশেষত ঘড়ংবসধ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে জীবাণুঘটিত কীটনাশকের ব্যবহার খুবই সীমিত। ধানের শিষকাটা লেদাপোকার বিরুদ্ধে Bacillus thuringiensis কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ জাতীয় অনেক জীবাণু শনাক্ত এবং সেগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। সব কীটনাশক সব পোকার জন্য সমভাবে কার্যকরী নয়। বিশেষ বিশেষ ওষুধ অনেক সময় বিশেষ ধরনের পোকা দমনের জন্য উপযোগী। কীটপতঙ্গ দমনে কীটনাশক ওষুধের সাফল্য নির্ভর করে কতগুলো শর্তের ওপর। উপযুক্ত ওষুধ উপযুক্ত সময়ে সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলেই তবে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। তবে মনে রাখতে হবে যে, সব কীটনাশকই মারাত্মক বিষ। তাই সতর্কতা ও বিজ্ঞতার সঙ্গে এদের ব্যবহার করতে হবে।
আজকাল কেবল ওষুধের ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন দমন পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করে ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ ধরনের পদ্ধতিকে সমন্বিত দমন পদ্ধতি বলা হয়। যেহেতু কীটনাশকের ব্যবহার নিশ্চিতরূপে পরিবেশকে দূষিত করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে, সেহেতু এর ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা যায় ততই মানুষের জন্য মঙ্গলকর।
[লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়]