এনামুল হক খান
আমরা দেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার মধ্যে অনেক কিছু ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া খাল-বিলের মধ্যে অধিকাংশের অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে বিভিন্ন রকমের খেলাধুলাও হারিয়ে গেছে। একটি দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য- এটা ভালো লক্ষণ নয়। কথায় আছে- একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং কৃষিসহ অনেক বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়।
এগিয়ে যাওয়ার পথগুলো ভালোভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়, লালন করতে হয়। পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হয়। এগিয়ে যেতে হলে- দেশের সব ফসল উৎপাদন, প্রাকৃতিক মাছ, খেলাধুলা, বিভিন্ন রকম পিঠা, সংগীত-নৃত্য, নদী-নালা, খল-বিল, ডোবা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখতে হবে- হারিয়ে যাক বলে এদের ভুলে গেলে চলবে না। অতীতের অতি দরকারি জিনিসের উন্নয়নের দিকটি ভুলে যাওয়া হবে বোকামি।
গ্রামবাংলার মানুষ আগের দিনে গরু দিয়ে হাল চাষ করত। প্রত্যেকের ঘরে এক-দুই জোড়া হালের গরু ছিল। আরো ছিল গাভী ও ছাগল। মানুষ এদের দুধ খেতো সারা বছর।
গরু, গাভী, ছাগল এখন আর ঘরে-ঘরে নেই। আছে গ্রামের মাত্র দুই-একটা পরিবারে। গরু-গাভী নাই বলে এখন লাঙ্গল-জোয়াল, মই- আঞ্চলিক ভাষায় চগম, আচড়া, কাবাইর, পাজুইন, ইটাবাড়ি কিছুই নেই।
গরু-গাভীকে ভাতের মার খাওয়ানোর জন্য ছিল নাইন্দ। ঘাস খাওয়ানোর জন্য ছিল খোয়ার। আরো ছিল গরুকে রাতে রাখার জন্য গরুর ঘর। গরুকে খাওয়ানো হতো খড়-ঘাস। আজ হারিয়ে গেছে খড়ের পালা। গরু নাই বলে জমিতে আগের মতো দেয়া হয় না গোবর সার। কৃষিকাজ আগের মতো নেই বলে প্রত্যেকের ঘরে আগের মতো নেই কাঁচি-ছেনি।
গ্রামের মানুষ আগে পাট চাষ করত। পাট বিক্রি করে সংসার চালাতো। পাট ছিল তখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। পাট চাষ আজ হারিয়ে গেছে। পাট খেতে থাকতো শিয়াল। এখন আর পাট চাষ নেই বলে, গ্রামে এখন পাটশোলা নেই। পাট খেত নেই বলে এলাকায় আগের মতো শিয়াল ও নেই। পাট কাটা, পাট ভিজানো, পাট লওয়া, পাট ধোঁয়া এবং পাট শুকানোর চিত্র আজ চোখে পড়ে না।
শুধু তাই নয় কারোর বাড়িতে এখন আর পাটের কাড়ি নেই, নেই পাটশোলার কাড়ি। তাই তো এখন আর পাটশোলা দিয়ে ধান সিদ্ধ করা, চুলায় রান্না করার চিত্র ও দেখা যায় না। শুধু তাই নয় পাটশোলা দিয়ে বানানো হতো আওতা বেড়া যা ছিল মেয়েদের পর্দা বেড়া, পাটশোলার পর্দাবেড়াও এখন নেই।
এলাকায় আগে পুকুর পাড়ে অনেক তুলা গাছ ছিল। আবার মানুষ করতো কারপাস তুলার চাষ। ঘরে-ঘরে ছিল চড়কা, করতো সুতা তৈরির কাজ। উৎপাদিত তুলায় চলতো টেক্সটাইল মিলগুলো। তুলার অভাবে আজ অনেক মিল বন্ধ হয়েছে।
আবার ধানের মধ্যে ছিল নাজিরসাইল, গরচা, তিলি বাজালসহ অন্যান্য ধান। আরো ছিল ধোন্দা, কাউন। এলাকায় বছরে কয়েক মাস ধান সিদ্ধ, ধান শুকানো, খড় শুকানোর ধূম লেগেই থাকত। প্রত্যেকের ঘরে ছিল ধান চাল রাখার জন্য ডোল, মটকা। ঢেকিতে ধান ভানা, চাউল গুড়া করা প্রত্যেকের জন্য ছিল বড় কাজ।া
জমির নাড়া পোড়া দেয়ার দৃশ্য এখন আর নেই। নাড়া পোড়া দেয়া জমিতে মেড্ডা বা খর পেঁচানো বল দিয়ে ছেলেরা খেলতো প্রতিদিন। সেই চিত্রও এখন আর নেই
আরো থাকতো চাউলের গুঁড়া দিয়ে খোলা পিঠা, বড়া পিঠা, ফুল পিঠার মতো অন্যান্য পিঠা ও চিড়া তৈরির প্রতিযোগিতা। তখন প্রত্যেকের ঘরে ছিল মাটির হাড়ি-পাতিল। ছিল মাটির কলসি, ছিল পাটের তৈরি ছিক্কা। আরো ছিল হারিকেন, কুপি, ঠনা। এগুলো এখন আর নেই।
এক সময় মানুষ পিড়ি তে বসে খেতো, এটাও অনেকটা কমে গেছে। তখন প্রতি পরিবারেই থাকতো ঢেঁকি, কাইল, ছিয়া, কুলা, ডুলা, চালনি। তখন প্রায় প্রত্যেক পরিবারে থাকতো বাৎসরিক কামলা বা কাজের লোক। তাদের প্রায় সবাই হুক্কায় তামাক খেতো, বেনা য় আগুন জ্বালিয়ে রাখতো। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষায় তারা মাথায় দিতো মাথলা, জোংড়া। তারা করতো হাল চাষ। হাল চাষের পরে থাকতো মাছ ধরা নিয়ে ব্যাস্ত। তারা কাজের মাঝে গান ধরতো পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া। এই গান ও এখন হারিয়ে গেছে।
কাজের লোকজন বাড়ির কোলা জমিতে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, বেগুন ও অন্যান্য তরি-তরকারি লাগাতো। আরো একটু নিচু জায়গায় লাগাতো লাউ, ছই, কুমড়া, মিষ্টি আলু। আবার চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া হতো ঘরের চালে।
বাড়িতে যখন বিভিন্ন রকম পিঠা এবং ফলের আয়োজন থাকতো তখন মেয়ের জামাই, বোনের জামাই এবং তাদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দেয়া হতো। আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসতেন। এতে সবার মাঝে বাড়তো আন্তরিকতা। তাই আনন্দময় হয়ে উঠতো দাওয়াতের অনুষ্ঠানটি।
কৃষকের ঘরে এখন পাট নেই বলে বোট-মুরালি বিক্রেতাদের এখন আর বাড়ি-বাড়ি দেখা যায় না। এরা বর্ষায় আসতো নৌকায়। বর্ষা গেলে আসতো মালামাল কাঁধে নিয়ে।তখন খালগুলো নাব্য ছিল বলে বর্ষাকালে জমির উপর ৬-৭ ফুট পানি হতো। গ্রামের খালগুলো আছে এখন মৃত্যুশয্যায়। তাই এখন আর বর্ষায় জমিতে আগের মতো পানি হয় না। খালে নৌকা চলে না- বোট মুরালি বিক্রেতা ও আসে না। পানি হয় না বলে এলাকায় খাল, পুকুর, ডোবায় শাপলা, শালুক নেই। এলাকার মানুষ শাপলা, শালুক তোলা, শামুক, ঝিনুক কুড়ানো ভুলে গেছে। এখন আর আগের মতো জমি, খালের পানিতে সাঁতার কাটার চিত্র নেই। পানি নেই বলে খালগুলোতে আগের মতো ভেল জালে মাছ ধরা নেই। বিল, ডোবাগুলোতেও নেই আগের মতো মাছ ধরার চিত্র।
এখন আর নেই আন্তা, কৈয়া জাল পাতা, বড়শি পাতার দৃশ্য। নেই খালগুলোতে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সাঁকো। নেই ছেলে-মেয়েদের পানিতে লাফ-ঝাঁপ। নেই শাপলা-শালুক, শামুক-ঝিনুক কুড়ানোর আনন্দ। নেই কোচ, টেঁডা, শাবল, খোন্তা, নেই ধর্ম জাল, কুনী জাল, পাসন জাল- নেই পলো। নেই পুকুর-ডোবা থেকে হাতিয়ে মাছ ধরার চিত্র। নেই পুকুরে সাঁতার কাটা, নেই গাছ থেকে পানিতে লাফ দেয়ার চিত্র। গ্রামে এখন আর নেই কলার ভেলাও। নেই গ্রামের প্রতি পরিবারে নৌকা, নেই নৌকায় জাল দিয়ে পুকুর-ডোবা থেকে মাছ ধরার চিত্র।
এখন আর সম্ভব হয় না ছইয়া নৌকায় নানা বাড়ি, ফুফু বাড়ি যাওয়া। এখন আর দেখা মেলে না এলাকায় বাদাম দেয়া নৌকা। নেই ছটকি দিয়ে আগের মতো বক ধরার চিত্র। আগে এলাকার সমবয়সীদের মধ্যে এবং স্কুল, কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতো সাঁতার প্রতিযোগিতা, ফুটবল, ভলিবল প্রতিযোগিতা। এলাকায় হতো হাডুডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, টেমডাং, কানামাছি, চাড়াখেলাসহ অনেক খেলাধুলা। হাডুডু, গোল্লাছুট, সাঁতার প্রতিযোগিতা ও হতো গ্রামের সমবয়সীদের মধ্যে। এগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি খেলা বর্তমানে আছে, বাকী অনেকগুলো হারিয়ে গেছে। এলাকার খাস জমিগুলো ছিল খেলার মাঠ। তখন এলাকায় অনেকের মধ্যে ছিল ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দ। ঘুড়ির মধ্যে ছিল হাফা, পত্তন, ডাবুইস, তেলেঙ্গার মতো আরো অনেক ঘুড়ি। ঘুড়িতে থাকতো বোমা, বাতাসে বাজতো দিন-রাত।
জমির নাড়া পোড়া দেয়ার দৃশ্য এখন আর নেই। নাড়া পোড়া দেয়া জমিতে মেড্ডা বা খর পেঁচানো বল দিয়ে ছেলেরা খেলতো প্রতিদিন। সেই চিত্রও এখন আর নেই। শুধু তাই নয় এলাকার জমিতে প্রত্যেক পরিবারের লোকজন কলাই, মটর ফসল বুনতো। অনেক ছেলে-মেয়ে মটর পোড়া দিয়ে খেতো, আনন্দ করতো। সব হারিয়ে গেছে বলে কারোর মনে এখন আনন্দ নেই।
ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে পাড়তো জামগাছ থেকে জাম। সেই চিত্রও আজ আর নেই। এখন আর দেয়া হয় না মিলাদে বাতাসা। তাই এলাকার মিষ্টি দোকানে এখন আর বাতাসা তৈরির ধুম নেই। নেই আগের মতো ঘরে ঘরে কবুতর পালার চিত্র। এলাকায় এখন আর আগের মতো হয় না যাত্রা-নাটক, জারিগান, পালাগান। নেই সার্কাস, জাদু দেখানোর আয়োজন। কমে গেছে ওঝাদের সাপের খেলা, সিঙ্গা লাগানো ও কবিরাজি চিকিৎসার ব্যবস্থা।
এখন গ্রামে নেই রাতের বিয়েতে বর যাত্রী পাল্কিতে যাওয়ার ব্যবস্থা। নেই কলাগাছের সিংহ দরজার আয়োজন। এখন আর নেই বিয়ের পর বউকে পালকি দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা। এখন আর আগের মতো নেই এলাকায় বড় বড় বটগাছ। যেখানে পথচারীরা ক্লান্তি দূর করতো বটগাছের ছায়ায় নির্মল বাতাসে। এমন চিত্র এখন আর নেই, সব হারিয়ে গেছে।
[লেখক : প্রকৌশলী]
এনামুল হক খান
রোববার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩
আমরা দেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার মধ্যে অনেক কিছু ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া খাল-বিলের মধ্যে অধিকাংশের অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে বিভিন্ন রকমের খেলাধুলাও হারিয়ে গেছে। একটি দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য- এটা ভালো লক্ষণ নয়। কথায় আছে- একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং কৃষিসহ অনেক বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়।
এগিয়ে যাওয়ার পথগুলো ভালোভাবে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়, লালন করতে হয়। পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হয়। এগিয়ে যেতে হলে- দেশের সব ফসল উৎপাদন, প্রাকৃতিক মাছ, খেলাধুলা, বিভিন্ন রকম পিঠা, সংগীত-নৃত্য, নদী-নালা, খল-বিল, ডোবা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখতে হবে- হারিয়ে যাক বলে এদের ভুলে গেলে চলবে না। অতীতের অতি দরকারি জিনিসের উন্নয়নের দিকটি ভুলে যাওয়া হবে বোকামি।
গ্রামবাংলার মানুষ আগের দিনে গরু দিয়ে হাল চাষ করত। প্রত্যেকের ঘরে এক-দুই জোড়া হালের গরু ছিল। আরো ছিল গাভী ও ছাগল। মানুষ এদের দুধ খেতো সারা বছর।
গরু, গাভী, ছাগল এখন আর ঘরে-ঘরে নেই। আছে গ্রামের মাত্র দুই-একটা পরিবারে। গরু-গাভী নাই বলে এখন লাঙ্গল-জোয়াল, মই- আঞ্চলিক ভাষায় চগম, আচড়া, কাবাইর, পাজুইন, ইটাবাড়ি কিছুই নেই।
গরু-গাভীকে ভাতের মার খাওয়ানোর জন্য ছিল নাইন্দ। ঘাস খাওয়ানোর জন্য ছিল খোয়ার। আরো ছিল গরুকে রাতে রাখার জন্য গরুর ঘর। গরুকে খাওয়ানো হতো খড়-ঘাস। আজ হারিয়ে গেছে খড়ের পালা। গরু নাই বলে জমিতে আগের মতো দেয়া হয় না গোবর সার। কৃষিকাজ আগের মতো নেই বলে প্রত্যেকের ঘরে আগের মতো নেই কাঁচি-ছেনি।
গ্রামের মানুষ আগে পাট চাষ করত। পাট বিক্রি করে সংসার চালাতো। পাট ছিল তখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। পাট চাষ আজ হারিয়ে গেছে। পাট খেতে থাকতো শিয়াল। এখন আর পাট চাষ নেই বলে, গ্রামে এখন পাটশোলা নেই। পাট খেত নেই বলে এলাকায় আগের মতো শিয়াল ও নেই। পাট কাটা, পাট ভিজানো, পাট লওয়া, পাট ধোঁয়া এবং পাট শুকানোর চিত্র আজ চোখে পড়ে না।
শুধু তাই নয় কারোর বাড়িতে এখন আর পাটের কাড়ি নেই, নেই পাটশোলার কাড়ি। তাই তো এখন আর পাটশোলা দিয়ে ধান সিদ্ধ করা, চুলায় রান্না করার চিত্র ও দেখা যায় না। শুধু তাই নয় পাটশোলা দিয়ে বানানো হতো আওতা বেড়া যা ছিল মেয়েদের পর্দা বেড়া, পাটশোলার পর্দাবেড়াও এখন নেই।
এলাকায় আগে পুকুর পাড়ে অনেক তুলা গাছ ছিল। আবার মানুষ করতো কারপাস তুলার চাষ। ঘরে-ঘরে ছিল চড়কা, করতো সুতা তৈরির কাজ। উৎপাদিত তুলায় চলতো টেক্সটাইল মিলগুলো। তুলার অভাবে আজ অনেক মিল বন্ধ হয়েছে।
আবার ধানের মধ্যে ছিল নাজিরসাইল, গরচা, তিলি বাজালসহ অন্যান্য ধান। আরো ছিল ধোন্দা, কাউন। এলাকায় বছরে কয়েক মাস ধান সিদ্ধ, ধান শুকানো, খড় শুকানোর ধূম লেগেই থাকত। প্রত্যেকের ঘরে ছিল ধান চাল রাখার জন্য ডোল, মটকা। ঢেকিতে ধান ভানা, চাউল গুড়া করা প্রত্যেকের জন্য ছিল বড় কাজ।া
জমির নাড়া পোড়া দেয়ার দৃশ্য এখন আর নেই। নাড়া পোড়া দেয়া জমিতে মেড্ডা বা খর পেঁচানো বল দিয়ে ছেলেরা খেলতো প্রতিদিন। সেই চিত্রও এখন আর নেই
আরো থাকতো চাউলের গুঁড়া দিয়ে খোলা পিঠা, বড়া পিঠা, ফুল পিঠার মতো অন্যান্য পিঠা ও চিড়া তৈরির প্রতিযোগিতা। তখন প্রত্যেকের ঘরে ছিল মাটির হাড়ি-পাতিল। ছিল মাটির কলসি, ছিল পাটের তৈরি ছিক্কা। আরো ছিল হারিকেন, কুপি, ঠনা। এগুলো এখন আর নেই।
এক সময় মানুষ পিড়ি তে বসে খেতো, এটাও অনেকটা কমে গেছে। তখন প্রতি পরিবারেই থাকতো ঢেঁকি, কাইল, ছিয়া, কুলা, ডুলা, চালনি। তখন প্রায় প্রত্যেক পরিবারে থাকতো বাৎসরিক কামলা বা কাজের লোক। তাদের প্রায় সবাই হুক্কায় তামাক খেতো, বেনা য় আগুন জ্বালিয়ে রাখতো। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষায় তারা মাথায় দিতো মাথলা, জোংড়া। তারা করতো হাল চাষ। হাল চাষের পরে থাকতো মাছ ধরা নিয়ে ব্যাস্ত। তারা কাজের মাঝে গান ধরতো পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া। এই গান ও এখন হারিয়ে গেছে।
কাজের লোকজন বাড়ির কোলা জমিতে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, বেগুন ও অন্যান্য তরি-তরকারি লাগাতো। আরো একটু নিচু জায়গায় লাগাতো লাউ, ছই, কুমড়া, মিষ্টি আলু। আবার চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া হতো ঘরের চালে।
বাড়িতে যখন বিভিন্ন রকম পিঠা এবং ফলের আয়োজন থাকতো তখন মেয়ের জামাই, বোনের জামাই এবং তাদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত দেয়া হতো। আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসতেন। এতে সবার মাঝে বাড়তো আন্তরিকতা। তাই আনন্দময় হয়ে উঠতো দাওয়াতের অনুষ্ঠানটি।
কৃষকের ঘরে এখন পাট নেই বলে বোট-মুরালি বিক্রেতাদের এখন আর বাড়ি-বাড়ি দেখা যায় না। এরা বর্ষায় আসতো নৌকায়। বর্ষা গেলে আসতো মালামাল কাঁধে নিয়ে।তখন খালগুলো নাব্য ছিল বলে বর্ষাকালে জমির উপর ৬-৭ ফুট পানি হতো। গ্রামের খালগুলো আছে এখন মৃত্যুশয্যায়। তাই এখন আর বর্ষায় জমিতে আগের মতো পানি হয় না। খালে নৌকা চলে না- বোট মুরালি বিক্রেতা ও আসে না। পানি হয় না বলে এলাকায় খাল, পুকুর, ডোবায় শাপলা, শালুক নেই। এলাকার মানুষ শাপলা, শালুক তোলা, শামুক, ঝিনুক কুড়ানো ভুলে গেছে। এখন আর আগের মতো জমি, খালের পানিতে সাঁতার কাটার চিত্র নেই। পানি নেই বলে খালগুলোতে আগের মতো ভেল জালে মাছ ধরা নেই। বিল, ডোবাগুলোতেও নেই আগের মতো মাছ ধরার চিত্র।
এখন আর নেই আন্তা, কৈয়া জাল পাতা, বড়শি পাতার দৃশ্য। নেই খালগুলোতে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সাঁকো। নেই ছেলে-মেয়েদের পানিতে লাফ-ঝাঁপ। নেই শাপলা-শালুক, শামুক-ঝিনুক কুড়ানোর আনন্দ। নেই কোচ, টেঁডা, শাবল, খোন্তা, নেই ধর্ম জাল, কুনী জাল, পাসন জাল- নেই পলো। নেই পুকুর-ডোবা থেকে হাতিয়ে মাছ ধরার চিত্র। নেই পুকুরে সাঁতার কাটা, নেই গাছ থেকে পানিতে লাফ দেয়ার চিত্র। গ্রামে এখন আর নেই কলার ভেলাও। নেই গ্রামের প্রতি পরিবারে নৌকা, নেই নৌকায় জাল দিয়ে পুকুর-ডোবা থেকে মাছ ধরার চিত্র।
এখন আর সম্ভব হয় না ছইয়া নৌকায় নানা বাড়ি, ফুফু বাড়ি যাওয়া। এখন আর দেখা মেলে না এলাকায় বাদাম দেয়া নৌকা। নেই ছটকি দিয়ে আগের মতো বক ধরার চিত্র। আগে এলাকার সমবয়সীদের মধ্যে এবং স্কুল, কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতো সাঁতার প্রতিযোগিতা, ফুটবল, ভলিবল প্রতিযোগিতা। এলাকায় হতো হাডুডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, টেমডাং, কানামাছি, চাড়াখেলাসহ অনেক খেলাধুলা। হাডুডু, গোল্লাছুট, সাঁতার প্রতিযোগিতা ও হতো গ্রামের সমবয়সীদের মধ্যে। এগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি খেলা বর্তমানে আছে, বাকী অনেকগুলো হারিয়ে গেছে। এলাকার খাস জমিগুলো ছিল খেলার মাঠ। তখন এলাকায় অনেকের মধ্যে ছিল ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দ। ঘুড়ির মধ্যে ছিল হাফা, পত্তন, ডাবুইস, তেলেঙ্গার মতো আরো অনেক ঘুড়ি। ঘুড়িতে থাকতো বোমা, বাতাসে বাজতো দিন-রাত।
জমির নাড়া পোড়া দেয়ার দৃশ্য এখন আর নেই। নাড়া পোড়া দেয়া জমিতে মেড্ডা বা খর পেঁচানো বল দিয়ে ছেলেরা খেলতো প্রতিদিন। সেই চিত্রও এখন আর নেই। শুধু তাই নয় এলাকার জমিতে প্রত্যেক পরিবারের লোকজন কলাই, মটর ফসল বুনতো। অনেক ছেলে-মেয়ে মটর পোড়া দিয়ে খেতো, আনন্দ করতো। সব হারিয়ে গেছে বলে কারোর মনে এখন আনন্দ নেই।
ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে পাড়তো জামগাছ থেকে জাম। সেই চিত্রও আজ আর নেই। এখন আর দেয়া হয় না মিলাদে বাতাসা। তাই এলাকার মিষ্টি দোকানে এখন আর বাতাসা তৈরির ধুম নেই। নেই আগের মতো ঘরে ঘরে কবুতর পালার চিত্র। এলাকায় এখন আর আগের মতো হয় না যাত্রা-নাটক, জারিগান, পালাগান। নেই সার্কাস, জাদু দেখানোর আয়োজন। কমে গেছে ওঝাদের সাপের খেলা, সিঙ্গা লাগানো ও কবিরাজি চিকিৎসার ব্যবস্থা।
এখন গ্রামে নেই রাতের বিয়েতে বর যাত্রী পাল্কিতে যাওয়ার ব্যবস্থা। নেই কলাগাছের সিংহ দরজার আয়োজন। এখন আর নেই বিয়ের পর বউকে পালকি দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা। এখন আর আগের মতো নেই এলাকায় বড় বড় বটগাছ। যেখানে পথচারীরা ক্লান্তি দূর করতো বটগাছের ছায়ায় নির্মল বাতাসে। এমন চিত্র এখন আর নেই, সব হারিয়ে গেছে।
[লেখক : প্রকৌশলী]