alt

উপ-সম্পাদকীয়

জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক

গৌতম রায়

: শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
image

জ্ঞানবাপী মসজিদ

ভারতের আসন্ন লোকসভা ভোটকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ভিত্তিতে পরিচালিত করবার জন্য গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির ভারতজুড়ে যে ভয়ংকর কর্মকা- চালাচ্ছে, তাতে নতুন করে সংযোজিত হচ্ছে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক। হিন্দুত্ববাদী শিবির, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকেই সেøাগান দিয়ে চলেছে যে, এটা তো কেবল ট্রেলার। এখনো কাশি, মথুরা বাকি আছে।

গোটা ভারতে সমন্বয়ী সংস্কৃতির যে কিছু আদর্শ, কীর্তি, সৌধ আছে সমস্ত কিছুর পেছনে মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির আজগুবি, অসত্য তত্ত্বকে খাড়া করা, হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক কর্মসূচির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেভাবেই তারা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ঘিরে রামের জন্মভূমির এক অনৈতিহাসিক, অবাস্তব তত্ত্ব হাজির করেছিল। যে তত্ত্বের বাজারীকরণের ভিতর দিয়ে তারা রাষ্ট্রশক্তির একাংশকে ব্যবহার করে, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলমানের ভাগ করে, মেরুকরণের রাজনীতিকে একটা ভয়ংকর জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়েই হিন্দুত্ববাদী শিবির, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতাকে তারা সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত করেছে। আর সেই আধিপত্যবাদী রাজনীতির জেরেই আইন আদালতকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে, একটি পবিত্র মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপরে বিতর্কিত রাম মন্দির উদ্বোধন পর্যন্ত তারা করেছে। তারপরেই আসন্ন লোকসভা ভোটকে (২০২৪) আরো বেশি প্রভাবিত করবার লক্ষ্যে কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে তারা নতুন করে ভয়ংকর রকমের আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছে।

ড. পট্টাভি সীতারামাইয়া, তার ‘ফেদার্স অ্যান্ড স্টোন’ বইতে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণসহ কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের গর্ভ গৃহের নিচে, একটি গোপন প্রকোষ্ঠে, মন্দিরের পা-াদের দ্বারা, কচ্ছের রাণীদের গণধর্ষণের ঘটনাক্রমের বিবরণ রেখেছেন। এই ভয়ংকর ঘটনার পর কাশীর হিন্দু রাজা, বিশ্বনাথ মন্দিরের পা-াদের শায়েস্তা করতে না পেরে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে মন্দিরের পা-াদের মন্দিরের অভ্যন্তরে এই নারী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছিলেন।

কাশীর হিন্দু রাজার কিছু অবলা রমণীকে বাঁচানোর কাতর আবেদনের ভিত্তিতে সম্রাট আওরঙ্গজেব বিশ্বনাথ মন্দিরের অপরাধী পা-াদের শায়েস্তা করেন। এ তথ্য-প্রমাণের স্বপক্ষে ড. পট্টাভি সীতারামাইয়া একাধিক ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ, তার ওই গ্রন্থে উপস্থাপিত করেছিলেন। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগেই গ্রন্থটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শিবির সীতারামাইয়ার এই গবেষণা কর্ম সম্পর্কে বিপরীত ধর্মী কোনো তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। এমনকি এ বিতর্ককে ও খুব একটা জোরদারভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেননি।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময় থেকে আরএসএস যেভাবে রাজনৈতিক হিন্দু ভারত নির্মাণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেই প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসেবে পবিত্র জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে এ ধরনের বিকৃত ঐতিহাসিক উপস্থাপনা তারা রাখতে শুরু করে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে।

হিন্দুত্ববাদী শিবির যাতে কোনো অবস্থাতে পবিত্র জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে কোনো ধরনের নাশকতা চালাতে না পারে, সেজন্য উত্তর প্রদেশের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব, পবিত্র মসজিদ টিকে ঘিরে কিছু সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যার জেরে পবিত্র মসজিদের মধ্যে ঢুকে পড়ে, ধর্মের নাম করে একদল দুষ্কৃতকারী যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পূজার্চনা করবার প্রচলন করেছিল, সেটি বাধাপ্রাপ্ত হয়।

মুলায়ম সিং যাদবের জারি করা সেই নিষেধাজ্ঞার পরে রাজনৈতিক হিন্দু পূজারীরা আর পবিত্র মসজিদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি এবং তথাকথিত পূজার্চনা ও করতে পারেনি। আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, গত ২০১৪ সালে একক ক্ষমতায় কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর থেকেই অযোধ্যায় ঐতিহাসিক রামমন্দিরের ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির নির্মাণের কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গেই কাশীর (বেনারস) জ্ঞানবাপী মসজিদকে ও তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে নিয়ে আসে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আবার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ভারতে সরকার গঠনের পর, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়িকতাকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত করে যে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন তারা চালাচ্ছে গোটা ভারতব্যাপী, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো এ মসজিদটি ঘিরে তাদের আগ্রাসী মনোভাব।

হিন্দুত্ববাদীদের ধারাবাহিক কর্মকা-, অজয় সিং বিশোয়াত, ওরফে স্বঘোচিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথ, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে অযোধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা বারানসীজুড়ে, রাজনৈতিক হিন্দু আধিপত্যবাদের যে ভয়ংকর কর্মকা- শুরু করেছে, তার অঙ্গ হিসেবে বেনারস শহরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের একটা অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বারানসীর বিশ্বনাথ মন্দিরের সংস্কারের নাম করে গোটা এলাকায় ছোট ছোট ব্যবসায়ী, যাদের বেশিরভাগই জন্মসূত্রে মুসলমান, তাদের গণহারে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিশ্বনাথ মন্দির লাগোয়া এলাকায় যেসব ছোট ছোট হিন্দু ব্যবসায়ী ছিলেন বিশ্বনাথ করিটরের নাম করে উচ্ছেদের সময় তাদের উচ্ছেদ করা হলেও তাদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কিন্তু গরিব ছোট দোকানদার, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান তাদের পুনর্বাসনের কোনো কাজই হয়নি।

এ চিত্র যে কেবলমাত্র বেনারস শহরের তা নয়। কেবল উত্তর প্রদেশের তাও নয়। গোটা গোবলয়জুড়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর নানা আকারে অর্থনৈতিক অবরোধ হিন্দু আধিপত্যবাদীদের গত দশ বছরে ভারতে এক ব-াহীন জায়গায় এসে পৌঁছেছে। ভারতের লোকসভা নির্বাচন (২০২৪) যত এগিয়ে আসছে, তত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্বার্থে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীরকে ভয়াবহ করে তুলতে বিভিন্ন মন্দির মসজিদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্ববাদীরা যে সমস্ত কর্মকা- ক্রমাগত করে চলেছে, তার এক সাম্প্রদায়িকতার জতুগৃহের মধ্যে বর্তমান ভারতকে বসবাস কারতে শুরু করেছে।

জ্ঞানবাপী মসজিদকে ঘিরে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্ট যে অবস্থান গ্রহণ করেছে, সেই অবস্থানকে কতখানি নিরপেক্ষ অবস্থান বলে চিহ্নিত করা যায়, তা নিয়ে গোটা ভারতে বড় রকমের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট যেভাবে জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্কে, সরাসরি রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের প্রতি পক্ষপতিত্ব দেখিয়ে চলেছে, তা কেবলমাত্র হিন্দি বলয়তেই নয়, হিন্দি বলয় থেকে বহু দূরে বাংলা মুলুকেও সামাজিক বিভাজনের অক্ষরেখাটিকে একটা চরম জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

জ্ঞানবাপী মসজিদে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে উপাসনার ক্ষেত্রে, যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন মুলায়াম সেই নিষেধাজ্ঞা ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবার পক্ষে একটি অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই পদক্ষেপকে পদদলিত করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাস্তাকে যেভাবে নতুন করে খুলে দিলেন, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। এলাহাবাদ হাইকোর্ট, জ্ঞানবাপী মসজিদকে কেন্দ্র করে, হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন, এমনকি দাঙ্গার রাস্তাকে যে নতুন করে খুলে দিলেন তাই-ই নয়। ভারতের সহ-নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের আইনি অধিকারকে পর্যন্ত সংকুচিত করে দিলেন। আরএসএস-বিজেপি মুসলমানকে যে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে চায়, তাদের সেই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে প্রশাসনিক সিলমোহর দেওয়ার ক্ষেত্রে এলাহাবাদ হাইকোর্টের জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে অবস্থান অনেকখানি সহায়ক হবে।

জ্ঞানবাপী মসজিদের সুরক্ষা ঘিরে মসজিদ কমিটির উচ্চ আদালতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করতে উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার যে অবস্থান নিলেন তাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই। তবে উত্তর প্রদেশের চরম প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার, সহ-নাগরিক মুসলমানদের, নাগরিক অধিকার, ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কোনোভাবেই সচেষ্ট হবে নাÑ সেটা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত, ভারতের নাগরিকেরা আগে থেকেই খুব ভালোভাবে জানতেন। তবুও ভারতের সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া একটি সরকার, হিন্দু সম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে সহ-নাগরিক মুসলমানদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এতখানি পক্ষপাতমূলক আচরণ করবেÑ এটা যেন সাধারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না;

কিন্তু দেখা গেল জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে মুসলমান সমাজকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সমস্ত রকমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে উত্তর প্রদেশ সরকার যেভাবে সরাসরি পবিত্র মসজিদের অভ্যন্তরে পূজার কর্মকা- শুরু করতে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করল, তা আগামী নির্বাচনকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজে বেনারস ঘিরে একটা আবেগ কাজ করে। সেই আবেগের মধ্যে আধ্যাত্মিক আকুলতা থাকলেও ধর্মান্ধতার জায়গা অতীতে তেমন একটা ছিল না; কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগের কিছু সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজে বেনারস বা সেখানকার বিশ্বনাথ মন্দির ঘিরে, ধর্মীয় আবেগকে ধর্মান্ধতায় পরিণত করবার জন্যই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি এ রাজ্যে সমানভাবে সক্রিয়। বেনারসের সোনারপুরা নামক এলাকায় একটা সময় যথেষ্ট বাঙালি জনবসতি ছিল। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিদের একটা অংশের মানুষের বাড়িঘর-দুয়ারও সেখানে ছিল। ক্রমান্বয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের জেরে আজ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজ গোটা গোবলয়ের মতোই বেনারসে অত্যন্ত কোণঠাসা। তবুও সেই কোণঠাসা হিন্দু বাঙালিকে ধর্মান্ধতায় মাতিয়ে দিতে আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রচেষ্টার অঙ্গ হলোÑ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালির একটা বড় অংশকে একটা সাম্প্রদায়িক প্ররোচনার জগতে এনে দাঁড় করানো।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর বিতর্কিত রামমন্দিরের উদ্বোধনের পর কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের পথে আরএসএস-বিজেপি হাঁটছে তা নিয়ে গোটা দেশে বামপন্থিরা অত্যন্ত সরব; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানকার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বা তাদের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত একটা শব্দও এ নিয়ে উচ্চারণ করেননি।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট জ্ঞানবাপী ঘিরে যে রায় দান করেছেন, তা কতখানি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অনুমোদন করে, সেই প্রশ্ন যখন চারিদিক থেকে উঠছে। তখন এলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই রায় সম্পর্কে একটা শব্দ আজ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্চারণ করেননি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে ব্যবহার করে উত্তর প্রদেশে বিজেপির সরকারের ক্ষমতায় থাকবার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পবিত্র মসজিদের মধ্যে যেভাবে হিন্দু ধর্মের ক্রিয়াকর্ম শুরু করেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির, অথচ মসজিদে পবিত্র নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা যখন সমবেত হলো পুলিশ-প্রশাসন তাদের সেখানে বাধা দিয়েছে। এই যে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণকারী কর্মকা- এ সম্পর্কে গোটা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি দল এবং বিভিন্ন ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক

গৌতম রায়

image

জ্ঞানবাপী মসজিদ

শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ভারতের আসন্ন লোকসভা ভোটকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ভিত্তিতে পরিচালিত করবার জন্য গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির ভারতজুড়ে যে ভয়ংকর কর্মকা- চালাচ্ছে, তাতে নতুন করে সংযোজিত হচ্ছে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক। হিন্দুত্ববাদী শিবির, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকেই সেøাগান দিয়ে চলেছে যে, এটা তো কেবল ট্রেলার। এখনো কাশি, মথুরা বাকি আছে।

গোটা ভারতে সমন্বয়ী সংস্কৃতির যে কিছু আদর্শ, কীর্তি, সৌধ আছে সমস্ত কিছুর পেছনে মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির আজগুবি, অসত্য তত্ত্বকে খাড়া করা, হিন্দু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক কর্মসূচির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেভাবেই তারা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ঘিরে রামের জন্মভূমির এক অনৈতিহাসিক, অবাস্তব তত্ত্ব হাজির করেছিল। যে তত্ত্বের বাজারীকরণের ভিতর দিয়ে তারা রাষ্ট্রশক্তির একাংশকে ব্যবহার করে, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলমানের ভাগ করে, মেরুকরণের রাজনীতিকে একটা ভয়ংকর জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। এভাবেই সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়েই হিন্দুত্ববাদী শিবির, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতাকে তারা সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত করেছে। আর সেই আধিপত্যবাদী রাজনীতির জেরেই আইন আদালতকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে, একটি পবিত্র মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপরে বিতর্কিত রাম মন্দির উদ্বোধন পর্যন্ত তারা করেছে। তারপরেই আসন্ন লোকসভা ভোটকে (২০২৪) আরো বেশি প্রভাবিত করবার লক্ষ্যে কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে তারা নতুন করে ভয়ংকর রকমের আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছে।

ড. পট্টাভি সীতারামাইয়া, তার ‘ফেদার্স অ্যান্ড স্টোন’ বইতে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণসহ কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের গর্ভ গৃহের নিচে, একটি গোপন প্রকোষ্ঠে, মন্দিরের পা-াদের দ্বারা, কচ্ছের রাণীদের গণধর্ষণের ঘটনাক্রমের বিবরণ রেখেছেন। এই ভয়ংকর ঘটনার পর কাশীর হিন্দু রাজা, বিশ্বনাথ মন্দিরের পা-াদের শায়েস্তা করতে না পেরে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে মন্দিরের পা-াদের মন্দিরের অভ্যন্তরে এই নারী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছিলেন।

কাশীর হিন্দু রাজার কিছু অবলা রমণীকে বাঁচানোর কাতর আবেদনের ভিত্তিতে সম্রাট আওরঙ্গজেব বিশ্বনাথ মন্দিরের অপরাধী পা-াদের শায়েস্তা করেন। এ তথ্য-প্রমাণের স্বপক্ষে ড. পট্টাভি সীতারামাইয়া একাধিক ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ, তার ওই গ্রন্থে উপস্থাপিত করেছিলেন। গত শতাব্দীর প্রথম ভাগেই গ্রন্থটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শিবির সীতারামাইয়ার এই গবেষণা কর্ম সম্পর্কে বিপরীত ধর্মী কোনো তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। এমনকি এ বিতর্ককে ও খুব একটা জোরদারভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেননি।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময় থেকে আরএসএস যেভাবে রাজনৈতিক হিন্দু ভারত নির্মাণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেই প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসেবে পবিত্র জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে এ ধরনের বিকৃত ঐতিহাসিক উপস্থাপনা তারা রাখতে শুরু করে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে।

হিন্দুত্ববাদী শিবির যাতে কোনো অবস্থাতে পবিত্র জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে কোনো ধরনের নাশকতা চালাতে না পারে, সেজন্য উত্তর প্রদেশের সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব, পবিত্র মসজিদ টিকে ঘিরে কিছু সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যার জেরে পবিত্র মসজিদের মধ্যে ঢুকে পড়ে, ধর্মের নাম করে একদল দুষ্কৃতকারী যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পূজার্চনা করবার প্রচলন করেছিল, সেটি বাধাপ্রাপ্ত হয়।

মুলায়ম সিং যাদবের জারি করা সেই নিষেধাজ্ঞার পরে রাজনৈতিক হিন্দু পূজারীরা আর পবিত্র মসজিদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি এবং তথাকথিত পূজার্চনা ও করতে পারেনি। আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, গত ২০১৪ সালে একক ক্ষমতায় কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর থেকেই অযোধ্যায় ঐতিহাসিক রামমন্দিরের ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির নির্মাণের কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গেই কাশীর (বেনারস) জ্ঞানবাপী মসজিদকে ও তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে নিয়ে আসে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আবার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ভারতে সরকার গঠনের পর, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়িকতাকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত করে যে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন তারা চালাচ্ছে গোটা ভারতব্যাপী, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো এ মসজিদটি ঘিরে তাদের আগ্রাসী মনোভাব।

হিন্দুত্ববাদীদের ধারাবাহিক কর্মকা-, অজয় সিং বিশোয়াত, ওরফে স্বঘোচিত ‘যোগী’ আদিত্যনাথ, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে অযোধ্যার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা বারানসীজুড়ে, রাজনৈতিক হিন্দু আধিপত্যবাদের যে ভয়ংকর কর্মকা- শুরু করেছে, তার অঙ্গ হিসেবে বেনারস শহরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের একটা অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বারানসীর বিশ্বনাথ মন্দিরের সংস্কারের নাম করে গোটা এলাকায় ছোট ছোট ব্যবসায়ী, যাদের বেশিরভাগই জন্মসূত্রে মুসলমান, তাদের গণহারে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিশ্বনাথ মন্দির লাগোয়া এলাকায় যেসব ছোট ছোট হিন্দু ব্যবসায়ী ছিলেন বিশ্বনাথ করিটরের নাম করে উচ্ছেদের সময় তাদের উচ্ছেদ করা হলেও তাদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কিন্তু গরিব ছোট দোকানদার, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান তাদের পুনর্বাসনের কোনো কাজই হয়নি।

এ চিত্র যে কেবলমাত্র বেনারস শহরের তা নয়। কেবল উত্তর প্রদেশের তাও নয়। গোটা গোবলয়জুড়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর নানা আকারে অর্থনৈতিক অবরোধ হিন্দু আধিপত্যবাদীদের গত দশ বছরে ভারতে এক ব-াহীন জায়গায় এসে পৌঁছেছে। ভারতের লোকসভা নির্বাচন (২০২৪) যত এগিয়ে আসছে, তত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্বার্থে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীরকে ভয়াবহ করে তুলতে বিভিন্ন মন্দির মসজিদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্ববাদীরা যে সমস্ত কর্মকা- ক্রমাগত করে চলেছে, তার এক সাম্প্রদায়িকতার জতুগৃহের মধ্যে বর্তমান ভারতকে বসবাস কারতে শুরু করেছে।

জ্ঞানবাপী মসজিদকে ঘিরে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্ট যে অবস্থান গ্রহণ করেছে, সেই অবস্থানকে কতখানি নিরপেক্ষ অবস্থান বলে চিহ্নিত করা যায়, তা নিয়ে গোটা ভারতে বড় রকমের প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট যেভাবে জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্কে, সরাসরি রাজনৈতিক হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের প্রতি পক্ষপতিত্ব দেখিয়ে চলেছে, তা কেবলমাত্র হিন্দি বলয়তেই নয়, হিন্দি বলয় থেকে বহু দূরে বাংলা মুলুকেও সামাজিক বিভাজনের অক্ষরেখাটিকে একটা চরম জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

জ্ঞানবাপী মসজিদে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে উপাসনার ক্ষেত্রে, যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন মুলায়াম সেই নিষেধাজ্ঞা ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবার পক্ষে একটি অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই পদক্ষেপকে পদদলিত করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাস্তাকে যেভাবে নতুন করে খুলে দিলেন, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। এলাহাবাদ হাইকোর্ট, জ্ঞানবাপী মসজিদকে কেন্দ্র করে, হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন, এমনকি দাঙ্গার রাস্তাকে যে নতুন করে খুলে দিলেন তাই-ই নয়। ভারতের সহ-নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের আইনি অধিকারকে পর্যন্ত সংকুচিত করে দিলেন। আরএসএস-বিজেপি মুসলমানকে যে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে চায়, তাদের সেই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে প্রশাসনিক সিলমোহর দেওয়ার ক্ষেত্রে এলাহাবাদ হাইকোর্টের জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে অবস্থান অনেকখানি সহায়ক হবে।

জ্ঞানবাপী মসজিদের সুরক্ষা ঘিরে মসজিদ কমিটির উচ্চ আদালতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করতে উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার যে অবস্থান নিলেন তাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই। তবে উত্তর প্রদেশের চরম প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার, সহ-নাগরিক মুসলমানদের, নাগরিক অধিকার, ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যাপারে কোনোভাবেই সচেষ্ট হবে নাÑ সেটা ধর্মনিরপেক্ষ ভারত, ভারতের নাগরিকেরা আগে থেকেই খুব ভালোভাবে জানতেন। তবুও ভারতের সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া একটি সরকার, হিন্দু সম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে সহ-নাগরিক মুসলমানদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এতখানি পক্ষপাতমূলক আচরণ করবেÑ এটা যেন সাধারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না;

কিন্তু দেখা গেল জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে মুসলমান সমাজকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সমস্ত রকমের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে উত্তর প্রদেশ সরকার যেভাবে সরাসরি পবিত্র মসজিদের অভ্যন্তরে পূজার কর্মকা- শুরু করতে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করল, তা আগামী নির্বাচনকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজে বেনারস ঘিরে একটা আবেগ কাজ করে। সেই আবেগের মধ্যে আধ্যাত্মিক আকুলতা থাকলেও ধর্মান্ধতার জায়গা অতীতে তেমন একটা ছিল না; কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগের কিছু সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজে বেনারস বা সেখানকার বিশ্বনাথ মন্দির ঘিরে, ধর্মীয় আবেগকে ধর্মান্ধতায় পরিণত করবার জন্যই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি এ রাজ্যে সমানভাবে সক্রিয়। বেনারসের সোনারপুরা নামক এলাকায় একটা সময় যথেষ্ট বাঙালি জনবসতি ছিল। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিদের একটা অংশের মানুষের বাড়িঘর-দুয়ারও সেখানে ছিল। ক্রমান্বয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের জেরে আজ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি সমাজ গোটা গোবলয়ের মতোই বেনারসে অত্যন্ত কোণঠাসা। তবুও সেই কোণঠাসা হিন্দু বাঙালিকে ধর্মান্ধতায় মাতিয়ে দিতে আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রচেষ্টার অঙ্গ হলোÑ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালির একটা বড় অংশকে একটা সাম্প্রদায়িক প্ররোচনার জগতে এনে দাঁড় করানো।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর বিতর্কিত রামমন্দিরের উদ্বোধনের পর কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ ঘিরে যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের পথে আরএসএস-বিজেপি হাঁটছে তা নিয়ে গোটা দেশে বামপন্থিরা অত্যন্ত সরব; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানকার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বা তাদের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত একটা শব্দও এ নিয়ে উচ্চারণ করেননি।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট জ্ঞানবাপী ঘিরে যে রায় দান করেছেন, তা কতখানি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অনুমোদন করে, সেই প্রশ্ন যখন চারিদিক থেকে উঠছে। তখন এলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই রায় সম্পর্কে একটা শব্দ আজ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্চারণ করেননি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে ব্যবহার করে উত্তর প্রদেশে বিজেপির সরকারের ক্ষমতায় থাকবার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পবিত্র মসজিদের মধ্যে যেভাবে হিন্দু ধর্মের ক্রিয়াকর্ম শুরু করেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির, অথচ মসজিদে পবিত্র নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা যখন সমবেত হলো পুলিশ-প্রশাসন তাদের সেখানে বাধা দিয়েছে। এই যে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণকারী কর্মকা- এ সম্পর্কে গোটা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি দল এবং বিভিন্ন ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top