মিহির কুমার রায়
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ২৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছে, বিশ্বে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু কেন এত আমদানি? খাদ্য উৎপাদনের অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। তারপরও অনেক খাদ্যপণ্যই আমাদেরকে আমাদানি করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থানে অবস্থান করে বিশ্ব পরিম-লে সমাদৃত। বর্তমানে বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০২২ সালে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় ও সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দেশ আজ কৃষিতে সমৃদ্ধ। কৃষির এই অভাবনীয় সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১১১টি জাত, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ধান, পাঠ, গম, তেলবীজ, সবজি ও মসলা জাতীয় শস্যের ১৯টি উচ্চ ফলনশীল এবং উন্নত গুণসম্পন্ন ১১৪টি জাত, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২১০টির অধিক ফসলের ৭০০টি প্রযুক্তি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ২১টি জাত, বিজেআরআই ৬৪টি জাত, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ইক্ষুর ৪৮টি ও সুগারবিট তাল ও স্টিভিয়ার জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশি ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের এহেন খাদ্য সাহায্যনির্ভরতা মারাত্মক পর্যায়ে ছিল। ১৯৯৯ সালে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এরপর দুই বছরের মধ্যে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল ২০১১ সালে। এরপর গত ১২ বছরের মধ্যে ২ বছর ছাড়া ১০ বছর দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে চলেছে কিংবা উদ্বৃত্ত ধান উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু দুধ, পেঁয়াজ, মসলা, বিভিন্ন ধরনের ডাল, তৈল বীজ, খেজুর, বিভিন্ন ফল, শাকসবজি, হাঁস-মুরগির মাংস ইত্যাদিতে বাংলাদেশ কি স্বনির্ভর হয়েছে? সব সাফল্যগুলোকে খাটো না করেও স্বীকার করতে হবে যে খাদ্য আমদানিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক হওয়া বাংলাদেশের জন্য কি স্বাভাবিক? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে। ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো, ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে। গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় হয়। মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে সাধারণ চিত্র, গম উৎপাদন বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই বিধায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছর । একসময় সরিষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বর্তমানে এই ধারা রক্ষা করা যায়নি উচ্চফলনশীল বোরো ধান চাষের কারনে। বাংলাদেশে আমদানিনির্ভর হওয়ার প্রশ্নে সতর্কও হতে হবে। বিশেষত জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেবে ঝুঁকি। যেমন, চালের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর হওয়া যাবে না। তারপরও কিছু চাল আমদানি হচ্ছে, গম তো সিংহভাগ আমদানিই করতে হয়, ভোজ্যতেল ও চিনির প্রায় পুরোটা আমদানিনির্ভর। এ দুটি পণ্য আবার আনে মাত্র কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে সিন্ডিকেশনের প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক। তাই সার্বিক বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে অনুভব করতে হবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশজ উৎপাদন বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আগামী দিনে আবহাওয়া-সহনশীল জাতের গম চাষে জোর দিতে হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শীতের দীর্ঘতা ও তীব্রতা বেশি হওয়ায় ওই অঞ্চলে গম আবাদে জোর দিতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে একটি জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে আগামী মার্চ ও এপ্রিলে কী পরিমাণ চাল আমদানি প্রয়োজন হতে পারে এবং তদনুযায়ী চাল আমদানির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গম আমদানিতেও অনুরূপ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
[লেখক: ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]
মিহির কুমার রায়
সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত ২৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছে, বিশ্বে খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ফিলিপাইনের পর বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু কেন এত আমদানি? খাদ্য উৎপাদনের অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। তারপরও অনেক খাদ্যপণ্যই আমাদেরকে আমাদানি করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থানে অবস্থান করে বিশ্ব পরিম-লে সমাদৃত। বর্তমানে বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০২২ সালে দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের নিরলস প্রচেষ্টায় ও সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দেশ আজ কৃষিতে সমৃদ্ধ। কৃষির এই অভাবনীয় সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১১১টি জাত, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ধান, পাঠ, গম, তেলবীজ, সবজি ও মসলা জাতীয় শস্যের ১৯টি উচ্চ ফলনশীল এবং উন্নত গুণসম্পন্ন ১১৪টি জাত, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২১০টির অধিক ফসলের ৭০০টি প্রযুক্তি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ২১টি জাত, বিজেআরআই ৬৪টি জাত, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ইক্ষুর ৪৮টি ও সুগারবিট তাল ও স্টিভিয়ার জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশি ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও উন্মুক্ত করা হয়েছে। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের এহেন খাদ্য সাহায্যনির্ভরতা মারাত্মক পর্যায়ে ছিল। ১৯৯৯ সালে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এরপর দুই বছরের মধ্যে দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল ২০১১ সালে। এরপর গত ১২ বছরের মধ্যে ২ বছর ছাড়া ১০ বছর দেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে চলেছে কিংবা উদ্বৃত্ত ধান উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু দুধ, পেঁয়াজ, মসলা, বিভিন্ন ধরনের ডাল, তৈল বীজ, খেজুর, বিভিন্ন ফল, শাকসবজি, হাঁস-মুরগির মাংস ইত্যাদিতে বাংলাদেশ কি স্বনির্ভর হয়েছে? সব সাফল্যগুলোকে খাটো না করেও স্বীকার করতে হবে যে খাদ্য আমদানিতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক হওয়া বাংলাদেশের জন্য কি স্বাভাবিক? জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হচ্ছে আর ১ কোটি ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করছে। ভোজ্যতেলের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত খাদ্যের মোট চাহিদার ৯ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি করা হতো, ২০২২ সালে খাদ্য আমদানি চাহিদার ১১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাড়ার কারণে বাজার থেকে খাদ্য কেনার সক্ষমতা এই তিন বছরে বেড়েছে, তেমনি দেশের খাদ্য আমদানির আর্থিক সক্ষমতাও বেড়েছে। গম, ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় হয়। মসলাপাতি, ডাল ও ফল আমদানি বাংলাদেশে সাধারণ চিত্র, গম উৎপাদন বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই বিধায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছর । একসময় সরিষা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বর্তমানে এই ধারা রক্ষা করা যায়নি উচ্চফলনশীল বোরো ধান চাষের কারনে। বাংলাদেশে আমদানিনির্ভর হওয়ার প্রশ্নে সতর্কও হতে হবে। বিশেষত জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেবে ঝুঁকি। যেমন, চালের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর হওয়া যাবে না। তারপরও কিছু চাল আমদানি হচ্ছে, গম তো সিংহভাগ আমদানিই করতে হয়, ভোজ্যতেল ও চিনির প্রায় পুরোটা আমদানিনির্ভর। এ দুটি পণ্য আবার আনে মাত্র কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে সিন্ডিকেশনের প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক। তাই সার্বিক বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে অনুভব করতে হবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশজ উৎপাদন বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আগামী দিনে আবহাওয়া-সহনশীল জাতের গম চাষে জোর দিতে হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শীতের দীর্ঘতা ও তীব্রতা বেশি হওয়ায় ওই অঞ্চলে গম আবাদে জোর দিতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে একটি জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে আগামী মার্চ ও এপ্রিলে কী পরিমাণ চাল আমদানি প্রয়োজন হতে পারে এবং তদনুযায়ী চাল আমদানির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গম আমদানিতেও অনুরূপ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
[লেখক: ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]