alt

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু সম্মেলন এবং নয়া উদারবাদী কর্তৃত্ব

পাভেল পার্থ

: মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

চারদিকে কেবল দালান আর দালান। দুবাই যেন এক দালানের শহর। এ শহরের এক্সপোসিটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৮তম বিশ^ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ সম্মেলন শেষ হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ইউনিয়ন থেকে বুর্জখলিফা যাওয়ার পথে মেট্রোতে আলাপ হয় বেনিন থেকে আসা কোপোকামে কে হারম্যানের সঙ্গে। রেডিও বেনিনের এই সাংবাদিক জানান, ‘..ব্রোঞ্জ এবং হাতির দাঁতের বাণিজ্যের কারণে বেনিন দীর্ঘসময় ঔপনিবেশিক শাসনের ভেতর ছিল। যেমন ছিল আইভরি কোস্ট। এখন বিশ^ব্যাপী হাতি বিপন্ন। এখনো চোরাই হাতির দাঁত বাণিজ্য হয়, হাতি খুন হয়। এই দাঁত চীনে চলে যায়। সর্বত্রই আজ চীনের বাজার। এক উপনিবেশের পর আরেক উপনিবেশ। এমনকি এই চীনই সবচে বেশি কার্বণ নিঃসরণ করছে; কিন্তু জলবায়ু সুরক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।’

জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেয়া এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র কিংবা কানাডার বহুজনের সঙ্গে আলাপেই জানা যায়, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ প্রতিটি দেশের নি¤œবর্গের জীবনে কী নির্দয় উপনিবেশিক বাহাদুরি জারি ছিল। এখন এই ঔপনিবেশিকতার বৈশি^ক চেহারা ও নিপীড়নের ধরন পাল্টেছে। তথাকথিত মুক্তবাজার ও বিশ^ায়নের নামে দুনিয়া আজ বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির উপনিবেশে বন্দী। উন্নত ও ধনী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলোর ক্রমাগত কার্বণ নিঃসরণ আজ পৃথিবী নামের সৌরজগতের এক ছোট্টগ্রহকে অসুস্থ ও ভঙ্গুর করে দিয়েছে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার বিনাশী ভোগবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে গ্রাম থেকে শহর, দ্বীপ থেকে অরণ্য কিংবা পাহাড় থেকে সমতলে।

বিশ^নেতৃত্ব পৃথিবী সুরক্ষায় এর আগে ২৭টি জলবায়ু সম্মেলনে নানা অঙ্গীকার করলেও প্রতিনিয়ত তা বরখেলাপ করছেন। দীর্ঘ করোনা মহামারীর ক্ষত শুকাতে না শুকাতে প্রশ্নহীনভাবে জারি আছে যুদ্ধ ও গণহত্যা। সিরিয়া থেকে সম্মেলনে যোগ দেয়া সাংবাদিক রুলা আসাদের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘..যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধ না করে জলবায়ু ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। গাজায় শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে অন্যায়ভাবে। অস্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে একটি যুদ্ধ চালানোর যাবতীয় কর্মকান্ড জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা ঝুঁকি বাড়াবো না কমাব। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আমরা ঝুঁকি হ্রাসের অঙ্গীকার করেছিলাম। নিজেদের অঙ্গীকারগুলো বারবার ভুলে যাওয়া অন্যায়।’

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধ করে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বেশ কিছু আলোচনা ও প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছেন আলা কানান। জানালেন যুদ্ধের ভেতর কেমন ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়েছে। এমনকি প্রায় সময়টাই ফিলিস্তিন প্যাভিলিয়ন খালি পড়েছিল। বহু মানুষ এখান থেকে খুফিয়া নিতে এসেছেন। সম্মেলনে বহুজনের গলায় খুফিয়া দেখা গেছে। ভারতীয় তরুণ শিল্পী শিলো শিব সুলেমান এক শাড়িকে পরিণত করলেন দীর্ঘতম এক খুফিয়ায়। আর এই খুফিয়া নিয়ে দুবাই সম্মেলনে হেঁটেছেন অধিকারকর্মীরা। ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইরানের রাষ্ট্রপক্ষের একটি দল প্রতিবাদ জানিয়ে প্রথম সপ্তাহেই জলবায়ু সম্মেলন ত্যাগ করে। মায়ানমার সম্মেলনে অংশ নেয়নি। ইসরাইল ‘খাদ্য অপচয়’ নিয়ে পূর্বনির্ধারিত একটি সহ-অধিবেশন হঠাৎ বাতিল করে।

জলবায়ু পরিবর্তন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। জোর করে অস্বীকারের কোনো উপায় নাই। দুবাই জলবায়ু সম্মেলন শুরু হতে না হতে ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে ভূমিকম্প, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস, ভারতে ঘূর্ণিঝড়। প্রাণহানি ও বিনাশের খবরে বহুজনের চোখে বিষাদ দেখেছি। তাঞ্জানিয়ার রাষ্ট্রপতি সামিয়া সুলুহু হাসানকে সফর সংক্ষেপ করে ফিরে যেতে হয়েছে। জলবায়ুজনিত ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের অঙ্গীকার দিয়ে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনের শুরুকে অনেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে এই তহবিল কিভাবে কাদের মাধ্যমে কাদের কাছে যাবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এখানে বিশ^ব্যাংক, এডিবি কিংবা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব কতটুকু তা স্পষ্ট করতে হবে। বিশেষ করে তহবিল ও অর্থায়নের উৎস এবং ব্যবস্থাপনা উন্মুক্ত, ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহির ভেতর থাকতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল উগান্ডার প্রতিনিধি প্রসকভিয়ার ন্যানইয়নজু ভিকম্যান এ বিষয়ে জানান, ‘...লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড নিয়ে অবশ্যই আমাদের আলোচনা করা দরকার। তহবিলের উৎস ও ব্যবস্থাপনা সবকিছু স্বচ্ছ হতে হবে। বহু কোম্পানি তাদের লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যারা ক্লিন এনার্জি নিয়ে কথা বলছে কিন্তু এনার্জি ট্রান্সজিশনের কথা বলছে না জোরদারভাবে। জলবায়ু অর্থায়নের কোনো কিছু আমাদের কাছ থেকে গোপন করা যাবে না।’

সম্মেলনের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ২০২৩-২০৩১ সৌরসেচের স্কেলআপ রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হয়। জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে সেচকার্যক্রমকে সৌরবিদ্যুৎ নির্ভর করার জন্য রোডম্যাপটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে। ২০৪০ সালের ভেতর জ¦ালানি খাতকে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে রূপান্তর করতে চায় বাংলাদেশ। সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণেরও দাবি জানায় বাংলাদেশ। ‘বৈশি^ক অভিযোজন লক্ষ্যের’ খসড়া নিয়ে আলাপ তুলেছে বাংলাদেশ। ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু তহবিল, সবুজ জলবায়ু তহবিল, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য তহবিল, অভিযোজন তহবিল এবং বৈশি^ক পরিবেশ সহায়তা তহবিলসমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন করে সব তহবিলে বাংলাদেশের দ্রুত ও সহজ অভিগম্যতা দাবি করেছে বাংলাদেশ। সম্মেলনের সপ্তম দিনে জীবাশ্ম জ¦ালানি রোধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনা এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও জাপান ছাড়া ১০৬টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার সুপারিশ দিয়ে আরেকটি প্রস্তাব এনেছে, যাতে চীন ও ভারত সম্মত নয়।

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্য ও খাদ্যব্যবস্থা নিয়ে বিশ^নেতৃত্ব আলাপ শুরু করেছেন। সম্মেলন থেকে তৈরি লেখাগুলো পড়ে হোয়াটসঅ্যাপে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ করেন ‘প্রকৃতিবীক্ষণের’ বিপুল কুমার শর্মা। জানান, লেখাগুলো তাকে ভারতের পরিবেশবিজ্ঞানীবন্দনা শিবার ‘হু রিয়েলি ফিডস দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটি বাংলায় অনুবাদ করতে সহায়তা করছে। বইটিতে শিবা লিখেন, ‘দুনিয়ায় ৭০ ভাগ খাদ্যের জোগান দেয় পৃথিবীর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং মাত্র ৩০ ভাগ খাদ্য আসে বিশালসব বাণিজ্যিক খামার থেকে; কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষিই পৃথিবীর খাদ্য জোগায় এমন মিথ সর্বত্র ছড়ানো হয়।’

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে সমাধানহীন তর্ক চলছে বহুজাতিক কোম্পানির বহু লবিস্টের অংশগ্রহণ নিয়ে। তারা বহু অধিবেশন, আলোচনা, সভা সর্বত্র অংশ নিয়ে ‘অবৈজ্ঞানিক’ নানা বিতর্ক তৈরি করছেন। বৃহৎ বাণিজ্যিক কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি, কৃষি রাসায়নিক কোম্পানি, বীজ কোম্পানি, মাংস কোম্পানির লবিস্টে জলবায়ু সম্মেলন সয়লাব। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাংস কোম্পানি ব্রাজিলের ‘জেবিএস’, সিনথেটিক সার কোম্পানি ‘নিওট্রেইন’ খাদ্য কোম্পানি ‘নেসলে’ কিংবা পেস্টিসাইড কোম্পানি ‘বায়ার’ এর কোম্পানির লবিস্টরা জলবায়ু সম্মেলনে কর্তৃত্ব তৈরি করছে। যেখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ একত্র হয়ে এক রুগ্ণ ভঙ্গুর পৃথিবীতে বাঁচানোর চেষ্টা করছে সেখানে এই কোম্পানিরা তাদের ‘মিথ্যা জলবায়ু সমাধানের’ বিজ্ঞাপন নিয়ে একটা ভিন্ন ন্যারেটিভ ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চাইছে।

প্রায় ১০২ জন বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিনিধি রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্বের প্রায় ৩০ ভাগ, যদিও মিসর সম্মেলনে এদের উপস্থিতি ছিল ৬ ভাগ। সবচেয়ে বেশি বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিনিধি ব্রাজিল থেকে এসেছেন, প্রায় ৩৬ জন, যাদের প্রায় সবাই বৃহৎসব মাংস উৎপাদনকারী কোম্পানির সঙ্গে জড়িত। পরবর্র্তী সারিতে আছেন রাশিয়া এবং কানাডার সিনথেটিক সার কোম্পানির লবিস্টরা। বায়ার কোম্পানির বিষ বা সিনজেনটা কোম্পানির হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে সর্বস্বান্ত হওয়া বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের বঞ্চিত কৃষকেরা যেন মনে হলো দূর থেকে কী প্রশ্ন করছেন। কিংবা নেসলের ম্যাগি নুডলসে সিসা এবং কোক-পেপসির প্লাস্টিক দূষণের মতো প্রমাণিত সত্যগুলো যেন ভেসে উঠলো চারধারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ বছরের মেয়ে জেনেভাইভ ক্যাসামেন্টো ‘জেন এফ’ নামে একটি বই লিখেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নাগরিকদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে। বইটির একটি অংশ ফ্যাশন। লেখক এখানে জানাচ্ছেন, বস্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর ১০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ ঘটে। ‘ড্রেসড টু কিল : ফ্যাশনস ব্র্যান্ডস হিডেন লিংক টু রাশিয়ান অয়েল ইন আ টাইম অব ওয়ার’ নামের একটি গবেষণা পুস্তক প্রকাশ করেছে যৌথভাবে ‘চেঞ্জিং মার্কেটস ফাউন্ডেশন’, ‘জিরো ওয়াস্ট অ্যালায়েনস ইউক্রেন’ এবং ‘স্ট্যান্ড আর্থ’। বহু তথ্যপ্রমাণসমেত বইটি প্রমাণ করেছে রাশিয়া এবং চায়নার বহু জীবাশ্ম জ¦ালানি কোম্পানির সঙ্গে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। কেন জানি বাংলাদেশের তাজরীন কিংবা রানা প্লাজায় হারিয়ে যাওয়া মানুষদের স্মৃতি ভেসে আসে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে।

জার্মানি থেকে সম্মেলনে যোগ দেয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি ও ‘গ্রিন পার্টির’ সদস্য রাজনীতিবিদ জুট্টা পাওলুসের সঙ্গে দুবাই মেরিনা এলাকার এক হোটেলে নৈশভোজে বিস্তারিত আলাপ হয়। তিনি জানান, ‘...জলবায়ু আন্দোলন রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজ রূপান্তরের আন্দোলন। ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে সমাজ এবং বিশে^র সর্বত্র এখানে কাজ করার সুযোগ আছে। এ আন্দোলন জোরদার করতে হবে, সংহতি গড়ে তুলতে হবে এবং অবশ্যই পৃথিবীর প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে নিজেদের দায়িত্বশীলতাকে প্রমাণ করতে হবে।’ ঘোষণা হয়েছে আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত হবে পরের জলবায়ু সম্মেলন। আমাদের তর্ক, গল্প, বাহাস, প্রমাণ, তৎপরতা, দেনদরবার, সংহতি এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো আরো জোরালো এবং সক্রিয় হয়ে উঠুক।

বৈশ্বিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সশস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে গবেষণা এবং অস্ত্রমুক্ত শান্তিময় বিশ্বের জন্য কাজ করে ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি অস্ত্র ও সামরিক সেবা উৎপাদক বহুজাতিক কোম্পানির একটি তালিকা তৈরি করেছে সিপ্রি। ২০২২ সালের সেই তালিকা অনুযায়ী দেখা যায় শীর্ষ ১০টি অস্ত্র কোম্পানিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, ৩টি চীনের, বাকি দুটি রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের। যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন করপোরেশন, রেথিয়ন টেকনোলজিস, নর্থরূপ গ্রুম্মান করপোরেশন, বোয়িং এবং জেনারেল ডিনামিক্স দুনিয়ার শীর্ষ পাঁচ অস্ত্র কোম্পানি। যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমস, চীনের নরিংকো, এভিক, সিএএসসি এবং রাশিয়ার রসটেক কোম্পানিও শীর্ষ দশের ভেতর আছে। ইসরায়েলের এলবিট সিস্টেমস কোম্পানি তালিকায় ২৪তম অবস্থানে আছে। ‘সিপ্রি আর্মস ট্রান্সফার ডাটাবেজ (২০২৩)’ অনুযায়ী বৈশ্বিক অস্ত্রখাতের প্রায় ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

কারখানায় কেন বিস্কুট কিংবা পনির উৎপাদিত হয় আমরা ধারণা করতে পারি। কিন্তু কারখানায় কেন অস্ত্র উৎপাদিত হবে? দুনিয়ায় এত অস্ত্রের ঝনঝনানি কেন দরকার? প্রতি ১০ সেকেন্ডে এই পৃথিবীতে একটি বাচ্চা ক্ষুধার কারণে মারা যায়। অপুষ্টির কারণে বছরে প্রায় ৩০ লাখ শিশু কাঠামোগতভাবে খুন হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ শিশু না খেয়ে ঘুমাতে যায়। এসব উপাত্ত হয়তো কোনোভাবেই বিশ্বনেতৃত্বকে স্পর্শ করে না। কিংবা এসব প্রমাণ তাদের বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধ করে না। তা না হলে গত ২৭ বছর ধরে বিশ্বনেতৃত্বর অঙ্গীকার করা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু তহবিল কেন গঠন করা যায়নি?

ধনী আর উত্তরের ভোগবিলাসী জীবন আর যুদ্ধ সহিংসতা ও অস্ত্রবাণিজ্যের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। আর তাই তারা পৃথিবীর সুরক্ষায় এ তহবিল গঠনে বাধ্য এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ; কিন্তু জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নে কেবল তাদের টাকায় ঘাটতি আর অনীহা; কিন্তু অস্ত্রবাণিজ্য চাঙ্গা রাখার জন্য তাদের অর্থায়নের কোনো ঘাটতি হয় না। যুদ্ধ পাতিয়ে গাজার শিশুদের লাশের স্তূপ বানাতে তাদের কোনো অনীহা হয় না। বিশ্বনেতৃত্বের এ অন্যায় বাহাদুরি থামাতেই হবে। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কোনোভাবেই মোকাবিলা করে পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। অস্ত্র ও যুদ্ধের ঝুঁকি ও বিপদ থেকে এ ফিলিস্তিনসহ এই গ্রহকে উদ্ধার করতে বিশ্বনেতৃত্বকে সত্যিকারভাবে জলবায়ু-অঙ্গীকার করতে হবে।

[লেখক : গবেষক, পরিবেশ ও প্রতিবেশ]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু সম্মেলন এবং নয়া উদারবাদী কর্তৃত্ব

পাভেল পার্থ

মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

চারদিকে কেবল দালান আর দালান। দুবাই যেন এক দালানের শহর। এ শহরের এক্সপোসিটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৮তম বিশ^ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ সম্মেলন শেষ হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ইউনিয়ন থেকে বুর্জখলিফা যাওয়ার পথে মেট্রোতে আলাপ হয় বেনিন থেকে আসা কোপোকামে কে হারম্যানের সঙ্গে। রেডিও বেনিনের এই সাংবাদিক জানান, ‘..ব্রোঞ্জ এবং হাতির দাঁতের বাণিজ্যের কারণে বেনিন দীর্ঘসময় ঔপনিবেশিক শাসনের ভেতর ছিল। যেমন ছিল আইভরি কোস্ট। এখন বিশ^ব্যাপী হাতি বিপন্ন। এখনো চোরাই হাতির দাঁত বাণিজ্য হয়, হাতি খুন হয়। এই দাঁত চীনে চলে যায়। সর্বত্রই আজ চীনের বাজার। এক উপনিবেশের পর আরেক উপনিবেশ। এমনকি এই চীনই সবচে বেশি কার্বণ নিঃসরণ করছে; কিন্তু জলবায়ু সুরক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।’

জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেয়া এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র কিংবা কানাডার বহুজনের সঙ্গে আলাপেই জানা যায়, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ প্রতিটি দেশের নি¤œবর্গের জীবনে কী নির্দয় উপনিবেশিক বাহাদুরি জারি ছিল। এখন এই ঔপনিবেশিকতার বৈশি^ক চেহারা ও নিপীড়নের ধরন পাল্টেছে। তথাকথিত মুক্তবাজার ও বিশ^ায়নের নামে দুনিয়া আজ বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির উপনিবেশে বন্দী। উন্নত ও ধনী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলোর ক্রমাগত কার্বণ নিঃসরণ আজ পৃথিবী নামের সৌরজগতের এক ছোট্টগ্রহকে অসুস্থ ও ভঙ্গুর করে দিয়েছে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার বিনাশী ভোগবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে গ্রাম থেকে শহর, দ্বীপ থেকে অরণ্য কিংবা পাহাড় থেকে সমতলে।

বিশ^নেতৃত্ব পৃথিবী সুরক্ষায় এর আগে ২৭টি জলবায়ু সম্মেলনে নানা অঙ্গীকার করলেও প্রতিনিয়ত তা বরখেলাপ করছেন। দীর্ঘ করোনা মহামারীর ক্ষত শুকাতে না শুকাতে প্রশ্নহীনভাবে জারি আছে যুদ্ধ ও গণহত্যা। সিরিয়া থেকে সম্মেলনে যোগ দেয়া সাংবাদিক রুলা আসাদের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘..যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধ না করে জলবায়ু ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। গাজায় শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে অন্যায়ভাবে। অস্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে একটি যুদ্ধ চালানোর যাবতীয় কর্মকান্ড জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা ঝুঁকি বাড়াবো না কমাব। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আমরা ঝুঁকি হ্রাসের অঙ্গীকার করেছিলাম। নিজেদের অঙ্গীকারগুলো বারবার ভুলে যাওয়া অন্যায়।’

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধ করে জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বেশ কিছু আলোচনা ও প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছেন আলা কানান। জানালেন যুদ্ধের ভেতর কেমন ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়েছে। এমনকি প্রায় সময়টাই ফিলিস্তিন প্যাভিলিয়ন খালি পড়েছিল। বহু মানুষ এখান থেকে খুফিয়া নিতে এসেছেন। সম্মেলনে বহুজনের গলায় খুফিয়া দেখা গেছে। ভারতীয় তরুণ শিল্পী শিলো শিব সুলেমান এক শাড়িকে পরিণত করলেন দীর্ঘতম এক খুফিয়ায়। আর এই খুফিয়া নিয়ে দুবাই সম্মেলনে হেঁটেছেন অধিকারকর্মীরা। ইসরায়েলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইরানের রাষ্ট্রপক্ষের একটি দল প্রতিবাদ জানিয়ে প্রথম সপ্তাহেই জলবায়ু সম্মেলন ত্যাগ করে। মায়ানমার সম্মেলনে অংশ নেয়নি। ইসরাইল ‘খাদ্য অপচয়’ নিয়ে পূর্বনির্ধারিত একটি সহ-অধিবেশন হঠাৎ বাতিল করে।

জলবায়ু পরিবর্তন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। জোর করে অস্বীকারের কোনো উপায় নাই। দুবাই জলবায়ু সম্মেলন শুরু হতে না হতে ফিলিপাইন ও বাংলাদেশে ভূমিকম্প, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস, ভারতে ঘূর্ণিঝড়। প্রাণহানি ও বিনাশের খবরে বহুজনের চোখে বিষাদ দেখেছি। তাঞ্জানিয়ার রাষ্ট্রপতি সামিয়া সুলুহু হাসানকে সফর সংক্ষেপ করে ফিরে যেতে হয়েছে। জলবায়ুজনিত ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের অঙ্গীকার দিয়ে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনের শুরুকে অনেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন। তবে এই তহবিল কিভাবে কাদের মাধ্যমে কাদের কাছে যাবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এখানে বিশ^ব্যাংক, এডিবি কিংবা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব কতটুকু তা স্পষ্ট করতে হবে। বিশেষ করে তহবিল ও অর্থায়নের উৎস এবং ব্যবস্থাপনা উন্মুক্ত, ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহির ভেতর থাকতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল উগান্ডার প্রতিনিধি প্রসকভিয়ার ন্যানইয়নজু ভিকম্যান এ বিষয়ে জানান, ‘...লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড নিয়ে অবশ্যই আমাদের আলোচনা করা দরকার। তহবিলের উৎস ও ব্যবস্থাপনা সবকিছু স্বচ্ছ হতে হবে। বহু কোম্পানি তাদের লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যারা ক্লিন এনার্জি নিয়ে কথা বলছে কিন্তু এনার্জি ট্রান্সজিশনের কথা বলছে না জোরদারভাবে। জলবায়ু অর্থায়নের কোনো কিছু আমাদের কাছ থেকে গোপন করা যাবে না।’

সম্মেলনের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ২০২৩-২০৩১ সৌরসেচের স্কেলআপ রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হয়। জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে সেচকার্যক্রমকে সৌরবিদ্যুৎ নির্ভর করার জন্য রোডম্যাপটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে। ২০৪০ সালের ভেতর জ¦ালানি খাতকে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে রূপান্তর করতে চায় বাংলাদেশ। সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণেরও দাবি জানায় বাংলাদেশ। ‘বৈশি^ক অভিযোজন লক্ষ্যের’ খসড়া নিয়ে আলাপ তুলেছে বাংলাদেশ। ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু তহবিল, সবুজ জলবায়ু তহবিল, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য তহবিল, অভিযোজন তহবিল এবং বৈশি^ক পরিবেশ সহায়তা তহবিলসমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন করে সব তহবিলে বাংলাদেশের দ্রুত ও সহজ অভিগম্যতা দাবি করেছে বাংলাদেশ। সম্মেলনের সপ্তম দিনে জীবাশ্ম জ¦ালানি রোধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনা এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও জাপান ছাড়া ১০৬টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার সুপারিশ দিয়ে আরেকটি প্রস্তাব এনেছে, যাতে চীন ও ভারত সম্মত নয়।

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্য ও খাদ্যব্যবস্থা নিয়ে বিশ^নেতৃত্ব আলাপ শুরু করেছেন। সম্মেলন থেকে তৈরি লেখাগুলো পড়ে হোয়াটসঅ্যাপে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় থেকে যোগাযোগ করেন ‘প্রকৃতিবীক্ষণের’ বিপুল কুমার শর্মা। জানান, লেখাগুলো তাকে ভারতের পরিবেশবিজ্ঞানীবন্দনা শিবার ‘হু রিয়েলি ফিডস দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটি বাংলায় অনুবাদ করতে সহায়তা করছে। বইটিতে শিবা লিখেন, ‘দুনিয়ায় ৭০ ভাগ খাদ্যের জোগান দেয় পৃথিবীর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং মাত্র ৩০ ভাগ খাদ্য আসে বিশালসব বাণিজ্যিক খামার থেকে; কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষিই পৃথিবীর খাদ্য জোগায় এমন মিথ সর্বত্র ছড়ানো হয়।’

দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে সমাধানহীন তর্ক চলছে বহুজাতিক কোম্পানির বহু লবিস্টের অংশগ্রহণ নিয়ে। তারা বহু অধিবেশন, আলোচনা, সভা সর্বত্র অংশ নিয়ে ‘অবৈজ্ঞানিক’ নানা বিতর্ক তৈরি করছেন। বৃহৎ বাণিজ্যিক কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি, কৃষি রাসায়নিক কোম্পানি, বীজ কোম্পানি, মাংস কোম্পানির লবিস্টে জলবায়ু সম্মেলন সয়লাব। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাংস কোম্পানি ব্রাজিলের ‘জেবিএস’, সিনথেটিক সার কোম্পানি ‘নিওট্রেইন’ খাদ্য কোম্পানি ‘নেসলে’ কিংবা পেস্টিসাইড কোম্পানি ‘বায়ার’ এর কোম্পানির লবিস্টরা জলবায়ু সম্মেলনে কর্তৃত্ব তৈরি করছে। যেখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ একত্র হয়ে এক রুগ্ণ ভঙ্গুর পৃথিবীতে বাঁচানোর চেষ্টা করছে সেখানে এই কোম্পানিরা তাদের ‘মিথ্যা জলবায়ু সমাধানের’ বিজ্ঞাপন নিয়ে একটা ভিন্ন ন্যারেটিভ ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চাইছে।

প্রায় ১০২ জন বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিনিধি রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্বের প্রায় ৩০ ভাগ, যদিও মিসর সম্মেলনে এদের উপস্থিতি ছিল ৬ ভাগ। সবচেয়ে বেশি বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিনিধি ব্রাজিল থেকে এসেছেন, প্রায় ৩৬ জন, যাদের প্রায় সবাই বৃহৎসব মাংস উৎপাদনকারী কোম্পানির সঙ্গে জড়িত। পরবর্র্তী সারিতে আছেন রাশিয়া এবং কানাডার সিনথেটিক সার কোম্পানির লবিস্টরা। বায়ার কোম্পানির বিষ বা সিনজেনটা কোম্পানির হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে সর্বস্বান্ত হওয়া বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের বঞ্চিত কৃষকেরা যেন মনে হলো দূর থেকে কী প্রশ্ন করছেন। কিংবা নেসলের ম্যাগি নুডলসে সিসা এবং কোক-পেপসির প্লাস্টিক দূষণের মতো প্রমাণিত সত্যগুলো যেন ভেসে উঠলো চারধারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ বছরের মেয়ে জেনেভাইভ ক্যাসামেন্টো ‘জেন এফ’ নামে একটি বই লিখেছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নাগরিকদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে। বইটির একটি অংশ ফ্যাশন। লেখক এখানে জানাচ্ছেন, বস্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর ১০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ ঘটে। ‘ড্রেসড টু কিল : ফ্যাশনস ব্র্যান্ডস হিডেন লিংক টু রাশিয়ান অয়েল ইন আ টাইম অব ওয়ার’ নামের একটি গবেষণা পুস্তক প্রকাশ করেছে যৌথভাবে ‘চেঞ্জিং মার্কেটস ফাউন্ডেশন’, ‘জিরো ওয়াস্ট অ্যালায়েনস ইউক্রেন’ এবং ‘স্ট্যান্ড আর্থ’। বহু তথ্যপ্রমাণসমেত বইটি প্রমাণ করেছে রাশিয়া এবং চায়নার বহু জীবাশ্ম জ¦ালানি কোম্পানির সঙ্গে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। কেন জানি বাংলাদেশের তাজরীন কিংবা রানা প্লাজায় হারিয়ে যাওয়া মানুষদের স্মৃতি ভেসে আসে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে।

জার্মানি থেকে সম্মেলনে যোগ দেয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি ও ‘গ্রিন পার্টির’ সদস্য রাজনীতিবিদ জুট্টা পাওলুসের সঙ্গে দুবাই মেরিনা এলাকার এক হোটেলে নৈশভোজে বিস্তারিত আলাপ হয়। তিনি জানান, ‘...জলবায়ু আন্দোলন রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজ রূপান্তরের আন্দোলন। ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে সমাজ এবং বিশে^র সর্বত্র এখানে কাজ করার সুযোগ আছে। এ আন্দোলন জোরদার করতে হবে, সংহতি গড়ে তুলতে হবে এবং অবশ্যই পৃথিবীর প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে নিজেদের দায়িত্বশীলতাকে প্রমাণ করতে হবে।’ ঘোষণা হয়েছে আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত হবে পরের জলবায়ু সম্মেলন। আমাদের তর্ক, গল্প, বাহাস, প্রমাণ, তৎপরতা, দেনদরবার, সংহতি এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো আরো জোরালো এবং সক্রিয় হয়ে উঠুক।

বৈশ্বিক সহিংসতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সশস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে গবেষণা এবং অস্ত্রমুক্ত শান্তিময় বিশ্বের জন্য কাজ করে ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি অস্ত্র ও সামরিক সেবা উৎপাদক বহুজাতিক কোম্পানির একটি তালিকা তৈরি করেছে সিপ্রি। ২০২২ সালের সেই তালিকা অনুযায়ী দেখা যায় শীর্ষ ১০টি অস্ত্র কোম্পানিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, ৩টি চীনের, বাকি দুটি রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের। যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন করপোরেশন, রেথিয়ন টেকনোলজিস, নর্থরূপ গ্রুম্মান করপোরেশন, বোয়িং এবং জেনারেল ডিনামিক্স দুনিয়ার শীর্ষ পাঁচ অস্ত্র কোম্পানি। যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমস, চীনের নরিংকো, এভিক, সিএএসসি এবং রাশিয়ার রসটেক কোম্পানিও শীর্ষ দশের ভেতর আছে। ইসরায়েলের এলবিট সিস্টেমস কোম্পানি তালিকায় ২৪তম অবস্থানে আছে। ‘সিপ্রি আর্মস ট্রান্সফার ডাটাবেজ (২০২৩)’ অনুযায়ী বৈশ্বিক অস্ত্রখাতের প্রায় ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

কারখানায় কেন বিস্কুট কিংবা পনির উৎপাদিত হয় আমরা ধারণা করতে পারি। কিন্তু কারখানায় কেন অস্ত্র উৎপাদিত হবে? দুনিয়ায় এত অস্ত্রের ঝনঝনানি কেন দরকার? প্রতি ১০ সেকেন্ডে এই পৃথিবীতে একটি বাচ্চা ক্ষুধার কারণে মারা যায়। অপুষ্টির কারণে বছরে প্রায় ৩০ লাখ শিশু কাঠামোগতভাবে খুন হয়। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ শিশু না খেয়ে ঘুমাতে যায়। এসব উপাত্ত হয়তো কোনোভাবেই বিশ্বনেতৃত্বকে স্পর্শ করে না। কিংবা এসব প্রমাণ তাদের বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধ করে না। তা না হলে গত ২৭ বছর ধরে বিশ্বনেতৃত্বর অঙ্গীকার করা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু তহবিল কেন গঠন করা যায়নি?

ধনী আর উত্তরের ভোগবিলাসী জীবন আর যুদ্ধ সহিংসতা ও অস্ত্রবাণিজ্যের কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। আর তাই তারা পৃথিবীর সুরক্ষায় এ তহবিল গঠনে বাধ্য এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ; কিন্তু জলবায়ু তহবিলে অর্থায়নে কেবল তাদের টাকায় ঘাটতি আর অনীহা; কিন্তু অস্ত্রবাণিজ্য চাঙ্গা রাখার জন্য তাদের অর্থায়নের কোনো ঘাটতি হয় না। যুদ্ধ পাতিয়ে গাজার শিশুদের লাশের স্তূপ বানাতে তাদের কোনো অনীহা হয় না। বিশ্বনেতৃত্বের এ অন্যায় বাহাদুরি থামাতেই হবে। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কোনোভাবেই মোকাবিলা করে পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। অস্ত্র ও যুদ্ধের ঝুঁকি ও বিপদ থেকে এ ফিলিস্তিনসহ এই গ্রহকে উদ্ধার করতে বিশ্বনেতৃত্বকে সত্যিকারভাবে জলবায়ু-অঙ্গীকার করতে হবে।

[লেখক : গবেষক, পরিবেশ ও প্রতিবেশ]

back to top