alt

উপ-সম্পাদকীয়

সুন্দরবন কি আরেকটু বেশি মনোযোগ পেতে পারে না

আবু আফজাল সালেহ

: বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
image

সুন্দরবন

সুন্দরবন আমাদের অগাধ স¤পদের আধার। এটি বিশ্বেরও অনন্য স¤পদ। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দরবন অতুলনীয়। জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ এ বন। বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী জেলায় ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় সুন্দরবনের অবস্থান। সুন্দরবনের ৬২ ভাগ বাংলাদেশের। এটি বিশ্ব-ঐতিহ্যের একটি স্থান। এখানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন সম্পদ রয়েছে। একেক স¤পদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। আন্তঃদপ্তরের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের জন্য আলাদা দপ্তর ও মন্ত্রী রয়েছে। অথচ ৬২ শতাংশ সুন্দরবন বাংলাদেশের হয়েও আলাদা কোন দপ্তর নেই। সুন্দরবন কি আরেকটু বেশি মনোযোগ পেতে পারে না।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতি এলাকা নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চল। ভৌগোলিক আয়তন ৯৬৩০ বর্গ কিমি। ৪২৬৫ বর্গ কিমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বাকি অংশে মনুষ্য বসতি। সুন্দরবন বলতে এক সময় অনুন্নত অভাবী মানুষের দেশের ছবি ভেসে উঠত; কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। উন্নয়ন ও প্রগতির পথে সামিল হয়েছে সুন্দরবনের মূল ভূখ- ও দ্বীপাঞ্চল। গণমুখী উন্নয়নের জোয়ার এনেছে সুন্দরবন বিষয়ক দপ্তর। উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য রাজ্য সরকার উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করে ১৯৭৩ সালে। সুন্দরবন বিষয়ক বিভাগ নামে পুরোদস্তুর বিভাগ গঠন করা হয় ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে। সুন্দরবনের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তর। বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ, সৌর প্যানেল স্থাপন, পানীয় জলের ব্যবস্থা (নলকূপ স্থাপন ইত্যাদি), কৃষি সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে সেচ ও বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সেতু নির্মাণ, গুরুত্বপূর্ণ বাজার স্থাপন ইত্যাদি করেছে। জল সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প (খাল সম্প্রসারণ, সøুইসগেট, ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন ইত্যাদি) গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এছাড়া পশ্চাৎপদ এই এলাকায় কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বা বাস্তবায়ন করেছে।

সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা ও মায়া হরিণ, বানর, বনবিড়াল, সজারু ও বন্য শূকর, কুমির, সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পাখি। সুন্দরনের কাঠ, ফল, গোলপাতা, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি অনেকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। সুন্দরবনের মধু বিশ্বিখ্যাত। দেশে বিক্রির পাশাপাশি সুন্দরবনের মধু বিদেশেও রপ্তানি হয়। জৈবিক উপাদানগুলো এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সৈকত, মোহনা, স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী জলাভূমি, কাদা চর, খাঁড়ি, বালিয়াড়ি, মাটির স্তূপের মত বৈচিত্র্যময় অংশ গঠিত হয়েছে। স্রোতের গতি, ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক স্রোত চক্র এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী দীর্ঘ সমুদ্রতটের স্রোত ইত্যাদি উপকূল বরাবর সুন্দরবনের গঠন প্রকৃতি বহুমাত্রিক উপাদানসমূহ দ্বারা প্রভাবিত। বিভিন্ন মৌসুমে সমুদ্রতটের স্রোত যথেষ্ট পরিবর্তনশীল। এরা অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের কারণেও পরিবর্তিত হয়। এসব বিষয় আলাদাভাবে নজর দেওয়ার জন্য আলাদা দপ্তর দরকার।

সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্যপ্রাণীর বিশাল আবসস্থল। বন্যপ্রাণীর সংখ্যা এবং এর লালনক্ষেত্রের ওপর মানুষের স¤পদ সংগ্রহ ও বন ব্যবস্থাপনার প্রভাব অনেক। সুন্দরবনে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির একটি বড় অংশ বিদ্যমান (যেমন- ৩০ শতাংশ সরীসৃপ, ৩৭ শতাংশ পাখি ও ৩৭ শতাংশ স্তন্যপায়ী)। অনেক প্রজাতি বাংলাদেশের অন্যপ্রান্তে বিরল বা সংকটাপন্ন। প্রাণীবৈচিত্র্যের এই ধারার বিভিন্ন প্রজাতি বর্তমানে হুমকির মুখে। সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৪ মিলিয়নের বেশি; কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়। এদের কর্মসংস্থান সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবন দেশের বনজ স¤পদের একক বৃহত্তম উৎস। আসবাবপত্র ও নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা ইত্যাদি শিল্পের অনেক উপাদান সুন্দরবন থেকে পেয়ে থাকি। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের স¤পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ তদারকি ও ¯েপশাল নজর দেওয়ার দরকার। আর তার জন্য দরকার ক্ষমতায়িত আলাদা দপ্তর।

১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন ‘রামসার স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখ- ম্যানগ্রোভ বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবনের মধ্যে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে। বাকি অংশ রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সুন্দরবন এলাকায় বিশ্ববিখ্যাত রয়েলবেঙ্গল টাইগার ও চিত্রাহরিণ রয়েছে। প্রকৃতি ও প্রাণীর বিশাল আবাসস্থল দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসেন এবং সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। সুন্দরবনের নদী, সৈকত পর্যটনে নতুনমাত্রা দেবে। এজন্য দরকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা। সুন্দরবনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষির পাশাপাশি পর্যটন সেক্টরে দারুণ উন্নয়ন হবে। ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের মতো আমাদের আশপাশের অনেক দেশ পর্যটনে অনেক আয় করছে; যা অনেকাংশ বনভূমিকেন্দ্রিক। এটা আমাদের জন্য অণুপ্রেরণামূলক উদাহরণ হতে পারে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরের তুলনায় সুন্দরবনের মাটি ও আবহাওয়া আলাদা ধরনের। জোয়ার-ভাটার কারণে এখানকার পানিতে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বেশি। এখানকার মাটি পলিযুক্ত দোআঁশ। তাই এ অঞ্চলের কৃষির জন্য আলাদা পরিকল্পনা দরকার। সুন্দরবন দপ্তর গঠন করা গেলে কৃষি, প্রাণী ও বন স¤পদের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। মৎস্য, কৃষি, প্রাণিস¤পদ, পানি, বন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিভিন্ন দপ্তর। বিভিন্ন দপ্তর আবার ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এতে সুন্দরবন অঞ্চলে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। সুন্দরবন-দপ্তর গঠন করা গেলে সুন্দরবন এলাকার স¤পদ রক্ষণাবেক্ষণসহ সামগ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রভৃতির ক্ষমতা সুন্দরবন দপ্তরের থাকবে। এতে আন্তঃদপ্তরের মধ্যের ঝামেলা বা নথিগত/সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে সমন্বয়হীনতা কমে যাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সহজতর হবে। কৃষি, বন ও প্রাণিস¤পদের উন্নয়ন করা সহজ হবে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন দপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তাদের কার্যক্রম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

[লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি), সাতক্ষীরা]

বয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

বর্ষার আগেই নদীভাঙনের আতঙ্কে উপকূলবাসী

ছবি

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ : মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রয়োজন

‘রিসেটের’ পরাকৌশল কী হওয়া প্রয়োজন

প্রসঙ্গ : জাতীয় বাজেট

ব্রুনোর শ্মশান মঞ্চ

দুর্নীতির অবিশ্বাস্য খতিয়ান

সাম্য, ন্যায়বিচার, সুশাসন, বহুত্ববাদ : সবকা সাথ্ সবকা বিকাশ!

পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ সংকটে ধর্মনিরপেক্ষতা

পেশাগত দায় ও নৈতিকতা

বিনোদনের রূপান্তর : সংস্কৃতির সংকোচন ও নতুন পথ

রম্যগদ্য : ‘চোর চাই, চোর...’

শুভ-অশুভ বলে কিছু কি আছে

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে মিশে আছে কৃষি ও কৃষক

বাংলাদেশে ঘটনা অঘটন: প্রায় সবক্ষেত্রেই ইস্যু নির্বাচন

ছবি

নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ

বৈসাবি : সম্মিলনের জাতীয় উৎসব

সংকট ও সংক্রান্তির শক্তি

ছবি

গাজার অশ্রু : ইসরায়েলের বর্বরতা ও বিশ্বের নীরবতা

দেশের কৃষি অর্থনীতির নীরব নায়িকারা

বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের ফেরে বিএনপি ও এনসিপি

ফৌজদারি মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ভারতে ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক

কীটনাশকের বিষচক্র : উন্নয়নের নামে শোষণ ও বিপর্যয়

বোরো ধান উৎপাদনে প্রধান অন্তরায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট

ঢাকার বাসিন্দাদের নিঃশ্বাসে এক বিপন্নতা

‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হলে ‘ওয়াশিং মেশিন পার্টি’ বেকার হয়ে পড়বে না তো!

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

বাসন্তী পূজা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র

মার্কিন নীতির পরিবর্তনে ইউক্রেনের পরিণতি

গাজা : ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ পলিথিনে বিপন্ন প্রকৃতি

রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সতর্কবার্তা

ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই : আইনের শক্তি ও সমাজের দুর্বলতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সুন্দরবন কি আরেকটু বেশি মনোযোগ পেতে পারে না

আবু আফজাল সালেহ

image

সুন্দরবন

বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

সুন্দরবন আমাদের অগাধ স¤পদের আধার। এটি বিশ্বেরও অনন্য স¤পদ। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দরবন অতুলনীয়। জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ এ বন। বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী জেলায় ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় সুন্দরবনের অবস্থান। সুন্দরবনের ৬২ ভাগ বাংলাদেশের। এটি বিশ্ব-ঐতিহ্যের একটি স্থান। এখানে প্রাকৃতিক বিভিন্ন সম্পদ রয়েছে। একেক স¤পদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। আন্তঃদপ্তরের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের জন্য আলাদা দপ্তর ও মন্ত্রী রয়েছে। অথচ ৬২ শতাংশ সুন্দরবন বাংলাদেশের হয়েও আলাদা কোন দপ্তর নেই। সুন্দরবন কি আরেকটু বেশি মনোযোগ পেতে পারে না।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতি এলাকা নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চল। ভৌগোলিক আয়তন ৯৬৩০ বর্গ কিমি। ৪২৬৫ বর্গ কিমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বাকি অংশে মনুষ্য বসতি। সুন্দরবন বলতে এক সময় অনুন্নত অভাবী মানুষের দেশের ছবি ভেসে উঠত; কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। উন্নয়ন ও প্রগতির পথে সামিল হয়েছে সুন্দরবনের মূল ভূখ- ও দ্বীপাঞ্চল। গণমুখী উন্নয়নের জোয়ার এনেছে সুন্দরবন বিষয়ক দপ্তর। উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য রাজ্য সরকার উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করে ১৯৭৩ সালে। সুন্দরবন বিষয়ক বিভাগ নামে পুরোদস্তুর বিভাগ গঠন করা হয় ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে। সুন্দরবনের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তর। বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ, সৌর প্যানেল স্থাপন, পানীয় জলের ব্যবস্থা (নলকূপ স্থাপন ইত্যাদি), কৃষি সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে সেচ ও বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সেতু নির্মাণ, গুরুত্বপূর্ণ বাজার স্থাপন ইত্যাদি করেছে। জল সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প (খাল সম্প্রসারণ, সøুইসগেট, ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন ইত্যাদি) গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এছাড়া পশ্চাৎপদ এই এলাকায় কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বা বাস্তবায়ন করেছে।

সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ৪০০ প্রজাতির মাছ। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা ও মায়া হরিণ, বানর, বনবিড়াল, সজারু ও বন্য শূকর, কুমির, সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পাখি। সুন্দরনের কাঠ, ফল, গোলপাতা, শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি অনেকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। সুন্দরবনের মধু বিশ্বিখ্যাত। দেশে বিক্রির পাশাপাশি সুন্দরবনের মধু বিদেশেও রপ্তানি হয়। জৈবিক উপাদানগুলো এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সৈকত, মোহনা, স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী জলাভূমি, কাদা চর, খাঁড়ি, বালিয়াড়ি, মাটির স্তূপের মত বৈচিত্র্যময় অংশ গঠিত হয়েছে। স্রোতের গতি, ব্যষ্টিক ও সমষ্টিক স্রোত চক্র এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী দীর্ঘ সমুদ্রতটের স্রোত ইত্যাদি উপকূল বরাবর সুন্দরবনের গঠন প্রকৃতি বহুমাত্রিক উপাদানসমূহ দ্বারা প্রভাবিত। বিভিন্ন মৌসুমে সমুদ্রতটের স্রোত যথেষ্ট পরিবর্তনশীল। এরা অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের কারণেও পরিবর্তিত হয়। এসব বিষয় আলাদাভাবে নজর দেওয়ার জন্য আলাদা দপ্তর দরকার।

সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্যপ্রাণীর বিশাল আবসস্থল। বন্যপ্রাণীর সংখ্যা এবং এর লালনক্ষেত্রের ওপর মানুষের স¤পদ সংগ্রহ ও বন ব্যবস্থাপনার প্রভাব অনেক। সুন্দরবনে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির একটি বড় অংশ বিদ্যমান (যেমন- ৩০ শতাংশ সরীসৃপ, ৩৭ শতাংশ পাখি ও ৩৭ শতাংশ স্তন্যপায়ী)। অনেক প্রজাতি বাংলাদেশের অন্যপ্রান্তে বিরল বা সংকটাপন্ন। প্রাণীবৈচিত্র্যের এই ধারার বিভিন্ন প্রজাতি বর্তমানে হুমকির মুখে। সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৪ মিলিয়নের বেশি; কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়। এদের কর্মসংস্থান সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবন দেশের বনজ স¤পদের একক বৃহত্তম উৎস। আসবাবপত্র ও নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা ইত্যাদি শিল্পের অনেক উপাদান সুন্দরবন থেকে পেয়ে থাকি। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের স¤পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ তদারকি ও ¯েপশাল নজর দেওয়ার দরকার। আর তার জন্য দরকার ক্ষমতায়িত আলাদা দপ্তর।

১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন ‘রামসার স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখ- ম্যানগ্রোভ বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবনের মধ্যে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে। বাকি অংশ রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সুন্দরবন এলাকায় বিশ্ববিখ্যাত রয়েলবেঙ্গল টাইগার ও চিত্রাহরিণ রয়েছে। প্রকৃতি ও প্রাণীর বিশাল আবাসস্থল দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসেন এবং সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যান। সুন্দরবনের নদী, সৈকত পর্যটনে নতুনমাত্রা দেবে। এজন্য দরকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা। সুন্দরবনকে ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষির পাশাপাশি পর্যটন সেক্টরে দারুণ উন্নয়ন হবে। ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের মতো আমাদের আশপাশের অনেক দেশ পর্যটনে অনেক আয় করছে; যা অনেকাংশ বনভূমিকেন্দ্রিক। এটা আমাদের জন্য অণুপ্রেরণামূলক উদাহরণ হতে পারে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরের তুলনায় সুন্দরবনের মাটি ও আবহাওয়া আলাদা ধরনের। জোয়ার-ভাটার কারণে এখানকার পানিতে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বেশি। এখানকার মাটি পলিযুক্ত দোআঁশ। তাই এ অঞ্চলের কৃষির জন্য আলাদা পরিকল্পনা দরকার। সুন্দরবন দপ্তর গঠন করা গেলে কৃষি, প্রাণী ও বন স¤পদের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। মৎস্য, কৃষি, প্রাণিস¤পদ, পানি, বন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিভিন্ন দপ্তর। বিভিন্ন দপ্তর আবার ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এতে সুন্দরবন অঞ্চলে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। সুন্দরবন-দপ্তর গঠন করা গেলে সুন্দরবন এলাকার স¤পদ রক্ষণাবেক্ষণসহ সামগ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রভৃতির ক্ষমতা সুন্দরবন দপ্তরের থাকবে। এতে আন্তঃদপ্তরের মধ্যের ঝামেলা বা নথিগত/সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে সমন্বয়হীনতা কমে যাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সহজতর হবে। কৃষি, বন ও প্রাণিস¤পদের উন্নয়ন করা সহজ হবে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন দপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তাদের কার্যক্রম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

[লেখক : উপপরিচালক (বিআরডিবি), সাতক্ষীরা]

back to top