শাহ্ শেখ মজলিশ ফুয়াদ
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ বাংলাকে অগ্রাহ্য করে উর্দু ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে চাপিয়ে দেয়ার দুরভিসন্ধি চালায়। ওই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোনো রাজনৈতিক নেতা ওই মুহূর্তে এ দেশে ছিল না। ওই প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষকসহ আজিমপুরের বাসিন্দা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের কয়েকজন ছাত্র। ওই সাহসী মানুষদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক (পরবর্তীকালে প্রিন্সিপাল হিসেবে খ্যাত) আবুল কাশেম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি তার ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসায় গঠন করেন ‘তমুদ্দন মজলিস’ নামের সংগঠন।
বাঙালির ভাষা আন্দোলনে আজিমপুরের অবদান নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন রাষ্ট্র-ভাষা আন্দোলনের গবেষক, ইতিহাস বিষয়ক লেখক এমআর মাহবুব। তাঁরই লিখিত ‘আজিমপুরে ভাষা-আন্দোলন’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে বিস্তারিত তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো। তিনি লিখেছেন- ‘১৯নং আজিমপুরের বাড়িটিকে কেন্দ্র করেই ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালীন সব কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এখানেই মজলিসের প্রথম অফিস স্থাপন করা হয়। আর সে কারণেই ১৯নং আজিমপুরকে বলা হয় ভাষা আন্দোলনের জন্মভূমি বা সূতিকাগার।’
আবুল কাসেম লিখেছেন, ‘পাকিস্তান লাভের সাথে সাথে বাংলাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার কথা আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি। এই বিষয়ে প্রথম আলাপ করি আমার বন্ধু অধ্যাপক এ কে আহসান সাহেবের সাথে। এ সময় আমার বাসা ছিল ১৯নং আজিমপুর রোডে; আর অধ্যাপনা করতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। এ বাসাই পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এরপর আলোচনা করি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ও শামসুল আলমের সাথে। তারা সকলেই এ ব্যাপারে আমাকে সমর্থন করেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বরে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করি।’ (সূত্র : প্রবন্ধ মঞ্জুষা-প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, স্ববিকাশ পাবলিকাশ, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ. ৭৬-৭৭)
তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার পর কোন চড়ষরপু ফবপষধৎব না করেই তারা এখানে উর্দু চালাতে শুরু করল স্ট্যাম্প, রেল টিকেট, টাকা, মনি অর্ডার, ফরম ইত্যাদিতে। এই সময় অধ্যাপক আবুল কাসেম, এ কে আহসান দুজন ১৯ আজিমপুরে একসাথে থাকতেন। তারাই এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। আমাদের সাথে ঝ. গ. ঐধষষ-এর ডবংঃ ঐড়ঁংব-এর একটা কামরায় একদিন তারা এই নিয়ে আলাপ করলেন।’ (সূত্র : ভাষা-আন্দোলনের প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খ-, কৃত-বদরুদ্দীন উমর, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫, পৃ. ৩৩২)।
ভাষা আন্দোলনে আজিমপুর এবং ঢাকেশ্বরী রোডের দৈনিক আজাদ : দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়। আর তখন বাংলাভাষার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছিল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা। দৈনিক আজাদ ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে আজিমপুরের ২৭/ঢাকেশ্বরী রোডে স্থানান্তরিত হওয়ার পর বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল; যা ভাষা আন্দোলন ও সাংবাদিকতার ইতিহাসেরও অপরিহার্য অংশ। উল্লেখ্য, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ে দৈনিক হিসেবে যাত্রা করা প্রথম দৈনিক সংবাদপত্রটিই হচ্ছে দৈনিক আজাদ। এখন অবশ্য সেই দৈনিকের কোনো অস্তিত্ব ঢাকেশ্বরী রোডে নেই।
ভাষা আন্দোলন পরিচালনার প্রথম অফিস স্থাপন করা হয় আজিমপুরে
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তারিখে ঢাকাস্থ ১৯নং আজিমপুর রোডের বাসভবনের একটি কক্ষ তমদ্দুন মজলিসের অফিস হিসেবে বরাদ্দ প্রদান করা হয়। তখন থেকেই প্রতিদিন এখানে ভাষা-আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের নিয়মিত সমাবেশ ঘটতে থাকে। এদিনই উক্ত অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর ভাষা-আন্দোলন ও মজলিসের আদর্শ-উদ্দেশ্যের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে সাংগঠনিক পক্ষ পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র প্রকাশ
তমদ্দুন মজলিস পুস্তিকাগারে প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের উক্ত ঘোষণাপত্রের শিরোনাম ছিলÑ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’। ১৮ পৃষ্ঠার উক্ত পুস্তিকায় ৩টি প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে তদপ্রেক্ষিতে সরকার ও জনগণের করণীয় বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা হয় :
(ক) প্রস্তাব-প্রবন্ধ ‘আমাদের প্রস্তাব’-অধ্যাপক আবুল কাসেম
(খ) ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’-ড. কাজী মোতাহার হোসেন
(গ) ‘বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হইবে’-আবুল মনসুর আহমদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘বলা চলে উপরোক্ত পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা সূচিত হয়’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক ১৬ মার্চ, ১৯৫৬)।
উর্দুভাষী, শ্রমজীবী ও পুরান ঢাকাবাসীদের সমর্থন আদায়
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে পুরান ঢাকায় অবস্থানকারী ভারতীয় উর্দুভাষী মোহাজের গোষ্ঠী ও কতিপয় উর্দুভাষী ঢাকাইয়া এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরা বিক্ষুব্ধ হয়ে তমদ্দুন মজলিস অফিসে (তখন অফিস ছিল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিং) হামলা চালিয়ে অফিসটি ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। পরে অফিস আবার ১৯নং আজিমপুরে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় পুরান ঢাকার জনগণ তমদ্দুন মজলিসের কর্মীগণকে নানাস্থানে মারধর ও অপমান করতে শুরু করে। ১৯নং আজিমপুরের বাসায় অবস্থানরত এ কে আহসান সাহেবকেও মারপিট করা হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম এ পর্যায়ে তার কর্মীবাহিনী নিয়ে ১৯ নং আজিমপুরে আালোচনায় বসেন। পরবর্তীকালে তারা কৌশল প্রয়োগ করে পুরান ঢাকার জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে অধ্যাপক আবুর কাসেমকে তারা রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচন করে এবং ভাষা-আন্দোলনের মুখপত্র ‘সৈনিক’ প্রকাশের সময় বিনা ভাড়ায় একটি অফিস কক্ষ ব্যবহারের জন্য প্রদান করেন। তাছাড়াও ‘সৈনিকের’ সার্কুলেশনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯নং আজিমপুরে এসে পুরান ঢাকার লোকেরা তখন বাংলা ভাষার পক্ষে কাজ করেছেন।
ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের আত্মপ্রকাশ
১৪ নভেম্বর ১৯৪৮ তারিখ থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেম কর্তৃক ভাষা আন্দোলন ও তমুদ্দন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকা প্রকাশিত ও পরিচালনার যাত্রা শুরু করে। ১৯ নম্বর আজিমপুরেই ছিল ‘সৈনিক’ পত্রিকার অফিস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এ সময় সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ই ছিল সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা। তখন ‘ভাষা আন্দোলন’, ‘তমুদ্দন মজলিস’ ও ‘সৈনিক’ এ তিনটি নামকে পৃথক করে ভাবা যেতো না। ভাষা-আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় সৈনিকের ভূমিকা খুবই বড়। কেবল ভাষার দাবি নয়, স্বাধীনতার সেই প্রথম দিনগুলোতে সৈনিক পত্রিকা প্রাদেশিক মুসলিম সরকারের স্বাধীনতাপূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, তাদের গণবিরোধী ভূমিকার স্বরূপ উন্মোচন করেছিল। পূর্ব-বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের অন্ন-বস্ত্রের দাবির পাশেও ‘সৈনিক’ দাঁড়িয়ে ছিল।’
অন্যান্য সাংগঠনিক তৎপরতা
ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশ পর্বের প্রায় সব কর্মকা-ই পরিচালনা হতো ১৯নং আজিমপুর থেকে। এ সময়ে ভাষা-আন্দোলন পরিচালনার প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির প্রেক্ষাপট, পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল ১৯নং আজিমপুর থেকেই। পরবর্তীতে সেই সব কর্মসূচি বিভিন্ন স্থানে বাস্তবায়ন করা হয়। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সভা ও কর্মসূচি বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হলেও এসবের কর্মপরিকল্পনা হতো ১৯নং আজিমপুরের অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেবের বাসায়। এসব সাহিত্য সাংস্কৃতিক সভায় সমকালীন বুদ্ধিজীবী ও সরকারি মন্ত্রী পর্যায়ের লোকদের আমন্ত্রণ করে তাদের নিকট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করে। এ সভার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি সাংস্কৃতিক সভা ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে সংবর্ধনা দেয়া উপলক্ষে ৫ নভেম্বর ১৯৪৭ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে।
১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্রের একটি সভা ও মিছিল হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সভাশেষে মিছিলটি সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এদিকে ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশের পর থেকেই উক্ত সংগঠনের নেতারা তমুদ্দন মজলিসের সাথে যৌথভাবে ভাষা-আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। মুসলিম ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা তমুদ্দন মজলিসের কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্টভাষা, সরকারি ভাষা, অফিস আন্দোলনের ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে তমুদ্দন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি ও মুসলিম ছাত্রলীগের একটি যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
[লেখক : পরিচালক (অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ), চলতি দায়িত্ব, পিআইবি]
শাহ্ শেখ মজলিশ ফুয়াদ
বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ বাংলাকে অগ্রাহ্য করে উর্দু ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে চাপিয়ে দেয়ার দুরভিসন্ধি চালায়। ওই দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোনো রাজনৈতিক নেতা ওই মুহূর্তে এ দেশে ছিল না। ওই প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষকসহ আজিমপুরের বাসিন্দা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের কয়েকজন ছাত্র। ওই সাহসী মানুষদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক (পরবর্তীকালে প্রিন্সিপাল হিসেবে খ্যাত) আবুল কাশেম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি তার ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসায় গঠন করেন ‘তমুদ্দন মজলিস’ নামের সংগঠন।
বাঙালির ভাষা আন্দোলনে আজিমপুরের অবদান নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন রাষ্ট্র-ভাষা আন্দোলনের গবেষক, ইতিহাস বিষয়ক লেখক এমআর মাহবুব। তাঁরই লিখিত ‘আজিমপুরে ভাষা-আন্দোলন’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে বিস্তারিত তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো। তিনি লিখেছেন- ‘১৯নং আজিমপুরের বাড়িটিকে কেন্দ্র করেই ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালীন সব কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এখানেই মজলিসের প্রথম অফিস স্থাপন করা হয়। আর সে কারণেই ১৯নং আজিমপুরকে বলা হয় ভাষা আন্দোলনের জন্মভূমি বা সূতিকাগার।’
আবুল কাসেম লিখেছেন, ‘পাকিস্তান লাভের সাথে সাথে বাংলাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার কথা আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি। এই বিষয়ে প্রথম আলাপ করি আমার বন্ধু অধ্যাপক এ কে আহসান সাহেবের সাথে। এ সময় আমার বাসা ছিল ১৯নং আজিমপুর রোডে; আর অধ্যাপনা করতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। এ বাসাই পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এরপর আলোচনা করি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ও শামসুল আলমের সাথে। তারা সকলেই এ ব্যাপারে আমাকে সমর্থন করেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বরে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করি।’ (সূত্র : প্রবন্ধ মঞ্জুষা-প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, স্ববিকাশ পাবলিকাশ, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ. ৭৬-৭৭)
তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার পর কোন চড়ষরপু ফবপষধৎব না করেই তারা এখানে উর্দু চালাতে শুরু করল স্ট্যাম্প, রেল টিকেট, টাকা, মনি অর্ডার, ফরম ইত্যাদিতে। এই সময় অধ্যাপক আবুল কাসেম, এ কে আহসান দুজন ১৯ আজিমপুরে একসাথে থাকতেন। তারাই এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। আমাদের সাথে ঝ. গ. ঐধষষ-এর ডবংঃ ঐড়ঁংব-এর একটা কামরায় একদিন তারা এই নিয়ে আলাপ করলেন।’ (সূত্র : ভাষা-আন্দোলনের প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খ-, কৃত-বদরুদ্দীন উমর, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫, পৃ. ৩৩২)।
ভাষা আন্দোলনে আজিমপুর এবং ঢাকেশ্বরী রোডের দৈনিক আজাদ : দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়। আর তখন বাংলাভাষার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছিল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা। দৈনিক আজাদ ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে আজিমপুরের ২৭/ঢাকেশ্বরী রোডে স্থানান্তরিত হওয়ার পর বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিল; যা ভাষা আন্দোলন ও সাংবাদিকতার ইতিহাসেরও অপরিহার্য অংশ। উল্লেখ্য, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ে দৈনিক হিসেবে যাত্রা করা প্রথম দৈনিক সংবাদপত্রটিই হচ্ছে দৈনিক আজাদ। এখন অবশ্য সেই দৈনিকের কোনো অস্তিত্ব ঢাকেশ্বরী রোডে নেই।
ভাষা আন্দোলন পরিচালনার প্রথম অফিস স্থাপন করা হয় আজিমপুরে
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তারিখে ঢাকাস্থ ১৯নং আজিমপুর রোডের বাসভবনের একটি কক্ষ তমদ্দুন মজলিসের অফিস হিসেবে বরাদ্দ প্রদান করা হয়। তখন থেকেই প্রতিদিন এখানে ভাষা-আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের নিয়মিত সমাবেশ ঘটতে থাকে। এদিনই উক্ত অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর ভাষা-আন্দোলন ও মজলিসের আদর্শ-উদ্দেশ্যের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে সাংগঠনিক পক্ষ পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র প্রকাশ
তমদ্দুন মজলিস পুস্তিকাগারে প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের উক্ত ঘোষণাপত্রের শিরোনাম ছিলÑ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’। ১৮ পৃষ্ঠার উক্ত পুস্তিকায় ৩টি প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে তদপ্রেক্ষিতে সরকার ও জনগণের করণীয় বিষয়ে মতামত প্রকাশ করা হয় :
(ক) প্রস্তাব-প্রবন্ধ ‘আমাদের প্রস্তাব’-অধ্যাপক আবুল কাসেম
(খ) ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’-ড. কাজী মোতাহার হোসেন
(গ) ‘বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হইবে’-আবুল মনসুর আহমদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘বলা চলে উপরোক্ত পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা সূচিত হয়’ (সূত্র : সাপ্তাহিক সৈনিক ১৬ মার্চ, ১৯৫৬)।
উর্দুভাষী, শ্রমজীবী ও পুরান ঢাকাবাসীদের সমর্থন আদায়
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে পুরান ঢাকায় অবস্থানকারী ভারতীয় উর্দুভাষী মোহাজের গোষ্ঠী ও কতিপয় উর্দুভাষী ঢাকাইয়া এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরা বিক্ষুব্ধ হয়ে তমদ্দুন মজলিস অফিসে (তখন অফিস ছিল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিং) হামলা চালিয়ে অফিসটি ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। পরে অফিস আবার ১৯নং আজিমপুরে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় পুরান ঢাকার জনগণ তমদ্দুন মজলিসের কর্মীগণকে নানাস্থানে মারধর ও অপমান করতে শুরু করে। ১৯নং আজিমপুরের বাসায় অবস্থানরত এ কে আহসান সাহেবকেও মারপিট করা হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম এ পর্যায়ে তার কর্মীবাহিনী নিয়ে ১৯ নং আজিমপুরে আালোচনায় বসেন। পরবর্তীকালে তারা কৌশল প্রয়োগ করে পুরান ঢাকার জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। এক পর্যায়ে অধ্যাপক আবুর কাসেমকে তারা রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচন করে এবং ভাষা-আন্দোলনের মুখপত্র ‘সৈনিক’ প্রকাশের সময় বিনা ভাড়ায় একটি অফিস কক্ষ ব্যবহারের জন্য প্রদান করেন। তাছাড়াও ‘সৈনিকের’ সার্কুলেশনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯নং আজিমপুরে এসে পুরান ঢাকার লোকেরা তখন বাংলা ভাষার পক্ষে কাজ করেছেন।
ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের আত্মপ্রকাশ
১৪ নভেম্বর ১৯৪৮ তারিখ থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেম কর্তৃক ভাষা আন্দোলন ও তমুদ্দন মজলিসের মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ পত্রিকা প্রকাশিত ও পরিচালনার যাত্রা শুরু করে। ১৯ নম্বর আজিমপুরেই ছিল ‘সৈনিক’ পত্রিকার অফিস। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এ সময় সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ই ছিল সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা। তখন ‘ভাষা আন্দোলন’, ‘তমুদ্দন মজলিস’ ও ‘সৈনিক’ এ তিনটি নামকে পৃথক করে ভাবা যেতো না। ভাষা-আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় সৈনিকের ভূমিকা খুবই বড়। কেবল ভাষার দাবি নয়, স্বাধীনতার সেই প্রথম দিনগুলোতে সৈনিক পত্রিকা প্রাদেশিক মুসলিম সরকারের স্বাধীনতাপূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, তাদের গণবিরোধী ভূমিকার স্বরূপ উন্মোচন করেছিল। পূর্ব-বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণের অন্ন-বস্ত্রের দাবির পাশেও ‘সৈনিক’ দাঁড়িয়ে ছিল।’
অন্যান্য সাংগঠনিক তৎপরতা
ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশ পর্বের প্রায় সব কর্মকা-ই পরিচালনা হতো ১৯নং আজিমপুর থেকে। এ সময়ে ভাষা-আন্দোলন পরিচালনার প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির প্রেক্ষাপট, পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল ১৯নং আজিমপুর থেকেই। পরবর্তীতে সেই সব কর্মসূচি বিভিন্ন স্থানে বাস্তবায়ন করা হয়। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সভা ও কর্মসূচি বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হলেও এসবের কর্মপরিকল্পনা হতো ১৯নং আজিমপুরের অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেবের বাসায়। এসব সাহিত্য সাংস্কৃতিক সভায় সমকালীন বুদ্ধিজীবী ও সরকারি মন্ত্রী পর্যায়ের লোকদের আমন্ত্রণ করে তাদের নিকট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করে। এ সভার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি সাংস্কৃতিক সভা ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে সংবর্ধনা দেয়া উপলক্ষে ৫ নভেম্বর ১৯৪৭ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে।
১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্রের একটি সভা ও মিছিল হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। সভাশেষে মিছিলটি সেক্রেটারিয়েটের সম্মুখে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এদিকে ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশের পর থেকেই উক্ত সংগঠনের নেতারা তমুদ্দন মজলিসের সাথে যৌথভাবে ভাষা-আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। মুসলিম ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা তমুদ্দন মজলিসের কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্টভাষা, সরকারি ভাষা, অফিস আন্দোলনের ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে তমুদ্দন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি ও মুসলিম ছাত্রলীগের একটি যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
[লেখক : পরিচালক (অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ), চলতি দায়িত্ব, পিআইবি]