alt

উপ-সম্পাদকীয়

কাঁঠাল হতে পারে রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত

মনির উদ্দিন

: বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

বিগত বছরগুলোতে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে বেড়েছে। আর এর মধ্যে ফলজাতীয় ফসল বিশেষভাবে বেড়েছে যার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ফল উৎপাদনে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে, মৌসুমী ফলের বৈচিত্র্যের কারণে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে ফল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, গত ১৮ বছর ধরে দেশের ফলের বার্ষিক উৎপাদন গড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে গত ১০ বছরে ফলের ব্যবহারও বেড়েছে দ্ধিগুণ।

মৌসুমী ফলের মধ্যে কাঁঠাল বড় গাছে জন্মানো বাংলাদেশের জাতীয় ফল। গবেষকদের মতে, কাঁঠালের মতো পুষ্টিকর অন্য কোনো ফল নেই। কাঁঠাল থেকে কোন কিছুই নষ্ট হয় না এবং পৃথিবীতে আর কোনো ফল বা ফসলের এমন বৈচিত্র্যময় ব্যবহার উপযোগিতা নেই। কৃষিবিজ্ঞানীরা কাঁঠালকে একটি অলৌকিক ফসল হিসেবে অভিহিত করেছেন যা সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে অনাহার থেকেও বাঁচাতে পারে। যেহেতু দেশে বর্তমানে উৎপাদিত কাঁঠালের অর্ধেকই পাকার পর নষ্ট হয়ে যায় তাই এর ব্যবহারে পরিবর্তন আনা জরুরি। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাঁঠালের সংগ্রত্তোর অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ। আর, এই বিশাল অপচয় রোধের সহজ উপায় হচ্ছে কাঁচা কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্যব্যবস্থায় যুক্ত করা। সেই সঙ্গে কাঁচা ও পাকা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে তা দেশীয় ও দেশের বাইরের বাজারে সরবরাহ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।

দেশের জাতীয় ফল কাঁঠালকে ঘিরে আমাদের যে সনাতনী খাদ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব দেশের উৎপাদিত কাঁঠালের ব্যাপক অপচয় রোধের পাশাপাশি এর প্রক্রিয়াজাত বিকল্প খাদ্যপণ্য দেশীয় খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা এবং বিদেশের বাজারে সরবরাহ করার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ১৮-২০ লাখ টন কাঁঠালের বড় একটি অংশ কাঁচা অবস্থায় দেশীয় খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা অতিব জরুরি। সেই সঙ্গে কাঁচা কাঁঠালের বিকল্প নানা ধরনের খাদ্যপণ্য বা কাঁচা কাঁঠাল সরাসরি বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেহেতু ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে কাঁচা ও পাকা উভয় কাঁঠালেরই প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে।

দেশে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদিত কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে পারলে এ জাতীয় ফলটি দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আজকাল দেশের তরুণ ছেলেমেয়েসহ শহরের বড় একটি শ্রেণী ফাস্টফুডের প্রতি আকৃষ্ট। আর ফাস্টফুডের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের আইটেমগুলো হচ্ছে-বার্গার, রোল, শর্মা, কাটলেট, স্যান্ডউইচ, সমোসা, সিংগাড়া, টিক্কা, কাবাব, বারবিকিউ, ভেজিটেবল পরোটা ইত্যাদি যার মধ্যে সাধারণত মুরগি, গরুর মাংস ও সবজি ব্যবহার করা হয়। ফাস্টফুডের এসব খাদ্য তৈরিতে প্রোটিনসমৃদ্ধ কাঁচা কাঁঠাল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ব্যবহার করে খাদ্যের পুষ্টিমান বাড়ানোর পাশাপাশি কাঁচা কাঁঠালের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের খাদ্যব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে কাঁচা কাঁঠাল সবজি বা তরকারি হিসেবে কদাচিৎ ব্যবহার করার প্রচলন অনেক আগে থেকে থাকলেও অধিকাংশ মানুষই কাঁচা কাঁঠালের পুষ্টিগুণ সর্ম্পকে মোটেই অবগত নয়। এক্ষেত্রে, মানুষের সচেতনতা বাড়াতে পারলে গ্রামাঞ্চলেও এই কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব এবং এতে গ্রামীণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পুষ্টিমান উন্নত হওয়া ও কাঁঠালের অপচয় রোধে সহায়ক হবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তার ‘এক দেশ এক অগ্রাধিকার পণ্য বা ওসিওপি’ প্রকল্পের আওতায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি বিশেষ কৃষিপণ্য হিসেবে কাঁঠালের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ১৯৭৯ সালে জাপানের ওইতা প্রিফিকচারে ’এক গ্রাম এক পণ্য’ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল যার সূত্র ধরেই ২০২১ সালে ওসিওপি কার্যক্রম শুরু হয়। কাঁঠাল একটি রপ্তানি পণ্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যেটি দেশের নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তথা গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে। সেই সঙ্গে জনবহুল বাংলাদেশের পরিবর্তিত খাদ্যাভাসে টেকসই অবদান রাখতে পারে। কারণ বিশ্বব্যাপী কাঁঠালের একটি শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা রয়েছে এবং এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় ফল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর একটি উপযুক্ত নিয়ামক। যেহেতু কাঁঠাল গ্রীষ্মম-লীয় এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল যা ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জন্মে না। ফলে এর বিভিন্ন ধরনের ওষধিগুণ, প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের উৎস সেই সঙ্গে এটির চাষে কোনো রাসায়নিক প্রয়োজন না হওয়ায় এই সমস্ত দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

ভারত তার বেশির ভাগ কাঁচা কাঁঠাল যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে রপ্তানি করে এবং বিশ্বে কাঁচা কাঁঠালের বৃহত্তম রপ্তানিকারক। বিশ্বে কাঁচা কাঁঠাল রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া ৪.১৭ বিলিয়ন ডলারের লাল মাংসের বিকল্প কাঁচা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার দখল করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এর বাজার ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাজেই বিশ্বের দ্বিতীয় কাঁঠাল উৎপাদনকারী বাংলাদেশ এখানে একটি বড় বাজার দখল করতে পারে।

দেশের রপ্তানির তালিকায় ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে পাকা কাঁঠাল ও কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারী ও বণিক সমিতির (বিএপিপিএমএ) অধীনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাঁঠাল থেকে তৈরি অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড খাবার এবং কাঁঠালের বীজের পাউডার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফুড চেইনে রপ্তানি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ টু আই প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় ফলের ভেল্যু সংযোজনের জন্য কাঁচা কাঁঠাল থেকে মাংসের বিকল্প চিপস প্রক্রিয়াকরণে বেসরকারি খাতকে জড়িত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে লাল মাংসের বিকল্প হিসেবে সিদ্ধ ও প্রক্রিয়াজাত কাঁচা কাঁঠালের খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দেশের মোট ফল উৎপাদনের ২৫ শতাংশই কাঁঠাল এবং ইতোমধ্যে ফলটির কাঁচা প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম জনবহুল দেশ চীনেও কাঁঠালের ক্রমবর্ধমান বাজার দখল করার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের বাজারে ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাঁঠালের আধিপত্য রয়েছে। আমরা কাঁচা কাঁঠাল এবং এর প্রক্রিয়াজাত পণ্য উভয়ই চীনে রপ্তানি করতে পারি।

অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক এবং বাস্তব সফলতা এই যে, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) তাদের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আইসল্যান্ডের একটি সুপারস্টোরে ৪ লাখ পিস কাঁঠালের বার্গার সরবরাহ করেছে এবং পিকেএসএফের এই কর্মসূচিটি অব্যাহত আছে।

কাঁঠালের প্যাটি স্বাদ, গন্ধ ও রসালোতার দিক থেকে মাংসের সঙ্গে তুলনীয়। নিরামিষ খাদ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এই খাতে উল্লেখযোগ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে প্রায় ১০০০ টন পাকা কাঁঠাল রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মাটিতে উৎপাদিত জাতীয় ফল কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বছরজুড়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সেইসঙ্গে কাঁচা ও পাকা উভয় ধরনের কাঁঠালের সরাসরি এবং প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পণ্য বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া জরুরি যার মাধ্যমে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। দেশের সম্ভাবনাময় এই জাতীয় ফলকে নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহন করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে দেশের আভ্যন্তরীণ খাদ্য ব্যবস্থায় কাঁঠালের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের বাইরে কাঁচা ও পাকা কাঁঠাল এবং কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক: অ্যাগ্রোনমিস্ট ও কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ]

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কাঁঠাল হতে পারে রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত

মনির উদ্দিন

বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

বিগত বছরগুলোতে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে বেড়েছে। আর এর মধ্যে ফলজাতীয় ফসল বিশেষভাবে বেড়েছে যার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ফল উৎপাদনে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে, মৌসুমী ফলের বৈচিত্র্যের কারণে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে ফল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, গত ১৮ বছর ধরে দেশের ফলের বার্ষিক উৎপাদন গড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে গত ১০ বছরে ফলের ব্যবহারও বেড়েছে দ্ধিগুণ।

মৌসুমী ফলের মধ্যে কাঁঠাল বড় গাছে জন্মানো বাংলাদেশের জাতীয় ফল। গবেষকদের মতে, কাঁঠালের মতো পুষ্টিকর অন্য কোনো ফল নেই। কাঁঠাল থেকে কোন কিছুই নষ্ট হয় না এবং পৃথিবীতে আর কোনো ফল বা ফসলের এমন বৈচিত্র্যময় ব্যবহার উপযোগিতা নেই। কৃষিবিজ্ঞানীরা কাঁঠালকে একটি অলৌকিক ফসল হিসেবে অভিহিত করেছেন যা সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে অনাহার থেকেও বাঁচাতে পারে। যেহেতু দেশে বর্তমানে উৎপাদিত কাঁঠালের অর্ধেকই পাকার পর নষ্ট হয়ে যায় তাই এর ব্যবহারে পরিবর্তন আনা জরুরি। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাঁঠালের সংগ্রত্তোর অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ। আর, এই বিশাল অপচয় রোধের সহজ উপায় হচ্ছে কাঁচা কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্যব্যবস্থায় যুক্ত করা। সেই সঙ্গে কাঁচা ও পাকা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে তা দেশীয় ও দেশের বাইরের বাজারে সরবরাহ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।

দেশের জাতীয় ফল কাঁঠালকে ঘিরে আমাদের যে সনাতনী খাদ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব দেশের উৎপাদিত কাঁঠালের ব্যাপক অপচয় রোধের পাশাপাশি এর প্রক্রিয়াজাত বিকল্প খাদ্যপণ্য দেশীয় খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা এবং বিদেশের বাজারে সরবরাহ করার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ১৮-২০ লাখ টন কাঁঠালের বড় একটি অংশ কাঁচা অবস্থায় দেশীয় খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা অতিব জরুরি। সেই সঙ্গে কাঁচা কাঁঠালের বিকল্প নানা ধরনের খাদ্যপণ্য বা কাঁচা কাঁঠাল সরাসরি বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেহেতু ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে কাঁচা ও পাকা উভয় কাঁঠালেরই প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে।

দেশে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদিত কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে পারলে এ জাতীয় ফলটি দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আজকাল দেশের তরুণ ছেলেমেয়েসহ শহরের বড় একটি শ্রেণী ফাস্টফুডের প্রতি আকৃষ্ট। আর ফাস্টফুডের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের আইটেমগুলো হচ্ছে-বার্গার, রোল, শর্মা, কাটলেট, স্যান্ডউইচ, সমোসা, সিংগাড়া, টিক্কা, কাবাব, বারবিকিউ, ভেজিটেবল পরোটা ইত্যাদি যার মধ্যে সাধারণত মুরগি, গরুর মাংস ও সবজি ব্যবহার করা হয়। ফাস্টফুডের এসব খাদ্য তৈরিতে প্রোটিনসমৃদ্ধ কাঁচা কাঁঠাল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ব্যবহার করে খাদ্যের পুষ্টিমান বাড়ানোর পাশাপাশি কাঁচা কাঁঠালের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের খাদ্যব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে কাঁচা কাঁঠাল সবজি বা তরকারি হিসেবে কদাচিৎ ব্যবহার করার প্রচলন অনেক আগে থেকে থাকলেও অধিকাংশ মানুষই কাঁচা কাঁঠালের পুষ্টিগুণ সর্ম্পকে মোটেই অবগত নয়। এক্ষেত্রে, মানুষের সচেতনতা বাড়াতে পারলে গ্রামাঞ্চলেও এই কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব এবং এতে গ্রামীণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পুষ্টিমান উন্নত হওয়া ও কাঁঠালের অপচয় রোধে সহায়ক হবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তার ‘এক দেশ এক অগ্রাধিকার পণ্য বা ওসিওপি’ প্রকল্পের আওতায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি বিশেষ কৃষিপণ্য হিসেবে কাঁঠালের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ১৯৭৯ সালে জাপানের ওইতা প্রিফিকচারে ’এক গ্রাম এক পণ্য’ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল যার সূত্র ধরেই ২০২১ সালে ওসিওপি কার্যক্রম শুরু হয়। কাঁঠাল একটি রপ্তানি পণ্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যেটি দেশের নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তথা গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে। সেই সঙ্গে জনবহুল বাংলাদেশের পরিবর্তিত খাদ্যাভাসে টেকসই অবদান রাখতে পারে। কারণ বিশ্বব্যাপী কাঁঠালের একটি শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা রয়েছে এবং এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় ফল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর একটি উপযুক্ত নিয়ামক। যেহেতু কাঁঠাল গ্রীষ্মম-লীয় এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল যা ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জন্মে না। ফলে এর বিভিন্ন ধরনের ওষধিগুণ, প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের উৎস সেই সঙ্গে এটির চাষে কোনো রাসায়নিক প্রয়োজন না হওয়ায় এই সমস্ত দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

ভারত তার বেশির ভাগ কাঁচা কাঁঠাল যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে রপ্তানি করে এবং বিশ্বে কাঁচা কাঁঠালের বৃহত্তম রপ্তানিকারক। বিশ্বে কাঁচা কাঁঠাল রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া ৪.১৭ বিলিয়ন ডলারের লাল মাংসের বিকল্প কাঁচা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার দখল করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এর বাজার ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাজেই বিশ্বের দ্বিতীয় কাঁঠাল উৎপাদনকারী বাংলাদেশ এখানে একটি বড় বাজার দখল করতে পারে।

দেশের রপ্তানির তালিকায় ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে পাকা কাঁঠাল ও কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারী ও বণিক সমিতির (বিএপিপিএমএ) অধীনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাঁঠাল থেকে তৈরি অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড খাবার এবং কাঁঠালের বীজের পাউডার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফুড চেইনে রপ্তানি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ টু আই প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় ফলের ভেল্যু সংযোজনের জন্য কাঁচা কাঁঠাল থেকে মাংসের বিকল্প চিপস প্রক্রিয়াকরণে বেসরকারি খাতকে জড়িত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে লাল মাংসের বিকল্প হিসেবে সিদ্ধ ও প্রক্রিয়াজাত কাঁচা কাঁঠালের খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দেশের মোট ফল উৎপাদনের ২৫ শতাংশই কাঁঠাল এবং ইতোমধ্যে ফলটির কাঁচা প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম জনবহুল দেশ চীনেও কাঁঠালের ক্রমবর্ধমান বাজার দখল করার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। চীনের বাজারে ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাঁঠালের আধিপত্য রয়েছে। আমরা কাঁচা কাঁঠাল এবং এর প্রক্রিয়াজাত পণ্য উভয়ই চীনে রপ্তানি করতে পারি।

অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক এবং বাস্তব সফলতা এই যে, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) তাদের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আইসল্যান্ডের একটি সুপারস্টোরে ৪ লাখ পিস কাঁঠালের বার্গার সরবরাহ করেছে এবং পিকেএসএফের এই কর্মসূচিটি অব্যাহত আছে।

কাঁঠালের প্যাটি স্বাদ, গন্ধ ও রসালোতার দিক থেকে মাংসের সঙ্গে তুলনীয়। নিরামিষ খাদ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এই খাতে উল্লেখযোগ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে প্রায় ১০০০ টন পাকা কাঁঠাল রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মাটিতে উৎপাদিত জাতীয় ফল কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বছরজুড়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সেইসঙ্গে কাঁচা ও পাকা উভয় ধরনের কাঁঠালের সরাসরি এবং প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পণ্য বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া জরুরি যার মাধ্যমে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। দেশের সম্ভাবনাময় এই জাতীয় ফলকে নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহন করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে দেশের আভ্যন্তরীণ খাদ্য ব্যবস্থায় কাঁঠালের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের বাইরে কাঁচা ও পাকা কাঁঠাল এবং কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক: অ্যাগ্রোনমিস্ট ও কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ]

back to top