মোস্তাফা জব্বার
দুই ॥
যারা ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা তখন ভারত সরকারের কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন এবং অনুরোধ করেন যেন এমন একটি সুনিয়ন্ত্রিত আদর্শিক গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যে বাহিনীটি পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে আত্মস্থ করে যুদ্ধ করবে।
শেখ ফজলুল হক মণি (মরহুম), সিরাজুল আলম খান (মরহুম), আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রথম চারজন উদ্যোক্তা। এরপর ছিলো একটি মধ্যপর্যায়ের নেতৃত্ব। এছাড়াও ছিলো হাজার হাজার নেতাকর্মী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ছিলো লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে এই বাহিনীর কথা না বলে পারা যাবে না।
আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে, মুজিব বাহিনীই ছিলো বস্তুত বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজস্ব একটি বাহিনী। প্রাসঙ্গিকভাবে এ প্রশ্নটিও ওঠে আসতে পারে যে, কেউ কেন মুজিব বাহিনী নিয়ে কথা বলে না? এমনকি মুজিব বাহিনীর নেতারাও কেন প্রসঙ্গটি সামনে আনেন না? স্বাধীনতার এতো বছর পরও কি আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব না?
মুজিব বাহিনী বিষয়ক নিবন্ধটির শুরুতে প্রথম পর্বে আমরা মুজিব বাহিনীর গঠন সম্পর্কে কোন আলোচনা করিনি। তবে মুজিব বাহিনী গঠন করার যেসব কারণগুলো আমরা উল্লেখ করেছি তার বাইরেও আরও কিছু বিষয় ছিলো যার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক ও কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) এসএস ওবান তার বইতে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন; যার শিরোনাম হচ্ছে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী। তিনি মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোক্তাদের মুজিব বাহিনী গঠন করার বিষয়ে যুক্তিগুলো তার বইতে এভাবে তুলে ধরেনÑ ‘যুবনেতারা বাংলাদেশের ভেতরে তাদের বিস্তৃত সংগঠনের বদৌলতে জানতে পেরেছিলেন যে, কিছু মুক্তিবাহিনী ইউনিট কিছু বদঅভ্যাস রপ্ত করেছে, যাদের মধ্যে কতকে সাধারণ জনগণের ওপর লুটতরাজ করেছে এবং তাদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে, অন্যেরা ব্যক্তিগত শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। ...যদিও একটি ফোর্স হিসেবে মুক্তিবাহিনী চমৎকার কাজ করেছিল, তবু মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ ছিল নিন্দনীয় এবং তারা গোটা ফোর্সের দুর্নাম সৃষ্টি করেছিল। ...তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল যে, বাংলাদেশে মুজিববাহিনী নামটার গ্রহণযোগ্যতা হবে অপরিসীম এবং এটা শুধু তাদের সংগঠন থেকেই সহায়তা বয়ে আনবে না বরং সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও সহায়তা বয়ে আনবে।’ (ওবানের বইয়ের বাংলা অনুবাদ থেকে-পৃষ্ঠা ৪০)।
মুজিব বাহিনীর গঠন নিয়ে মুজিবনগর সরকারে বহুমত ছিলো এটি এখন প্রকাশিত সত্য। একাত্তরে মুজিব বাহিনীর গঠনও ঐতিহাসিক সত্য।
জেনারেল ওবানের বক্তব্যে মুক্তিবাহিনীর কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তার পরিমাণ একেবারেই অতি নগন্য বা হাতে গোণা কয়েকজন ছিলো। এতো বড় বাহিনীতে দুচারটা খারাপ লোক ঢুকে পড়তেই পারে। এর অন্যতম কারণ ছিলো যে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার সময় কোন যাচাই-বাছাই ছিলো না। অন্যদিকে রাজাকার বাহিনীতেও কেউ কেউ গিয়েছিলো ব্যক্তিগত-পারিবারিক কোন্দল বা দলাদলির জন্য। সেই সময়ে অনেকের পক্ষে এটি বিশ্বাস করা কঠিন ছিলো যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটা ভেঙ্গে যেতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে শুরু করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিক, দূরদর্শী ও সমন্বিত আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী মানুষের স্রোত সামলানো কঠিন ছিলো। এই বিপুল বিশাল বাহিনীর বড় অংশই সাধারণ মানুষ ছিলো। ফলে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এদের কারও কারও মাঝে পেশাদারি রাজনৈতিক বাহিনীর গুণাবলী অনুপস্থিত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধ বা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য অনিবার্য ছিলো। জেনারেল ওবানের কাছে মুজিব বাহিনী গঠনের যতো কারণই থাকুক আমার কাছে মনে হয়েছে মুজিব বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো রাজনৈতিক। একাত্তরের যুদ্ধের সময় একটি রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও সচেতন সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী যারা রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করবে তাদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই ছিলো। মুক্তিবাহিনী সাধারণ মানুষের বাহিনী ছিলো বলে এর রাজনৈতিক চরিত্র নির্ণয় করাও কঠিন ছিলো। যদিও ৭০-এর নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে তেমন কোন বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিলো না; তথাপি আওয়ামী লীগের কর্মী হলেও সে স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রকৃত অর্থ বুঝবে সেটি নাও হতে পারতো। বরং মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী ইপিআর-পুলিশ সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ভিত্তিটা ততোটা স্পষ্ট ও দৃঢ় ছিলো না। সেটি থাকার কথাও নয়। পেশাদার সৈনিক, রাজনৈতিক বাহিনী ও সাধারণ জনগণের মাঝে বিশাল ফারাক থাকবেই।
ষাটের দশকের নিউক্লিয়াসের কথা আলোচনায় না আনলেও এটি স্পষ্ট করে বলা যায় যে, ৬৯-৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নিয়ে যাবার পেছনে স্বাধীনতাকামী যুব নেতৃত্ব সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচনসহ একাত্তরের যুদ্ধে ছাত্রলীগ কেবল নেতৃত্ব দেয়নি বস্তুত স্রোতের বিপক্ষে তারুণ্যকে সংগঠিত করেছে। কেউ যেন ভুলে না যান যে, একাত্তরের মার্চের আগে বাংলাদেশের একটি ছাত্র সংগঠনই সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করার লড়াইটা করেছে। ছাত্রলীগের কাছাকাছি জনপ্রিয় সংগঠন দুনিয়ার মজদুর এক হও সেøাগান তো দিতোই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে বুর্জোয়াদের কামড়াকামড়ি বলেও আখ্যায়িত করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের (পিকিংপন্থি) একটি অংশ তো স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। আমরা তাদের পিকিংপন্থি বলে চিহ্নিত করতাম। অন্যদিকে জাতির পিতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া, জয় বাংলা সেøাগানের জন্ম দেয়া, জাতীয় পতাকা তৈরি, জাতীয় সঙ্গীত বাছাই, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ, জয় বাংলা সেøাগান দেয়া, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদির সবটা ছাত্রলীগই করেছে। ওরাই যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গেছে তখন যুদ্ধের অগ্রসেনানীর জায়গাটিতে তাদের গড়ে তোলাটাই একটি অপরিহার্য বিষয় ছিলো।
[লেখক : সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]
মোস্তাফা জব্বার
মঙ্গলবার, ০৫ মার্চ ২০২৪
দুই ॥
যারা ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা তখন ভারত সরকারের কাছে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেন এবং অনুরোধ করেন যেন এমন একটি সুনিয়ন্ত্রিত আদর্শিক গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়, যে বাহিনীটি পুরোপুরি রাজনৈতিক আদর্শকে আত্মস্থ করে যুদ্ধ করবে।
শেখ ফজলুল হক মণি (মরহুম), সিরাজুল আলম খান (মরহুম), আব্দুর রাজ্জাক (মরহুম) এবং তোফায়েল আহমেদ ছিলেন এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রথম চারজন উদ্যোক্তা। এরপর ছিলো একটি মধ্যপর্যায়ের নেতৃত্ব। এছাড়াও ছিলো হাজার হাজার নেতাকর্মী। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ছিলো লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক কর্মী। প্রধানত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে এই বাহিনীর কথা না বলে পারা যাবে না।
আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে, মুজিব বাহিনীই ছিলো বস্তুত বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজস্ব একটি বাহিনী। প্রাসঙ্গিকভাবে এ প্রশ্নটিও ওঠে আসতে পারে যে, কেউ কেন মুজিব বাহিনী নিয়ে কথা বলে না? এমনকি মুজিব বাহিনীর নেতারাও কেন প্রসঙ্গটি সামনে আনেন না? স্বাধীনতার এতো বছর পরও কি আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব না?
মুজিব বাহিনী বিষয়ক নিবন্ধটির শুরুতে প্রথম পর্বে আমরা মুজিব বাহিনীর গঠন সম্পর্কে কোন আলোচনা করিনি। তবে মুজিব বাহিনী গঠন করার যেসব কারণগুলো আমরা উল্লেখ করেছি তার বাইরেও আরও কিছু বিষয় ছিলো যার জন্য মুজিব বাহিনী গঠন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক ও কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) এসএস ওবান তার বইতে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন; যার শিরোনাম হচ্ছে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী। তিনি মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোক্তাদের মুজিব বাহিনী গঠন করার বিষয়ে যুক্তিগুলো তার বইতে এভাবে তুলে ধরেনÑ ‘যুবনেতারা বাংলাদেশের ভেতরে তাদের বিস্তৃত সংগঠনের বদৌলতে জানতে পেরেছিলেন যে, কিছু মুক্তিবাহিনী ইউনিট কিছু বদঅভ্যাস রপ্ত করেছে, যাদের মধ্যে কতকে সাধারণ জনগণের ওপর লুটতরাজ করেছে এবং তাদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে, অন্যেরা ব্যক্তিগত শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। ...যদিও একটি ফোর্স হিসেবে মুক্তিবাহিনী চমৎকার কাজ করেছিল, তবু মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ ছিল নিন্দনীয় এবং তারা গোটা ফোর্সের দুর্নাম সৃষ্টি করেছিল। ...তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল যে, বাংলাদেশে মুজিববাহিনী নামটার গ্রহণযোগ্যতা হবে অপরিসীম এবং এটা শুধু তাদের সংগঠন থেকেই সহায়তা বয়ে আনবে না বরং সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও সহায়তা বয়ে আনবে।’ (ওবানের বইয়ের বাংলা অনুবাদ থেকে-পৃষ্ঠা ৪০)।
মুজিব বাহিনীর গঠন নিয়ে মুজিবনগর সরকারে বহুমত ছিলো এটি এখন প্রকাশিত সত্য। একাত্তরে মুজিব বাহিনীর গঠনও ঐতিহাসিক সত্য।
জেনারেল ওবানের বক্তব্যে মুক্তিবাহিনীর কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তার পরিমাণ একেবারেই অতি নগন্য বা হাতে গোণা কয়েকজন ছিলো। এতো বড় বাহিনীতে দুচারটা খারাপ লোক ঢুকে পড়তেই পারে। এর অন্যতম কারণ ছিলো যে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার সময় কোন যাচাই-বাছাই ছিলো না। অন্যদিকে রাজাকার বাহিনীতেও কেউ কেউ গিয়েছিলো ব্যক্তিগত-পারিবারিক কোন্দল বা দলাদলির জন্য। সেই সময়ে অনেকের পক্ষে এটি বিশ্বাস করা কঠিন ছিলো যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটা ভেঙ্গে যেতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে শুরু করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিক, দূরদর্শী ও সমন্বিত আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী মানুষের স্রোত সামলানো কঠিন ছিলো। এই বিপুল বিশাল বাহিনীর বড় অংশই সাধারণ মানুষ ছিলো। ফলে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এদের কারও কারও মাঝে পেশাদারি রাজনৈতিক বাহিনীর গুণাবলী অনুপস্থিত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা মুজিব বাহিনী সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধ বা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য অনিবার্য ছিলো। জেনারেল ওবানের কাছে মুজিব বাহিনী গঠনের যতো কারণই থাকুক আমার কাছে মনে হয়েছে মুজিব বাহিনী গঠনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো রাজনৈতিক। একাত্তরের যুদ্ধের সময় একটি রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও সচেতন সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী যারা রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে সশস্ত্র লড়াই করবে তাদের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই ছিলো। মুক্তিবাহিনী সাধারণ মানুষের বাহিনী ছিলো বলে এর রাজনৈতিক চরিত্র নির্ণয় করাও কঠিন ছিলো। যদিও ৭০-এর নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বাইরে তেমন কোন বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিলো না; তথাপি আওয়ামী লীগের কর্মী হলেও সে স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রকৃত অর্থ বুঝবে সেটি নাও হতে পারতো। বরং মুক্তিবাহিনীতে যোগদানকারী ইপিআর-পুলিশ সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ভিত্তিটা ততোটা স্পষ্ট ও দৃঢ় ছিলো না। সেটি থাকার কথাও নয়। পেশাদার সৈনিক, রাজনৈতিক বাহিনী ও সাধারণ জনগণের মাঝে বিশাল ফারাক থাকবেই।
ষাটের দশকের নিউক্লিয়াসের কথা আলোচনায় না আনলেও এটি স্পষ্ট করে বলা যায় যে, ৬৯-৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নিয়ে যাবার পেছনে স্বাধীনতাকামী যুব নেতৃত্ব সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচনসহ একাত্তরের যুদ্ধে ছাত্রলীগ কেবল নেতৃত্ব দেয়নি বস্তুত স্রোতের বিপক্ষে তারুণ্যকে সংগঠিত করেছে। কেউ যেন ভুলে না যান যে, একাত্তরের মার্চের আগে বাংলাদেশের একটি ছাত্র সংগঠনই সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করার লড়াইটা করেছে। ছাত্রলীগের কাছাকাছি জনপ্রিয় সংগঠন দুনিয়ার মজদুর এক হও সেøাগান তো দিতোই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে বুর্জোয়াদের কামড়াকামড়ি বলেও আখ্যায়িত করেছে। ছাত্র ইউনিয়নের (পিকিংপন্থি) একটি অংশ তো স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো। আমরা তাদের পিকিংপন্থি বলে চিহ্নিত করতাম। অন্যদিকে জাতির পিতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া, জয় বাংলা সেøাগানের জন্ম দেয়া, জাতীয় পতাকা তৈরি, জাতীয় সঙ্গীত বাছাই, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ, জয় বাংলা সেøাগান দেয়া, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদির সবটা ছাত্রলীগই করেছে। ওরাই যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গেছে তখন যুদ্ধের অগ্রসেনানীর জায়গাটিতে তাদের গড়ে তোলাটাই একটি অপরিহার্য বিষয় ছিলো।
[লেখক : সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]