alt

উপ-সম্পাদকীয়

সম্পর্কের জটিলতা ও আত্মহত্যা

সাদিকুর সাদিক

: সোমবার, ২৫ মার্চ ২০২৪

আমাদের দেশে আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে পরিবার, প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা ও কলহ অন্যতম। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে একে অপরের সঙ্গে যেকোনোভাবে, যেকোনো কারণে প্রয়োজন হতে পারে। তাদের প্রতি নির্ভরতা তৈরি হওয়ার ফলে সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়। এভাবেই সম্পর্ক হয় আত্মার সঙ্গে আত্মার মেলবন্ধনে তৈরি হওয়া আত্মীয়দের সঙ্গে, নিজের শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে, ক্লাসমেট বন্ধু-বান্ধবী, প্রিয়জনসহ নিজের আশপাশে অবস্থান করা মানুষদের সঙ্গে। জটিলতা শব্দটিই বলে দেয়, সম্পর্ক স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও আন্তরিকতা অভাব দেখা দিয়েছে। সম্পর্কের জটিলতা বলতে সম্পর্ক রাখাটাকে কঠিন করে ফেলাকেই বোঝায়।

প্রতিটা মানুষের চলাফেরার এক বা একাধিক নির্দিষ্ট সার্কেল থাকে যা তার ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলে। সেই সার্কেলে থাকা সদস্যদের প্রভাবতাকে নিজের মন-মানসিকতাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেÑ হোক তা নেতিবাচকভাবে বা ইতিবাচকভাবে। এই সার্কেলে হয়তো কাউকে ইচ্ছামতো যুক্ত করি বা সেখানে বসবাস, পড়াশোনা বা চাকরির সুবাদে নিজেই যুক্ত হই। বিভিন্ন রকম দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক, ভাবের আদান-প্রদান হয়। আমরা যখন কোনো একটা পরিবেশের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করিÑ স্বভাবতই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয় কেননা তাদের সঙ্গে একে অপরের প্রয়োজনে কাছে রাখতেই হয় অথবা তাদের পাশে থাকতেই হয়। তাদের চিন্তাধারা ও আচরণ আমাদের প্রভাবিত করে। এই প্রভাবটা যদি নেতবাচক হয় তাহলেই সম্পর্কের জটিলতা তৈরি হয়। এজন্য সবসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা কমিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা সহজ হয়।

বন্ধু বা শুভাকাক্সক্ষী সার্কেলের প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক সহজে রাখতে পারাতেই নিজেদের কমফোর্ট জোন হিসেবে মনে হয়। কিন্তু নিজেকে ভালো রাখার জন্য কমফোর্ট জোনের ওপর নির্ভর করাটা অনেক সময় অনুচিত হয়ে যায় কেননা এই কমফোর্ট জোনের কারোর সঙ্গে মনোমালিন্য অনেক সময় ব্যক্তিভেদে মানসিক অশান্তির কারণ হয়। কমফোর্ট জোনের সবাইকেই অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ, আত্মসম্মানবোধ ও মনমেজাজের মতো স্পর্শকাতর বিষয় খেয়াল না রেখে হাসি-তামাসা, ঠাট্টা করা বেশির ভাগ সময় অনেক ভালো সম্পর্কগুলোকেও জটিল করে তোলে। এই জটিলতা থেকেই অনেক সময় সম্পর্ক বিষাক্ত হতে শুরু করে।

প্রিয়জনদের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যেই সম্পর্কের গভীরতা বুঝা যায়। আবার কথার মাধ্যমেই সম্পর্ক জটিল করা যায় খুব সহজেই। মুখের ভাষার মাধুর্যতাই ভালো সম্পর্কের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ভদ্রতা, শিষ্টাচার, আনুগত্য, নমনীয়তা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলোÑ কথা, স্বর বা শব্দচয়ন। এর অল্প একটু হেরফের অনেক বড় ঝামেলার সৃষ্টি করে। এই কথা ও কাজের মিল রাখাটাও কথার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। এ দিকটাই বিশেষ নজর দেয়া জরুরি।

সম্পর্ক জটিল করার পেছনে আমাদের নৈতিক চরিত্রের ভূমিকা অনেক বেশি। নিজের আত্মীয় বা বন্ধু সার্কেলে নৈতিকতার অবক্ষয়জনিত বিষয় থাকলে তা সম্পর্ক অবনতির কারণ হয়। এমন অবক্ষয় সম্পর্কের মধুরতা নষ্ট করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তথাকথিতা আবেগি প্রেমকাহিনী, বন্ধুত্বের কাহিনী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় আমাদের অন্যের প্রতি প্রত্যাশা বেড়ে যায়। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়েও নিজের প্রত্যাশা বাড়িয়ে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়েও হতাশায় ভুগে থাকে। কথা কাজে মিল না রাখা, লেনদেন এ স্বচ্ছতা না রাখা, আশপাশের মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন না থাকলেও অধস্তন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপড়েন হয়।

সম্পর্কে ধৈর্যের গুরুত্ব আমরা ভুলতে বসেছি। একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে যদি খুব বেশি পরিশ্রম করা লাগে তাহলেই একসময় হয়ত ধৈর্যের বাধ ভেঙে তিক্ত অভিজ্ঞতার সূচনা হয়। এই তিক্ত অভিজ্ঞতায় সম্পর্ককে জটিল করে। আমরা কারো প্রতি অভিযোগ করাটাকেও সবসময় একমাত্র সমাধান ভেবে ভুল করি। অধিকাংশ সম্পর্ক অবশ্যই ধৈর্যের ওপর ভিত্তি করেই টিকে থাকে। কখনো কখনো ধৈর্য ধারণ করে, মেনে নিয়ে বা মানিয়ে নিয়েই সব সম্পর্ককে সহজ করতে হয়। অনেক সময় যোগাযোগের ভাষা এবং যোগাযোগের সুযোগ কাজে লাগানো সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। খুব গোমরামুখো বা চাপা স্বভাবের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ না বিধায় তাদের বুঝে উঠতে পারাটা কঠিন। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাও কঠিন হয়। সেক্ষেত্রে পরিমিত ভাবের প্রকাশ এই অসুবিধা দূর করতে পারে।

নিজের দায়িত্ব অবহেলার মাধ্যমেও আমরা নিজেদের সম্পর্ককে জটিল করে ফেলি। সবাই সবার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেÑ যেটা খুব সাধারণ একটা প্রত্যাশা। সার্কেল, পরিবারে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাব পালন না করলে অন্যের অভিযোগ জমা হয়। কেউ অভিযোগ প্রকাশ করলে তা মেনে নেয়ার মতো সৎ সাহসের অভাবে সম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয়। কখনো আবার অযৌক্তিক অভিযোগের কারণেও পরিবেশ অশান্ত হয়ে যায়।

সম্পর্কের জটিলতা কমাতে হলে সম্পর্কটা নিজের সমান সামাজিক স্ট্যাটাস রয়েছে এমন মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কে করাটাই ভালো। যদি সামাজিক অবস্থানের তারতম্য হয় তাহলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকটাও বিশেষভাবে জেনে সম্পর্কে জড়ানো উচিত। এলাকাভেদে সামাজিক রীতিনীতি একটু পার্থক্য থাকলেও সেটা অবশ্যই বিবেচনায় রেখেই সম্পর্ক রক্ষার কথা ভাবতে হবে।

সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়াটা খুব জরুরি। সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই উভয়ের আপত্তিকর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে আপত্তির বিষয়গুলো অনেক কম এবং স্পষ্ট হওয়াটাই শ্রেয়। নিকটাত্মীয়, প্রিয়জন বা বন্ধুÑ সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে যদি অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় মেনটেইন করা লাগে তাহলে সেই সম্পর্কটা দিনে দিনে বোঝা হতে শুরু করে। যাদের ব্যক্তিত্ব পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে খুব বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয় সাধারণত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। খুব অল্পতেই অপর কেউ কিছু মনে করল কিনা, কষ্ট পেল কিনা, ভুল বুঝল কিনাÑ প্রশ্নগুলো সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। অনেক সময় সরাসরি অভিযোগ না দিয়ে পরোক্ষভাবে তার সমাধান করা যায় কিনা ভাবতে হয়। অভিযোগের পাহাড় জমানোর আগে সেগুলোর যৌক্তিকতা অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত।

সব সম্পর্কেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকাটা খুবই জরুরি। একে অপরের ছাড় দেয়ার বিষয়গুলোর মধ্যে যত ভালো বোঝাপড়া সে সম্পর্কগুলো তত মধুর স্মৃতি জমা করে। শুধু অন্যের ছাড় দেয়ার অপেক্ষায় থাকলেই হবে না, অনেক সময় সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভব করে নিজেকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এই বিষয়ে একে অপরের প্রতিযোগী হলেও দোষের কিছু নেই।

অপরের মতামত ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া খুব জরুরি। অন্যের আবেগ, ভালোবাসা, ভালো লাগা, রাগ ও ঘৃণার তীব্রতা মাঝে মধ্যেই ওঠানামা করে এবং কমবেশি হয়। এর পেছনে যে সবসময় একটা উপযুক্ত বা বড় কারণ থাকবে বা থাকতেই হবে বিষয়টা সবসময় এমন না-ও হতে পারে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই অন্যের আবেগ ভালোবাসা ও ভালো লাগার বিষয়বস্তুর প্রতি এক্সপেক্টেশন সবসময় একইরকম রাখা উচিত না। অন্যের পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে নিজের এক্সপেকটেশনেরও সে অনুযায়ী লাগাম টানাটাই সবথেকে ভালো। বিষয়টা সবসময় সব ক্ষেত্রে মনে রাখাটা মানসিকভাবে অনেক ভালো থাকার কারণ।

সব থেকে বড় বিষয় উপরিউক্ত সবকিছুর মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখা। উক্ত বিষয়গুলোর অভাব বা তার অতিরিক্ততার কারণে ভারসাম্য নষ্টই মূলত যাবতীয় জটিলতার জন্ম দেয়। অনেক সময় আমরা ভুলেই যায় যে আমাদের চারপাশের মানুষেরদের সঙ্গে সম্পর্কের অবস্থান অবশ্যই একটা মধ্যম পর্যায়ে রাখতেÑ অন্যথায় সময়ের পরিক্রমায় ভারসাম্য নষ্ট হবে। নিজেদের চারপাশের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কগুলোকে সহজ করার মাধ্যমেই আত্মহত্যা, একাকিত্ব, মানসিক অশান্তির মতো নীরব সামাজিক ব্যাধি অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মনে করি। যদি সবাই একটু নিজের মতো করে উপলব্ধি করে সম্পর্কের জটিলতা কমাতে পদক্ষেপ নিইÑ তাহলেই একটি সুখী সমাজ, পরিবার, সর্বোপরি দেশ গঠনে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

[লেখক : সাইকোসোশ্যাল সাপোর্টার, ইবি মনোবাতায়ন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট : সংকোচন, সংকট ও সম্ভাবনার প্রতিফলন

আম রপ্তানি : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

সামাজিকমাধ্যম গুরুত্বহীন নয়

জমির শ্রেণী চেনার উপায় ও পরিবর্তনের নিয়ম-কানুন

বাংলাদেশ : “রক্তে জন্ম আর পানিতে মরণ”

নতুন নোট, নতুন বিতর্ক

রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের হতাশা ও উপজেলা পর্যায়ের অদক্ষতা : কে নেবে দায়িত্ব?

তরল সম্পর্কের গোলকধাঁধা

পরিবার থেকে রাষ্ট্র : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উপায়

বাজেটে বৈষম্য কমানোর কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন আছে কি

চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে

রম্যগদ্য : ‘নির্বাচন, না নীর-বচন...’

প্লাস্টিক দূষণ নয়, প্রকৃতির পাশে দাঁড়ান

কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ত্যাগের মহিমায় ঈদুল আজহা

নাম ও মর্যাদা : অর্থবহ নামকরণে বৈষম্য রোধের আহ্বান

ডিজিটাল পুঁজিবাদের যুগে নগর বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামো

পারিবারিক শিক্ষা ও রাষ্ট্রসংস্কার : ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথরেখা

প্রসঙ্গ : রাজধানীর যানজট

নবায়নযোগ্য জ্বালানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ছবি

তাহলে একাত্তরে হয়নিকো কোনো অপরাধ!

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে বাস্তববাদী বাঁক

রম্যগদ্য : ‘জনগণের ভালোবাসা কি আমার ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াইবো?’

ভালো থাকার কঠিন কলা : কিছু সরল সত্য

নীরব ঘাতক তামাক

পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা

নিয়ন্ত্রণহীন নেটজগৎ ও ফেইসবুক : সমাজে বিভ্রান্তির ডিজিটাল উৎপত্তি

বস্তিবাসী নারী : অদৃশ্য শক্তির আখ্যান

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল : বিতর্ক, নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন

সংস্কারের ভবিষ্যত কী?

বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড় চায় না তো কেউ, প্রকৃতির নিয়মে আসে কিন্তু তাই!

কেন থমকে আছে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সম্পর্কের জটিলতা ও আত্মহত্যা

সাদিকুর সাদিক

সোমবার, ২৫ মার্চ ২০২৪

আমাদের দেশে আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে পরিবার, প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা ও কলহ অন্যতম। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে একে অপরের সঙ্গে যেকোনোভাবে, যেকোনো কারণে প্রয়োজন হতে পারে। তাদের প্রতি নির্ভরতা তৈরি হওয়ার ফলে সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়। এভাবেই সম্পর্ক হয় আত্মার সঙ্গে আত্মার মেলবন্ধনে তৈরি হওয়া আত্মীয়দের সঙ্গে, নিজের শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে, ক্লাসমেট বন্ধু-বান্ধবী, প্রিয়জনসহ নিজের আশপাশে অবস্থান করা মানুষদের সঙ্গে। জটিলতা শব্দটিই বলে দেয়, সম্পর্ক স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও আন্তরিকতা অভাব দেখা দিয়েছে। সম্পর্কের জটিলতা বলতে সম্পর্ক রাখাটাকে কঠিন করে ফেলাকেই বোঝায়।

প্রতিটা মানুষের চলাফেরার এক বা একাধিক নির্দিষ্ট সার্কেল থাকে যা তার ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলে। সেই সার্কেলে থাকা সদস্যদের প্রভাবতাকে নিজের মন-মানসিকতাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেÑ হোক তা নেতিবাচকভাবে বা ইতিবাচকভাবে। এই সার্কেলে হয়তো কাউকে ইচ্ছামতো যুক্ত করি বা সেখানে বসবাস, পড়াশোনা বা চাকরির সুবাদে নিজেই যুক্ত হই। বিভিন্ন রকম দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক, ভাবের আদান-প্রদান হয়। আমরা যখন কোনো একটা পরিবেশের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করিÑ স্বভাবতই তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয় কেননা তাদের সঙ্গে একে অপরের প্রয়োজনে কাছে রাখতেই হয় অথবা তাদের পাশে থাকতেই হয়। তাদের চিন্তাধারা ও আচরণ আমাদের প্রভাবিত করে। এই প্রভাবটা যদি নেতবাচক হয় তাহলেই সম্পর্কের জটিলতা তৈরি হয়। এজন্য সবসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা কমিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা সহজ হয়।

বন্ধু বা শুভাকাক্সক্ষী সার্কেলের প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক সহজে রাখতে পারাতেই নিজেদের কমফোর্ট জোন হিসেবে মনে হয়। কিন্তু নিজেকে ভালো রাখার জন্য কমফোর্ট জোনের ওপর নির্ভর করাটা অনেক সময় অনুচিত হয়ে যায় কেননা এই কমফোর্ট জোনের কারোর সঙ্গে মনোমালিন্য অনেক সময় ব্যক্তিভেদে মানসিক অশান্তির কারণ হয়। কমফোর্ট জোনের সবাইকেই অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ, আত্মসম্মানবোধ ও মনমেজাজের মতো স্পর্শকাতর বিষয় খেয়াল না রেখে হাসি-তামাসা, ঠাট্টা করা বেশির ভাগ সময় অনেক ভালো সম্পর্কগুলোকেও জটিল করে তোলে। এই জটিলতা থেকেই অনেক সময় সম্পর্ক বিষাক্ত হতে শুরু করে।

প্রিয়জনদের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যেই সম্পর্কের গভীরতা বুঝা যায়। আবার কথার মাধ্যমেই সম্পর্ক জটিল করা যায় খুব সহজেই। মুখের ভাষার মাধুর্যতাই ভালো সম্পর্কের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ভদ্রতা, শিষ্টাচার, আনুগত্য, নমনীয়তা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলোÑ কথা, স্বর বা শব্দচয়ন। এর অল্প একটু হেরফের অনেক বড় ঝামেলার সৃষ্টি করে। এই কথা ও কাজের মিল রাখাটাও কথার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। এ দিকটাই বিশেষ নজর দেয়া জরুরি।

সম্পর্ক জটিল করার পেছনে আমাদের নৈতিক চরিত্রের ভূমিকা অনেক বেশি। নিজের আত্মীয় বা বন্ধু সার্কেলে নৈতিকতার অবক্ষয়জনিত বিষয় থাকলে তা সম্পর্ক অবনতির কারণ হয়। এমন অবক্ষয় সম্পর্কের মধুরতা নষ্ট করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তথাকথিতা আবেগি প্রেমকাহিনী, বন্ধুত্বের কাহিনী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় আমাদের অন্যের প্রতি প্রত্যাশা বেড়ে যায়। এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়েও নিজের প্রত্যাশা বাড়িয়ে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়েও হতাশায় ভুগে থাকে। কথা কাজে মিল না রাখা, লেনদেন এ স্বচ্ছতা না রাখা, আশপাশের মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন না থাকলেও অধস্তন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপড়েন হয়।

সম্পর্কে ধৈর্যের গুরুত্ব আমরা ভুলতে বসেছি। একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে যদি খুব বেশি পরিশ্রম করা লাগে তাহলেই একসময় হয়ত ধৈর্যের বাধ ভেঙে তিক্ত অভিজ্ঞতার সূচনা হয়। এই তিক্ত অভিজ্ঞতায় সম্পর্ককে জটিল করে। আমরা কারো প্রতি অভিযোগ করাটাকেও সবসময় একমাত্র সমাধান ভেবে ভুল করি। অধিকাংশ সম্পর্ক অবশ্যই ধৈর্যের ওপর ভিত্তি করেই টিকে থাকে। কখনো কখনো ধৈর্য ধারণ করে, মেনে নিয়ে বা মানিয়ে নিয়েই সব সম্পর্ককে সহজ করতে হয়। অনেক সময় যোগাযোগের ভাষা এবং যোগাযোগের সুযোগ কাজে লাগানো সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। খুব গোমরামুখো বা চাপা স্বভাবের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ না বিধায় তাদের বুঝে উঠতে পারাটা কঠিন। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠাও কঠিন হয়। সেক্ষেত্রে পরিমিত ভাবের প্রকাশ এই অসুবিধা দূর করতে পারে।

নিজের দায়িত্ব অবহেলার মাধ্যমেও আমরা নিজেদের সম্পর্ককে জটিল করে ফেলি। সবাই সবার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেÑ যেটা খুব সাধারণ একটা প্রত্যাশা। সার্কেল, পরিবারে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাব পালন না করলে অন্যের অভিযোগ জমা হয়। কেউ অভিযোগ প্রকাশ করলে তা মেনে নেয়ার মতো সৎ সাহসের অভাবে সম্পর্কে তিক্ততা শুরু হয়। কখনো আবার অযৌক্তিক অভিযোগের কারণেও পরিবেশ অশান্ত হয়ে যায়।

সম্পর্কের জটিলতা কমাতে হলে সম্পর্কটা নিজের সমান সামাজিক স্ট্যাটাস রয়েছে এমন মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কে করাটাই ভালো। যদি সামাজিক অবস্থানের তারতম্য হয় তাহলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকটাও বিশেষভাবে জেনে সম্পর্কে জড়ানো উচিত। এলাকাভেদে সামাজিক রীতিনীতি একটু পার্থক্য থাকলেও সেটা অবশ্যই বিবেচনায় রেখেই সম্পর্ক রক্ষার কথা ভাবতে হবে।

সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়াটা খুব জরুরি। সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই উভয়ের আপত্তিকর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। সেক্ষেত্রে আপত্তির বিষয়গুলো অনেক কম এবং স্পষ্ট হওয়াটাই শ্রেয়। নিকটাত্মীয়, প্রিয়জন বা বন্ধুÑ সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে যদি অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় মেনটেইন করা লাগে তাহলে সেই সম্পর্কটা দিনে দিনে বোঝা হতে শুরু করে। যাদের ব্যক্তিত্ব পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে খুব বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয় সাধারণত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। খুব অল্পতেই অপর কেউ কিছু মনে করল কিনা, কষ্ট পেল কিনা, ভুল বুঝল কিনাÑ প্রশ্নগুলো সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। অনেক সময় সরাসরি অভিযোগ না দিয়ে পরোক্ষভাবে তার সমাধান করা যায় কিনা ভাবতে হয়। অভিযোগের পাহাড় জমানোর আগে সেগুলোর যৌক্তিকতা অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত।

সব সম্পর্কেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকাটা খুবই জরুরি। একে অপরের ছাড় দেয়ার বিষয়গুলোর মধ্যে যত ভালো বোঝাপড়া সে সম্পর্কগুলো তত মধুর স্মৃতি জমা করে। শুধু অন্যের ছাড় দেয়ার অপেক্ষায় থাকলেই হবে না, অনেক সময় সম্পর্কের গুরুত্ব অনুভব করে নিজেকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এই বিষয়ে একে অপরের প্রতিযোগী হলেও দোষের কিছু নেই।

অপরের মতামত ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া খুব জরুরি। অন্যের আবেগ, ভালোবাসা, ভালো লাগা, রাগ ও ঘৃণার তীব্রতা মাঝে মধ্যেই ওঠানামা করে এবং কমবেশি হয়। এর পেছনে যে সবসময় একটা উপযুক্ত বা বড় কারণ থাকবে বা থাকতেই হবে বিষয়টা সবসময় এমন না-ও হতে পারে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই অন্যের আবেগ ভালোবাসা ও ভালো লাগার বিষয়বস্তুর প্রতি এক্সপেক্টেশন সবসময় একইরকম রাখা উচিত না। অন্যের পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে নিজের এক্সপেকটেশনেরও সে অনুযায়ী লাগাম টানাটাই সবথেকে ভালো। বিষয়টা সবসময় সব ক্ষেত্রে মনে রাখাটা মানসিকভাবে অনেক ভালো থাকার কারণ।

সব থেকে বড় বিষয় উপরিউক্ত সবকিছুর মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখা। উক্ত বিষয়গুলোর অভাব বা তার অতিরিক্ততার কারণে ভারসাম্য নষ্টই মূলত যাবতীয় জটিলতার জন্ম দেয়। অনেক সময় আমরা ভুলেই যায় যে আমাদের চারপাশের মানুষেরদের সঙ্গে সম্পর্কের অবস্থান অবশ্যই একটা মধ্যম পর্যায়ে রাখতেÑ অন্যথায় সময়ের পরিক্রমায় ভারসাম্য নষ্ট হবে। নিজেদের চারপাশের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কগুলোকে সহজ করার মাধ্যমেই আত্মহত্যা, একাকিত্ব, মানসিক অশান্তির মতো নীরব সামাজিক ব্যাধি অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মনে করি। যদি সবাই একটু নিজের মতো করে উপলব্ধি করে সম্পর্কের জটিলতা কমাতে পদক্ষেপ নিইÑ তাহলেই একটি সুখী সমাজ, পরিবার, সর্বোপরি দেশ গঠনে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

[লেখক : সাইকোসোশ্যাল সাপোর্টার, ইবি মনোবাতায়ন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top