alt

উপ-সম্পাদকীয়

অবন্তিকাদের আত্মহনন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪
image

ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা

১৫ মার্চ ২০২৪; কুমিল্লা শহরের নিজ বাসায় রাত ১০টার দিকে আত্মহত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। আত্মহত্যার আগে নিজের ফেইসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তার মৃত্যুর জন্য সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করে গেছেন। ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে বহিষ্কার এবং দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এই দুইজনের বিরুদ্ধে অবন্তিকার অভিযোগ হচ্ছে, আম্মান যৌন নিপীড়নমূলক কমেন্ট করে অবন্তিকাকে শুধু উত্ত্যক্তই করত না, অনলাইন ও অফলাইনে অহর্নিশ হুমকি দিত। আম্মানের বিরুদ্ধে প্রক্টর অফিসে নালিশ করার পর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম অভিযোগ আমলে না নিয়ে বরং অবন্তিকাকে নানাভাবে ভয় দেখাতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিতেন।

অবন্তিকার কথামতো তাকে সাতবার প্রক্টর অফিসে ডেকে নিয়ে দ্বীন ইসলাম জুতা দিয়ে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। অবন্তিকা নিজেকে ‘লড়াকু মানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেও কেন লড়াইটা অব্যাহত রাখল না তা স্পষ্ট নয়। অবন্তিকা এবং আম্মানের মধ্যে ঘটনার শুরু ২০২২ সালে, কিন্তু ঘটনার আদ্যোপান্ত এখনো উন্মোচিত হয়নি। সহকারী প্রক্টর খারাপ আচরণ করলে প্রক্টর বা উপচার্যের নিকট কেন গেল না তাও অবন্তিকার পোস্টে স্পষ্ট করা হয়নি। অনলাইনে সেক্সুয়ালি এবিউজিভ কমেন্ট করে থাকলে তা তো ডিজিটাল আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, লড়াকু অবন্তিকা না লড়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করল কেন? আম্মান কি প্রভাবশালী ছাত্রনেতা? আম্মান কি অপ্রতিরোধ্য?

আম্মানের সাথে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সম্পর্কটা কেন গাঢ়- এই সকল প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে গঠিত কমিটি ও গোয়েন্দা সংস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্বের বিদ্যালয়, এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সব শিক্ষককে ছাত্র-ছাত্রীরা মা-বাবার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে থাকে। তাই শিক্ষকের কাছ থেকে যৌন নিপীড়নের শিকার হলে সমাজের অবক্ষয়ের করুণ চিত্র পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এবং ছাত্রীদের অসহায়ত্ব বেড়ে যায়। পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বা ফেল করে দেওয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করে শিক্ষকদের যৌন নিপীড়ন করার বহু খবর শোনা যায়। পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়ার আগাম বার্তা একজন মেধাবী ছাত্রীকে আতঙ্কগ্রস্ত করতেই পারে, অনেকে তাই শিক্ষকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে আগত অবন্তিকার সহপাঠী কাজী ফারজানা মিমের বক্তব্য হচ্ছেÑ তার ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনের কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাকে ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় মাত্র ০৩ নম্বর এবং ৫০ নম্বরে ১০ নম্বর দেওয়া হয়েছে।

একাডেমিক কাজে মিমকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ২০২১ সনে পেশ করা হলেও ২০২৪ সনের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে কয়েক দিন আগে নতুন উপচার্যের উদ্যোগে প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে এবং অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিভাগের প্রধান জুনায়েদ আহমদ হালিমকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তখন, যখন ওই কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বিগত কয়েক দিনে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে যৌন হয়রানির ২০টি অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে স্নাতকোত্তর থিসিস পর্বের এক ছাত্রী রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মতিন কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। ল্যাবে কাজ করার সময় ঠান্ডা লাগার অজুহাত দিয়ে ছাত্রীকে জড়িয়ে ধরা এবং ল্যাবের জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল দেওয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে ধর্ষণের চেষ্টা করার অভিযোগ ওঠেছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অতি সম্প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

উল্লেখিত যৌন নিপীড়নের কোন ঘটনায় কর্তৃপক্ষ প্রথমে কর্ণপাত করেনি; শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও ছাত্রের বিরুদ্ধেও একই ঘটনা ঘটেছে, অবন্তিকার আত্মহত্যার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে কর্তৃপক্ষের ঘুম ভেঙ্গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানির ব্যাপকতায় উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে যৌন নিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল গঠন করে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে; কিন্তু সেলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। না করারও কারণ আছে। আইনজীবী, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও জাতীয় রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। বিএনপির আমলে নিয়োগ পেয়ে এক ভিসি গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির চেয়ারে বসে পড়েছিলেন, সকাল পর্যন্ত বিদায়ী ভিসিকে সময় দেননি। যৌন নিপীড়ক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হলে তার বিচার করার সাহস অভিযোগ সেল বা কর্তৃপক্ষের থাকে না। অবশ্য সেলের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ক্ষমতাসীন দলের লোক, সরকারের অন্ধ সমর্থক না হলে এই সকল পদ পাওয়া যায় না। তাই যৌন নিপীড়ক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করে বিধায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যতীত অভিযোগ আমলে নেওয়ার রীতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ক শিক্ষকের চেয়ে ছাত্রের সংখ্যা বেশি, এবং যৌন নিপীড়ক ছাত্রদের বেশিরভাগ সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সীমাহীন, তাই তাদেরও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত বিচার হয় না।

পরীক্ষায় পাস-ফেলের ফাঁদে জিম্মি করে যৌন হয়রানি করার অপকর্ম কোনভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। এমন শিক্ষকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দিলেও কম হয়। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আতঙ্কজনক হয়ে ওঠছে, মাদ্রাসায় তো বলাৎকার করে অনেক শিশুকে মেরেই ফেলা হয়েছে। প্রভাবশালী ছাত্র নেতা আর দুর্বৃত্ত শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা। গুরুত্বপূর্ণ পদের নেত্রী হওয়ার বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতার শয্যাসঙ্গী হতে হয়েছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ দলের অনেক নারী কর্মীকে।

শুধু ছাত্র সংগঠনে নয়, মূল রাজনৈতিক দলেও কান পাতলে এমন বহু ঘটনার খবর পাওয়া যায়। পাকিস্তানে ইমরান খানের শয্যাসঙ্গী হয়ে অনেক নারী পিটিআই দলের উচ্চতর পদ লাভে সক্ষম হয়েছে বলে ইমরান খানের স্ত্রীর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা যখন যৌন নিপীড়ন করে তখন তা ভিন্ন মাত্রা পায়, শিক্ষকদের প্রতি জাতির যে শর্তহীন শ্রদ্ধা তা নিমেষে উবে যায়। নিপীড়কদের পক্ষে কথা বলার সংস্কৃতি প্রবল বিধায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে সাহস করে না। গঠিত কমিটির শিক্ষক সদস্যরা অভিযোগ থেকে সহকর্মী অভিযুক্তকে বাঁচানোর নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন এবং তদনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট সাজিয়ে থাকেন। অবশ্য প্রতিটি পেশায় এই রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযোগ করার পরও যখন কোন ছাত্রী বিচার পায় না তখন ভুক্তভোগী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। নিজের জীবন নিজের হাতে শেষ করে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়; একজন নারী যখন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও কোথাও অভিযোগের স্বীকৃতি পায় না, বরং নিপীড়কের অবিরত হুমকিতে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়, তখন ভুক্তভোগী নারীর অসহায়ত্ব বেড়ে যায়, প্রচ- মানসিক চাপ ও হতাশা চরমভাবে তাকে গ্রাস করতে থাকে, অবচেতন অবস্থায় তার মন সমাজ, রাষ্ট্র, সহকর্মী, সতীর্থ, শিক্ষক সবার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে, আক্রোশ মেটানোর কোন পাত্র না পেয়ে নিজের জীবনের ঘাতক নিজেই হয়ে ওঠে। আর যারা যৌন হয়রানির চেয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের অংককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তারা শিক্ষকদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হচ্ছে। নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনা শিক্ষা কার্যক্রমকে নাজুক করে তুলছে।

যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল ভিকটিমদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না বিধায় অধিকতর হয়রানির আশঙ্কায় কেউ অভিযোগ করতেও ভয় পাচ্ছে। শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের প্রতিকার হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাবমূর্তি এভাবে নষ্ট হতো না। মাদ্রাসার মতো এই সংক্রামক ব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাগ্য ভালো, যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ ভাগই অভিযোগ করে না। ন্যায় বিচার না পাওয়া এবং চরিত্র হননের ভয়ে তারা অভিযোগ করে না।

গণতন্ত্র থাকলে রাজনীতি থাকবে, সব পেশাজীবী রাজনীতি করার অধিকারও পাবে। পেশাজীবীরা রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই সচেতন থাকবে, কিন্তু নিজস্ব পেশার সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন বহির্ভূত রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পেশাকে কলুষিত করে। দেশে আইনজীবীদের মতো শিক্ষকগণও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে উলঙ্গভাবে সম্পৃক্ত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপচার্যের নিয়োগ হয় দলীয় সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে, অপরাধ ও অপরাধীর বিচারের পূর্বে বিবেচনা করা হয় অভিযুক্তের দলীয় আনুগত্যের মাত্রা। দেশের উন্নতি শুধু ফিতা কাটার উন্নতি নয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নয়, উন্নয়ন হতে হবে সংস্কৃতির, মূল্যবোধের, নৈতিকতার, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের। অভিযোগ করলে বিচার পাওয়া যাবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন আস্থা তৈরি করা জরুরি, না পারলে ভিসিসহ প্রশাসনের সব কর্মকর্তার স্বেচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করা উচিত, নতুবা নিপীড়ক শিক্ষকদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো আরও বেশি জরুরি। যেদিন অবন্তিকাদের আত্মহননের চিন্তা তিরোহিত হবে, শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নির্বিঘেœ, নিরাপদে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে, সেদিনই কেবল শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার হবে।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]

লোকসান কমাতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও আগামী বাজেট

স্মার্ট দেশ গড়তে চাই স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায় কার

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাছে দোষ স্বীকারে সাক্ষ্যগত মূল্য ও বাস্তবতা

সমস্যায় জর্জরিত সড়ক, প্রতিকার কী

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

শিক্ষক নিয়োগ : পর্বতসম দুর্নীতির সামান্য প্রকাশ

সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি

চৌবাচ্চার ফুটো এবং আমাদের উন্নয়ন

কিশোর গ্যাং : নষ্ট রাজনীতির বিনষ্ট সংস্কৃতি

মন্ত্রণালয় ভাগ করে লাভবান হলো কারা?

রম্যগদ্য : মর্জিনার কলঙ্কিত দাগ

সোমালিয়ার গরিব জেলেরা কীভাবে জলদস্যু হলো

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অবন্তিকাদের আত্মহনন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা

শনিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৪

১৫ মার্চ ২০২৪; কুমিল্লা শহরের নিজ বাসায় রাত ১০টার দিকে আত্মহত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। আত্মহত্যার আগে নিজের ফেইসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তার মৃত্যুর জন্য সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করে গেছেন। ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে বহিষ্কার এবং দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এই দুইজনের বিরুদ্ধে অবন্তিকার অভিযোগ হচ্ছে, আম্মান যৌন নিপীড়নমূলক কমেন্ট করে অবন্তিকাকে শুধু উত্ত্যক্তই করত না, অনলাইন ও অফলাইনে অহর্নিশ হুমকি দিত। আম্মানের বিরুদ্ধে প্রক্টর অফিসে নালিশ করার পর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম অভিযোগ আমলে না নিয়ে বরং অবন্তিকাকে নানাভাবে ভয় দেখাতেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিতেন।

অবন্তিকার কথামতো তাকে সাতবার প্রক্টর অফিসে ডেকে নিয়ে দ্বীন ইসলাম জুতা দিয়ে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। অবন্তিকা নিজেকে ‘লড়াকু মানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেও কেন লড়াইটা অব্যাহত রাখল না তা স্পষ্ট নয়। অবন্তিকা এবং আম্মানের মধ্যে ঘটনার শুরু ২০২২ সালে, কিন্তু ঘটনার আদ্যোপান্ত এখনো উন্মোচিত হয়নি। সহকারী প্রক্টর খারাপ আচরণ করলে প্রক্টর বা উপচার্যের নিকট কেন গেল না তাও অবন্তিকার পোস্টে স্পষ্ট করা হয়নি। অনলাইনে সেক্সুয়ালি এবিউজিভ কমেন্ট করে থাকলে তা তো ডিজিটাল আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, লড়াকু অবন্তিকা না লড়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করল কেন? আম্মান কি প্রভাবশালী ছাত্রনেতা? আম্মান কি অপ্রতিরোধ্য?

আম্মানের সাথে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সম্পর্কটা কেন গাঢ়- এই সকল প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে গঠিত কমিটি ও গোয়েন্দা সংস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্বের বিদ্যালয়, এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সব শিক্ষককে ছাত্র-ছাত্রীরা মা-বাবার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে থাকে। তাই শিক্ষকের কাছ থেকে যৌন নিপীড়নের শিকার হলে সমাজের অবক্ষয়ের করুণ চিত্র পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এবং ছাত্রীদের অসহায়ত্ব বেড়ে যায়। পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বা ফেল করে দেওয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করে শিক্ষকদের যৌন নিপীড়ন করার বহু খবর শোনা যায়। পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেওয়ার আগাম বার্তা একজন মেধাবী ছাত্রীকে আতঙ্কগ্রস্ত করতেই পারে, অনেকে তাই শিক্ষকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে আগত অবন্তিকার সহপাঠী কাজী ফারজানা মিমের বক্তব্য হচ্ছেÑ তার ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনের কুপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাকে ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় মাত্র ০৩ নম্বর এবং ৫০ নম্বরে ১০ নম্বর দেওয়া হয়েছে।

একাডেমিক কাজে মিমকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ২০২১ সনে পেশ করা হলেও ২০২৪ সনের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে কয়েক দিন আগে নতুন উপচার্যের উদ্যোগে প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে এবং অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিভাগের প্রধান জুনায়েদ আহমদ হালিমকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তখন, যখন ওই কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। বিগত কয়েক দিনে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭টি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে যৌন হয়রানির ২০টি অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে স্নাতকোত্তর থিসিস পর্বের এক ছাত্রী রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মতিন কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। ল্যাবে কাজ করার সময় ঠান্ডা লাগার অজুহাত দিয়ে ছাত্রীকে জড়িয়ে ধরা এবং ল্যাবের জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল দেওয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে ধর্ষণের চেষ্টা করার অভিযোগ ওঠেছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অতি সম্প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

উল্লেখিত যৌন নিপীড়নের কোন ঘটনায় কর্তৃপক্ষ প্রথমে কর্ণপাত করেনি; শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও ছাত্রের বিরুদ্ধেও একই ঘটনা ঘটেছে, অবন্তিকার আত্মহত্যার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে কর্তৃপক্ষের ঘুম ভেঙ্গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানির ব্যাপকতায় উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে যৌন নিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল গঠন করে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে; কিন্তু সেলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। না করারও কারণ আছে। আইনজীবী, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও জাতীয় রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। বিএনপির আমলে নিয়োগ পেয়ে এক ভিসি গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির চেয়ারে বসে পড়েছিলেন, সকাল পর্যন্ত বিদায়ী ভিসিকে সময় দেননি। যৌন নিপীড়ক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হলে তার বিচার করার সাহস অভিযোগ সেল বা কর্তৃপক্ষের থাকে না। অবশ্য সেলের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ক্ষমতাসীন দলের লোক, সরকারের অন্ধ সমর্থক না হলে এই সকল পদ পাওয়া যায় না। তাই যৌন নিপীড়ক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করে বিধায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যতীত অভিযোগ আমলে নেওয়ার রীতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ক শিক্ষকের চেয়ে ছাত্রের সংখ্যা বেশি, এবং যৌন নিপীড়ক ছাত্রদের বেশিরভাগ সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সীমাহীন, তাই তাদেরও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত বিচার হয় না।

পরীক্ষায় পাস-ফেলের ফাঁদে জিম্মি করে যৌন হয়রানি করার অপকর্ম কোনভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। এমন শিক্ষকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দিলেও কম হয়। বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে আতঙ্কজনক হয়ে ওঠছে, মাদ্রাসায় তো বলাৎকার করে অনেক শিশুকে মেরেই ফেলা হয়েছে। প্রভাবশালী ছাত্র নেতা আর দুর্বৃত্ত শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা। গুরুত্বপূর্ণ পদের নেত্রী হওয়ার বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতার শয্যাসঙ্গী হতে হয়েছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ দলের অনেক নারী কর্মীকে।

শুধু ছাত্র সংগঠনে নয়, মূল রাজনৈতিক দলেও কান পাতলে এমন বহু ঘটনার খবর পাওয়া যায়। পাকিস্তানে ইমরান খানের শয্যাসঙ্গী হয়ে অনেক নারী পিটিআই দলের উচ্চতর পদ লাভে সক্ষম হয়েছে বলে ইমরান খানের স্ত্রীর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা যখন যৌন নিপীড়ন করে তখন তা ভিন্ন মাত্রা পায়, শিক্ষকদের প্রতি জাতির যে শর্তহীন শ্রদ্ধা তা নিমেষে উবে যায়। নিপীড়কদের পক্ষে কথা বলার সংস্কৃতি প্রবল বিধায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে সাহস করে না। গঠিত কমিটির শিক্ষক সদস্যরা অভিযোগ থেকে সহকর্মী অভিযুক্তকে বাঁচানোর নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন এবং তদনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট সাজিয়ে থাকেন। অবশ্য প্রতিটি পেশায় এই রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযোগ করার পরও যখন কোন ছাত্রী বিচার পায় না তখন ভুক্তভোগী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। নিজের জীবন নিজের হাতে শেষ করে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়; একজন নারী যখন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও কোথাও অভিযোগের স্বীকৃতি পায় না, বরং নিপীড়কের অবিরত হুমকিতে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়, তখন ভুক্তভোগী নারীর অসহায়ত্ব বেড়ে যায়, প্রচ- মানসিক চাপ ও হতাশা চরমভাবে তাকে গ্রাস করতে থাকে, অবচেতন অবস্থায় তার মন সমাজ, রাষ্ট্র, সহকর্মী, সতীর্থ, শিক্ষক সবার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে, আক্রোশ মেটানোর কোন পাত্র না পেয়ে নিজের জীবনের ঘাতক নিজেই হয়ে ওঠে। আর যারা যৌন হয়রানির চেয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের অংককে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তারা শিক্ষকদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হচ্ছে। নারী শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনা শিক্ষা কার্যক্রমকে নাজুক করে তুলছে।

যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল ভিকটিমদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না বিধায় অধিকতর হয়রানির আশঙ্কায় কেউ অভিযোগ করতেও ভয় পাচ্ছে। শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের প্রতিকার হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাবমূর্তি এভাবে নষ্ট হতো না। মাদ্রাসার মতো এই সংক্রামক ব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাগ্য ভালো, যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ ভাগই অভিযোগ করে না। ন্যায় বিচার না পাওয়া এবং চরিত্র হননের ভয়ে তারা অভিযোগ করে না।

গণতন্ত্র থাকলে রাজনীতি থাকবে, সব পেশাজীবী রাজনীতি করার অধিকারও পাবে। পেশাজীবীরা রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই সচেতন থাকবে, কিন্তু নিজস্ব পেশার সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন বহির্ভূত রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পেশাকে কলুষিত করে। দেশে আইনজীবীদের মতো শিক্ষকগণও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে উলঙ্গভাবে সম্পৃক্ত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপচার্যের নিয়োগ হয় দলীয় সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে, অপরাধ ও অপরাধীর বিচারের পূর্বে বিবেচনা করা হয় অভিযুক্তের দলীয় আনুগত্যের মাত্রা। দেশের উন্নতি শুধু ফিতা কাটার উন্নতি নয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নয়, উন্নয়ন হতে হবে সংস্কৃতির, মূল্যবোধের, নৈতিকতার, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের। অভিযোগ করলে বিচার পাওয়া যাবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন আস্থা তৈরি করা জরুরি, না পারলে ভিসিসহ প্রশাসনের সব কর্মকর্তার স্বেচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করা উচিত, নতুবা নিপীড়ক শিক্ষকদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো আরও বেশি জরুরি। যেদিন অবন্তিকাদের আত্মহননের চিন্তা তিরোহিত হবে, শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নির্বিঘেœ, নিরাপদে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে, সেদিনই কেবল শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার হবে।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]

back to top