alt

উপ-সম্পাদকীয়

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

: সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলুকÑ এর পক্ষে কিছু মানুষ এখন সরব। অপরদিকে কিছু মানুষ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকুক এরকম মতামত দিচ্ছেন। যারা মতাতম দিচ্ছেন তারা সমাজের কথিত গুণী ও সুশীল হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আমি আমার নিজের ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতা বলব এখানে। আসলে ছাত্ররাজনীতিটা কী? এটা কি সমাজ গর্হিত কোন কাজ? কোন ছেলে ছাত্ররাজনীতি করে শুনলে কথিত ভদ্র মানুষরা নাক ছিটকায়। তাদের দৃষ্টিতে ছাত্ররাজনীতি মানে দুর্গন্ধযুক্ত একটা বিষয়।

১৯৪৮ সালে উর্দুকে প্রতিহত করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তদানিন্তন পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ছাত্ররাজনীতি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি আন্দোলনের বারুদ হিসেবে ছাত্র নেতারা ছিল সম্মুখ সমরে। আজ সেই রাজনীতি কেন আপদে পরিণত হলো? আসলে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গাটা কী? আমরা বা বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা জানে কী? ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য? ছাত্ররাজনীতি কী কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করা হয়? ছাত্র রাজনীতি ছাত্র ও সমাজের মঙ্গলার্থে একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম।

ছাত্র রাজনীতি দেখবে দেশে চলমান শিক্ষানীতি কতটুকু বাস্তবসম্মত। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান সমাজের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু বাস্তবসম্মত তা পরিবীক্ষণ করবে ছাত্ররাজনীতি যারা করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাটা কি কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা দেখবে ছাত্ররাজনীতি। সমাজের ধনী দরিদ্র ধর্ম বর্ণের মানুষকে দেশজ সংস্কৃতির বলয়ে এক ধরনের শিক্ষার আওতায় আসতে পেরেছে কি? তা পরিবীক্ষণ করবে ছাত্ররাজনীতি। এগুলো কি এখনকার ছাত্রনেতারা পর্যবেক্ষণ করেন?

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করবে ছাত্র রাজনীতিকরা। ছাত্ররাজনীতির মূল এজেন্ডা এখন কেতাবে বন্দী? ছাত্ররা যা করছেন তা হলো কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের জন্য কিছু কাজ। তাছাড়া এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলো চেহার সঙ্গে মূল ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর চেহারা, বৈশিষ্ট্য, কার্যক্রমের মিল পাওয়া যায়। ছাত্ররা ছাত্রদের তথা শিক্ষা নিয়ে কোন কার্যক্রম করেন না। তারা তাদের মূল সংগঠনের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করছে, তাই সাধারণ মানুষের ধারণা ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন নেই। এই ধারণাটা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ ঘোর অন্ধকারে দিকে ধাবিত হবে। বাংলাদেশ জন্মের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, অথচ জন্মের ৫৩ বছরের এসে ছাত্ররাজনীতি মহিমান্বিত হওয়ার কথা কিন্তু তা না হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে?

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা অক্ষরের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নেন। শিক্ষামন্ত্রী বাংলা শব্দগুলোকে আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান তার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য বিশিষ্ট্য শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দিয়েছিলেন একটি চিঠি। ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই চিঠি প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করে দেন সংবাদপত্রে, আর এই সংবাদ দেখে ছাত্রনেতারা প্রতিবাদ করে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই সময় দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

আন্দোলনের মুখে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। বাংলা ফিরে পায় তার নিজের বর্ণমালা। ছাত্ররাজনীতির এই গৌরবময় কৃতিত্বকে ম্লান করে চলছে ছাত্ররাজনীতি বাতিলের চক্রান্ত। এর জন্য দায়ী কারা? স্বৈরাচার এরশাদ হটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করে এ দেশের ছাত্রসমাজ। সামরিক জান্তা এরশাদ শত চেষ্টা করেও একটি ছাত্র সংগঠন দাঁড় করাতে পারেনি? দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ ছাত্ররা এরশাদের ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়নি। শত চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে এরশাদ ছাত্র সংগঠন করা বাদ দেয়। আমি ছাত্রজীবনে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির কর্মী ছিলাম। ১৯৮৪ সালে মাধ্যমিকে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকারÑ এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে, এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার তৎসম্পর্কিত রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো আমাদের ছাত্র সংগঠন গ্রহণ করত, আর এই বিষয়টির সঙ্গে সব ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা মিছিল, মিটিং, বৈঠক করতাম। যেমন কুদরতে খুদার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক চালু করা। ক্যাডেট কলেজ, কিন্ডার গার্ডেন, সরকারি-বেসরকারিসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারি ব্যয় সমান করা। ধনীক তোষণ গরিব শোষণ বন্ধ করা। কারণ গরিবের ছেলেমেয়েরা গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি ব্যায় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক কম। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার, ল্যাব সুবিধা ছিল না, অথচ শহরের সরকারি স্কুল-কলেজে তা ছিল।

আমরা ছাত্ররাজনীতি করেছি সমতার জন্য। নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটা আমাদের ছাত্রনেতারা কর্মীদের আর্দশবান করে তৈরি করেছিলেন। আমাদের ছাত্রনেতারা কোন অনৈতিক কার্যকলাপ করতেন না। বেশির ভাগ ছাত্রনেতা যারা ছিলেন তারা টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন আর সংগঠনের খরচের জন্য চাঁদা দিতেন। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে উপজেলা স্তরে নকলের মহোৎসব ছিল। আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল নকল থেকে বিরত থাকার। যদি কোন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী পরীক্ষার হলে নকল করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যেত সঙ্গে সঙ্গে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হতো। সংগঠন থেকে বলা হতো ছাত্ররাজনীতি করলে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হতে হবে। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা ছিলÑ নিজের নৈতিক স্খলন ঘটলে এই নৈতিক অবক্ষয়যুক্ত ছাত্রনেতার সংগঠন সাধারণ ছাত্ররা সদস্য হতে আসবে না।

সুতরাং ছাত্ররাজনীতি করতে হলে নিজেকে অপরাধ, অন্যায় বা অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে না। শিক্ষাঙ্গনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষে কার্যক্রম চালাতে হবে। সবাই ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে তাই অযাচিতভাবে কোন ছাত্র সংগঠনের কর্মকা-ে বাধা দেয়া যাবে না। ছাত্র সংগঠনগুলোর নৈতিক শিক্ষা ছিল এমন। তখনকার সময় একমাত্র উগ্রবাদী ছাত্র সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্র শিবির, এরা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের অঙ্গসংগঠন। একমাত্র শিবিরই ৯০ পূর্ববর্তী সময় সন্ত্রাসী আচরণ করত। তবে ৯০ এর পর এদের সন্ত্রাস আরও বেশি বেড়ে যায়। বর্তমানে নিষিদ্ধ থাকলেও এরা গোপনে তাদের মিশন চালাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে ছাত্ররাজনীতি বুয়েট ক্যাম্পাসে বন্ধ হওয়ার পর মৌলবাদী রাজনীতি বুয়েটে গোপনে চলছে, এর নানা নির্দশন পাওয়া যায়। আবরার হত্যার সঙ্গে যে ছাত্র সংগঠন জড়িত তাদের নিষিদ্ধ করাটা ছিল কিছুটা যৌক্তিক, ঢালাওভাবে সব ছাত্র সংগঠনের কর্মকা- বন্ধ করাটা অযৌক্তিক।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন স্বনামধন্য অসংখ্য প্রকৌশলী দেশে-বিদেশে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। ছাত্ররাজনীতি করলে পড়াশোনার ক্ষতি হয় এটা ঠিক না।

তবে পরিশীলিত ছাত্ররাজনীতি চাইলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুরবৃত্তি থেকে বের করে আনতে হবে, প্রতিটি ছাত্র সংগঠনকে তাদের নিজস্ব সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র সংসদ নিবার্চন ব্যবস্থা করার প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সোমবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৪

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলুকÑ এর পক্ষে কিছু মানুষ এখন সরব। অপরদিকে কিছু মানুষ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকুক এরকম মতামত দিচ্ছেন। যারা মতাতম দিচ্ছেন তারা সমাজের কথিত গুণী ও সুশীল হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আমি আমার নিজের ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতা বলব এখানে। আসলে ছাত্ররাজনীতিটা কী? এটা কি সমাজ গর্হিত কোন কাজ? কোন ছেলে ছাত্ররাজনীতি করে শুনলে কথিত ভদ্র মানুষরা নাক ছিটকায়। তাদের দৃষ্টিতে ছাত্ররাজনীতি মানে দুর্গন্ধযুক্ত একটা বিষয়।

১৯৪৮ সালে উর্দুকে প্রতিহত করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তদানিন্তন পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ছাত্ররাজনীতি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি আন্দোলনের বারুদ হিসেবে ছাত্র নেতারা ছিল সম্মুখ সমরে। আজ সেই রাজনীতি কেন আপদে পরিণত হলো? আসলে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গাটা কী? আমরা বা বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা জানে কী? ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য? ছাত্ররাজনীতি কী কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করা হয়? ছাত্র রাজনীতি ছাত্র ও সমাজের মঙ্গলার্থে একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম।

ছাত্র রাজনীতি দেখবে দেশে চলমান শিক্ষানীতি কতটুকু বাস্তবসম্মত। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান সমাজের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু বাস্তবসম্মত তা পরিবীক্ষণ করবে ছাত্ররাজনীতি যারা করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাটা কি কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা দেখবে ছাত্ররাজনীতি। সমাজের ধনী দরিদ্র ধর্ম বর্ণের মানুষকে দেশজ সংস্কৃতির বলয়ে এক ধরনের শিক্ষার আওতায় আসতে পেরেছে কি? তা পরিবীক্ষণ করবে ছাত্ররাজনীতি। এগুলো কি এখনকার ছাত্রনেতারা পর্যবেক্ষণ করেন?

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করবে ছাত্র রাজনীতিকরা। ছাত্ররাজনীতির মূল এজেন্ডা এখন কেতাবে বন্দী? ছাত্ররা যা করছেন তা হলো কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের জন্য কিছু কাজ। তাছাড়া এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলো চেহার সঙ্গে মূল ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর চেহারা, বৈশিষ্ট্য, কার্যক্রমের মিল পাওয়া যায়। ছাত্ররা ছাত্রদের তথা শিক্ষা নিয়ে কোন কার্যক্রম করেন না। তারা তাদের মূল সংগঠনের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করছে, তাই সাধারণ মানুষের ধারণা ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন নেই। এই ধারণাটা যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ ঘোর অন্ধকারে দিকে ধাবিত হবে। বাংলাদেশ জন্মের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, অথচ জন্মের ৫৩ বছরের এসে ছাত্ররাজনীতি মহিমান্বিত হওয়ার কথা কিন্তু তা না হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে?

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা অক্ষরের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নেন। শিক্ষামন্ত্রী বাংলা শব্দগুলোকে আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান তার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য বিশিষ্ট্য শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দিয়েছিলেন একটি চিঠি। ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই চিঠি প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করে দেন সংবাদপত্রে, আর এই সংবাদ দেখে ছাত্রনেতারা প্রতিবাদ করে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই সময় দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

আন্দোলনের মুখে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। বাংলা ফিরে পায় তার নিজের বর্ণমালা। ছাত্ররাজনীতির এই গৌরবময় কৃতিত্বকে ম্লান করে চলছে ছাত্ররাজনীতি বাতিলের চক্রান্ত। এর জন্য দায়ী কারা? স্বৈরাচার এরশাদ হটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করে এ দেশের ছাত্রসমাজ। সামরিক জান্তা এরশাদ শত চেষ্টা করেও একটি ছাত্র সংগঠন দাঁড় করাতে পারেনি? দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ ছাত্ররা এরশাদের ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়নি। শত চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে এরশাদ ছাত্র সংগঠন করা বাদ দেয়। আমি ছাত্রজীবনে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির কর্মী ছিলাম। ১৯৮৪ সালে মাধ্যমিকে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকারÑ এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে, এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার তৎসম্পর্কিত রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো আমাদের ছাত্র সংগঠন গ্রহণ করত, আর এই বিষয়টির সঙ্গে সব ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা মিছিল, মিটিং, বৈঠক করতাম। যেমন কুদরতে খুদার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক চালু করা। ক্যাডেট কলেজ, কিন্ডার গার্ডেন, সরকারি-বেসরকারিসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারি ব্যয় সমান করা। ধনীক তোষণ গরিব শোষণ বন্ধ করা। কারণ গরিবের ছেলেমেয়েরা গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি ব্যায় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক কম। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার, ল্যাব সুবিধা ছিল না, অথচ শহরের সরকারি স্কুল-কলেজে তা ছিল।

আমরা ছাত্ররাজনীতি করেছি সমতার জন্য। নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটা আমাদের ছাত্রনেতারা কর্মীদের আর্দশবান করে তৈরি করেছিলেন। আমাদের ছাত্রনেতারা কোন অনৈতিক কার্যকলাপ করতেন না। বেশির ভাগ ছাত্রনেতা যারা ছিলেন তারা টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন আর সংগঠনের খরচের জন্য চাঁদা দিতেন। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে উপজেলা স্তরে নকলের মহোৎসব ছিল। আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল নকল থেকে বিরত থাকার। যদি কোন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী পরীক্ষার হলে নকল করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যেত সঙ্গে সঙ্গে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হতো। সংগঠন থেকে বলা হতো ছাত্ররাজনীতি করলে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হতে হবে। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা ছিলÑ নিজের নৈতিক স্খলন ঘটলে এই নৈতিক অবক্ষয়যুক্ত ছাত্রনেতার সংগঠন সাধারণ ছাত্ররা সদস্য হতে আসবে না।

সুতরাং ছাত্ররাজনীতি করতে হলে নিজেকে অপরাধ, অন্যায় বা অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে না। শিক্ষাঙ্গনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষে কার্যক্রম চালাতে হবে। সবাই ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে তাই অযাচিতভাবে কোন ছাত্র সংগঠনের কর্মকা-ে বাধা দেয়া যাবে না। ছাত্র সংগঠনগুলোর নৈতিক শিক্ষা ছিল এমন। তখনকার সময় একমাত্র উগ্রবাদী ছাত্র সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্র শিবির, এরা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের অঙ্গসংগঠন। একমাত্র শিবিরই ৯০ পূর্ববর্তী সময় সন্ত্রাসী আচরণ করত। তবে ৯০ এর পর এদের সন্ত্রাস আরও বেশি বেড়ে যায়। বর্তমানে নিষিদ্ধ থাকলেও এরা গোপনে তাদের মিশন চালাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে ছাত্ররাজনীতি বুয়েট ক্যাম্পাসে বন্ধ হওয়ার পর মৌলবাদী রাজনীতি বুয়েটে গোপনে চলছে, এর নানা নির্দশন পাওয়া যায়। আবরার হত্যার সঙ্গে যে ছাত্র সংগঠন জড়িত তাদের নিষিদ্ধ করাটা ছিল কিছুটা যৌক্তিক, ঢালাওভাবে সব ছাত্র সংগঠনের কর্মকা- বন্ধ করাটা অযৌক্তিক।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন স্বনামধন্য অসংখ্য প্রকৌশলী দেশে-বিদেশে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। ছাত্ররাজনীতি করলে পড়াশোনার ক্ষতি হয় এটা ঠিক না।

তবে পরিশীলিত ছাত্ররাজনীতি চাইলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুরবৃত্তি থেকে বের করে আনতে হবে, প্রতিটি ছাত্র সংগঠনকে তাদের নিজস্ব সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র সংসদ নিবার্চন ব্যবস্থা করার প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top