alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

রেজাউল করিম খোকন

: শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য ১৬ বছর আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর নেয়া ‘এক জেলা এক পণ্য’ উদ্যোগটি মোটামুটি ব্যর্থ হওয়ার পর সেই ব্যর্থতার কারণ না খুঁজে এবার হাতে নেয়া হয়েছে ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ নামে নতুন উদ্যোগ। এক বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এ উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ উদ্যোগের পর ভবিষ্যতে এ সংক্রান্ত প্রকল্প নেয়া হবে। পরীক্ষামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে গ্রামওয়ারি পণ্য নির্বাচনের জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি থেকে কেন সুফল পাওয়া গেল না, তারও মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। আর নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল মিলতে পারে। সরকার এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে ‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’র এই সেøাগান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রামে তৈরি পণ্যকে দেশে-বিদেশে মূলধারার বাজারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের তৈরি হস্তশিল্প ও খাদ্যসামগ্রীর বাণিজ্য সম্ভাবনা কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক পণ্যকে মূলধারার বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। পণ্যের সঙ্গে পণ্যের কারিগরদেরও মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোন গ্রাম থেকে কোন কারিগর পণ্যটি তৈরি করল; তা সবার সামনে তুলে ধরা হবে। উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে হলে পণ্য তৈরির কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামে তৈরি পণ্যের কারিগর ও তৈরির স্থান চিহ্নিত করে তা দেশি-বিদেশি বাজারে পৌঁছে দেয়া হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে ১২৮টি পণ্য নিয়ে জীবিকায়ন শিল্পপল্লী গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড ছয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে পল্লী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পল্লী অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এলাকাভিত্তিক সুফলভোগীদের জন্য তাদের ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়ানোসহ কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর ও শ্রমঘন এসব পণ্য উৎপাদনে বেশি পুঁজির দরকার হয় না। তাই প্রতিটি গ্রাম থেকে হস্তশিল্পজাত পণ্য নির্বাচন করতে হবে, যার মধ্যে খাদ্যজাত পণ্যও থাকতে পারে। নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

দেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারার বাজার ঝালকাঠি জেলায়। বরিশালের মিষ্টি আমড়া বলতে যা বোঝানো হয়, তার ৮০ শতাংশই ঝালকাঠির। এছাড়া শীতলপাটি, সুপারি এবং হাতেভাজা একধরনের মুড়ি রয়েছে ঝালকাঠিতে, যা অন্য সব জেলা থেকে আলাদা। কিশোরগঞ্জের শিদল বা চ্যাপা শুঁটকি, রাতাবোরো চাল এবং পনির- এই তিন পণ্যের খ্যাতি রয়েছে। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে যথাসময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। ডিসিদের কাছ থেকে তালিকা পেলে তা থেকে দেশসেরা পণ্য নির্বাচন করবে সরকার। ভবিষ্যতে সেগুলোর ব্র্যান্ডিংও করা হবে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মেলায় এসব পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে স্টল বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া এসব পণ্য উৎপাদনে স্বল্প সুদে, বিনা সুদে বা বিনা জামানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এর বাইরে আগামী পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব মেলা হবে, সেগুলোতে হস্তশিল্পজাত পণ্যের বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা যেন নেয়া হয়, সেজন্য পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

জাপান সরকার আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১৯৭৯ সালে প্রথম একটি গ্রাম একটি পণ্যকে আন্দোলন আকারে শুরু করে। এ আন্দোলনের জনক দেশটির একটি অঞ্চলের তৎকালীন গভর্নর মরিহিকো হিরামাৎসু। ১৯৮০ সাল থেকে এ আন্দোলনকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজ শুরু করে দেশটি। তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রাম থেকে উচ্চ মূল্য সংযোজনের ৩০০ পণ্য চিহ্নিত করে জাপান। জাপানের এ আন্দোলন পরে কিরগিজস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। একটি গ্রাম একটি পণ্য কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করতে জাপানি রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

পৃথিবীর যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আমাদের দেশে এখনও নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। যদিও আমাদের সংবিধানে এ বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সরকারি বেতনর্ভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।

এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব। অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসাথে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না।

বর্তমানে আমাদের বেশকিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানি হয়। এসব পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রফতানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। এসব কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিভূমির পরিমাণ খুবই কম; কিন্তু উন্নত বীজ ও সার এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে কৃষিজ প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের কৃষকরা এক বছর যে ফসল উৎপাদন করে লাভবান হয় পরবর্তী বছর একই ফসল উৎপাদনে উদ্যোগী হয়। এভাবে একজনকে লাভবান হতে দেখে অনেকে একই ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবে ফসলের বাড়তি উৎপাদনের কারণে মূল্য পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের উৎপাদন, বিপণন ও চাহিদা বিষয়ে কৃষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা কমে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কঠিন চীবরদান

ছবি

দুর্গাপূজার মর্মবাণী

মানুষ মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে কীভাবে

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : সমাজের এক ভয়াবহ ব্যাধি

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন

পুরাতত্ত্বের ধারায় সনাতনী সমাজের দুর্গাপূজা

জীবন-মৃত্যু কী?

নাসা : বিজ্ঞানের পীঠস্থান

শিক্ষা সংস্কারে প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

সাংঘাতিক ভাই, সাংঘাতিক...

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

রেজাউল করিম খোকন

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য ১৬ বছর আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর নেয়া ‘এক জেলা এক পণ্য’ উদ্যোগটি মোটামুটি ব্যর্থ হওয়ার পর সেই ব্যর্থতার কারণ না খুঁজে এবার হাতে নেয়া হয়েছে ‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ নামে নতুন উদ্যোগ। এক বছরের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এ উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ উদ্যোগের পর ভবিষ্যতে এ সংক্রান্ত প্রকল্প নেয়া হবে। পরীক্ষামূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে গ্রামওয়ারি পণ্য নির্বাচনের জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এক জেলা এক পণ্য কর্মসূচি থেকে কেন সুফল পাওয়া গেল না, তারও মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। আর নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল মিলতে পারে। সরকার এখন গ্রামভিত্তিক পণ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে ‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’র এই সেøাগান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রামে তৈরি পণ্যকে দেশে-বিদেশে মূলধারার বাজারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের তৈরি হস্তশিল্প ও খাদ্যসামগ্রীর বাণিজ্য সম্ভাবনা কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

‘একটি গ্রাম, একটি পণ্য’ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামভিত্তিক পণ্যকে মূলধারার বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে। পণ্যের সঙ্গে পণ্যের কারিগরদেরও মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোন গ্রাম থেকে কোন কারিগর পণ্যটি তৈরি করল; তা সবার সামনে তুলে ধরা হবে। উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে হলে পণ্য তৈরির কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গ্রামে তৈরি পণ্যের কারিগর ও তৈরির স্থান চিহ্নিত করে তা দেশি-বিদেশি বাজারে পৌঁছে দেয়া হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে ১২৮টি পণ্য নিয়ে জীবিকায়ন শিল্পপল্লী গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড ছয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে পল্লী কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পল্লী অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এলাকাভিত্তিক সুফলভোগীদের জন্য তাদের ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত পণ্যের জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়ানোসহ কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর ও শ্রমঘন এসব পণ্য উৎপাদনে বেশি পুঁজির দরকার হয় না। তাই প্রতিটি গ্রাম থেকে হস্তশিল্পজাত পণ্য নির্বাচন করতে হবে, যার মধ্যে খাদ্যজাত পণ্যও থাকতে পারে। নতুন উদ্যোগের জন্য আমলাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্থানীয় সরকার তথা ডিসি কার্যালয়, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যুক্ত করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

দেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারার বাজার ঝালকাঠি জেলায়। বরিশালের মিষ্টি আমড়া বলতে যা বোঝানো হয়, তার ৮০ শতাংশই ঝালকাঠির। এছাড়া শীতলপাটি, সুপারি এবং হাতেভাজা একধরনের মুড়ি রয়েছে ঝালকাঠিতে, যা অন্য সব জেলা থেকে আলাদা। কিশোরগঞ্জের শিদল বা চ্যাপা শুঁটকি, রাতাবোরো চাল এবং পনির- এই তিন পণ্যের খ্যাতি রয়েছে। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে যথাসময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। ডিসিদের কাছ থেকে তালিকা পেলে তা থেকে দেশসেরা পণ্য নির্বাচন করবে সরকার। ভবিষ্যতে সেগুলোর ব্র্যান্ডিংও করা হবে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মেলায় এসব পণ্যের প্রদর্শন ও বিপণনের জন্য বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে স্টল বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া এসব পণ্য উৎপাদনে স্বল্প সুদে, বিনা সুদে বা বিনা জামানতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এর বাইরে আগামী পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব মেলা হবে, সেগুলোতে হস্তশিল্পজাত পণ্যের বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা যেন নেয়া হয়, সেজন্য পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

জাপান সরকার আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১৯৭৯ সালে প্রথম একটি গ্রাম একটি পণ্যকে আন্দোলন আকারে শুরু করে। এ আন্দোলনের জনক দেশটির একটি অঞ্চলের তৎকালীন গভর্নর মরিহিকো হিরামাৎসু। ১৯৮০ সাল থেকে এ আন্দোলনকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজ শুরু করে দেশটি। তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রাম থেকে উচ্চ মূল্য সংযোজনের ৩০০ পণ্য চিহ্নিত করে জাপান। জাপানের এ আন্দোলন পরে কিরগিজস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়া, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। একটি গ্রাম একটি পণ্য কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করতে জাপানি রাষ্ট্রদূতের সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

পৃথিবীর যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন অপরিহার্য। আমাদের দেশে এখনও নগর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। যদিও আমাদের সংবিধানে এ বৈষম্য দূর করার জন্য কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিককরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সরকারি বেতনর্ভুক্ত যেসব ব্যক্তি জড়িত তাদের কর্মের প্রতি অনীহা, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, আন্তরিকতা, একাগ্রতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রভৃতি এ বিষয়ক সরকারের প্রতিটি কার্যক্রমকেই বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।

এমন অনেক ফসল আছে যেগুলো মৌসুমি কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের কারণে সেসব ফসলও এখন সারা বছর উৎপন্ন করা সম্ভব। অতীতে যে ভূমিতে বার্ষিক একটি ফসল হতো এখন একই ভূমিতে বার্ষিক দুটি বা ক্ষেত্রবিশেষে তিনটি ফসলের চাষ করা হচ্ছে। আবার একই ভূমিতে একটি ফসলের ফাঁকে ফাঁকে আরেকটি ফসলের চাষ হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ধান ও মাছের চাষ একই ভূমিতে একসাথে করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রতিটি ফসল ও মাছ উৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটালেও কৃষকপর্যায়ে পাইকারি বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকায় বাড়তি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারছে না।

বর্তমানে আমাদের বেশকিছু কৃষিপণ্য বিদেশে রফতানি হয়। এসব পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত পণ্য বিধায় রফতানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হয়। যদিও এ প্রণোদনার একটি অংশ কৃষকের পাওয়ার কথা; কিন্তু আজ আমাদের দেশের কৃষক সে প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত। এসব কারণেই আমাদের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব দীর্ঘদিন ধরে একটি আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিভূমির পরিমাণ খুবই কম; কিন্তু উন্নত বীজ ও সার এবং বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে কৃষিজ প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের কৃষকরা এক বছর যে ফসল উৎপাদন করে লাভবান হয় পরবর্তী বছর একই ফসল উৎপাদনে উদ্যোগী হয়। এভাবে একজনকে লাভবান হতে দেখে অনেকে একই ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এভাবে ফসলের বাড়তি উৎপাদনের কারণে মূল্য পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফসলের উৎপাদন, বিপণন ও চাহিদা বিষয়ে কৃষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা কমে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top