alt

উপ-সম্পাদকীয়

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

মিথুশিলাক মুরমু

: মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
image

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ‘সাঁওতাল দম্পতি’

২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর পরিদর্শনের সুযোগ ঘটেছিলো ময়মনসিংহে অবস্থিত ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাটি। অফিস সংক্রান্ত কাজে সাহেব কোয়ার্টার, কাঁচিঝুলিতে চার দিন অবস্থান করছিলাম। সেদিন অত্যন্ত উৎসুক হয়ে জানার ও খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘সাঁওতালী নারী’ প্রভৃতি চিত্রকর্ম; যাতে স্বচক্ষে দেখতে পারি। সংগ্রহশালার দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানালেন, মূল চিত্রকর্মগুলো ঢাকাতে রয়েছে। এখান থেকে মূল্যবান চিত্রকর্মগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে অনেক আগেই। আশাহত হয়ে ভিজিটর বুকে সম্ভবত এভাবেই লিখেছিলাম, ‘সাঁওতালদের নিয়ে কোনো চিত্রকর্ম চোখে পড়েনি, সংগ্রহশালা পরিদর্শন করে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছি।’ অর্থাৎ একজন আদিবাসী সাঁওতাল হিসেবে, অর্থ খরচ করে ময়মনসিংহে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় পৌঁছেও নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়েছে। জয়নুল আবেদিনের অমর কীর্তিগুলো দর্শনের অতৃপ্তি আমার থেকেই গেছে।

২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশবরেণ্য শিল্পী জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘সাঁওতাল দম্পতি’ সম্প্রতিকালে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়কে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ১৮ মার্চ ‘সোদেবিস’ নামক সংস্থা নিলামে তোলে। মর্ডান অ্যান্ড কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়ান আর্ট শিরোনামে ওই নিলাম আয়োজন করে। সাঁওতাল দম্পত্তির ছবির মূল্য ধরা হয়েছিলো এক লাখ থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার, তবে তা বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৩ টাকা)। বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর শিল্পকর্মের জন্য এটিই সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড।

শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, চিত্রকর্মটি বিশ^বাজারে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেছেন, ‘জানামতে এর আগে বাংলাদেশি কোনও শিল্পীর আঁকা পেইন্টিং এত দামে বিক্রি হয়নি।’

সাঁওতাল গ্রামীণ দম্পতিকে ঐতিহ্যবাহী শঙ্কুময় টুপি (গ্রামীণ ভাষায়Ñ মাথাল অর্থাৎ বাঁশ বা বেতের তৈরি) পরে খালি পায়ে হাঁটতে দেখা যায়। কাঠের প্যানেলে তৈল মাধ্যমে জয়নুল আবেদিন ‘সাঁওতাল দম্পতি’ প্রথম এঁকেছিলেন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। পরে ছবিটির একাধিক সংস্করণও করেছিলেন তিনি। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তৈল মাধ্যমে আঁকা ১০২ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ১৩৫.৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে চিত্রকর্মটি জয়নুলের স্বাক্ষর বহন করে। একদিকে শিল্পী হিসেবে নিজের সমস্ত চিত্রকর্মে বাংলার মাটি, জল, মানুষ, ইতিহাসকে তুলে ধরা ও অপরদিকে এদেশের চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াÑ এসবের জন্যই তিনি শিল্পাচার্য অর্থাৎ শিল্পের গুরু বা শিক্ষক হিসেবে ভূষিত হয়েছেন।

সোদেবিসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছেÑ ‘সাঁওতাল দম্পতি’ চিত্র আগে জয়নুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানি কূটনৈতিক ও ধারাভাষ্যকার জামশেদ কে মার্কার এবং ডিয়ানা জে মার্কারের পরিবারের মালিকানাধীন ছিল; যা জয়নুল নিজে তাদের দিয়েছিলেন।’ জানা যায়, শিল্পী জয়নুল আবেদিন প্রায়ই মার্কার দম্পতির বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন, সে সময় শিল্পী রশীদ চৌধুরীসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীকে মার্কার দম্পতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ইতোপূর্বে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ক্রিসটিজে জয়নুল আবেদিনের সাঁওতাল সিরিজের আরেকটি চিত্রকর্ম নিলামে বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিলো।

ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এমপি (হবিগঞ্জ-৪, মাধবপুর-চুনারুঘাট) একটি মাইলফলক ঘটনার অবতারণা করেছেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় যাত্রী ছাউনিতে যে কারিশমা দেখিয়েছেন, সেটি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। অবেহিলত ও পরিত্যক্ত যাত্রী ছাউনিকে পর্যটকদের আকর্ষণ ও সাম্যক ধারণা দিতে তুলে ধরেছেন আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনাচরণ। যাত্রী ছাউনিকে সাজিয়েছেন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা খাড়িয়া দুজন নারীর অবয়বে। তথ্যমতে, এই দুইজনেই খাড়িয়া ভাষা জানা শেষব্যক্তি; অতঃপর আর কেউই শোনবে না খাড়িয়া ভাষার কথোপকথন। মাধবপুর-চুনারুঘাট এলাকাটিতে বেশ কয়েকটি চা বাগান রয়েছে, চা বাগানগুলোতে বসবাস করে সাঁওতাল, উরাঁও, উড়িয়া, মু-া, খাড়িয়াসহ আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী।

প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। জনগোষ্ঠীভিত্তিক খাবার-দাবার, পোশাক-আসাক, নাচ-গান ও পারিস্পরিক যোগবন্ধনেরও ভিন্নতা রয়েছে। আর সেলক্ষ্যে সংস্কৃতির ঐশ^র্যতা তুলে ধরতে যাত্র ছাউনির ওয়ালে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। চা বাগানে বসবাসরত আদিবাসীদের নিজস্ব পোশাকে, বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন, এমনই একটি চিত্র উপস্থাপন করে পর্যটকদের মনোজগতকে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক প্রকার জোর দিয়েই বলা যায়, মাধবপুর-চুনারুঘাট এলাকায় কতকগুলো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে এখনো এলাকাবাসী ওয়াকিবহাল নন। আদিবাসীদের উৎসবকে আরো সার্বজনীন ও আকর্ষিত করা যায়, যেমনটি পার্বত্য এলাকায় ঘটে চলেছে। আদিবাসীদের লুপ্ত সংস্কৃতি, উৎসব, পার্বনকে জাগরণ করলে পর্যটন শিল্পের প্রসারতা ঘটবে বৈ কমবে না।

এমপি মহোদয় যাত্রী ছাউনিতে বাংলাসহ আদিবাসীদের ৬টি (সাঁওতাল, উরাঁও, উড়িয়া, মু-া, খাড়িয়া) ভাষায়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ লিপিবদ্ধ করে ভাষার স্বীকৃতি ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। চা বাগানের আদিবাসীরাও মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তেলিয়াপাড়ায় খোদিত স্মৃতিস্তম্ভে আদিবাসীদের নাম এখনো জ¦লজ¦ল করছে। সাঁওতালি ভাষায় লিখেছেনÑ ‘ওহধশ ঝড়হধৎ ইধহমষধ, ওহ ফড় ধসরহ ফঁষধৎবঃসব শধহধ. মু-া ভাষায়Ñ ‘হামার সোনার বাংলা, হাম তোকে ভালোবাসনা’। খাড়িয়া ভাষায়Ñ ইনার সোনার বাংলা, ইন আমতে ভালোবাসায়তে দিন’, পর্যায়ক্রমে উড়িয়া ও উরাঁও ভাষাতে।

ভাষার প্রতি নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করতে যে ভূমিকা, সেটি তাদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে। কখনো কখনো মনে হয়েছে, আদিবাসীদের মাতৃভাষা অপাঙ্ক্তেয়, সেই চেতনা ও বোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এমপি মহোদয় স্থাপন করলেন ভাষার প্রতি ভালোবাসার মহানুভবতা। স্রষ্টার সৃষ্টি মাতৃভাষাকে রক্ষা, লালন-পালন, সংরক্ষণ ও চর্চা করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়েই ভাষা বেঁচে থাকে। ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এমপি নির্বাচিত এলাকার রিসোর্স খুঁজে বের করছেন, যেটি এতোদিন অবহেলা ও অযতেœ পড়েছিলো। বিশ^াস করি, তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে, কেননা নিজস্ব রিসোর্স ব্যবহারে দরদ, মমতা ও ভালোবাসা থাকে।

আদিবাসীদের বসবাস সমগ্র বাংলাদেশে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা পিছিয়ে আছে পরিচিতিতে, শিক্ষায়, উন্নয়নে কিংবা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশেও। হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ নিজ উদ্যোগেই, সৌন্দর্যের তাগিদ থেকেই যে উদ্যোগের সুচনা করেছেন, সেটি অন্যদের জন্যেও একটি উৎসাহব্যাঞ্জক উদাহরণ। আদিবাসীদের পাশে থেকে উজ্জীবিত করে সৌন্দর্যের ফুলগুলোকে ভালোবাসলে এলাকাটি সৌরভে ম ম করবে। আদিবাসীদের ভালোবাসুন, আদিবাসীরাও আপনাকে সরলচিত্তে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

মিথুশিলাক মুরমু

image

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ‘সাঁওতাল দম্পতি’

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

২০২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর পরিদর্শনের সুযোগ ঘটেছিলো ময়মনসিংহে অবস্থিত ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাটি। অফিস সংক্রান্ত কাজে সাহেব কোয়ার্টার, কাঁচিঝুলিতে চার দিন অবস্থান করছিলাম। সেদিন অত্যন্ত উৎসুক হয়ে জানার ও খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘সাঁওতালী নারী’ প্রভৃতি চিত্রকর্ম; যাতে স্বচক্ষে দেখতে পারি। সংগ্রহশালার দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানালেন, মূল চিত্রকর্মগুলো ঢাকাতে রয়েছে। এখান থেকে মূল্যবান চিত্রকর্মগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে অনেক আগেই। আশাহত হয়ে ভিজিটর বুকে সম্ভবত এভাবেই লিখেছিলাম, ‘সাঁওতালদের নিয়ে কোনো চিত্রকর্ম চোখে পড়েনি, সংগ্রহশালা পরিদর্শন করে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছি।’ অর্থাৎ একজন আদিবাসী সাঁওতাল হিসেবে, অর্থ খরচ করে ময়মনসিংহে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় পৌঁছেও নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়েছে। জয়নুল আবেদিনের অমর কীর্তিগুলো দর্শনের অতৃপ্তি আমার থেকেই গেছে।

২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশবরেণ্য শিল্পী জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘সাঁওতাল দম্পতি’ সম্প্রতিকালে রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়কে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ১৮ মার্চ ‘সোদেবিস’ নামক সংস্থা নিলামে তোলে। মর্ডান অ্যান্ড কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়ান আর্ট শিরোনামে ওই নিলাম আয়োজন করে। সাঁওতাল দম্পত্তির ছবির মূল্য ধরা হয়েছিলো এক লাখ থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার, তবে তা বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৩ টাকা)। বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর শিল্পকর্মের জন্য এটিই সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড।

শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, চিত্রকর্মটি বিশ^বাজারে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেছেন, ‘জানামতে এর আগে বাংলাদেশি কোনও শিল্পীর আঁকা পেইন্টিং এত দামে বিক্রি হয়নি।’

সাঁওতাল গ্রামীণ দম্পতিকে ঐতিহ্যবাহী শঙ্কুময় টুপি (গ্রামীণ ভাষায়Ñ মাথাল অর্থাৎ বাঁশ বা বেতের তৈরি) পরে খালি পায়ে হাঁটতে দেখা যায়। কাঠের প্যানেলে তৈল মাধ্যমে জয়নুল আবেদিন ‘সাঁওতাল দম্পতি’ প্রথম এঁকেছিলেন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। পরে ছবিটির একাধিক সংস্করণও করেছিলেন তিনি। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তৈল মাধ্যমে আঁকা ১০২ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ১৩৫.৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে চিত্রকর্মটি জয়নুলের স্বাক্ষর বহন করে। একদিকে শিল্পী হিসেবে নিজের সমস্ত চিত্রকর্মে বাংলার মাটি, জল, মানুষ, ইতিহাসকে তুলে ধরা ও অপরদিকে এদেশের চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াÑ এসবের জন্যই তিনি শিল্পাচার্য অর্থাৎ শিল্পের গুরু বা শিক্ষক হিসেবে ভূষিত হয়েছেন।

সোদেবিসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছেÑ ‘সাঁওতাল দম্পতি’ চিত্র আগে জয়নুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানি কূটনৈতিক ও ধারাভাষ্যকার জামশেদ কে মার্কার এবং ডিয়ানা জে মার্কারের পরিবারের মালিকানাধীন ছিল; যা জয়নুল নিজে তাদের দিয়েছিলেন।’ জানা যায়, শিল্পী জয়নুল আবেদিন প্রায়ই মার্কার দম্পতির বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন, সে সময় শিল্পী রশীদ চৌধুরীসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীকে মার্কার দম্পতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ইতোপূর্বে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের নিলামকারী প্রতিষ্ঠান ক্রিসটিজে জয়নুল আবেদিনের সাঁওতাল সিরিজের আরেকটি চিত্রকর্ম নিলামে বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিলো।

ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এমপি (হবিগঞ্জ-৪, মাধবপুর-চুনারুঘাট) একটি মাইলফলক ঘটনার অবতারণা করেছেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় যাত্রী ছাউনিতে যে কারিশমা দেখিয়েছেন, সেটি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। অবেহিলত ও পরিত্যক্ত যাত্রী ছাউনিকে পর্যটকদের আকর্ষণ ও সাম্যক ধারণা দিতে তুলে ধরেছেন আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনাচরণ। যাত্রী ছাউনিকে সাজিয়েছেন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা খাড়িয়া দুজন নারীর অবয়বে। তথ্যমতে, এই দুইজনেই খাড়িয়া ভাষা জানা শেষব্যক্তি; অতঃপর আর কেউই শোনবে না খাড়িয়া ভাষার কথোপকথন। মাধবপুর-চুনারুঘাট এলাকাটিতে বেশ কয়েকটি চা বাগান রয়েছে, চা বাগানগুলোতে বসবাস করে সাঁওতাল, উরাঁও, উড়িয়া, মু-া, খাড়িয়াসহ আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী।

প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। জনগোষ্ঠীভিত্তিক খাবার-দাবার, পোশাক-আসাক, নাচ-গান ও পারিস্পরিক যোগবন্ধনেরও ভিন্নতা রয়েছে। আর সেলক্ষ্যে সংস্কৃতির ঐশ^র্যতা তুলে ধরতে যাত্র ছাউনির ওয়ালে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। চা বাগানে বসবাসরত আদিবাসীদের নিজস্ব পোশাকে, বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন, এমনই একটি চিত্র উপস্থাপন করে পর্যটকদের মনোজগতকে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক প্রকার জোর দিয়েই বলা যায়, মাধবপুর-চুনারুঘাট এলাকায় কতকগুলো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে এখনো এলাকাবাসী ওয়াকিবহাল নন। আদিবাসীদের উৎসবকে আরো সার্বজনীন ও আকর্ষিত করা যায়, যেমনটি পার্বত্য এলাকায় ঘটে চলেছে। আদিবাসীদের লুপ্ত সংস্কৃতি, উৎসব, পার্বনকে জাগরণ করলে পর্যটন শিল্পের প্রসারতা ঘটবে বৈ কমবে না।

এমপি মহোদয় যাত্রী ছাউনিতে বাংলাসহ আদিবাসীদের ৬টি (সাঁওতাল, উরাঁও, উড়িয়া, মু-া, খাড়িয়া) ভাষায়, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ লিপিবদ্ধ করে ভাষার স্বীকৃতি ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। চা বাগানের আদিবাসীরাও মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তেলিয়াপাড়ায় খোদিত স্মৃতিস্তম্ভে আদিবাসীদের নাম এখনো জ¦লজ¦ল করছে। সাঁওতালি ভাষায় লিখেছেনÑ ‘ওহধশ ঝড়হধৎ ইধহমষধ, ওহ ফড় ধসরহ ফঁষধৎবঃসব শধহধ. মু-া ভাষায়Ñ ‘হামার সোনার বাংলা, হাম তোকে ভালোবাসনা’। খাড়িয়া ভাষায়Ñ ইনার সোনার বাংলা, ইন আমতে ভালোবাসায়তে দিন’, পর্যায়ক্রমে উড়িয়া ও উরাঁও ভাষাতে।

ভাষার প্রতি নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করতে যে ভূমিকা, সেটি তাদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে। কখনো কখনো মনে হয়েছে, আদিবাসীদের মাতৃভাষা অপাঙ্ক্তেয়, সেই চেতনা ও বোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এমপি মহোদয় স্থাপন করলেন ভাষার প্রতি ভালোবাসার মহানুভবতা। স্রষ্টার সৃষ্টি মাতৃভাষাকে রক্ষা, লালন-পালন, সংরক্ষণ ও চর্চা করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়েই ভাষা বেঁচে থাকে। ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এমপি নির্বাচিত এলাকার রিসোর্স খুঁজে বের করছেন, যেটি এতোদিন অবহেলা ও অযতেœ পড়েছিলো। বিশ^াস করি, তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে, কেননা নিজস্ব রিসোর্স ব্যবহারে দরদ, মমতা ও ভালোবাসা থাকে।

আদিবাসীদের বসবাস সমগ্র বাংলাদেশে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা পিছিয়ে আছে পরিচিতিতে, শিক্ষায়, উন্নয়নে কিংবা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশেও। হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ নিজ উদ্যোগেই, সৌন্দর্যের তাগিদ থেকেই যে উদ্যোগের সুচনা করেছেন, সেটি অন্যদের জন্যেও একটি উৎসাহব্যাঞ্জক উদাহরণ। আদিবাসীদের পাশে থেকে উজ্জীবিত করে সৌন্দর্যের ফুলগুলোকে ভালোবাসলে এলাকাটি সৌরভে ম ম করবে। আদিবাসীদের ভালোবাসুন, আদিবাসীরাও আপনাকে সরলচিত্তে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top