alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডারউইনের খোঁজে নিউইয়র্কের জাদুঘরে

শঙ্কর প্রসাদ দে

: শনিবার, ১১ মে ২০২৪
image

আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি

১৮ ডিসেম্বর সোমবার ২০২৩। ওয়াশিংটন থেকে ফেরার পথে মামুন বললো, কাল অফিস করতে হবে। নিজেরা গিয়ে কি দেখবে বলো। বললাম, নেটে দেখলাম, ডারউইনকে খোঁজার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা হলো নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি।

রুনুর দেখি অনীহাভাব। প্রাণীবিদ্যায় পড়তে গিয়ে জীবনভর ডারউইন, ওয়ালেস, মেন্ডেল পড়তে পড়তে কাহিল। ওই সব ফসিল, কঙ্কাল দেখার ইচ্ছে তার নেই। অবশ্য শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হলো। রাত ১২টার দিকে মামুন ফোন করে জানাল তোমাদের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে রেখেছি।

৮টার দিকে ব্রেকফাস্ট সারলাম। স্টার হোটেলে বুফে ব্রেকফাস্ট মানে একেবারে ডিনার পর্যন্ত চলে যায়। ফ্লুশিং স্টেশনে ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করতেই এক্সেস দেয়া হল। সেন্ট্রাল পার্ক স্টেশন থেকে বের হতে দেখি বামপাশে অতিকায় এক ভবন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও লাইন ধরতে হলো। অবশ্য মিনিট ১৫-এর মধ্যে ঢুকে গেলাম। হাতের ডানে একটি নোটিশে লেখা আছেÑ নিরাপত্তার স্বার্থে এই ভবনে প্রদর্শিত প্রাণী কঙ্কাল ও জীবাশ্মের বেশিরভাগ রেপ্লিকা। সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তার স্বার্থে মূল জীবাশ্ম ও কঙ্কালগুলো সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় স্টোররুমে সংরক্ষিত আছে। গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এসব আইটেম দেখার অনুমতি দেয়া হয় না।

জাদুঘরের ছোট আকৃতির স্মারকগুলো এবং উপর তলায় বিশালাকার ডাইনোসর সংরক্ষণের হিমায়িত স্টোর। বৃহৎ হাতির ফসিলও চার তলায় সংরক্ষণ করা হয়। নরকঙ্কাল দেখতে পাবো না বলে একটু মন খারাপ ছিল। বহু আগে পড়েছিলাম, অপেক্ষাকৃত নিকট অতীত অর্থাৎ ব্রোঞ্জযুগের কিছু নরকঙ্কাল ও কঙ্কালের অংশ বিশেষ প্রদর্শিত হয়। জাদুঘরে ঢুকে খোঁজ নিয়ে জানলাম আমেরিকাবাসী নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে হইচই শুরু করে দেয়। প্রশ্ন দেখা দিল নরকঙ্কাল বড়জোর ডাক্তারি বিদ্যার প্রয়োজনে মেডিকেল কলেজে থাকতে পারে শিক্ষণ ও গবেষণার জন্য। জাদুঘরে প্রদর্শিত হবার পেছনে যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। অধিকতর প্রশ্ন ছিল প্রদর্শনের অনুমতির বিষয়টি। সরকারি অনুমতি নিয়ে এসব কঙ্কাল মূলত ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছে।

সমসাময়িককালে ওইসব শবদেহ কবরস্থ করা হয়েছিল। এখন জনসমক্ষে প্রদর্শন করার সময় উত্তরাধিকারী কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের অনুমতির প্রশ্ন জড়িত আছে। শেষ পর্যন্ত জাদুঘর কর্তৃপক্ষ নরকঙ্কাল প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছেন।

ডারউইনকে দুইভাবে খোঁজার ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেক গ্যালারি বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক এই দুই ভাগে বিভক্ত। ‘আফ্রিকান পিপলস’ প্রদর্শিত হচ্ছে দোতলায়। বিজ্ঞানীদের অভিমত হলো বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মনুষ্য প্রজাতির সৃষ্ঠি আফ্রিকায়। সেটির আনুমানিক সময় ২ লাখ বছর আগেকার। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এই দুই লাখ বছরের বিভিন্ন পর্বে মানুষ কিভাবে গুহা জীবনের ছবি এঁকেছে বা গুহার মধ্যে শিকারের অস্ত্র পাওয়া গেছে বা পাথুরে অস্ত্র যা দিয়ে শিকার করতো সেগুলো প্রদর্শনীতে রেখেছে।

আবার অনেক গুহায় পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জযুগের সূচালো অস্ত্র, যা দিয়ে পশু শিকার হতো। এরপর অনেক গুহায় বা খনন কাজে পাওয়া গেছে লৌহ নির্মিত ধাতব অস্ত্র। অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সাজানো শিকারের অস্ত্রগুলো থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, আদিম মানুষ একসময় পাথরকে ধারালো করে, এর পরে ব্রোঞ্জসামগ্রীর ধারালো বর্শা জাতীয় অস্ত্র দিয়ে, আরো পরে লোহা দিয়ে তৈরি ধারালো অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করেছে।

একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবহৃত লাঠি ও পাথরের টুকরার পর সাজিয়ে রাখা হয়েছে ধারালো পাথর ব্রোঞ্জ ও লৌহ অস্ত্রগুলো। সূচালো ব্রোঞ্জের ফলা অত:পর লোহার ধারালো দা, খন্তা জাতীয় অস্ত্র। পরিষ্কার বুঝা যায় দুই লাখ বছরে মানুষ কিভাবে আদিম অবস্থা থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের সভ্যতায় পৌঁছল।

প্রাগৈতিহাসিক নরজীবাশ্ম বা নর ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি বিবর্তনের সাংস্কৃতিক ডিসপ্লে লাখো বছরের বিবর্তন বুঝার জন্য একাধারে ধারালো এবং চমকপ্রদ। সাথে প্রদর্শিত হচ্ছে গাছের বাকল, পশুর চামড়ার নেংটি। এসব নেংটির কার্বনটেস্ট থেকে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে লেখা আছে ঠিক কখন থেকে মানুষ লজ্জা নিবারণ শিখেছে।

মানবিক বিভাগের ছাত্র হওয়ায় ডারউইনের উপর আমার জ্ঞান ছিল একেবারে সীমিত। ইন্টারে পড়ার সময় ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ এর বঙ্গানুবাদ পড়ে বুঝলাম, প্রাণের বিবর্তন বহু গভীরের বিষয়। ডারউইন বলেছিলেনÑ সকল প্রজাতিই কিছু সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে সাধারণ পূর্বপুরুষ বহু আগে বহু ভাগে বিভক্ত হয়েছে (এটাকে গাছের গোড়া থেকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হওয়ার মতো)। ডারউইন বিরোধীরা বলে থাকেন- বানর থেকে মানুষ হওয়ার বিষয়টি বিশ^াসযোগ্য নয়। বিবর্তনবাদে বানর থেকে মানুষ হয়েছে এতো সোজাসুজি কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে প্রত্যেক প্রজাতি সাধারণ পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার। একটি পাখির ডিসপ্লের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম অন্তত ২০ ধরনের ঘুঘু ডিসপ্লেতে দেয়া হয়েছে। কোনটার ঠোঁঠ লম্বা, কোনটার ঠোঁঠ ছোট, কোনটা মোটা, কোনটা আকারে ছোট, কোনটার পা লম্বা, কোনটার পা বেঁটে। খাদ্য শিকারের বাস্তবতায় কোনটার ঠোঁঠ লম্বা হয়ে গেছে। আমাদের মতো দেশে পোকা মাকড় মাটির উপরে পাওয়া যায় বলে ইন্ডিয়ান ঘুঘুর ঠোঁঠ ছোট ও ভোঁতা। বাস্তব প্রয়োজনে কাঠ ঠোকরার ঠোঁঠ ধারালো এবং লম্বা।

প্রাকৃতিক জাদুঘরটিতে ব্যতিক্রমী একটি শাখা রয়েছে। সেটির নাম মহাকাশ বিজ্ঞান, প্রথম তলার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে। আর্থার রস হলে বিশাল বিশাল উল্কাপি-ের কয়েকটি অংশ প্রদর্শিত হচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, মহাশূন্যে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ায় এসব উল্কাপিন্ড। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মধ্যে এসে পড়লে বায়ু ঘর্ষণে এদের ৯৯.৯৯ ভাগই ধ্বংস হয়ে যায়। পদার্থবিদ্যার সাজানো প্রতিরক্ষা ব্যুহ না থাকলে মেটেরয়েড বা উল্কাপি-ের আঘাতেই প্রাণিকুলে ৫ম গণবিলুপ্তি বহু আগেই ঘটে যেতো। ৬০ লাখ বছর আগে ১২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের উল্কাপি- মেস্কিকো উপকূলে আঘাত হানায় কয়েক দিনের জন্য গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ডাইনোসরসহ হাজার হাজার প্রাণিকুল। টিকে আছে শুধু তেলাপোকা আর রাজকাঁকড়া। যতদ্রুত জাদুঘরটি দেখে শেষ করেছি, ততো দ্রুত লিখে বর্ণনা করা অসম্ভব। প্রকৃতি বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ স্যাম্পল বা স্মারকগুলোর নিখুঁত উপস্থাপনা দেয়া আছে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে। ডারউইনের বির্বতনবাদ সম্পর্কিত দুটো বই-ই প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৮ এবং ১৮৫৯ সালে।

এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৬৫ বছর। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতক হলো প্রকৃতি বিজ্ঞানের সোনালি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা জলে স্থলে ও ভূগর্ভে হানা দিয়ে তন্ন তন্ন করে তুলে এনেছেন হাজার হাজার প্রাণিকুল জীবাশ্ম বা স্মারক। ডারউইন প্রাণী বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানে বিস্তীর্ণ জ্ঞানচর্চার দিগন্ত উন্মোচন করে গেছেন এবং যেটুকু এই জাদুঘরে আছে, তা বলার জন্য অন্তত আরেকটি নিবন্ধের প্রয়োজন। অতঃপর প্রথম পর্বের এতটুকুতে ইতি টানছি।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডারউইনের খোঁজে নিউইয়র্কের জাদুঘরে

শঙ্কর প্রসাদ দে

image

আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি

শনিবার, ১১ মে ২০২৪

১৮ ডিসেম্বর সোমবার ২০২৩। ওয়াশিংটন থেকে ফেরার পথে মামুন বললো, কাল অফিস করতে হবে। নিজেরা গিয়ে কি দেখবে বলো। বললাম, নেটে দেখলাম, ডারউইনকে খোঁজার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা হলো নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি।

রুনুর দেখি অনীহাভাব। প্রাণীবিদ্যায় পড়তে গিয়ে জীবনভর ডারউইন, ওয়ালেস, মেন্ডেল পড়তে পড়তে কাহিল। ওই সব ফসিল, কঙ্কাল দেখার ইচ্ছে তার নেই। অবশ্য শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হলো। রাত ১২টার দিকে মামুন ফোন করে জানাল তোমাদের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে রেখেছি।

৮টার দিকে ব্রেকফাস্ট সারলাম। স্টার হোটেলে বুফে ব্রেকফাস্ট মানে একেবারে ডিনার পর্যন্ত চলে যায়। ফ্লুশিং স্টেশনে ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করতেই এক্সেস দেয়া হল। সেন্ট্রাল পার্ক স্টেশন থেকে বের হতে দেখি বামপাশে অতিকায় এক ভবন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও লাইন ধরতে হলো। অবশ্য মিনিট ১৫-এর মধ্যে ঢুকে গেলাম। হাতের ডানে একটি নোটিশে লেখা আছেÑ নিরাপত্তার স্বার্থে এই ভবনে প্রদর্শিত প্রাণী কঙ্কাল ও জীবাশ্মের বেশিরভাগ রেপ্লিকা। সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তার স্বার্থে মূল জীবাশ্ম ও কঙ্কালগুলো সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় স্টোররুমে সংরক্ষিত আছে। গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এসব আইটেম দেখার অনুমতি দেয়া হয় না।

জাদুঘরের ছোট আকৃতির স্মারকগুলো এবং উপর তলায় বিশালাকার ডাইনোসর সংরক্ষণের হিমায়িত স্টোর। বৃহৎ হাতির ফসিলও চার তলায় সংরক্ষণ করা হয়। নরকঙ্কাল দেখতে পাবো না বলে একটু মন খারাপ ছিল। বহু আগে পড়েছিলাম, অপেক্ষাকৃত নিকট অতীত অর্থাৎ ব্রোঞ্জযুগের কিছু নরকঙ্কাল ও কঙ্কালের অংশ বিশেষ প্রদর্শিত হয়। জাদুঘরে ঢুকে খোঁজ নিয়ে জানলাম আমেরিকাবাসী নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে হইচই শুরু করে দেয়। প্রশ্ন দেখা দিল নরকঙ্কাল বড়জোর ডাক্তারি বিদ্যার প্রয়োজনে মেডিকেল কলেজে থাকতে পারে শিক্ষণ ও গবেষণার জন্য। জাদুঘরে প্রদর্শিত হবার পেছনে যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না। অধিকতর প্রশ্ন ছিল প্রদর্শনের অনুমতির বিষয়টি। সরকারি অনুমতি নিয়ে এসব কঙ্কাল মূলত ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছে।

সমসাময়িককালে ওইসব শবদেহ কবরস্থ করা হয়েছিল। এখন জনসমক্ষে প্রদর্শন করার সময় উত্তরাধিকারী কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের অনুমতির প্রশ্ন জড়িত আছে। শেষ পর্যন্ত জাদুঘর কর্তৃপক্ষ নরকঙ্কাল প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছেন।

ডারউইনকে দুইভাবে খোঁজার ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেক গ্যালারি বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক এই দুই ভাগে বিভক্ত। ‘আফ্রিকান পিপলস’ প্রদর্শিত হচ্ছে দোতলায়। বিজ্ঞানীদের অভিমত হলো বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মনুষ্য প্রজাতির সৃষ্ঠি আফ্রিকায়। সেটির আনুমানিক সময় ২ লাখ বছর আগেকার। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এই দুই লাখ বছরের বিভিন্ন পর্বে মানুষ কিভাবে গুহা জীবনের ছবি এঁকেছে বা গুহার মধ্যে শিকারের অস্ত্র পাওয়া গেছে বা পাথুরে অস্ত্র যা দিয়ে শিকার করতো সেগুলো প্রদর্শনীতে রেখেছে।

আবার অনেক গুহায় পাওয়া গেছে ব্রোঞ্জযুগের সূচালো অস্ত্র, যা দিয়ে পশু শিকার হতো। এরপর অনেক গুহায় বা খনন কাজে পাওয়া গেছে লৌহ নির্মিত ধাতব অস্ত্র। অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সাজানো শিকারের অস্ত্রগুলো থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, আদিম মানুষ একসময় পাথরকে ধারালো করে, এর পরে ব্রোঞ্জসামগ্রীর ধারালো বর্শা জাতীয় অস্ত্র দিয়ে, আরো পরে লোহা দিয়ে তৈরি ধারালো অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করেছে।

একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবহৃত লাঠি ও পাথরের টুকরার পর সাজিয়ে রাখা হয়েছে ধারালো পাথর ব্রোঞ্জ ও লৌহ অস্ত্রগুলো। সূচালো ব্রোঞ্জের ফলা অত:পর লোহার ধারালো দা, খন্তা জাতীয় অস্ত্র। পরিষ্কার বুঝা যায় দুই লাখ বছরে মানুষ কিভাবে আদিম অবস্থা থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের সভ্যতায় পৌঁছল।

প্রাগৈতিহাসিক নরজীবাশ্ম বা নর ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি বিবর্তনের সাংস্কৃতিক ডিসপ্লে লাখো বছরের বিবর্তন বুঝার জন্য একাধারে ধারালো এবং চমকপ্রদ। সাথে প্রদর্শিত হচ্ছে গাছের বাকল, পশুর চামড়ার নেংটি। এসব নেংটির কার্বনটেস্ট থেকে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে লেখা আছে ঠিক কখন থেকে মানুষ লজ্জা নিবারণ শিখেছে।

মানবিক বিভাগের ছাত্র হওয়ায় ডারউইনের উপর আমার জ্ঞান ছিল একেবারে সীমিত। ইন্টারে পড়ার সময় ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ এর বঙ্গানুবাদ পড়ে বুঝলাম, প্রাণের বিবর্তন বহু গভীরের বিষয়। ডারউইন বলেছিলেনÑ সকল প্রজাতিই কিছু সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে সাধারণ পূর্বপুরুষ বহু আগে বহু ভাগে বিভক্ত হয়েছে (এটাকে গাছের গোড়া থেকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হওয়ার মতো)। ডারউইন বিরোধীরা বলে থাকেন- বানর থেকে মানুষ হওয়ার বিষয়টি বিশ^াসযোগ্য নয়। বিবর্তনবাদে বানর থেকে মানুষ হয়েছে এতো সোজাসুজি কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে প্রত্যেক প্রজাতি সাধারণ পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার। একটি পাখির ডিসপ্লের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম অন্তত ২০ ধরনের ঘুঘু ডিসপ্লেতে দেয়া হয়েছে। কোনটার ঠোঁঠ লম্বা, কোনটার ঠোঁঠ ছোট, কোনটা মোটা, কোনটা আকারে ছোট, কোনটার পা লম্বা, কোনটার পা বেঁটে। খাদ্য শিকারের বাস্তবতায় কোনটার ঠোঁঠ লম্বা হয়ে গেছে। আমাদের মতো দেশে পোকা মাকড় মাটির উপরে পাওয়া যায় বলে ইন্ডিয়ান ঘুঘুর ঠোঁঠ ছোট ও ভোঁতা। বাস্তব প্রয়োজনে কাঠ ঠোকরার ঠোঁঠ ধারালো এবং লম্বা।

প্রাকৃতিক জাদুঘরটিতে ব্যতিক্রমী একটি শাখা রয়েছে। সেটির নাম মহাকাশ বিজ্ঞান, প্রথম তলার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে। আর্থার রস হলে বিশাল বিশাল উল্কাপি-ের কয়েকটি অংশ প্রদর্শিত হচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, মহাশূন্যে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ায় এসব উল্কাপিন্ড। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মধ্যে এসে পড়লে বায়ু ঘর্ষণে এদের ৯৯.৯৯ ভাগই ধ্বংস হয়ে যায়। পদার্থবিদ্যার সাজানো প্রতিরক্ষা ব্যুহ না থাকলে মেটেরয়েড বা উল্কাপি-ের আঘাতেই প্রাণিকুলে ৫ম গণবিলুপ্তি বহু আগেই ঘটে যেতো। ৬০ লাখ বছর আগে ১২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের উল্কাপি- মেস্কিকো উপকূলে আঘাত হানায় কয়েক দিনের জন্য গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ডাইনোসরসহ হাজার হাজার প্রাণিকুল। টিকে আছে শুধু তেলাপোকা আর রাজকাঁকড়া। যতদ্রুত জাদুঘরটি দেখে শেষ করেছি, ততো দ্রুত লিখে বর্ণনা করা অসম্ভব। প্রকৃতি বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ স্যাম্পল বা স্মারকগুলোর নিখুঁত উপস্থাপনা দেয়া আছে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে। ডারউইনের বির্বতনবাদ সম্পর্কিত দুটো বই-ই প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৮ এবং ১৮৫৯ সালে।

এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৬৫ বছর। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতক হলো প্রকৃতি বিজ্ঞানের সোনালি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা জলে স্থলে ও ভূগর্ভে হানা দিয়ে তন্ন তন্ন করে তুলে এনেছেন হাজার হাজার প্রাণিকুল জীবাশ্ম বা স্মারক। ডারউইন প্রাণী বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানে বিস্তীর্ণ জ্ঞানচর্চার দিগন্ত উন্মোচন করে গেছেন এবং যেটুকু এই জাদুঘরে আছে, তা বলার জন্য অন্তত আরেকটি নিবন্ধের প্রয়োজন। অতঃপর প্রথম পর্বের এতটুকুতে ইতি টানছি।

[লেখক : আইনজীবী, আপিল বিভাগ]

back to top