alt

উপ-সম্পাদকীয়

রবীন্দ্রনাথ ও গ্রীষ্মের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্ন-দুপুর

শেখর ভট্টাচার্য

: সোমবার, ২০ মে ২০২৪
image

আমরা ফিরে যেতে চাই রুদ্রতা এবং কোমলতার আদি-অকৃত্রিম অনিন্দ্য সুন্দর গ্রীষ্ম দিনে

গ্রীষ্মের দুপুর কেন জানি মনকে উদাস করে তুলে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। আমার মনের ভেতরে যে গ্রীষ্মের লালন করি সে গ্রীষ্ম ষাট-সত্তর দশকের গ্রীষ্ম। আমার শৈশব, কৈশোর, প্রাক যৌবনের গ্রীষ্ম। আমি যে শহরে জন্ম নিয়েছি, বড় হয়েছি শহরটি তখনও শহর হয়ে ওঠেনি। গ্রামের মতো শহর। বড় বড় পুকুর, দীঘি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গেলে ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার খেলা। আর একটু দূরে গেলে ছোট ছোট ঢেউ খেলানো টিলা। কোথাও শুধু টিলা আর কোথাও টিলার ওপর চা বাগান। গ্রীষ্মকালে প্রখর রৌদ্র তাপ থাকলেও আমার শহরে বর্ষা শুরু হয়ে যেতো গ্রীষ্মে। গ্রীষ্ম,বর্ষার পার্থক্য বোঝা দায় তখনও এখনও। আমি না বললেও পাঠকেরা নিশ্চয় ধারণা করে নিচ্ছেন যে শহরটির নাম সিলেট। মনে আছে এবারও গ্রীষ্মে যখন সারা দেশে তাপপ্রবাহ বয়ে চলছে, মানুষ গরমে হাঁসফাঁস করছে তখন সিলেটে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। চরম তাপপ্রবাহ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে শীতল সিলেটে তখন বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটকের ভিড়। গ্রীষ্মের দুপুরটা ছিলো খরতপ্ত। কাঁঠাল পাকা গরম। কী আশ্চর্য, এই কাঁঠাল পাকা গরমে চারদিকে গাছে গাছে কাঁঠাল। ম ম গন্ধ। কাঁচা পাকা আম সবুজ পাতা দিয়ে ঢেকে দিতো গাছের শাখা-প্রশাখাকে। মধু মাসের কথা শুনেনি। প্রকৃত মধুমাস আমাদের ছোট শহরে আমরা টের পেয়ে যেতাম, গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকেই।

শুরুতে বলেছিলাম গ্রীষ্মের দুপুরের কথা। গ্রীষ্মের দুপুর আর ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক আমার কাছে এই মধ্য বয়সেও সমার্থক, সমব্যঞ্জনাময় বলে মনে হয়। ফিরে আসি আমার প্রিয় শহর, আমার জন্ম স্থান সিলেটের গ্রীষ্ম দুপুরের গল্পে। উদাস দুপুরের নীরবতা ভেদ করে, হঠাৎ শোনা যেতো, লেইস-ফিতা ওয়ালাদের ডাক। শুধু লেইস ফিতা? এই দুপুর সময়টা ফেরিওয়ালাদের খুব প্রিয় সময় ছিলো। প্রিয় বলা ঠিক হবে না, বিকিকিনির আদর্শ সময়। বাড়ির বৌ, গিন্নিরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্পে মশগুল। কেউ বা দিবা নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠিক সেই সময় ডাক শোনা গেলো শাড়ি-কাপড়, কিংবা সিট-কাপড়, সিট কাপড়। শিশুদের জন্য হাওয়াই মিঠাই, আইসক্রিম কিংবা কটকটি। আমি জানি না এ যুগের শিশুরা কটকটির নামটি শুনেছে কিনা। গুড় দিয়ে তৈরি করা চারকোনা মিষ্টির মতো। প্রচন্ড শক্ত। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ফেরিওয়ালাদের ছিলো অনন্য এবং অদ্ভুত সুর। মনে হতো স্বপ্ন লোক থেকে আসা, কোন এক জাদুকরের আহব্বান। সে সুরে এক অন্যরকম মাদকতা। কৃষ্ণের বাঁশির সুর কিংবা হ্যামিলনের বংশীবাদকের সন্মোহনী বংশীবাদন। সব বাড়ি থেকে বৌ গিন্নিরা বেরিয়ে এসে যার যা প্রয়োজন সেই ফেরিওয়ালাকে ডেকে বারান্দায় বসালেন। ফেরিওয়ালা বসলো এক বাড়িতে কিন্তু পাড়ার প্রায় সব বাড়ির বৌ, গিন্নিরা এসে জড়ো হলেন ফেরিওয়ালের চারদিক ঘিরে। শপিং মলের নাম শুনা যায়নি তখনও। শহরের কেন্দ্রে, শাড়িপট্টি, চুড়িপট্টি যাতীয় কিছু এলাকা ছিলো। বাড়ির বৌ, গিন্নিরা বড় অনুষ্ঠান হলে আয়োজন করে সেখান থেকে কেনা কেটা করতেন না হলে ওই ফেরিওয়ালারাই ছিলো কেনাকাটার নির্ভরযোগ্য চলন্ত দোকান।

গ্রীষ্মের দুপুরে যখন আগুন হাওয়া বইতো চারদিকে, তখন বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলোনা শিশু কিশোরদের। তারপরও অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাছে, গাছে আম কাঁঠাল খুঁজে বেড়ানো হতো যে কোন ভাবেই। একান্ত বের হতে না পারলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রূপকথার গল্পের চরিত্রদের আবিষ্কারে মনযোগ দিতে হতো। শৈশব-কৈশোর এমনকি প্রাক-যৌবনেও বিছানার পাশের দেয়ালে আকাশ খুঁজে পেতাম, পাখি উড়ে যাচ্ছে মনে হতো। আরও শৈশবে রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাক্ষস, খক্ষোস দেয়ালে ঘুরে বেড়াতো। এসব কল্পনার সুতো উড়ানো শুধু মাত্র যে গ্রীষ্মের দুপুরেই স্বপ্নালু চোখে খেলা করতো তা কিন্তু নয়। সারা বছরেই এসব চরিত্র হাঁটা চলা করতো বিছানার পাশের দেয়ালে।

গ্রীষ্মের দুপুরে মানুষ কিছুটা হলেও দার্শনিক হয়ে যেতো। আমার মনে আছে শামসুর রাহমান ‘দৈনিক বাংলায়’ ‘মৈনাক’ ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লিখতেন। তার উপসম্পাদকীয়র গদ্য আমার কাছে কবিতার মতো মনে হতো। শামসুর রাহমানের কোন এক দিনের উপসম্পাদকীয়তে দেয়ালের গায়ে তার কল্পনা বিলাসের কথা লিখেছিলেন। হুবহু উদ্বৃতি দিতে না পারলেও কিছুটা মনে আছে। অনেকটা এরকম- ‘দেয়ালের গায়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, আকাশের কী অপরূপ রঙ, মনটা উদাস হয়ে আছে। দেয়ালে মেঘের সাথে আমার খেলা।’ মধ্য বয়সের শামসুর রাহমানকে দেয়ালের গায়ের প্রকৃতির সাথে মিতালী পাততে দেখেছি আমরা। গ্রীষ্মের দুপুরে আমি জানিনা, আমাদের এ প্রজন্মের শিশু কিশোর এমন কী যূবকদের সেই কল্পনা বিলাসের সময় কিংবা মানসিকতা আছে কিনা। প্রযুক্তি আমাদের মনের আকাশও দখল করে ফেলেছে। ইমাজিনেশন বা কল্পনা না থাকলে সৃজনশীলতা থাকে না। যন্ত্র চর্চা করেও সৃজনশীলতা তৈরি হয় কিনা আমার জানা নেই। বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। নাকি এক সময় মানুষের চিন্তার ভারও নিয়ে নেবে এআই দিয়ে তৈরি বুদ্ধিমান যন্ত্র মানব।

ষাট, সত্তর দশকে জলবায়ু বিরূপ ছিলো না। ঋতুগুলোর চরিত্র আমাদের কাছে পরিস্ফুট ছিলো। আমরা বৈশাখে প্রকৃতির রুক্ষতা, রুদ্ররূপ এবং কোমলতাও দেখছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন আর প্রকৃতির রুক্ষ, রুদ্র, কোমল রূপ স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান হয় না।

রবীন্দ্র পূর্ব যুগে আমরা ষড়ঋতুর ব্যবহারিক দিকের বর্ণনা পাই। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা পেয়ে যাই প্রতিটি ঋতুর দর্শন। ঋতু-বৈচিত্র্যের বর্ণনাও অনুপস্থিত ছিলো রবীন্দ্র পূর্ব যুগে। রবীন্দ্রনাথ প্রখর বৈশাখের রুদ্রতা এবং কোমলতার মাঝে গ্লানি দূর করার আভাস পেয়েছেন। এই রুদ্রতা আমাদের সমস্ত মলিনতা দূর করে পবিত্র করে দেয়। মানুষ ও প্রকৃতি নির্মল, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম সঙ্গীতে দারুণ দাহনবেলার রসহীনতার চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে, বৈশাখী ঝড়কে তেমনি জীর্ণতার অবসানে নতুনের আগমনের পূর্ব সংকেতরূপে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র ভাবনায় বৈশাখী ঝড় শুধু বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, হৃদয়ের ভেতরেও বয়ে যায়। গ্রীষ্মের মধ্যে তিনি একদিকে দেখেছেন কঠোর রূপ, বৈরাগীর বেশ, অন্যদিকে তার রস-কোমলতা ও সৃষ্টির স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন। গীতবিতানে গ্রীষ্মের গান ১৬টি, যা রবীন্দ্রনাথ তার ৬০ থেকে ৭২ বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এসে আমাদের গ্রীষ্মকে যেভাবে মহিমান্বিত করে তুললেন, আমরা রবীন্দ্র যুগের পর থেকেই শুধু গ্রীষ্ম নয় সমস্ত ঋতুকে আবার নুতন করে আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম। রবীন্দ্রনাথ যখন বলে ওঠেনÑ

‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে.../ বৎসরের আবর্জনা/দূর হয়ে যাক যাক যাক.../এসো এসো...’, মনে হয় যেনো মানব সন্তান প্রকৃতির কাছে, বৈশাখের মাধ্যমে প্রার্থনা করছে সমস্ত দীনতা-মলিনতা দূর করে পরিশুদ্ধ করে যেন তোলা হয় মানুষের অন্তর। কী অসাধারণ প্রার্থনা। এই হলো রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম দর্শন।

প্রসঙ্গ থেকে মনে হয় অনেক দূরে চলে আসা হলো। আসলে খুব দূরে নয়। ষাট-সত্তর দশক পর্যন্ত জলবায়ুর এতোটা বিপর্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্র যুগের গ্রীষ্মকে আমরা কিছুটা হলেও দেখেছি, তাই রবীন্দ্র দর্শন আমাদেরকে স্মৃতি কাতর করে তোলে। ষাটের দশকে আমাদের এই বাংলাদেশে তেমন নগরায়ণ হয়নি। আমরা গ্রামীণ পটভূমির শহরগুলোতে বসত করতাম। গ্রীষ্ম এলে কালবৈশাখীর ঝড় আসতো, কুঁড়েঘরসহ দুর্বল কাঠামোকে উড়িয়ে নিয়ে যেতো; ফসলের মাঠে ঝড়ের প্রবলতায় কৃষকের ফসলহানি ঘটতো। ঝড়ের সঙ্গী ছিলো বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে প্রকৃতি জেগে ওঠতো। গাছে গাছে কিশলয় দেখা দিতো। প্রকৃতিতে কিছুটা সবুজাভ ভাব দেখা যেতো। গ্রীষ্ম ধ্বংস, সৃষ্টির আবেদন নিয়ে মানুষকে জাগিয়ে রাখতো। রবীন্দ্রনাথের মতো আকাশ ভরা সূর্য তারা এবং ‘বিশ্বভরা প্রাণের’ মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করে মানুষ বিস্মিত হতো।

গ্রীষ্মের দৃশ্যমান সাধারণ রূপকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গ্রীষ্ম এখন তাপপ্রবাহের ঋতুতে পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্মের দুপুর আর আমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করে স্বপ্ন লোকে নিয়ে যায় না। গ্রীষ্মের চিত্র, ধ্বনি, বর্ণ ও গন্ধকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। শুধু গ্রীষ্ম নয় প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে ষড়ঋতুকেও হারাতে বসেছি। রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম সঙ্গীতের চিত্রের মতো আমরা মনে হয় বলে উঠছি- ‘প্রখর তপন তাপে/ আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার...।’ আমরা যেনো আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমাদের যতো গ্লানি, আমাদের যতো পাপ, তা দূর করে দেয়ার সমবেত প্রার্থনা করতে পারি। আমরা ফিরে যেতে চাই রুদ্রতা এবং কোমলতার আদি-অকৃত্রিম অনিন্দ্য সুন্দর গ্রীষ্ম দিনে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রবীন্দ্রনাথ ও গ্রীষ্মের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্ন-দুপুর

শেখর ভট্টাচার্য

image

আমরা ফিরে যেতে চাই রুদ্রতা এবং কোমলতার আদি-অকৃত্রিম অনিন্দ্য সুন্দর গ্রীষ্ম দিনে

সোমবার, ২০ মে ২০২৪

গ্রীষ্মের দুপুর কেন জানি মনকে উদাস করে তুলে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। আমার মনের ভেতরে যে গ্রীষ্মের লালন করি সে গ্রীষ্ম ষাট-সত্তর দশকের গ্রীষ্ম। আমার শৈশব, কৈশোর, প্রাক যৌবনের গ্রীষ্ম। আমি যে শহরে জন্ম নিয়েছি, বড় হয়েছি শহরটি তখনও শহর হয়ে ওঠেনি। গ্রামের মতো শহর। বড় বড় পুকুর, দীঘি। শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গেলে ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ার খেলা। আর একটু দূরে গেলে ছোট ছোট ঢেউ খেলানো টিলা। কোথাও শুধু টিলা আর কোথাও টিলার ওপর চা বাগান। গ্রীষ্মকালে প্রখর রৌদ্র তাপ থাকলেও আমার শহরে বর্ষা শুরু হয়ে যেতো গ্রীষ্মে। গ্রীষ্ম,বর্ষার পার্থক্য বোঝা দায় তখনও এখনও। আমি না বললেও পাঠকেরা নিশ্চয় ধারণা করে নিচ্ছেন যে শহরটির নাম সিলেট। মনে আছে এবারও গ্রীষ্মে যখন সারা দেশে তাপপ্রবাহ বয়ে চলছে, মানুষ গরমে হাঁসফাঁস করছে তখন সিলেটে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। চরম তাপপ্রবাহ থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে শীতল সিলেটে তখন বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটকের ভিড়। গ্রীষ্মের দুপুরটা ছিলো খরতপ্ত। কাঁঠাল পাকা গরম। কী আশ্চর্য, এই কাঁঠাল পাকা গরমে চারদিকে গাছে গাছে কাঁঠাল। ম ম গন্ধ। কাঁচা পাকা আম সবুজ পাতা দিয়ে ঢেকে দিতো গাছের শাখা-প্রশাখাকে। মধু মাসের কথা শুনেনি। প্রকৃত মধুমাস আমাদের ছোট শহরে আমরা টের পেয়ে যেতাম, গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকেই।

শুরুতে বলেছিলাম গ্রীষ্মের দুপুরের কথা। গ্রীষ্মের দুপুর আর ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক আমার কাছে এই মধ্য বয়সেও সমার্থক, সমব্যঞ্জনাময় বলে মনে হয়। ফিরে আসি আমার প্রিয় শহর, আমার জন্ম স্থান সিলেটের গ্রীষ্ম দুপুরের গল্পে। উদাস দুপুরের নীরবতা ভেদ করে, হঠাৎ শোনা যেতো, লেইস-ফিতা ওয়ালাদের ডাক। শুধু লেইস ফিতা? এই দুপুর সময়টা ফেরিওয়ালাদের খুব প্রিয় সময় ছিলো। প্রিয় বলা ঠিক হবে না, বিকিকিনির আদর্শ সময়। বাড়ির বৌ, গিন্নিরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্পে মশগুল। কেউ বা দিবা নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠিক সেই সময় ডাক শোনা গেলো শাড়ি-কাপড়, কিংবা সিট-কাপড়, সিট কাপড়। শিশুদের জন্য হাওয়াই মিঠাই, আইসক্রিম কিংবা কটকটি। আমি জানি না এ যুগের শিশুরা কটকটির নামটি শুনেছে কিনা। গুড় দিয়ে তৈরি করা চারকোনা মিষ্টির মতো। প্রচন্ড শক্ত। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ফেরিওয়ালাদের ছিলো অনন্য এবং অদ্ভুত সুর। মনে হতো স্বপ্ন লোক থেকে আসা, কোন এক জাদুকরের আহব্বান। সে সুরে এক অন্যরকম মাদকতা। কৃষ্ণের বাঁশির সুর কিংবা হ্যামিলনের বংশীবাদকের সন্মোহনী বংশীবাদন। সব বাড়ি থেকে বৌ গিন্নিরা বেরিয়ে এসে যার যা প্রয়োজন সেই ফেরিওয়ালাকে ডেকে বারান্দায় বসালেন। ফেরিওয়ালা বসলো এক বাড়িতে কিন্তু পাড়ার প্রায় সব বাড়ির বৌ, গিন্নিরা এসে জড়ো হলেন ফেরিওয়ালের চারদিক ঘিরে। শপিং মলের নাম শুনা যায়নি তখনও। শহরের কেন্দ্রে, শাড়িপট্টি, চুড়িপট্টি যাতীয় কিছু এলাকা ছিলো। বাড়ির বৌ, গিন্নিরা বড় অনুষ্ঠান হলে আয়োজন করে সেখান থেকে কেনা কেটা করতেন না হলে ওই ফেরিওয়ালারাই ছিলো কেনাকাটার নির্ভরযোগ্য চলন্ত দোকান।

গ্রীষ্মের দুপুরে যখন আগুন হাওয়া বইতো চারদিকে, তখন বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলোনা শিশু কিশোরদের। তারপরও অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাছে, গাছে আম কাঁঠাল খুঁজে বেড়ানো হতো যে কোন ভাবেই। একান্ত বের হতে না পারলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রূপকথার গল্পের চরিত্রদের আবিষ্কারে মনযোগ দিতে হতো। শৈশব-কৈশোর এমনকি প্রাক-যৌবনেও বিছানার পাশের দেয়ালে আকাশ খুঁজে পেতাম, পাখি উড়ে যাচ্ছে মনে হতো। আরও শৈশবে রাজপুত্র, রাজকন্যা, রাক্ষস, খক্ষোস দেয়ালে ঘুরে বেড়াতো। এসব কল্পনার সুতো উড়ানো শুধু মাত্র যে গ্রীষ্মের দুপুরেই স্বপ্নালু চোখে খেলা করতো তা কিন্তু নয়। সারা বছরেই এসব চরিত্র হাঁটা চলা করতো বিছানার পাশের দেয়ালে।

গ্রীষ্মের দুপুরে মানুষ কিছুটা হলেও দার্শনিক হয়ে যেতো। আমার মনে আছে শামসুর রাহমান ‘দৈনিক বাংলায়’ ‘মৈনাক’ ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় লিখতেন। তার উপসম্পাদকীয়র গদ্য আমার কাছে কবিতার মতো মনে হতো। শামসুর রাহমানের কোন এক দিনের উপসম্পাদকীয়তে দেয়ালের গায়ে তার কল্পনা বিলাসের কথা লিখেছিলেন। হুবহু উদ্বৃতি দিতে না পারলেও কিছুটা মনে আছে। অনেকটা এরকম- ‘দেয়ালের গায়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, আকাশের কী অপরূপ রঙ, মনটা উদাস হয়ে আছে। দেয়ালে মেঘের সাথে আমার খেলা।’ মধ্য বয়সের শামসুর রাহমানকে দেয়ালের গায়ের প্রকৃতির সাথে মিতালী পাততে দেখেছি আমরা। গ্রীষ্মের দুপুরে আমি জানিনা, আমাদের এ প্রজন্মের শিশু কিশোর এমন কী যূবকদের সেই কল্পনা বিলাসের সময় কিংবা মানসিকতা আছে কিনা। প্রযুক্তি আমাদের মনের আকাশও দখল করে ফেলেছে। ইমাজিনেশন বা কল্পনা না থাকলে সৃজনশীলতা থাকে না। যন্ত্র চর্চা করেও সৃজনশীলতা তৈরি হয় কিনা আমার জানা নেই। বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। নাকি এক সময় মানুষের চিন্তার ভারও নিয়ে নেবে এআই দিয়ে তৈরি বুদ্ধিমান যন্ত্র মানব।

ষাট, সত্তর দশকে জলবায়ু বিরূপ ছিলো না। ঋতুগুলোর চরিত্র আমাদের কাছে পরিস্ফুট ছিলো। আমরা বৈশাখে প্রকৃতির রুক্ষতা, রুদ্ররূপ এবং কোমলতাও দেখছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন আর প্রকৃতির রুক্ষ, রুদ্র, কোমল রূপ স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যমান হয় না।

রবীন্দ্র পূর্ব যুগে আমরা ষড়ঋতুর ব্যবহারিক দিকের বর্ণনা পাই। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা পেয়ে যাই প্রতিটি ঋতুর দর্শন। ঋতু-বৈচিত্র্যের বর্ণনাও অনুপস্থিত ছিলো রবীন্দ্র পূর্ব যুগে। রবীন্দ্রনাথ প্রখর বৈশাখের রুদ্রতা এবং কোমলতার মাঝে গ্লানি দূর করার আভাস পেয়েছেন। এই রুদ্রতা আমাদের সমস্ত মলিনতা দূর করে পবিত্র করে দেয়। মানুষ ও প্রকৃতি নির্মল, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম সঙ্গীতে দারুণ দাহনবেলার রসহীনতার চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে, বৈশাখী ঝড়কে তেমনি জীর্ণতার অবসানে নতুনের আগমনের পূর্ব সংকেতরূপে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র ভাবনায় বৈশাখী ঝড় শুধু বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, হৃদয়ের ভেতরেও বয়ে যায়। গ্রীষ্মের মধ্যে তিনি একদিকে দেখেছেন কঠোর রূপ, বৈরাগীর বেশ, অন্যদিকে তার রস-কোমলতা ও সৃষ্টির স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন। গীতবিতানে গ্রীষ্মের গান ১৬টি, যা রবীন্দ্রনাথ তার ৬০ থেকে ৭২ বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এসে আমাদের গ্রীষ্মকে যেভাবে মহিমান্বিত করে তুললেন, আমরা রবীন্দ্র যুগের পর থেকেই শুধু গ্রীষ্ম নয় সমস্ত ঋতুকে আবার নুতন করে আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম। রবীন্দ্রনাথ যখন বলে ওঠেনÑ

‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে.../ বৎসরের আবর্জনা/দূর হয়ে যাক যাক যাক.../এসো এসো...’, মনে হয় যেনো মানব সন্তান প্রকৃতির কাছে, বৈশাখের মাধ্যমে প্রার্থনা করছে সমস্ত দীনতা-মলিনতা দূর করে পরিশুদ্ধ করে যেন তোলা হয় মানুষের অন্তর। কী অসাধারণ প্রার্থনা। এই হলো রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম দর্শন।

প্রসঙ্গ থেকে মনে হয় অনেক দূরে চলে আসা হলো। আসলে খুব দূরে নয়। ষাট-সত্তর দশক পর্যন্ত জলবায়ুর এতোটা বিপর্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্র যুগের গ্রীষ্মকে আমরা কিছুটা হলেও দেখেছি, তাই রবীন্দ্র দর্শন আমাদেরকে স্মৃতি কাতর করে তোলে। ষাটের দশকে আমাদের এই বাংলাদেশে তেমন নগরায়ণ হয়নি। আমরা গ্রামীণ পটভূমির শহরগুলোতে বসত করতাম। গ্রীষ্ম এলে কালবৈশাখীর ঝড় আসতো, কুঁড়েঘরসহ দুর্বল কাঠামোকে উড়িয়ে নিয়ে যেতো; ফসলের মাঠে ঝড়ের প্রবলতায় কৃষকের ফসলহানি ঘটতো। ঝড়ের সঙ্গী ছিলো বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে প্রকৃতি জেগে ওঠতো। গাছে গাছে কিশলয় দেখা দিতো। প্রকৃতিতে কিছুটা সবুজাভ ভাব দেখা যেতো। গ্রীষ্ম ধ্বংস, সৃষ্টির আবেদন নিয়ে মানুষকে জাগিয়ে রাখতো। রবীন্দ্রনাথের মতো আকাশ ভরা সূর্য তারা এবং ‘বিশ্বভরা প্রাণের’ মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করে মানুষ বিস্মিত হতো।

গ্রীষ্মের দৃশ্যমান সাধারণ রূপকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গ্রীষ্ম এখন তাপপ্রবাহের ঋতুতে পরিণত হয়েছে। গ্রীষ্মের দুপুর আর আমাদের তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করে স্বপ্ন লোকে নিয়ে যায় না। গ্রীষ্মের চিত্র, ধ্বনি, বর্ণ ও গন্ধকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। শুধু গ্রীষ্ম নয় প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে ষড়ঋতুকেও হারাতে বসেছি। রবীন্দ্রনাথের গ্রীষ্ম সঙ্গীতের চিত্রের মতো আমরা মনে হয় বলে উঠছি- ‘প্রখর তপন তাপে/ আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার...।’ আমরা যেনো আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমাদের যতো গ্লানি, আমাদের যতো পাপ, তা দূর করে দেয়ার সমবেত প্রার্থনা করতে পারি। আমরা ফিরে যেতে চাই রুদ্রতা এবং কোমলতার আদি-অকৃত্রিম অনিন্দ্য সুন্দর গ্রীষ্ম দিনে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top