হাসনাইন রিজেন
সুমন স্নাতকোত্তর শেষ করে বাসায় বসে আছেন। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে এখন সে ক্লান্ত। কোথায়ও তার চাকরি হচ্ছে না। পরিবার ও সামাজের কটু কথার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার দিন। একসময় তার কাছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হয়ে উঠে কষ্টকর। তাই সে সমাজ ও পরিবার ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। ঢাকায় এসে কী করবে সে বুজতে পারে না। তার পরিচিত এক ভাইয়ের বাসায় আসে যিনি ফ্রিল্যান্সিং কাজের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবত যুক্ত। সুমনকে তিনি পরামর্শ দেন ছয় মাস কষ্ট করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের একটি কোর্স করার জন্য। সুমন কী করবে? তার ভবিষ্যৎ কী হবে? কী করলে তার ভালো একটা ক্যারিয়ার হবে? কিছুই সে জানে না। তাই ভাইয়ের কথা মতো একটা আইটি প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যায়। ছয় মাস কষ্ট করার পর এখন সুমন নিজে একজন আইটি উদ্যোক্তা। এখন সে ঘরে বসে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, জাপানের মতো দেশের বিখ্যাত ব্রান্ডের সঙ্গে কাজ করছে।
বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে এই শিল্পবিপ্লব ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিল্পবিপ্লব কী? শিল্পবিপ্লব কাকে বলে? শিল্পবিপ্লব এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা উৎপাদন ক্ষেত্রে যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। শিল্পের কাঠামো ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সার্বিক, আমূল ও আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্মিলিত রূপই শিল্পবিপ্লব।
শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষের জীবনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে প্রযুক্তিগত শিল্পবিপ্লব। মানুষ যে কাজ করতে দিনের পর দিন লেগে যায় প্রযুক্তির উন্নতির কারণে সে কাজ কয়েক মিনিটে হয়ে যাবে। ঘরে বসে আপনি পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে কাজ করতে পারবেন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি স্তরে সেই তরুণ যুবকরাই জোগান দিয়েছিল। আজও বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেন তরুণরা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনেও তরুণদের ছিল ইতিবাচক ভূমিকা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবনযাপন করছে এবং সেটা বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ গ্র্যাজুয়েট হয় বেকার, না হয় তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশালসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।
বাংলাদেশের এই বেকার সংখ্যক তরুণকে যদি আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে আইসিটি সেক্টরে দক্ষ করে তুলতে পারি তাহলে তারা হয়ে উঠবে একেক জন দেশের সম্পদ। সুমনের মতো বেকার যুবকরা হয়ে হয়ে উঠবে সমাজের ও পরিবারের গর্ব করার কারণ।
এখনি সময় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে কারিকুলাম প্রণয়ন করা। পাবলিক প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এআই, সাইবার সিকিউরিটি, রোবটিক্স ইত্যাদি সাবজেক্টগুলো অন্তর্ভুক্ত করা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আইসিটি সেক্টরে দক্ষ কর্মীর বিকল্প নেই। বেকার তরুণদের চিন্তাচেতনা আর বুদ্ধি যদি কাজে লাগাতে পারে রাষ্ট্র, তবে বাংলাদেশ পরিণত হবে সোনার বাংলায়। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণ সমাজের বিকল্প নেই।
[লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম]
হাসনাইন রিজেন
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
সুমন স্নাতকোত্তর শেষ করে বাসায় বসে আছেন। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে এখন সে ক্লান্ত। কোথায়ও তার চাকরি হচ্ছে না। পরিবার ও সামাজের কটু কথার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার দিন। একসময় তার কাছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হয়ে উঠে কষ্টকর। তাই সে সমাজ ও পরিবার ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। ঢাকায় এসে কী করবে সে বুজতে পারে না। তার পরিচিত এক ভাইয়ের বাসায় আসে যিনি ফ্রিল্যান্সিং কাজের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবত যুক্ত। সুমনকে তিনি পরামর্শ দেন ছয় মাস কষ্ট করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের একটি কোর্স করার জন্য। সুমন কী করবে? তার ভবিষ্যৎ কী হবে? কী করলে তার ভালো একটা ক্যারিয়ার হবে? কিছুই সে জানে না। তাই ভাইয়ের কথা মতো একটা আইটি প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যায়। ছয় মাস কষ্ট করার পর এখন সুমন নিজে একজন আইটি উদ্যোক্তা। এখন সে ঘরে বসে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, জাপানের মতো দেশের বিখ্যাত ব্রান্ডের সঙ্গে কাজ করছে।
বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে এই শিল্পবিপ্লব ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিল্পবিপ্লব কী? শিল্পবিপ্লব কাকে বলে? শিল্পবিপ্লব এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যা উৎপাদন ক্ষেত্রে যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। শিল্পের কাঠামো ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সার্বিক, আমূল ও আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্মিলিত রূপই শিল্পবিপ্লব।
শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষের জীবনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে প্রযুক্তিগত শিল্পবিপ্লব। মানুষ যে কাজ করতে দিনের পর দিন লেগে যায় প্রযুক্তির উন্নতির কারণে সে কাজ কয়েক মিনিটে হয়ে যাবে। ঘরে বসে আপনি পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে কাজ করতে পারবেন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিহাস সৃষ্টি থেকে প্রতিটি স্তরে সেই তরুণ যুবকরাই জোগান দিয়েছিল। আজও বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেন তরুণরা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনেও তরুণদের ছিল ইতিবাচক ভূমিকা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবনযাপন করছে এবং সেটা বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ গ্র্যাজুয়েট হয় বেকার, না হয় তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশালসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।
বাংলাদেশের এই বেকার সংখ্যক তরুণকে যদি আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে আইসিটি সেক্টরে দক্ষ করে তুলতে পারি তাহলে তারা হয়ে উঠবে একেক জন দেশের সম্পদ। সুমনের মতো বেকার যুবকরা হয়ে হয়ে উঠবে সমাজের ও পরিবারের গর্ব করার কারণ।
এখনি সময় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে কারিকুলাম প্রণয়ন করা। পাবলিক প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এআই, সাইবার সিকিউরিটি, রোবটিক্স ইত্যাদি সাবজেক্টগুলো অন্তর্ভুক্ত করা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আইসিটি সেক্টরে দক্ষ কর্মীর বিকল্প নেই। বেকার তরুণদের চিন্তাচেতনা আর বুদ্ধি যদি কাজে লাগাতে পারে রাষ্ট্র, তবে বাংলাদেশ পরিণত হবে সোনার বাংলায়। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণ সমাজের বিকল্প নেই।
[লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম]