মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। কিশোর গ্যাং আসলে কারা? কিশোর গ্যাং হচ্ছে- ১৮ বছরের নিচে যেসব কিশোর দলবদ্ধভাবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা চালায়। দেখা যায়, ১৫ থেকে ১৬ বছরের কিশোররাই কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে।
সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। একই কমিউনিটির ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে, তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যকে বঞ্চিতদের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা অনুভব করে। আবার কমিউনিটিতে যখন অস্ত্র ও বিশেষ করে মাদকের দৌরাত্ম্য থাকে তখন গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে এবং বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে অথবা ওই গ্যাংয়ের বিদ্রোহী, দলছুট বা বহিষ্কৃত সদস্যরা আরেকটি গ্যাং তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ কমিউনিটিতে যখন গ্যাংয়ে যোগদান করার অভ্যাস অথবা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন একজন অপরকে বা সিনিয়রকে দেখে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। কখনো ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে অনুকরণ প্রবণশীল কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। তখন সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায় কিশোররা। তাই পরিবারের করণীয়টা এখানে বড় হয়ে দাঁড়ায়।
পারিবারিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই এ সমস্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক-নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলেও কিশোররা এ পথে আসতে উৎসাহিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে অথবা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মাঝে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। যেমন- দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে গ্যাং গড়ে তোলার প্রবণতা থাকে। ক্রমাগত শিক্ষকের বঞ্চনা, খারাপ ফলাফল, সহপাঠী দ্বারা বিদ্রƒপের শিকার থেকে হতাশা তৈরি হতে পারে। হতাশা থেকে পরে গ্যাংয়ে যোগদানের প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগ্রত হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা ইত্যাদি তৈরি হয়, যা থেকে গ্যাংয়ের উদ্ভব হতে পারে। বন্ধু-বান্ধবের যদি অপরাধপ্রবণতা থাকে বা তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে, মাদক সেবনের প্রবণতা থাকে বা মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এভাবে জড়িত হওয়ার কারণের মধ্যে আরও রয়েছে- ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা, দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব, হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা, অনুকরণপ্রবণতা, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি বা যৌন আসক্তি হওয়ার ক্ষেত্র ও সুযোগ তৈরি হওয়া।
কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরূপে দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং এখনো বেড়েই চলেছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার লক্ষ্যে এখনই এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে এটি খুব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
জীবনের অতি মূল্যবান অংশের নাম তারুণ্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার, উদ্যম ও গঠনের এটা এক সতেজ অধ্যায়। আর তাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ-সমাজ। এরাই তো নতুন সূর্য- সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার। এই সূর্য ক্ষয় ও অবক্ষয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়া মানে সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। আর প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় কিশোর অপরাধীদের খবর। এদের সুপথে আনতে হলে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪
কিশোর গ্যাং সমাজের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। কিশোর গ্যাং আসলে কারা? কিশোর গ্যাং হচ্ছে- ১৮ বছরের নিচে যেসব কিশোর দলবদ্ধভাবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা চালায়। দেখা যায়, ১৫ থেকে ১৬ বছরের কিশোররাই কিশোর গ্যাংয়ে পরিণত হচ্ছে।
সমাজব্যবস্থা, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাহচার্য, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রের নানাবিধ উপকরণ গ্যাং কালচার তৈরির উপাদান হিসাবে কাজ করে। একই কমিউনিটির ভেতর যখন দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের বসবাস থাকে, তখন উচ্চবিত্তের জীবনযাত্রা দেখে দরিদ্র শ্রেণির সন্তানরা নিজেদের ভাগ্যকে বঞ্চিতদের ভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করে হতাশা অনুভব করে। আবার কমিউনিটিতে যখন অস্ত্র ও বিশেষ করে মাদকের দৌরাত্ম্য থাকে তখন গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকে এবং বিপরীতে আরেকটি গ্যাং তৈরি হতে পারে অথবা ওই গ্যাংয়ের বিদ্রোহী, দলছুট বা বহিষ্কৃত সদস্যরা আরেকটি গ্যাং তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ কমিউনিটিতে যখন গ্যাংয়ে যোগদান করার অভ্যাস অথবা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন একজন অপরকে বা সিনিয়রকে দেখে গ্যাং সদস্য হতে উৎসাহী হয়। কখনো ভিনদেশি কালচারের অনুপ্রবেশে অনুকরণ প্রবণশীল কিশোররা সহিংসতা সম্পর্কে জানতে পারে। তখন সহিংসতায় আকৃষ্ট হয়ে ওই কালচার রপ্ত করতে চায় কিশোররা। তাই পরিবারের করণীয়টা এখানে বড় হয়ে দাঁড়ায়।
পারিবারিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই এ সমস্যার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। পারিবারিক বিশৃঙ্খলা অথবা ডিভোর্সের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবারে সন্তানদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়। নেশাগ্রস্ত পরিবার যেখানে মাদক-নেশাজাতীয় দ্রব্যের নিয়মিত আসর বসে, সেখানে কম বয়সে অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কেউ গ্যাং সদস্য থাকলেও কিশোররা এ পথে আসতে উৎসাহিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্য বা পিতা-মাতা রোল মডেল হতে ব্যর্থ হলে অথবা পিতা-মাতার কর্ম অদক্ষতা ও বেকারত্বের ফলে আর্থিক উপার্জনের জন্য সন্তানদের মাঝে গ্যাং সদস্য হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
আবার কখনো কখনো কর্মজীবী বা ব্যবসায়ী পিতা-মাতার পক্ষে সন্তানকে সময় দেওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গ্যাং তৈরির মধ্য দিয়ে সন্তান একাকিত্ব ও হতাশা দূর করার চেষ্টা করে। একাধিক বিবাহ এবং পারিবারিক অশান্তিও গ্যাং তৈরির কারণ হতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থাও এ কালচার গড়ে ওঠার পেছনে কিছুটা দায়ী। যেমন- দুর্বল ছাত্রদের মধ্যে গ্যাং গড়ে তোলার প্রবণতা থাকে। ক্রমাগত শিক্ষকের বঞ্চনা, খারাপ ফলাফল, সহপাঠী দ্বারা বিদ্রƒপের শিকার থেকে হতাশা তৈরি হতে পারে। হতাশা থেকে পরে গ্যাংয়ে যোগদানের প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া কোনো কারণে ব্যাহত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা জাগ্রত হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদককে কেন্দ্র করে আড্ডা ইত্যাদি তৈরি হয়, যা থেকে গ্যাংয়ের উদ্ভব হতে পারে। বন্ধু-বান্ধবের যদি অপরাধপ্রবণতা থাকে বা তারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে, মাদক সেবনের প্রবণতা থাকে বা মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এভাবে জড়িত হওয়ার কারণের মধ্যে আরও রয়েছে- ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধ জগতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা, দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিত্ব, হিরোইজম দেখানোর প্রবণতা, অনুকরণপ্রবণতা, অল্প বয়সে যৌন আসক্তি বা যৌন আসক্তি হওয়ার ক্ষেত্র ও সুযোগ তৈরি হওয়া।
কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে দিন যত যাচ্ছে তাদের অপরাধগুলো ক্রমেই হিংস্র, নৃশংস ও বিভীষিকাপূর্ণরূপে দেখা দিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো হিংস্র ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং এখনো বেড়েই চলেছে। সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় নৃশংসভাবে খুন করা হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার লক্ষ্যে এখনই এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। না হলে ভবিষ্যতে এটি খুব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
জীবনের অতি মূল্যবান অংশের নাম তারুণ্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার, উদ্যম ও গঠনের এটা এক সতেজ অধ্যায়। আর তাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ-সমাজ। এরাই তো নতুন সূর্য- সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার। এই সূর্য ক্ষয় ও অবক্ষয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়া মানে সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। আর প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় কিশোর অপরাধীদের খবর। এদের সুপথে আনতে হলে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]