দেবাহুতি চক্রবর্তী
নদীর সাথে জীবজগতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠে বিভিন্ন নদ-নদী ঘিরে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন যতটুকু পাওয়া যায় তা নদীকে কেন্দ্র করেই। যে কোনো সভ্যতার সমাজমনস্তত্ত্বে নদীর প্রভাব অপরিসীম। বৈদিক স্ত্রোতসমূহে বহুভাবে নদী বন্দনা রয়েছে। মাটি এবং জল ছাড়া জীবন নেই। নিত্যদিনের স্নানমন্ত্রে দেখা যায়Ñ ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব / গোদাবরী সরস্বতী / নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেস্মিন/ সন্নিধিং কুরুম ... বা ... হে জল! তুমি সুখের আধার। তুমি আমাদের অন্ন সঞ্চার করে দাও। হে জল! তুমি স্নেহমহী জননীর মতো, তোমার রস অতি মঙ্গলময়।’ সেই জলের ভাগী করে সবাই পাপ, হিংসা, মিথ্যা থেকে মুক্তির প্রার্থনা দেখা যায়।
নদী প্রাকৃতিক নিয়মেই মাটিতে রসের জোগান দেয়। সেই জোগানেই বৃক্ষাদি বেড়ে ওঠে। ফসলাদি জন্মে। উন্নত নগরায়নের প্রয়োজনে গ্রামাঞ্চলে শস্য উৎপাদনের তাগিদ বাড়ে। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা বিচার বিশ্লেষণেও দেখা যায়, নগর যত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, প্রাচীনেরাও নদী নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করা হয়। নগরের পাশে আড়া আড়ি বাঁধ বা ডাবরবাঁধ দেওয়া হয়েছে। অধিকতর শস্য উৎপাদন মাধ্যমে নগরোন্নয়ন ঠিক রাখতে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের এই উদ্ভাবন ও নির্মাণ সত্যিই বিস্ময়কর। ধারণা করা হয়, সরস্বতী নদী উপত্যকা মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে সভ্যতা রক্ষা বা পুননির্মাণ করতে কতক জনগোষ্ঠী উদ্যোগী হয়। অধিকাংশ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাথে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রাণস্পন্দন শুকিয়ে যায়। এই বাঁধ নির্মাণ আর ভাঙার প্রক্রিয়ার মাঝে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক লড়াইয়ের কাহিনি ভারতীয় পুরাণেও খুঁজে পাওয়া যায়। অসুর নেতা বৃত্র বাঁধ দিয়ে নিজ এলাকা শস্যশ্যামল করতে ও দেবলোক জনাকীর্ণ করতে চায়। তেমনি ইন্দ্র বাঁধ ভেঙে অসুরদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতা বিনষ্ট করে পশু পালন ভিত্তিক জীবন যাত্রা বহাল করতে চায়।
নদী শুকিয়ে যাওয়া, নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে সাথে বাস্তুতন্ত্রর পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক হতে পারে। যেমন ২৫০০ বছর আগে ভূমিকম্পে গঙ্গার ১৮০ কি মি গতিপথ পরিবর্তিত হয়। পার ভাঙা ও নদীর ধর্ম। নদীর পার উছলায় মানে জীবজগত ও সাথে সাথে উছলায়। আপন বেগে পাগল পারা এই নদীই মেশে সমুদ্রে। সব নদী সমুদ্রে মেশে না। প্রাকৃতিক পরিবর্তন ছাড়াও নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। ইংরেজিতে যাকে বলে এভালশনশ মানে বলপূর্বক বিচ্ছিন্নকরণ। নগরায়নের প্রয়োজনে বলপূর্বক নদীর চরিত্রও পরিবর্তন করা হয়। আর অদূরদর্শীতার কারণে তার ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীসংখ্যা ৫৪টি। তিস্তা তার অন্যতম। তিস্তা মানে ত্রি স্রোত বা তিন প্রবাহ। পুরাণে তিস্তার উৎস নিয়ে গল্পগাথা রয়েছে। যেমন দেবী পার্বতীর স্তন থেকে তিস্তা উৎপন্ন। বাস্তবে ভারতের সিকিম রাজ্যের চুং থাং থেকে হিমবাহ গলিত জল আর চীন সীমান্তের হ্রদের জল মিলিত হয়ে হিমালয় পর্বতমালার ৭২০০ মিটার উচ্চতা তিস্তার উৎস স্থল। এই নদী দার্জিলিংয়ের শিভক গোলা থেকে গিরিসংকট মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভূখ-ে এসেছে। কত যুগের কত শিলাখ- বুকে নিয়ে বহমান এই নদী আপাত নিরীহ দেখালেও অন্তর্নিহিত গ্রোত খুবই শক্তিশালী। এই খরগ্রোতা নদীতে ১৯১৫ সনে জরিপ কাজে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের নৌকা ডুবে যায়। পাহাড় থেকে সমতলে ৪৫৪ কিমি দৈর্ঘ্যরে এই নদী সিকিমে ১৫১ কিমি, পশ্চিমবঙ্গে ১৪২ কিমি, বাংলাদেশে ১২১ কিমি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ৩৫টি উপজেলার ৫২৪২টি গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৭৮৭ সালে গতিপথ পরিবর্তন করে রংপুর অতিক্রম করে চিলমারীর কাছে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার এই তিস্তা নদী। তিস্তার জলবন্টনে ও নদী ব্যবস্থাপনায় যার প্রভাব অস্বীকার করার নয়। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ ও নৌ-চলাচল ব্যবহার সংক্রান্ত আইনে বলা হয়, কোনো দেশ একক বা যৌথভাবে এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে না যাতে অন্য দেশ বা জাতির নদীপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ-ভারত এই আইনে স্বাক্ষর করেনি। আঞ্চলিক ভাবে বা দ্বিপাক্ষিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল নিয়মিত বিভিন্ন আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালে দ্বিপাক্ষিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে, তিস্তার জল বাংলাদেশ ৩৬%, ভারত ৩৯% মধ্যে বন্টন হবে। ২৫% সংরক্ষিত থাকবে। নদীকে বাঁচিয়ে রেখে তিস্তার জল বণ্টন হওয়ার কথা। নদীর উজানে ভারতীয় অংশে একাধিক বাঁধ-ব্যারেজ দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত হয়ে চলেছে। বিভিন্ন সময় তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়। ২০১১ সালে মনমোহন সিং সরকারের সাথে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে একটা ফ্রেমওয়ার্ক অনেক দূর অবধি এগোয়। তিস্তার উজানে ভারতীয় অংশে বড় বড় বাঁধ বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহের অন্যতম বাঁধা। ২০২০ সালের জুলাই মাসে তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প প্রাথমিক প্রস্তাব পানি মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পর্যাপ্ত জলের অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় ৩৯ হাজার হেক্টর জমি সেচের বাইরে রয়ে গেছে। উত্তরের দুই কোটি মানুষের অবলম্বন এই প্রমত্তা তিস্তা। বর্ষা মৌসুমে জল প্রবাহ ২ লাখ কিউসিক, শুকনো মৌসুমে সেখানে ৫০০ থেকে ২০০০ কিউসিক। জনজীবন-জীববৈচিত্র্য-পরিবেশ-প্রতিবেশ সবই হুমকির মুখে রয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক কবিতায় দেখা যায় একজন মানুষ পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। খেয়া পারাপারের মাঝিদের কাজ নেই। তারাও পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। হতাশা জর্জরিত মানুষের বিড়ির ধোঁয়া আকাশের কালপুরুষের দিক কু-লী পাকিয়ে উড়ছে।
‘এটা একটা দুঃখের দৃশ্য / এই একজন বিষন্ন মানুষ / এখানে রয়েছে নদী বিচ্ছেদের কাহিনী / এরসঙ্গে আমার বা তোমার দুঃখের/ কোনো তুলনাই হয় না।’ সত্যিই হয় না। নদীর খরস্রোতা জলপ্রবাহ শত শত গ্রামের ভাগ্য নির্ধারণ করে। মানুষের বুক ভেঙে যাওয়ার শত শত গল্প জমা হয় যা মানুষ নিজেও জানে না। নদীর জল বর্ষা মৌসুমে সুইচ গেট দিয়ে ছাড়া হলে নতুন রকম দিশেহারা হতে হয় তীরবর্তী জনগোষ্ঠীর। ডুবতে থাকে ঘর বাড়ি, গাছপালা, পশুপাখির বিচরণ ভূমি।
বাংলাদেশে ধু ধু বালুময় প্রান্তর বিভিন্ন সময় সেচ প্রকল্পর আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ১৯৯০ সালে প্রথম দফার কাজ শেষ হবার পর ৮৪৩৭৮ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য জল পাওয়ার কথা ছিল। তা প্রথমে সফল না হলেও পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু সফলতা দেখা যায়। এই প্রকল্প সংস্কারে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় লাগানো লাখ লাখ গাছ কাটা হয়। যা পরিবেশের জন্য হুমকি বটে। শুধু বাংলাদেশের নয়, তিস্তা নিয়ে ক্ষোভ ভারববর্ষের মানুষেরও রয়েছে।
গত ১৬-৬-২৪ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিস্তার নদী খাত ক্রমশ উঁচু হয়ে অনবরত বালি, পাথর, নুড়ি নেমে আসছে। নানাভাবে বিপুল পলি ও অন্যান্য সামগ্রী জমা হয়েও জল ধারণের ক্ষমতা কমছে। মাটির জলধারণ ক্ষমতা ধরে রাখার মতো গাছের সংখ্যাও কমছে। বৃষ্টি বা অন্য কোনো ভাবে জলস্ফীতি হলে রাস্তা, সেতু,জঙ্গল,পাহাড় ক্রমেই চলে যাচ্ছে তিস্তা গর্ভে। এদিকে পাহাড় থেকে সমতল তিস্তা খাতের বিপজ্জনক এলাকা দখল হয়ে জনবসতি হওয়ায় জল বাড়লেই ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। তিস্তার দুপাশে অনবরত পাহাড় কাটা চলছে। বাঁধের কাজের জন্য মাটিকাটা-পাথর ভাঙা চলছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিম অবধি একের পর এক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, জলাধারে জল আটকের জেরে নদীর স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হচ্ছে। পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয়েছেÑ ‘নির্বিচার নির্মাণেই ভয়াল তিস্তা।’
সেই ভয়াবহতা সম্পর্কে পরিবেশবিদদের মতেÑ ‘আমরাই তিস্তার উপর গিয়ে পড়েছি। অবৈধ নির্মাণ, যথেচ্ছ জলাধার দিয়ে তিস্তাকে বাঁধতে চাইছি। সেই বাঁধন ছিঁড়ে তিস্তা বের হবে।’ এখনো সাবধান না হলে তার ক্ষতি অকল্পনীয় হয়ে দাঁড়াবে। এটাও মনে রাখা দরকার যে তিস্তা নদী এলাকায় ভূমিকম্পগত ভাবে সক্রিয় জোন রয়েছে। তিস্তা নদীতে ক্রমাগত টেকনোলজিকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা চলা সত্বেও ভারতীয় অংশের বহু এলাকায় জলপ্রবাহ শুকিয়ে চর সৃষ্টি হচ্ছে। তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবনে চর-ডোবা-ভাসা এই শব্দগুলো বারবার বদল হয়ে সৃষ্টি করছে- তিস্তা পুরাণ। অসহায় মানুষের আর্তনাদÑ‘কখন কে কোন দেশের মানুষ হয়ে যায় তার কি কিছু ঠিক আছে?’
ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদের সাথে সাথে খানাপুরী, বুজারত, সেটলমেন্ট ইত্যাদিতে হয়রানি বাড়ছে। প্রকল্পের পর প্রকল্পে দেশের অর্থনীতি বদলে যাবে এই সেøাগানের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। শরীর দিয়ে পাখিরা জেনে নিচ্ছে তারা আশ্রয়হীন।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাওÑ এই সেøাগান নিয়ে দুই দেশেই বিভিন্নভাবে আন্দোলন চলছে। আড়াল থেকে আওয়াজ কখনো কখনো সংহত হচ্ছে। একটার পর একটা ধ্বনির প্রবাহ ঠিক নদীস্রোতের মতো। নদীগ্রোতের মতই নেপথ্যের সেই প্রবল কোলাহল নিজেদের জোরেই কখনো কখনো অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে। ভারতে তেহেরি, নর্মদা, মহানদীতে বাঁধের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী রা আর শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন দীর্ঘদিনের। পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের রাউজান আর ফটিকছড়ির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা হালদা নদীর সর্পিল বাঁক সোজা করার জন্য সেচ কর্তাদের বিপরীতে যেয়ে খনন কাজে অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষকে ঠেকিয়ে রাখতে না পেরে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। ১০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। সে দিনটা ছিল ১৯৪৮ এর ২৯ সেপ্টেম্বর। নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নদী শাসনের সামাজিক উদ্যোগের এক উজ্বল দৃষ্টান্ত।
বাস্তবে দেখা যায়, নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে গণস্বার্থের চেয়ে বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থ নানাভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সুখ সাচ্ছন্দ্য অবলীলায় বন্ধক রাখে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনায় তিস্তা প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে উঠে আসে। তিস্তার জলপ্রবাহ কমে আসার কারণ দেখিয়ে ২০১১র জলবন্টনের হিস্যা থেকে ভারত সম্ভবত পিছিয়ে আসতে আগ্রহী। জলপাইগুড়ির গজলডোবায় তৈরি বাঁধের কারণে বাংলাদেশে জলপ্রবাহ আরও কমে এসেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিরোধীতা জলবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে। পশ্চিমবঙ্গর অভিযোগ তারাই পর্যাপ্ত জল পাচ্ছে না। অন্যদিকে সিকিম বাঁধগুলোর সুবাদে বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদক রাজ্যে পৌঁছেছে। সেখান থেকে সরতে নারাজ। এ অবস্থায় তিস্তার দুই নয়নের অশ্রুই আমরা গড়িয়ে পড়তে দেখছি। আমাদের আশার কথা বাংলাদেশ নিজ ভূখ-ে তিস্তা ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
সর্বশেষ দুই দেশের সরকার প্রধানদের আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারত অর্থায়ন সহ সহযোগিতায় আগ্রহ দেখিয়েছে। তিস্তা বৃত্তান্তÑ নিয়ে কথা চালাচালি সংক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক। যুগ যুগ ধরে তিস্তাপারের মানুষের দহন যন্ত্রণার অবসান হোক।
[লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]
দেবাহুতি চক্রবর্তী
মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০২৪
নদীর সাথে জীবজগতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠে বিভিন্ন নদ-নদী ঘিরে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন যতটুকু পাওয়া যায় তা নদীকে কেন্দ্র করেই। যে কোনো সভ্যতার সমাজমনস্তত্ত্বে নদীর প্রভাব অপরিসীম। বৈদিক স্ত্রোতসমূহে বহুভাবে নদী বন্দনা রয়েছে। মাটি এবং জল ছাড়া জীবন নেই। নিত্যদিনের স্নানমন্ত্রে দেখা যায়Ñ ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব / গোদাবরী সরস্বতী / নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেস্মিন/ সন্নিধিং কুরুম ... বা ... হে জল! তুমি সুখের আধার। তুমি আমাদের অন্ন সঞ্চার করে দাও। হে জল! তুমি স্নেহমহী জননীর মতো, তোমার রস অতি মঙ্গলময়।’ সেই জলের ভাগী করে সবাই পাপ, হিংসা, মিথ্যা থেকে মুক্তির প্রার্থনা দেখা যায়।
নদী প্রাকৃতিক নিয়মেই মাটিতে রসের জোগান দেয়। সেই জোগানেই বৃক্ষাদি বেড়ে ওঠে। ফসলাদি জন্মে। উন্নত নগরায়নের প্রয়োজনে গ্রামাঞ্চলে শস্য উৎপাদনের তাগিদ বাড়ে। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা বিচার বিশ্লেষণেও দেখা যায়, নগর যত সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, প্রাচীনেরাও নদী নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করা হয়। নগরের পাশে আড়া আড়ি বাঁধ বা ডাবরবাঁধ দেওয়া হয়েছে। অধিকতর শস্য উৎপাদন মাধ্যমে নগরোন্নয়ন ঠিক রাখতে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের এই উদ্ভাবন ও নির্মাণ সত্যিই বিস্ময়কর। ধারণা করা হয়, সরস্বতী নদী উপত্যকা মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে সভ্যতা রক্ষা বা পুননির্মাণ করতে কতক জনগোষ্ঠী উদ্যোগী হয়। অধিকাংশ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাথে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রাণস্পন্দন শুকিয়ে যায়। এই বাঁধ নির্মাণ আর ভাঙার প্রক্রিয়ার মাঝে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক লড়াইয়ের কাহিনি ভারতীয় পুরাণেও খুঁজে পাওয়া যায়। অসুর নেতা বৃত্র বাঁধ দিয়ে নিজ এলাকা শস্যশ্যামল করতে ও দেবলোক জনাকীর্ণ করতে চায়। তেমনি ইন্দ্র বাঁধ ভেঙে অসুরদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতা বিনষ্ট করে পশু পালন ভিত্তিক জীবন যাত্রা বহাল করতে চায়।
নদী শুকিয়ে যাওয়া, নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে সাথে বাস্তুতন্ত্রর পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক হতে পারে। যেমন ২৫০০ বছর আগে ভূমিকম্পে গঙ্গার ১৮০ কি মি গতিপথ পরিবর্তিত হয়। পার ভাঙা ও নদীর ধর্ম। নদীর পার উছলায় মানে জীবজগত ও সাথে সাথে উছলায়। আপন বেগে পাগল পারা এই নদীই মেশে সমুদ্রে। সব নদী সমুদ্রে মেশে না। প্রাকৃতিক পরিবর্তন ছাড়াও নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। ইংরেজিতে যাকে বলে এভালশনশ মানে বলপূর্বক বিচ্ছিন্নকরণ। নগরায়নের প্রয়োজনে বলপূর্বক নদীর চরিত্রও পরিবর্তন করা হয়। আর অদূরদর্শীতার কারণে তার ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীসংখ্যা ৫৪টি। তিস্তা তার অন্যতম। তিস্তা মানে ত্রি স্রোত বা তিন প্রবাহ। পুরাণে তিস্তার উৎস নিয়ে গল্পগাথা রয়েছে। যেমন দেবী পার্বতীর স্তন থেকে তিস্তা উৎপন্ন। বাস্তবে ভারতের সিকিম রাজ্যের চুং থাং থেকে হিমবাহ গলিত জল আর চীন সীমান্তের হ্রদের জল মিলিত হয়ে হিমালয় পর্বতমালার ৭২০০ মিটার উচ্চতা তিস্তার উৎস স্থল। এই নদী দার্জিলিংয়ের শিভক গোলা থেকে গিরিসংকট মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভূখ-ে এসেছে। কত যুগের কত শিলাখ- বুকে নিয়ে বহমান এই নদী আপাত নিরীহ দেখালেও অন্তর্নিহিত গ্রোত খুবই শক্তিশালী। এই খরগ্রোতা নদীতে ১৯১৫ সনে জরিপ কাজে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের নৌকা ডুবে যায়। পাহাড় থেকে সমতলে ৪৫৪ কিমি দৈর্ঘ্যরে এই নদী সিকিমে ১৫১ কিমি, পশ্চিমবঙ্গে ১৪২ কিমি, বাংলাদেশে ১২১ কিমি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ৩৫টি উপজেলার ৫২৪২টি গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৭৮৭ সালে গতিপথ পরিবর্তন করে রংপুর অতিক্রম করে চিলমারীর কাছে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার এই তিস্তা নদী। তিস্তার জলবন্টনে ও নদী ব্যবস্থাপনায় যার প্রভাব অস্বীকার করার নয়। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ ও নৌ-চলাচল ব্যবহার সংক্রান্ত আইনে বলা হয়, কোনো দেশ একক বা যৌথভাবে এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে না যাতে অন্য দেশ বা জাতির নদীপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ-ভারত এই আইনে স্বাক্ষর করেনি। আঞ্চলিক ভাবে বা দ্বিপাক্ষিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল নিয়মিত বিভিন্ন আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালে দ্বিপাক্ষিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে, তিস্তার জল বাংলাদেশ ৩৬%, ভারত ৩৯% মধ্যে বন্টন হবে। ২৫% সংরক্ষিত থাকবে। নদীকে বাঁচিয়ে রেখে তিস্তার জল বণ্টন হওয়ার কথা। নদীর উজানে ভারতীয় অংশে একাধিক বাঁধ-ব্যারেজ দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত হয়ে চলেছে। বিভিন্ন সময় তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়। ২০১১ সালে মনমোহন সিং সরকারের সাথে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে একটা ফ্রেমওয়ার্ক অনেক দূর অবধি এগোয়। তিস্তার উজানে ভারতীয় অংশে বড় বড় বাঁধ বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহের অন্যতম বাঁধা। ২০২০ সালের জুলাই মাসে তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প প্রাথমিক প্রস্তাব পানি মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পর্যাপ্ত জলের অভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় ৩৯ হাজার হেক্টর জমি সেচের বাইরে রয়ে গেছে। উত্তরের দুই কোটি মানুষের অবলম্বন এই প্রমত্তা তিস্তা। বর্ষা মৌসুমে জল প্রবাহ ২ লাখ কিউসিক, শুকনো মৌসুমে সেখানে ৫০০ থেকে ২০০০ কিউসিক। জনজীবন-জীববৈচিত্র্য-পরিবেশ-প্রতিবেশ সবই হুমকির মুখে রয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক কবিতায় দেখা যায় একজন মানুষ পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। খেয়া পারাপারের মাঝিদের কাজ নেই। তারাও পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। হতাশা জর্জরিত মানুষের বিড়ির ধোঁয়া আকাশের কালপুরুষের দিক কু-লী পাকিয়ে উড়ছে।
‘এটা একটা দুঃখের দৃশ্য / এই একজন বিষন্ন মানুষ / এখানে রয়েছে নদী বিচ্ছেদের কাহিনী / এরসঙ্গে আমার বা তোমার দুঃখের/ কোনো তুলনাই হয় না।’ সত্যিই হয় না। নদীর খরস্রোতা জলপ্রবাহ শত শত গ্রামের ভাগ্য নির্ধারণ করে। মানুষের বুক ভেঙে যাওয়ার শত শত গল্প জমা হয় যা মানুষ নিজেও জানে না। নদীর জল বর্ষা মৌসুমে সুইচ গেট দিয়ে ছাড়া হলে নতুন রকম দিশেহারা হতে হয় তীরবর্তী জনগোষ্ঠীর। ডুবতে থাকে ঘর বাড়ি, গাছপালা, পশুপাখির বিচরণ ভূমি।
বাংলাদেশে ধু ধু বালুময় প্রান্তর বিভিন্ন সময় সেচ প্রকল্পর আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ১৯৯০ সালে প্রথম দফার কাজ শেষ হবার পর ৮৪৩৭৮ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য জল পাওয়ার কথা ছিল। তা প্রথমে সফল না হলেও পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু সফলতা দেখা যায়। এই প্রকল্প সংস্কারে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় লাগানো লাখ লাখ গাছ কাটা হয়। যা পরিবেশের জন্য হুমকি বটে। শুধু বাংলাদেশের নয়, তিস্তা নিয়ে ক্ষোভ ভারববর্ষের মানুষেরও রয়েছে।
গত ১৬-৬-২৪ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিস্তার নদী খাত ক্রমশ উঁচু হয়ে অনবরত বালি, পাথর, নুড়ি নেমে আসছে। নানাভাবে বিপুল পলি ও অন্যান্য সামগ্রী জমা হয়েও জল ধারণের ক্ষমতা কমছে। মাটির জলধারণ ক্ষমতা ধরে রাখার মতো গাছের সংখ্যাও কমছে। বৃষ্টি বা অন্য কোনো ভাবে জলস্ফীতি হলে রাস্তা, সেতু,জঙ্গল,পাহাড় ক্রমেই চলে যাচ্ছে তিস্তা গর্ভে। এদিকে পাহাড় থেকে সমতল তিস্তা খাতের বিপজ্জনক এলাকা দখল হয়ে জনবসতি হওয়ায় জল বাড়লেই ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। তিস্তার দুপাশে অনবরত পাহাড় কাটা চলছে। বাঁধের কাজের জন্য মাটিকাটা-পাথর ভাঙা চলছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিকিম অবধি একের পর এক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, জলাধারে জল আটকের জেরে নদীর স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হচ্ছে। পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয়েছেÑ ‘নির্বিচার নির্মাণেই ভয়াল তিস্তা।’
সেই ভয়াবহতা সম্পর্কে পরিবেশবিদদের মতেÑ ‘আমরাই তিস্তার উপর গিয়ে পড়েছি। অবৈধ নির্মাণ, যথেচ্ছ জলাধার দিয়ে তিস্তাকে বাঁধতে চাইছি। সেই বাঁধন ছিঁড়ে তিস্তা বের হবে।’ এখনো সাবধান না হলে তার ক্ষতি অকল্পনীয় হয়ে দাঁড়াবে। এটাও মনে রাখা দরকার যে তিস্তা নদী এলাকায় ভূমিকম্পগত ভাবে সক্রিয় জোন রয়েছে। তিস্তা নদীতে ক্রমাগত টেকনোলজিকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা চলা সত্বেও ভারতীয় অংশের বহু এলাকায় জলপ্রবাহ শুকিয়ে চর সৃষ্টি হচ্ছে। তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবনে চর-ডোবা-ভাসা এই শব্দগুলো বারবার বদল হয়ে সৃষ্টি করছে- তিস্তা পুরাণ। অসহায় মানুষের আর্তনাদÑ‘কখন কে কোন দেশের মানুষ হয়ে যায় তার কি কিছু ঠিক আছে?’
ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদের সাথে সাথে খানাপুরী, বুজারত, সেটলমেন্ট ইত্যাদিতে হয়রানি বাড়ছে। প্রকল্পের পর প্রকল্পে দেশের অর্থনীতি বদলে যাবে এই সেøাগানের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। শরীর দিয়ে পাখিরা জেনে নিচ্ছে তারা আশ্রয়হীন।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাওÑ এই সেøাগান নিয়ে দুই দেশেই বিভিন্নভাবে আন্দোলন চলছে। আড়াল থেকে আওয়াজ কখনো কখনো সংহত হচ্ছে। একটার পর একটা ধ্বনির প্রবাহ ঠিক নদীস্রোতের মতো। নদীগ্রোতের মতই নেপথ্যের সেই প্রবল কোলাহল নিজেদের জোরেই কখনো কখনো অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে। ভারতে তেহেরি, নর্মদা, মহানদীতে বাঁধের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী রা আর শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন দীর্ঘদিনের। পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের রাউজান আর ফটিকছড়ির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা হালদা নদীর সর্পিল বাঁক সোজা করার জন্য সেচ কর্তাদের বিপরীতে যেয়ে খনন কাজে অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষকে ঠেকিয়ে রাখতে না পেরে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। ১০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। সে দিনটা ছিল ১৯৪৮ এর ২৯ সেপ্টেম্বর। নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নদী শাসনের সামাজিক উদ্যোগের এক উজ্বল দৃষ্টান্ত।
বাস্তবে দেখা যায়, নদী ব্যবস্থাপনায় সরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে গণস্বার্থের চেয়ে বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থ নানাভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সুখ সাচ্ছন্দ্য অবলীলায় বন্ধক রাখে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনায় তিস্তা প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে উঠে আসে। তিস্তার জলপ্রবাহ কমে আসার কারণ দেখিয়ে ২০১১র জলবন্টনের হিস্যা থেকে ভারত সম্ভবত পিছিয়ে আসতে আগ্রহী। জলপাইগুড়ির গজলডোবায় তৈরি বাঁধের কারণে বাংলাদেশে জলপ্রবাহ আরও কমে এসেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিরোধীতা জলবণ্টন সংক্রান্ত চুক্তির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে। পশ্চিমবঙ্গর অভিযোগ তারাই পর্যাপ্ত জল পাচ্ছে না। অন্যদিকে সিকিম বাঁধগুলোর সুবাদে বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদক রাজ্যে পৌঁছেছে। সেখান থেকে সরতে নারাজ। এ অবস্থায় তিস্তার দুই নয়নের অশ্রুই আমরা গড়িয়ে পড়তে দেখছি। আমাদের আশার কথা বাংলাদেশ নিজ ভূখ-ে তিস্তা ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
সর্বশেষ দুই দেশের সরকার প্রধানদের আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারত অর্থায়ন সহ সহযোগিতায় আগ্রহ দেখিয়েছে। তিস্তা বৃত্তান্তÑ নিয়ে কথা চালাচালি সংক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক। যুগ যুগ ধরে তিস্তাপারের মানুষের দহন যন্ত্রণার অবসান হোক।
[লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]