alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিদেশি বিনিয়োগ কমছে কেন

রেজাউল করিম খোকন

: শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশে ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। মোট এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল এবং আগের বছরের চেয়ে বেড়েছিল ২০ শতাংশ। দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পরও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশে কেন বিদেশি বিনিয়োগ কমলো? বাংলাদেশে এফডিআই আগে থেকেই নিম্নস্তরে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় একই পরিমাণ জিডিপির দেশ ভিয়েতনামে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে এফডিআই এসেছে ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন, যা তাদের জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশের সমান।

বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ও বিনিয়োগ স্থিতি দুটোই কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। এর মানে নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণ এবং যারা আছে তাদেরকেও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাফল্য কম। কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। কিছু পুরোনো আইনকানুনের সংস্কার করা হয়নি। এছাড়া গত দুই বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, বিশেষত মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কারণ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ সবাই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করলে ১০ বছর কর অবকাশ সুবিধা মিলবে, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি পাওয়া যাবে। সরকারের কাছ থেকে এ রকম বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করেন; কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছে। এক প্রজ্ঞাপনে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানায় এনবিআর।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে এত দিন শুল্ক অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা ছিল। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এত দিন সব ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। এবার সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অন্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর আয়কর আরোপ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) উন্নয়নকাজে ব্যবহার করা পণ্য আমদানিতেও এত বছর শুল্ক অব্যাহতি ছিল। সেক্ষেত্রে নতুন বাজেটে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ইপিজেডে স্থাপিত ওয়্যারহাউসের অনুকূলে এত দিন দেয়া বন্ড সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়োজিত বিদেশি কর্মীদের প্রথম তিন বছরের আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর অব্যাহতি ছিল। সেটি বাতিল করা হয়েছে।

সরকারের সুবিধা প্রত্যাহারের এ ঘোষণায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে দেশি-বিদেশি অন্তত ৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ শঙ্কায় পড়বে। এর ফলে উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবেন কিনা, তা নিয়ে তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সুবিধা প্রত্যাহারের সমালোচনা করেছে। সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশে আর বিনিয়োগ করবেন না বলে জানিয়েছেন। একই আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যেতে পারে। বর্তমান সুবিধাগুলো না থাকলে উদ্যোক্তারা এ দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের ব্যাপারে এনবিআরের যুক্তি হচ্ছে, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের চেয়ে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি। এ জন্য সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তা ছাড়া শুল্ক অব্যাহতির অপব্যবহার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কিছু খাতে দুই বছর ধরে পর্যায়ক্রমে কর অব্যাহতি কমিয়ে আসছে এনবিআর। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ইজেড ও হাইটেক পার্কগুলো সম্মিলিতভাবে প্রায় ৪ হাজার ২২ কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছে। অন্যদিকে গত তিন বছরে এসব সুবিধা দেয়ায় সরকার ৫০০ কোটি টাকার কম রাজস্ব হারিয়েছে।

নতুন সিদ্ধান্তে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশিরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। অনেক দেশীয় উদ্যোক্তার মধ্যেও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বেশ কিছু বিদেশি বিনিয়োগ শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কোম্পানির বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে এখন কেন তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা জানতে চেয়েছেন তারা। সরকারের সিদ্ধান্তে দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশ, শুল্ক অব্যাহতিসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার আশায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। মাঝপথে হঠাৎ করে এভাবে শুল্ক আরোপ হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে পড়বেন। বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন। সরকারের কাছ থেকে এসব সুবিধা না পেলে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবেন, যা দেশের শিল্পায়নে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দেশে গত এক যুগ ধরে বার্ষিক বিদেশি বিনিয়োগ ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারের বারবার নীতিকৌশল পরিবর্তনে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমবে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে বিদেশি বিনিয়োগ আনা হয়েছিল। এখন সেসব সুবিধা বাতিল করায় উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। কেউই এখন বিশ্বাস করতে চাইবে না। এমন সিদ্ধান্ত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। সুবিধা প্রত্যাহার করলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপের প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। সেজন্য বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সংজ্ঞাটি বেশ সহজই বলতে হয়। একটি জনসংখ্যাবহুল দরিদ্র দেশে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস। বিনিয়োগ বলতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যেমন বোঝায়, অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আবার প্রযুক্তি হস্তান্তরও ঘটায়। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অতি আকাক্সিক্ষত তারল্য বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিদেশি বিনিয়োগ কমছে কেন

রেজাউল করিম খোকন

শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশে ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। মোট এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল এবং আগের বছরের চেয়ে বেড়েছিল ২০ শতাংশ। দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পরও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশে কেন বিদেশি বিনিয়োগ কমলো? বাংলাদেশে এফডিআই আগে থেকেই নিম্নস্তরে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় একই পরিমাণ জিডিপির দেশ ভিয়েতনামে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে এফডিআই এসেছে ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন, যা তাদের জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশের সমান।

বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ও বিনিয়োগ স্থিতি দুটোই কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। এর মানে নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণ এবং যারা আছে তাদেরকেও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাফল্য কম। কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। কিছু পুরোনো আইনকানুনের সংস্কার করা হয়নি। এছাড়া গত দুই বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, বিশেষত মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কারণ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ সবাই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করলে ১০ বছর কর অবকাশ সুবিধা মিলবে, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি পাওয়া যাবে। সরকারের কাছ থেকে এ রকম বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করেন; কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছে। এক প্রজ্ঞাপনে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানায় এনবিআর।

শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে এত দিন শুল্ক অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা ছিল। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এত দিন সব ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। এবার সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অন্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর আয়কর আরোপ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) উন্নয়নকাজে ব্যবহার করা পণ্য আমদানিতেও এত বছর শুল্ক অব্যাহতি ছিল। সেক্ষেত্রে নতুন বাজেটে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ইপিজেডে স্থাপিত ওয়্যারহাউসের অনুকূলে এত দিন দেয়া বন্ড সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়োজিত বিদেশি কর্মীদের প্রথম তিন বছরের আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর অব্যাহতি ছিল। সেটি বাতিল করা হয়েছে।

সরকারের সুবিধা প্রত্যাহারের এ ঘোষণায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে দেশি-বিদেশি অন্তত ৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ শঙ্কায় পড়বে। এর ফলে উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবেন কিনা, তা নিয়ে তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সুবিধা প্রত্যাহারের সমালোচনা করেছে। সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশে আর বিনিয়োগ করবেন না বলে জানিয়েছেন। একই আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যেতে পারে। বর্তমান সুবিধাগুলো না থাকলে উদ্যোক্তারা এ দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের ব্যাপারে এনবিআরের যুক্তি হচ্ছে, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের চেয়ে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি। এ জন্য সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তা ছাড়া শুল্ক অব্যাহতির অপব্যবহার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কিছু খাতে দুই বছর ধরে পর্যায়ক্রমে কর অব্যাহতি কমিয়ে আসছে এনবিআর। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ইজেড ও হাইটেক পার্কগুলো সম্মিলিতভাবে প্রায় ৪ হাজার ২২ কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছে। অন্যদিকে গত তিন বছরে এসব সুবিধা দেয়ায় সরকার ৫০০ কোটি টাকার কম রাজস্ব হারিয়েছে।

নতুন সিদ্ধান্তে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশিরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। অনেক দেশীয় উদ্যোক্তার মধ্যেও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বেশ কিছু বিদেশি বিনিয়োগ শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কোম্পানির বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে এখন কেন তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা জানতে চেয়েছেন তারা। সরকারের সিদ্ধান্তে দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশ, শুল্ক অব্যাহতিসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার আশায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। মাঝপথে হঠাৎ করে এভাবে শুল্ক আরোপ হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে পড়বেন। বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন। সরকারের কাছ থেকে এসব সুবিধা না পেলে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবেন, যা দেশের শিল্পায়নে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দেশে গত এক যুগ ধরে বার্ষিক বিদেশি বিনিয়োগ ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারের বারবার নীতিকৌশল পরিবর্তনে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমবে।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে বিদেশি বিনিয়োগ আনা হয়েছিল। এখন সেসব সুবিধা বাতিল করায় উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। কেউই এখন বিশ্বাস করতে চাইবে না। এমন সিদ্ধান্ত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। সুবিধা প্রত্যাহার করলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপের প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। সেজন্য বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সংজ্ঞাটি বেশ সহজই বলতে হয়। একটি জনসংখ্যাবহুল দরিদ্র দেশে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস। বিনিয়োগ বলতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যেমন বোঝায়, অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আবার প্রযুক্তি হস্তান্তরও ঘটায়। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অতি আকাক্সিক্ষত তারল্য বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top