alt

উপ-সম্পাদকীয়

অবাসযোগ্য ঢাকার গোপন রহস্য

মোহাম্মদ আবু নোমান

: মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

অফিসগামী বা কর্মব্যস্ত মানুষ পরিচিতজনকে বলছে, ভাই আমার একটু তারা আছে আপনি গাড়িতে যান, আমি হেঁটে যাব! সড়কে ৭ কি.মি. গতি নিয়ে দেশ কতটা এগোবে। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা সব তেল, এখন রাস্তায় জ্বলে, আর পরিবেশের কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা না-ই বলি। আর কিছুতে না পারলেও আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ বহুবার দূষিত, অবাসযোগ্য, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে!

ঢাকা এখন ক্লান্তির নগরী, বিরক্তির নগরী, দূষিত বায়ুর শহর, ঢাকা এখন বাসের অযোগ্য অর্থাৎ, ‘অবাসযোগ্য’ নগরী। গত ২৭ জুন প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৪-এ বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের র‌্যাঙ্কিং থেকে দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে ঢাকা। ৪৩.০ স্কোর নিয়ে তালিকায় ১৬৮তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী।

এখনই নয়, অনেক আগে থেকেই অবাসযোগ্য নগরীর তকমা নিয়ে অবস্থান হারানোর পর, এখন বলা যায় অন্তিম সময়ে উপনীত। ঢাকা এখন জীবনীশক্তি হারাতে বসা এক নগর। একে বাঁচাতে ও টেকানোর সময় যে ফুরিয়ে এসেছে। যেটা দেশের রাজধানী শহর হিসেবে কারোই কাম্য নয়। টানা প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আজ ষোলো বছরে এসেও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ষষ্ঠ! এই যে এত উন্নয়ন, উন্নয়নের আওয়াজ, এগুলো কি ঢাকায় হয়নি? যারা এত বছর শাসন করে দেশের রাজধানীকে অবাসযোগ্য শহর হওয়া থেকে বাঁচাতে পারছে না, মানা যায় কী? এমন একটা লজ্জার মাঝেও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কেমনে দেখবে মানুষ?

বহুবার প্রথম স্থান অর্জিত এ অবাসযোগ্য, দূষিত, ধীরগতির, অচল ঢাকার গোপন রহস্য নিয়ে কেন গবেষণা হচ্ছে না? পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দূষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? ঢাকা কেন বারবার ডেডলি দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? সরকারেরও সুমতি হবে না? ধুলা-বালি, শ্বাসকষ্ট, শিশুসহ নিরীহ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী দেশের কতিপয় ধান্দাবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীনরা ও সেবাদানকারী নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। রাস্তা খুঁড়লেই টাকা, কাটলেই টাকা! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারোরই কারোর সঙ্গে কাজের সমন্বয় না থাকায় একই রাস্তা বছরে ২-৩ বার কাটা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বহুবার এসেছেÑ ‘বায়ুদূষণে এক নম্বরে ঢাকা!’ তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে; সিটি করপোরেশন কি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে? আমাদের খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ; অফিস-বাসাবাড়িতে বিষ; মাছ-ফল-সবজিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এরকম কত কিছু নিয়ে আমরা বেঁচে আছি! আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! এটা সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। গবেষণায়ই প্রমাণ হয়, পরিবেশ রক্ষায় সরকারের তথা সিটি করপোরেশনের কার্যত যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। এর প্রতিকার কার কাছে আছে? কে দেবে সমাধান! পুরো দেশ তো ডিজিটালের উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর!

অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ঢাকা। ভোগান্তি কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পান পথচারী, কর্মজীবী ও অফিসগামীরা। বৃষ্টি থামলেই আবার অসহ্য গরম। শীতকালে ঢাকার আরেক নাম ধুলোর শহর। বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি থাকে তখন। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্কের (একিউআই) পরিসংখ্যানে আমাদের ঢাকা বহুবার বিশ্বের সেরা দূষিত শহরের মধ্যে এসেছে। তার মানে শীত, গরম বা বর্ষা কোনো সময়ই ঢাকায় শান্তি নেই। দুর্ভোগ লেগে থাকে সব সময়। ঢাকার চারপাশে নদী ছিল তা খেয়ে ফেলেছে খাদকরা। খালগুলোও বেদখলে। রাজনীতির পরিচয়ই তাদের এ কাজের টিকেট দিয়েছে।

ঢাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমে, জ্যামে বসে থাকা, তার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ফ্রি বিষাক্ত ধোঁয়া আর ধুলোবালি খাওয়াটা যেন আমাদের নাগরিক অধিকার হয়ে গেছে! ১৮ কোটি জনতার একটি দেশে, একটি ছোট্ট রাজধানী শহরে যে কোনো কাজের জন্যে সবাইকে আসতে বাধ্য হতে হয়। নিজে যেতে না চাইলেও আপনাকে যেতে বাধ্য করবেই দেশের সিস্টেম। একজন দুর্ঘটনার রোগীকে, ডায়াবেটিস রোগীকে, অসুস্থ শিশুকে, হার্টের রোগীকে, শিক্ষককে, অন্য সবপর্যায়ের চাকরিজীবী/ প্রার্থীকে ঢাকায় আসতেই হবে। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বিদেশ থাকে, কাউকে যদি বিদেশ যেতে হয় বা ফিরতে হয় তাকে অবশ্যই ঢাকামুখী হতে হয়।

আমাদের সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক। পৃথিবীর কোথাও আছে কী, সেনা/নৌ/বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর রাজধানীতে? শিক্ষা বোর্ড অফিস, এমনকি মাছ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পাঠ মন্ত্রণালয়, সমুদ্র গবেষণা মন্ত্রণালয়ও ঢাকায়। আরও কত কিছু আছে, আগামীতে আরো নতুন নতুন কার্যক্রম যোগ হবে, ‘পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়’। এসব কারণে ঢাকা আজ ওভারলোডেড। এছাড়া সব চাকরির পরীক্ষা তো ঢাকায়ই হবে। এরকম আনপ্লানেড ও আনথিংঅ্যাবল অনেক কিছু ঢাকায় আছে। যেগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দিলে ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমে যেত।

অফিস, আদালত, চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকরি, নিয়োগ, বদলি, তদবির এসব কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণ না করে, ঢাকায় আরও মেট্রোরেল হবে, পাতাল রেল হবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, অবস্থা এমন যে, দেশের ১৮ কোটি মানুষকে কোনো না কোনো বিষয়ে ঢাকায় আনতেই হবে। এসব কারণে বিপুল জনসংখ্যার ছোট এ দেশের জনস্রোত হয়েছে ঢাকামুখী। আর ঢাকা হয়ে উঠছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর একটিতে। পরিণামে ঢাকা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ দূষিত, অবাসযোগ্য ও যানজটের নগরীতে।

ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক। ঢাকায় বাসযোগ্যতা বাড়াতে মেয়র-কাউন্সিলরদের জবাবদিহিতা দরকার। ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জনসম্পৃক্ততা দিন দিন কমছে। এলাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উদ্যোগ এ কাউন্সিলরদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। রয়েছে ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিসের সক্ষমতার অভাবও। ঠিকাদারি ও ব্যবসায় আগ্রহ এবং এতে কাউন্সিলরদের আত্মীয়-পরিজনদের সম্পৃক্ততার অভিযোগের পাশাপাশি এলাকাবাসীর কাছে জবাবদিহিতার অভাব আছে। হকারদের রাস্তায় বসিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে চাঁদা আদায়, সরকারি যায়গা দখল, নদী দখল, খাল দখল, জমি দখল অভিযোগের পাশাপাশি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে অনেক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। এসব সমস্যা দূর না করতে পারলে ওয়ার্ড কাউন্সিল থেকে কার্যকর নাগরিক সেবা ও নগর উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থানের সমর্থন মিলেছে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বক্তব্যেও। গত ২৮ জুন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘টেকসই শহর তৈরি: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও বাধা’ শীর্ষক সেমিনারে মন্ত্রী বলেন, রাজধানী ঢাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ বাড়িঘর অনুমোদনহীন। এই অনুমোদনহীন বাড়ি-ঘরের দায়ভার কার?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের খাল উদ্ধার ও জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে মোহাম্মদপুরের লাউতলা ও রামচন্দ্রপুর খাল, মিরপুরের প্যারিস খাল এবং সাতারকুলের সূতিভোলা খাল সম্প্রতি সাদেক অ্যাগ্রো থেকে মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ ও আবর্জনা অপসারণ, খাল খনন উল্লেখযোগ্য। আর আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। ঢাকার বর্তমান দুই মেয়রের জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল সংস্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নগরের বেশ কিছু সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ দেখা গেছে।

শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, ফ্যাক্টরি, অফিসের সামনের জায়গাটুকু পরিস্কার রাখতে হবে। পাশাপাশি জনগণেরও সচেতন হওয়া দরকার, রাস্তায় যেসব ময়লা আবর্জনা ফেলছি সেগুলোই জীবাণু হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে! যতদিন পর্যন্ত আমরা সুশৃঙ্খল না হবো ততদিন আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন হবে না। কেউ কাউকে আলাদাভাবে সচেতন করা সম্ভব নয়। এজন্য থাকতে হবে নীতিমালা ও সুশাসন, যা আমাদের দেশে নেই। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

যতই যা বলি ঢাকা আমার শহর, আপনার শহর। শুধু আমাদের আপন মানুষগুলোর ভবিষ্যতের জন্য আসুন আমার সবাই মিলে ঢাকাকে পরিষ্কার রাখি। অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপানোর আগে সর্বসাধারণের সচেতন হতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস বিরাট শক্তিরূপে অর্জিত হতে পারে। সার্বিক দূষণের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলো অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

পশ্চিমবঙ্গ : রাজনৈতিক হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : উত্তরণের উপায়

কুষ্ঠ : স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে ইস্যুটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ঔপনিবেশিকতা নাকি মানবতার অবমূল্যায়ন?

রম্যগদ্য : ‘নারী মানেই ব্যভিচারী...’

প্রসঙ্গ: সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫

ছবি

নীরদ সি চৌধুরী : পেন্ডুলামের মতো দোলায়মান এক বাঙালি চরিত্র

ভোজবাজি ও ভানুমতির খেলা

সড়কে কিশোর মোটরবাইকার : নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মব জাস্টিস আইনের শাসনের পরিপন্থি

ছবি

গভীর সংকট আর বড় সম্ভাবনা পাশাপাশি হাঁটছে

জ্ঞানদায়িনী মা সরস্বতী দেবী

‘সংখ্যাস্বল্প’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কেন প্রয়োজন?

সব ক্ষেত্রে বাংলাকে প্রাধান্য দিন

গুজব : মানবসৃষ্ট দুর্যোগ

অন্তর্বর্তী সরকার: নাগরিকদের প্রত্যাশা কি পূরণ হবে?

পাঠ্যবই সংকটে থমকে গেছে শিক্ষার চাকা

আরজি কর : শাসক রোষে ভিকটিমের পরিবার

চাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

শুল্ক বনাম উদ্ভাবন যুদ্ধ

রম্যগদ্য : “ডক্টর.জ্বী-ভাগো...”

বায়ুদূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার

ছবি

যোগেন ম-লের ‘বহুজনবাদী’ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

একটি দেয়ালচিত্র ও কিছু কথা

আলো, অন্ধকার ও চরিত্রবান জীবন

শিক্ষকরা কেন বারবার মার খাবে?

মনোবিশ্লেষক নাট্যক্রিয়া অনুশীলনের ক্ষেত্র হোক সহজতর

প্রসঙ্গ জেনারেশন জেড

বাড়ছে বেকারত্ব : প্রতিকারে জরুরি পদক্ষেপ নিন

প্রকৃতির প্রতি সদয় হতে হবে

ছবি

আভিজাত্যের বাঁধ এবং প্রান্তিক মানুষ

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস

অর্থনীতি কোনদিকে যাচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী সংস্কার দরকার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অবাসযোগ্য ঢাকার গোপন রহস্য

মোহাম্মদ আবু নোমান

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

অফিসগামী বা কর্মব্যস্ত মানুষ পরিচিতজনকে বলছে, ভাই আমার একটু তারা আছে আপনি গাড়িতে যান, আমি হেঁটে যাব! সড়কে ৭ কি.মি. গতি নিয়ে দেশ কতটা এগোবে। বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা সব তেল, এখন রাস্তায় জ্বলে, আর পরিবেশের কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা না-ই বলি। আর কিছুতে না পারলেও আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ বহুবার দূষিত, অবাসযোগ্য, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে!

ঢাকা এখন ক্লান্তির নগরী, বিরক্তির নগরী, দূষিত বায়ুর শহর, ঢাকা এখন বাসের অযোগ্য অর্থাৎ, ‘অবাসযোগ্য’ নগরী। গত ২৭ জুন প্রকাশিত ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৪-এ বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের র‌্যাঙ্কিং থেকে দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে ঢাকা। ৪৩.০ স্কোর নিয়ে তালিকায় ১৬৮তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী।

এখনই নয়, অনেক আগে থেকেই অবাসযোগ্য নগরীর তকমা নিয়ে অবস্থান হারানোর পর, এখন বলা যায় অন্তিম সময়ে উপনীত। ঢাকা এখন জীবনীশক্তি হারাতে বসা এক নগর। একে বাঁচাতে ও টেকানোর সময় যে ফুরিয়ে এসেছে। যেটা দেশের রাজধানী শহর হিসেবে কারোই কাম্য নয়। টানা প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আজ ষোলো বছরে এসেও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ষষ্ঠ! এই যে এত উন্নয়ন, উন্নয়নের আওয়াজ, এগুলো কি ঢাকায় হয়নি? যারা এত বছর শাসন করে দেশের রাজধানীকে অবাসযোগ্য শহর হওয়া থেকে বাঁচাতে পারছে না, মানা যায় কী? এমন একটা লজ্জার মাঝেও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কেমনে দেখবে মানুষ?

বহুবার প্রথম স্থান অর্জিত এ অবাসযোগ্য, দূষিত, ধীরগতির, অচল ঢাকার গোপন রহস্য নিয়ে কেন গবেষণা হচ্ছে না? পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দূষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? ঢাকা কেন বারবার ডেডলি দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? সরকারেরও সুমতি হবে না? ধুলা-বালি, শ্বাসকষ্ট, শিশুসহ নিরীহ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী দেশের কতিপয় ধান্দাবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীনরা ও সেবাদানকারী নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। রাস্তা খুঁড়লেই টাকা, কাটলেই টাকা! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারোরই কারোর সঙ্গে কাজের সমন্বয় না থাকায় একই রাস্তা বছরে ২-৩ বার কাটা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বহুবার এসেছেÑ ‘বায়ুদূষণে এক নম্বরে ঢাকা!’ তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে; সিটি করপোরেশন কি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে? আমাদের খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ; অফিস-বাসাবাড়িতে বিষ; মাছ-ফল-সবজিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এরকম কত কিছু নিয়ে আমরা বেঁচে আছি! আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! এটা সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। গবেষণায়ই প্রমাণ হয়, পরিবেশ রক্ষায় সরকারের তথা সিটি করপোরেশনের কার্যত যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। এর প্রতিকার কার কাছে আছে? কে দেবে সমাধান! পুরো দেশ তো ডিজিটালের উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর!

অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ঢাকা। ভোগান্তি কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পান পথচারী, কর্মজীবী ও অফিসগামীরা। বৃষ্টি থামলেই আবার অসহ্য গরম। শীতকালে ঢাকার আরেক নাম ধুলোর শহর। বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি থাকে তখন। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্কের (একিউআই) পরিসংখ্যানে আমাদের ঢাকা বহুবার বিশ্বের সেরা দূষিত শহরের মধ্যে এসেছে। তার মানে শীত, গরম বা বর্ষা কোনো সময়ই ঢাকায় শান্তি নেই। দুর্ভোগ লেগে থাকে সব সময়। ঢাকার চারপাশে নদী ছিল তা খেয়ে ফেলেছে খাদকরা। খালগুলোও বেদখলে। রাজনীতির পরিচয়ই তাদের এ কাজের টিকেট দিয়েছে।

ঢাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরমে, জ্যামে বসে থাকা, তার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ফ্রি বিষাক্ত ধোঁয়া আর ধুলোবালি খাওয়াটা যেন আমাদের নাগরিক অধিকার হয়ে গেছে! ১৮ কোটি জনতার একটি দেশে, একটি ছোট্ট রাজধানী শহরে যে কোনো কাজের জন্যে সবাইকে আসতে বাধ্য হতে হয়। নিজে যেতে না চাইলেও আপনাকে যেতে বাধ্য করবেই দেশের সিস্টেম। একজন দুর্ঘটনার রোগীকে, ডায়াবেটিস রোগীকে, অসুস্থ শিশুকে, হার্টের রোগীকে, শিক্ষককে, অন্য সবপর্যায়ের চাকরিজীবী/ প্রার্থীকে ঢাকায় আসতেই হবে। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ বিদেশ থাকে, কাউকে যদি বিদেশ যেতে হয় বা ফিরতে হয় তাকে অবশ্যই ঢাকামুখী হতে হয়।

আমাদের সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক। পৃথিবীর কোথাও আছে কী, সেনা/নৌ/বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর রাজধানীতে? শিক্ষা বোর্ড অফিস, এমনকি মাছ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, পাঠ মন্ত্রণালয়, সমুদ্র গবেষণা মন্ত্রণালয়ও ঢাকায়। আরও কত কিছু আছে, আগামীতে আরো নতুন নতুন কার্যক্রম যোগ হবে, ‘পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়’। এসব কারণে ঢাকা আজ ওভারলোডেড। এছাড়া সব চাকরির পরীক্ষা তো ঢাকায়ই হবে। এরকম আনপ্লানেড ও আনথিংঅ্যাবল অনেক কিছু ঢাকায় আছে। যেগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দিলে ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমে যেত।

অফিস, আদালত, চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকরি, নিয়োগ, বদলি, তদবির এসব কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণ না করে, ঢাকায় আরও মেট্রোরেল হবে, পাতাল রেল হবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, অবস্থা এমন যে, দেশের ১৮ কোটি মানুষকে কোনো না কোনো বিষয়ে ঢাকায় আনতেই হবে। এসব কারণে বিপুল জনসংখ্যার ছোট এ দেশের জনস্রোত হয়েছে ঢাকামুখী। আর ঢাকা হয়ে উঠছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর একটিতে। পরিণামে ঢাকা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ দূষিত, অবাসযোগ্য ও যানজটের নগরীতে।

ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক। ঢাকায় বাসযোগ্যতা বাড়াতে মেয়র-কাউন্সিলরদের জবাবদিহিতা দরকার। ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জনসম্পৃক্ততা দিন দিন কমছে। এলাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উদ্যোগ এ কাউন্সিলরদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। রয়েছে ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিসের সক্ষমতার অভাবও। ঠিকাদারি ও ব্যবসায় আগ্রহ এবং এতে কাউন্সিলরদের আত্মীয়-পরিজনদের সম্পৃক্ততার অভিযোগের পাশাপাশি এলাকাবাসীর কাছে জবাবদিহিতার অভাব আছে। হকারদের রাস্তায় বসিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে চাঁদা আদায়, সরকারি যায়গা দখল, নদী দখল, খাল দখল, জমি দখল অভিযোগের পাশাপাশি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে অনেক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। এসব সমস্যা দূর না করতে পারলে ওয়ার্ড কাউন্সিল থেকে কার্যকর নাগরিক সেবা ও নগর উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থানের সমর্থন মিলেছে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বক্তব্যেও। গত ২৮ জুন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘টেকসই শহর তৈরি: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও বাধা’ শীর্ষক সেমিনারে মন্ত্রী বলেন, রাজধানী ঢাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ বাড়িঘর অনুমোদনহীন। এই অনুমোদনহীন বাড়ি-ঘরের দায়ভার কার?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের খাল উদ্ধার ও জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে মোহাম্মদপুরের লাউতলা ও রামচন্দ্রপুর খাল, মিরপুরের প্যারিস খাল এবং সাতারকুলের সূতিভোলা খাল সম্প্রতি সাদেক অ্যাগ্রো থেকে মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ ও আবর্জনা অপসারণ, খাল খনন উল্লেখযোগ্য। আর আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। ঢাকার বর্তমান দুই মেয়রের জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল সংস্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নগরের বেশ কিছু সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ দেখা গেছে।

শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, ফ্যাক্টরি, অফিসের সামনের জায়গাটুকু পরিস্কার রাখতে হবে। পাশাপাশি জনগণেরও সচেতন হওয়া দরকার, রাস্তায় যেসব ময়লা আবর্জনা ফেলছি সেগুলোই জীবাণু হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে! যতদিন পর্যন্ত আমরা সুশৃঙ্খল না হবো ততদিন আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন হবে না। কেউ কাউকে আলাদাভাবে সচেতন করা সম্ভব নয়। এজন্য থাকতে হবে নীতিমালা ও সুশাসন, যা আমাদের দেশে নেই। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

যতই যা বলি ঢাকা আমার শহর, আপনার শহর। শুধু আমাদের আপন মানুষগুলোর ভবিষ্যতের জন্য আসুন আমার সবাই মিলে ঢাকাকে পরিষ্কার রাখি। অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপানোর আগে সর্বসাধারণের সচেতন হতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস বিরাট শক্তিরূপে অর্জিত হতে পারে। সার্বিক দূষণের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলো অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top