alt

উপ-সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

পাভেল পার্থ

: সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০২৪

জামদানির পর টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে আমরা কিছুদিন তৎপর ছিলাম। ভারত একতরফাভাবে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়া শাড়িকে জিআই হিসেবে নিবন্ধন করেছিল। আমাদের প্রতিবাদের রাষ্ট্র টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের জিআই হিসেবে নিবন্ধন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপর রাষ্ট্র আবার নিশ্চুপ। এর ভেতর ভারত আবার সুন্দরবনের মধুকে তাদের জিআই হিসেবে নিবন্ধন করে। জিআই বা ভৌগলিক নির্দেশক সম্পদমূলক কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক বাস্তুতন্ত্র হতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে। কোনো এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, মাটি, নদী, আবহাওয়া এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ঐতিহাসিক সম্পর্কও সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।

যেমনÑ টাঙ্গাইল শাড়ি কেন দুনিয়ার অন্যত্র হয় না? কারণ হলো টাঙ্গাইলের পাথরাইলের বিশেষ ভৌগলিক বাস্তুতন্ত্র। লৌহজং নদীর টলটলা পানি শাড়ি বুনতে কাজে লাগে। আর হলো পোড়াবিন্নি ধানের খই। এই খই থেকে জরা বা ম- তৈরি হয়। এই জরা সূতাকে নমনীয় কিন্তু শক্তিশালী করে তোলে। জরা বানাতে বিলের ঝিনুকের চুন লাগে। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা বা মোটিফগুলো স্থানীয় প্রকৃতি থেকে নেয়া। ধানছড়া, শংখ, দোয়েল, ময়ূর, চড়–ই, মাছি, মৌমাছি, লতা, আম, পদ্ম, পান, মাছ কত কী!

কিন্তু এখন টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে জড়িত প্রাণ-প্রকৃতির কিছুই আর আগের মতো নাই। লৌহজং নদী দখল ও দূষিত। পোড়াবিন্নি ধানের আবাদ কমেছে। আগের সেই সূতির কার্পাস তুলা নাই। মৌমাছি, ঝিনুক, দেশি মাছ, পাখি, লতাগুল্ম সবই নিঃশেষ। কেন নিঃশেষ, কেন দখল, কেন দূষণ? কেন সূতা ও উপকরণের বাজার দখল করেছে চীন বা ভারত? এইসব প্রশ্ন আমরা বহুবার রাষ্ট্রকে করেছি। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা আমাদের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় নাই। আমাদের প্রশ্নগুলো প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও পরিবেশগত ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।

আমরা যদি টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে গর্ব করতে চাই, তাহলে আমাদের নদীকে সুস্থ রাখতে হবে। পোড়াবিন্নি ধান আবাদ হতে হবে। চারধারের প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষিত হতে হবে। শাড়ি কারিগরদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে হবে। একটি টাঙ্গাইল শাড়ি কেবল শাড়ি মাত্র নয়; পরিবেশগত ন্যায়বিচারের এক প্রামাণ্য নির্দেশনাও। তেমনি সব বাস্তুতন্ত্র এবং প্রাণপ্রজাতি কেবল প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নয়; একইসঙ্গে মানুষের সমাজ-সংস্কৃতিরও অংশীদার। কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও পরিবেশের ন্যায়বিচার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। বোলতা থেকে বনরুই, বেজি থেকে বাঘ, বাদাবন থেকে বান্দরবান প্রাণ-প্রকৃতি রক্তাক্ত। নিহত নদী, চুরমার পাহাড়। প্রমাণিত হয়েছে পরিবেশগত অন্যায়ের সঙ্গে কাঠামোগত বৈষম্য, লুটেরা কর্তৃত্ববাদ এবং নয়াউদারবাদী বাহাদুরি জড়িত।

দেশে বহু আইন ও নীতি আছে, বাংলাদেশে বহু বৈশ্বিক দলিলে স্বাক্ষর করেছে। তারপরও প্রাণ-প্রকৃতিতে রক্তদাগ থামছে না। একইসঙ্গে জলবায়ু সংকটের কারণে পরিবেশগত বিপন্নতা আরও প্রকট ও জটিল হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর আদিবাসীসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা প্রবলভাবে হুমকির প্রান্তে দাঁড়িয়ে। দেশব্যাপী গ্রামীণ জনগণের বহু পরিবেশবান্ধব অনুশীলন এবং প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার উদ্যোগ ও আন্দোলন জাগ্রত আছে। আর এটিই পরিবেশগত ন্যায়বিচার সুরক্ষায় আমাদের ভরসা।

প্রকৃতিতে একমাত্র সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল প্রজাতি মানুষ, কিন্তু মানুষের এলোপাতাড়ি কোপেই প্রাণ-প্রকৃতি আজ বিপন্ন। মানুষ কেবল তার নিজের উন্নয়ন চায়, চারধারের অন্য কোনো প্রাণ-প্রজাতিকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। অথচ অণুজীব থেকে শুরু করে তিমি মাছ, পতঙ্গ থেকে বৃক্ষ সবার অবদানেই এই দুনিয়ায় বেঁচে আছে মানুষ। কিন্তু আমরা পরিবেশের এই অবদানের কথা বারবার ভুলে যাই আর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদ। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এই প্রবল কর্তৃত্ববাদকে প্রশ্ন করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রের পরিবেশবান্ধব রূপান্তর আমরা চাই। পরিবেশগত সব অন্যায় বঞ্চনার ন্যায়বিচার ও অবসান চাই। মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহার করে দেশের সব বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণবৈচিত্র্যকে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন সমাজ বির্নিমাণের স্বপ্ন দেখি আমরা। এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে মানুষের জন্য রাস্তা বানাতে গিয়ে জোর করে গাছ কেটে মা আর ছানা পাখিদের আলাদা করবে না। মানুষের জন্য ধান উৎপাদন করতে গিয়ে জমিতে বিষ দিয়ে কেঁচো, মাকড়সা ও ব্যাঙ খুন করবে না। এমন একটি সমাজ চাই যেখানে একটি বটগাছ কিংবা একজন রাজনীতিবিদ সমান নাগরিক অধিকার পাবেন। স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ শূন্য কার্বণ নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে মর্যাদা পাবে। শূন্য বর্জ্য কিংবা শূন্য দূষণ হবে আমাদের পরিচয়।

বিপ্লবী জেন-জি প্রজন্মের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে, দেয়াল লিখনে পরিবেশপ্রেমের বিষয়টিও তারা তুলে ধরছে। এই প্রজন্ম দায়িত্বশীল ও অদম্য থাকলে পরিবেশগত ন্যায়বিচার সুরক্ষিত হবে। পরিবেশ-বন ও জলবায়ুসহ বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের সম্মানিত বহু উপদেষ্টা পরিবেশ ন্যায়বিচার নিয়ে আজীবন সোচ্চার ও সক্রিয় ছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি তাদের অন্তরে প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি দায় ও দায়িত্বশীলতা বলিষ্ঠভাবেই আছে। পরিবেশ ও জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে নি¤œলিখিত প্রস্তবনা পেশ করছি। আশা করি রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার ও রূপান্তরে এইসব প্রস্তাব গুরুত্ব সহকারে যুক্ত হবে।

প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও পরিবেশ ন্যায়বিচার বিষয়ক প্রস্তাব:

প্রাণ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় রাষ্ট্র ‘ইকোসেন্ট্রিক (প্রতিবেশবাদী)’ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সকল প্রাণসত্তার/প্রাণবৈচিত্র্যের (প্রাকৃতিক ও জীনগতবৈচিত্র্য) অবদান এবং পরস্পরনির্ভরশীলতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বপ্রাণের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।

প্রাণবৈচিত্র্য, প্রতিবেশ ও পরিবেশসম্পর্কিত কর্মসূচিসহ রাষ্ট্রের সব উন্নয়নচিন্তায় প্রবলভাবে অধিষ্ঠিত কতৃর্ত্ববাদী ‘মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (এথনোপোসেন্ট্রিক)’ খারিজ করে সব উন্নয়নচিন্তা ও তৎপরতায় মানুষসহ সর্বপ্রাণের বৈচিত্র্যর অস্তিত্ব, বিকাশ ও অধিকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

দেশের জনগণের মতামত, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত আইনের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র/পরিবেশগত বৈচিত্র্য (ইকোসিস্টেম), বৃক্ষ, বন্যপ্রাণী সবার ব্যক্তিসত্তাকেই আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

সংবিধানের ১৮(ক) ধারাকে সংশোধন করে উল্লেখ করতে হবে, ‘...রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য প্রাণ-প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও পরিবেশের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রাণবৈচিত্র্য, জীনগতবৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র, দেশীয় বীজ সম্পদ, কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চল, বনাঞ্চল, বৃক্ষ, বন্যপ্রাণী, পাহাড়, গড়, বরেন্দ্র, চরাঞ্চল, দ্বীপ, টিলা, ঝিরি, বিল, ঝরনা, নদ-নদী, ছড়া, দীঘি, হাওর, বাঁওড়, খাল, উদ্যান, পার্ক, সবুজবলয়, উন্মুক্ত জনচত্বর, সাংস্কৃতিকভাবে সুরক্ষিত পবিত্র অঞ্চল, গ্রামীণ বন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা ও প্রাকৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতার নিরাপত্তা বিধান করিবেন’।

বন, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আদিবাসীসহ স্থানীয় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত সম্পর্ক ও অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশগত জনব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

কৃষিপ্রতিবেশ, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, জলাভূমি বেদখল ও বিনষ্ট করে কোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে না। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বিপন্নকারী সব নকশা, স্থাপত্য পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন তৎপরতাগুলো বাতিল করতে হবে। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে বিশ্বস্ত জনমত জরিপ, পরিবেশগত-প্রতিবেশগত-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব যাচাই নিশ্চিত করতে হবে এবং সব পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে জনগণের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে।

আদিবাসীসহ বননির্ভর স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং জনগণের পূর্ব অনুমোদন, প্রস্তাব ও সুপারিশের ভিত্তিতে বনআইনের আমূল সংস্কার করতে হবে। পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র্য, নদী, জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনাসম্পর্কিত নীতি ও আইনসমূহ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংস্কার করে কার্যকর করতে হবে।

অবৈধ ও মিথ্যা বনমামলা বাতিল করে সর্বক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পরিবেশ ও বনসম্পর্কিত আইন ও বিচার কাঠামোকে জনবান্ধব করতে হবে।

সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশব্যাপী একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক-পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করতে হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। শিল্প ও রাসায়নিক দূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, দৃশ্যদূষণ, আলোকদূষণ, শব্দদূষণ রোধে দখলদার ও দূষণকারীদের আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রমাণিত প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংসকারীদের কোনোভাবেই পুনরায় কোনো সরকারি ও বেসরকারি কর্মসূচিতে পুনর্বাসন ও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

বৃক্ষ ও প্রাণীর সুনির্দিষ্ট তালিকাসহ আগ্রাসী (ইনভেসিভ/এলিয়েন স্পেসিস) প্রজাতি নিষিদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন নার্সারি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বাগান, উদ্যান, সামাজিক বনায়ন, মৎস্য-পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদ খামার থেকে ধারাবাহিকভাবে আগ্রাসী প্রজাতি হ্রাসকরণে সুনির্দিষ্ট জনপরিকল্পনা ও কর্মসূচি তৈরি করতে হবে।

নদী ও হাওর ব্যবস্থাপনা, বন্যপ্রাণী পাচার এবং দূষণ রোধে জনগণের সামনে সব তথ্য অবাধ ও উন্মুক্ত করে আন্তঃরাষ্ট্রিক কূটনীতিকে সক্রিয় করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক খনন, বৃহৎ বাঁধ এবং উন্নয়ন অবকাঠামো, উজানের পানি প্রত্যাহার এবং অন্যায় নদীশাসনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিহত করতে হবে।

দেশব্যাপী উদ্যান, পার্ক, উন্মুক্ত জনচত্বর এবং সবুজবলয় সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকতে হবে। এসব জনসম্পদ ও অঞ্চল ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থী, নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ নগরবাসীকে স্থানীয় সরকারের কর্মতৎপরতায় যুক্ত করতে হবে।

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সব সিলেবাস এবং পাঠ্যক্রমে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ অসংবেদনশীল কোনো কনটেন্ট এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাকে শিক্ষা ও শ্রেণী কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু ন্যায্যতাবিষয়ক প্রস্তাব :

জলবায়ু পরবির্তনের সংকট ও অভিঘাতকে গুরুত্ব দিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও দায়িত্ব যুক্ত করতে হবে। দেশের ভুক্তভোগী জনগণের সপক্ষে জলবায়ু ন্যায্যতা (ক্লাইমেট জাস্টিস) প্রতিষ্ঠাকে রাষ্ট্রের মৌলিক জলবায়ু-অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

খরা, তীব্র তাপদাহ, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, পাহাড়ি ঢল, অকাল বন্যা, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ, বজ্রপাতসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সকল আপদ-বিপদকে সুনির্দিষ্টভাবে বিবেচনায় নিয়ে দেশের কৃষিপ্রতিবেশ ভিন্নতায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জনবান্ধব কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। জলবায়ু সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় এনে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে (২০১৫) গুরুত্ব দিয়ে জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিযোজন চর্চা ও লোকায়ত জ্ঞানকে স্বীকৃতি দিয়ে জলবায়ু উপযোগী দেশীয় শস্যফসল ও স্থানীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতীয় অভিযোজন পদক্ষেপ ও নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকটাপন্ন গ্রামীণ সংস্কৃৃতি এবং শিল্পকর্ম বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে। এলাকাভিত্তিক অর্ন্তভুক্তিমূলক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

বৈশি^ক প্রশমন উদ্যোগসমূহ প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমানকরণ এবং বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের জলবায়ু-কূটনীতি জোরদার করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনে (কনফারেন্স অব পার্টিস/কপ) রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি দলে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, যুব সমাজ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে।

বহুজাতিক কোম্পানি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠাননির্ভর মিথ্যা জলবায়ু সমাধানগুলোকে কোনোভাবেই প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না এবং কার্বন-বাণিজ্যের মতো বিষয়কে উৎসাহিত করা যাবে না।

‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (২০০৯)’, ‘ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ এবং ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন’সহ জলবায়ু সংশ্লিষ্ট আইন, নথি, নীতি, পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও কর্মসূচিতে জনগণের মতামত, বাস্তবতা, সুপারিশ, উদ্যোগ এবং অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডসহ বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল, অভিযোজন তহবিল এবং অর্থায়নকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

জলবায়ু পরির্বনের কারণে পেশার পরিবর্তনশীলতা ও স্থানান্তর এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ুর কারণে জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের জন্য নতুন অভিবাসনস্থল নিরাপদ করতে হবে এবং এসব মানুষের জন্য মর্যাদার কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু-উদ্বাস্তু হয়ে নগর এলাকায় বসবাসরত নগরদরিদ্রদের জন্য নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যকরণে এবং নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানি শক্তির রূপান্তরে জনবান্ধব জ্বালানি রূপান্তর কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। কৃষিজমি-জলাভূমি বিনষ্ট না করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গ্রাম ও নগরের দরিদ্র জনগণের প্রবেশাধিকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে।

[লেখক : গবেষক, পরিবেশ-প্রতিবেশ]

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তিগত যুদ্ধ

বন্যাপরবর্তী কৃষি উৎপাদনে সময়োপযোগী সহায়তা প্রদান

গুণগত উন্নয়নই সমাজের প্রকৃত উন্নতির চাবিকাঠি

বিশেষ শিশু ও বিশেষ শিক্ষালয়

বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অধিকার

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি

প্রসঙ্গ : আনসার বাহিনী

শান্তির সংস্কৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

মব লিঞ্চিং আইনের শাসনের পরিপন্থি

মব জাস্টিসের মতো বর্বরতা বন্ধ হোক

বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রাজনীতি

জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক

জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক

ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন?

ছবি

নিবেদিত প্রাণ এক কৃষিবিজ্ঞানী

জনমনে স্বস্তি ফিরুক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

পাভেল পার্থ

সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০২৪

জামদানির পর টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে আমরা কিছুদিন তৎপর ছিলাম। ভারত একতরফাভাবে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়া শাড়িকে জিআই হিসেবে নিবন্ধন করেছিল। আমাদের প্রতিবাদের রাষ্ট্র টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের জিআই হিসেবে নিবন্ধন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপর রাষ্ট্র আবার নিশ্চুপ। এর ভেতর ভারত আবার সুন্দরবনের মধুকে তাদের জিআই হিসেবে নিবন্ধন করে। জিআই বা ভৌগলিক নির্দেশক সম্পদমূলক কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক বাস্তুতন্ত্র হতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে। কোনো এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, মাটি, নদী, আবহাওয়া এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ঐতিহাসিক সম্পর্কও সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।

যেমনÑ টাঙ্গাইল শাড়ি কেন দুনিয়ার অন্যত্র হয় না? কারণ হলো টাঙ্গাইলের পাথরাইলের বিশেষ ভৌগলিক বাস্তুতন্ত্র। লৌহজং নদীর টলটলা পানি শাড়ি বুনতে কাজে লাগে। আর হলো পোড়াবিন্নি ধানের খই। এই খই থেকে জরা বা ম- তৈরি হয়। এই জরা সূতাকে নমনীয় কিন্তু শক্তিশালী করে তোলে। জরা বানাতে বিলের ঝিনুকের চুন লাগে। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা বা মোটিফগুলো স্থানীয় প্রকৃতি থেকে নেয়া। ধানছড়া, শংখ, দোয়েল, ময়ূর, চড়–ই, মাছি, মৌমাছি, লতা, আম, পদ্ম, পান, মাছ কত কী!

কিন্তু এখন টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে জড়িত প্রাণ-প্রকৃতির কিছুই আর আগের মতো নাই। লৌহজং নদী দখল ও দূষিত। পোড়াবিন্নি ধানের আবাদ কমেছে। আগের সেই সূতির কার্পাস তুলা নাই। মৌমাছি, ঝিনুক, দেশি মাছ, পাখি, লতাগুল্ম সবই নিঃশেষ। কেন নিঃশেষ, কেন দখল, কেন দূষণ? কেন সূতা ও উপকরণের বাজার দখল করেছে চীন বা ভারত? এইসব প্রশ্ন আমরা বহুবার রাষ্ট্রকে করেছি। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা আমাদের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় নাই। আমাদের প্রশ্নগুলো প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও পরিবেশগত ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।

আমরা যদি টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে গর্ব করতে চাই, তাহলে আমাদের নদীকে সুস্থ রাখতে হবে। পোড়াবিন্নি ধান আবাদ হতে হবে। চারধারের প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষিত হতে হবে। শাড়ি কারিগরদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে হবে। একটি টাঙ্গাইল শাড়ি কেবল শাড়ি মাত্র নয়; পরিবেশগত ন্যায়বিচারের এক প্রামাণ্য নির্দেশনাও। তেমনি সব বাস্তুতন্ত্র এবং প্রাণপ্রজাতি কেবল প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নয়; একইসঙ্গে মানুষের সমাজ-সংস্কৃতিরও অংশীদার। কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও পরিবেশের ন্যায়বিচার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। বোলতা থেকে বনরুই, বেজি থেকে বাঘ, বাদাবন থেকে বান্দরবান প্রাণ-প্রকৃতি রক্তাক্ত। নিহত নদী, চুরমার পাহাড়। প্রমাণিত হয়েছে পরিবেশগত অন্যায়ের সঙ্গে কাঠামোগত বৈষম্য, লুটেরা কর্তৃত্ববাদ এবং নয়াউদারবাদী বাহাদুরি জড়িত।

দেশে বহু আইন ও নীতি আছে, বাংলাদেশে বহু বৈশ্বিক দলিলে স্বাক্ষর করেছে। তারপরও প্রাণ-প্রকৃতিতে রক্তদাগ থামছে না। একইসঙ্গে জলবায়ু সংকটের কারণে পরিবেশগত বিপন্নতা আরও প্রকট ও জটিল হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর আদিবাসীসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা প্রবলভাবে হুমকির প্রান্তে দাঁড়িয়ে। দেশব্যাপী গ্রামীণ জনগণের বহু পরিবেশবান্ধব অনুশীলন এবং প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার উদ্যোগ ও আন্দোলন জাগ্রত আছে। আর এটিই পরিবেশগত ন্যায়বিচার সুরক্ষায় আমাদের ভরসা।

প্রকৃতিতে একমাত্র সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল প্রজাতি মানুষ, কিন্তু মানুষের এলোপাতাড়ি কোপেই প্রাণ-প্রকৃতি আজ বিপন্ন। মানুষ কেবল তার নিজের উন্নয়ন চায়, চারধারের অন্য কোনো প্রাণ-প্রজাতিকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। অথচ অণুজীব থেকে শুরু করে তিমি মাছ, পতঙ্গ থেকে বৃক্ষ সবার অবদানেই এই দুনিয়ায় বেঁচে আছে মানুষ। কিন্তু আমরা পরিবেশের এই অবদানের কথা বারবার ভুলে যাই আর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদ। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এই প্রবল কর্তৃত্ববাদকে প্রশ্ন করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

রাষ্ট্রের পরিবেশবান্ধব রূপান্তর আমরা চাই। পরিবেশগত সব অন্যায় বঞ্চনার ন্যায়বিচার ও অবসান চাই। মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহার করে দেশের সব বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণবৈচিত্র্যকে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এক নতুন সমাজ বির্নিমাণের স্বপ্ন দেখি আমরা। এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে মানুষের জন্য রাস্তা বানাতে গিয়ে জোর করে গাছ কেটে মা আর ছানা পাখিদের আলাদা করবে না। মানুষের জন্য ধান উৎপাদন করতে গিয়ে জমিতে বিষ দিয়ে কেঁচো, মাকড়সা ও ব্যাঙ খুন করবে না। এমন একটি সমাজ চাই যেখানে একটি বটগাছ কিংবা একজন রাজনীতিবিদ সমান নাগরিক অধিকার পাবেন। স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ শূন্য কার্বণ নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে মর্যাদা পাবে। শূন্য বর্জ্য কিংবা শূন্য দূষণ হবে আমাদের পরিচয়।

বিপ্লবী জেন-জি প্রজন্মের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে, দেয়াল লিখনে পরিবেশপ্রেমের বিষয়টিও তারা তুলে ধরছে। এই প্রজন্ম দায়িত্বশীল ও অদম্য থাকলে পরিবেশগত ন্যায়বিচার সুরক্ষিত হবে। পরিবেশ-বন ও জলবায়ুসহ বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের সম্মানিত বহু উপদেষ্টা পরিবেশ ন্যায়বিচার নিয়ে আজীবন সোচ্চার ও সক্রিয় ছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি তাদের অন্তরে প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি দায় ও দায়িত্বশীলতা বলিষ্ঠভাবেই আছে। পরিবেশ ও জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে নি¤œলিখিত প্রস্তবনা পেশ করছি। আশা করি রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার ও রূপান্তরে এইসব প্রস্তাব গুরুত্ব সহকারে যুক্ত হবে।

প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ ও পরিবেশ ন্যায়বিচার বিষয়ক প্রস্তাব:

প্রাণ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষায় রাষ্ট্র ‘ইকোসেন্ট্রিক (প্রতিবেশবাদী)’ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সকল প্রাণসত্তার/প্রাণবৈচিত্র্যের (প্রাকৃতিক ও জীনগতবৈচিত্র্য) অবদান এবং পরস্পরনির্ভরশীলতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বপ্রাণের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।

প্রাণবৈচিত্র্য, প্রতিবেশ ও পরিবেশসম্পর্কিত কর্মসূচিসহ রাষ্ট্রের সব উন্নয়নচিন্তায় প্রবলভাবে অধিষ্ঠিত কতৃর্ত্ববাদী ‘মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (এথনোপোসেন্ট্রিক)’ খারিজ করে সব উন্নয়নচিন্তা ও তৎপরতায় মানুষসহ সর্বপ্রাণের বৈচিত্র্যর অস্তিত্ব, বিকাশ ও অধিকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

দেশের জনগণের মতামত, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত আইনের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র/পরিবেশগত বৈচিত্র্য (ইকোসিস্টেম), বৃক্ষ, বন্যপ্রাণী সবার ব্যক্তিসত্তাকেই আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

সংবিধানের ১৮(ক) ধারাকে সংশোধন করে উল্লেখ করতে হবে, ‘...রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য প্রাণ-প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও পরিবেশের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রাণবৈচিত্র্য, জীনগতবৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র, দেশীয় বীজ সম্পদ, কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চল, বনাঞ্চল, বৃক্ষ, বন্যপ্রাণী, পাহাড়, গড়, বরেন্দ্র, চরাঞ্চল, দ্বীপ, টিলা, ঝিরি, বিল, ঝরনা, নদ-নদী, ছড়া, দীঘি, হাওর, বাঁওড়, খাল, উদ্যান, পার্ক, সবুজবলয়, উন্মুক্ত জনচত্বর, সাংস্কৃতিকভাবে সুরক্ষিত পবিত্র অঞ্চল, গ্রামীণ বন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা ও প্রাকৃতিক বিকাশের ধারাবাহিকতার নিরাপত্তা বিধান করিবেন’।

বন, পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আদিবাসীসহ স্থানীয় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত সম্পর্ক ও অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশগত জনব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

কৃষিপ্রতিবেশ, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, জলাভূমি বেদখল ও বিনষ্ট করে কোনো ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে না। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বিপন্নকারী সব নকশা, স্থাপত্য পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন তৎপরতাগুলো বাতিল করতে হবে। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে বিশ্বস্ত জনমত জরিপ, পরিবেশগত-প্রতিবেশগত-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব যাচাই নিশ্চিত করতে হবে এবং সব পরিকল্পনা ও প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে জনগণের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে।

আদিবাসীসহ বননির্ভর স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং জনগণের পূর্ব অনুমোদন, প্রস্তাব ও সুপারিশের ভিত্তিতে বনআইনের আমূল সংস্কার করতে হবে। পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র্য, নদী, জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্র ব্যবস্থাপনাসম্পর্কিত নীতি ও আইনসমূহ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে সংস্কার করে কার্যকর করতে হবে।

অবৈধ ও মিথ্যা বনমামলা বাতিল করে সর্বক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পরিবেশ ও বনসম্পর্কিত আইন ও বিচার কাঠামোকে জনবান্ধব করতে হবে।

সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশব্যাপী একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক-পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করতে হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। শিল্প ও রাসায়নিক দূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, দৃশ্যদূষণ, আলোকদূষণ, শব্দদূষণ রোধে দখলদার ও দূষণকারীদের আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রমাণিত প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ ধ্বংসকারীদের কোনোভাবেই পুনরায় কোনো সরকারি ও বেসরকারি কর্মসূচিতে পুনর্বাসন ও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

বৃক্ষ ও প্রাণীর সুনির্দিষ্ট তালিকাসহ আগ্রাসী (ইনভেসিভ/এলিয়েন স্পেসিস) প্রজাতি নিষিদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন নার্সারি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, বাগান, উদ্যান, সামাজিক বনায়ন, মৎস্য-পোল্ট্রি ও প্রাণিসম্পদ খামার থেকে ধারাবাহিকভাবে আগ্রাসী প্রজাতি হ্রাসকরণে সুনির্দিষ্ট জনপরিকল্পনা ও কর্মসূচি তৈরি করতে হবে।

নদী ও হাওর ব্যবস্থাপনা, বন্যপ্রাণী পাচার এবং দূষণ রোধে জনগণের সামনে সব তথ্য অবাধ ও উন্মুক্ত করে আন্তঃরাষ্ট্রিক কূটনীতিকে সক্রিয় করতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক খনন, বৃহৎ বাঁধ এবং উন্নয়ন অবকাঠামো, উজানের পানি প্রত্যাহার এবং অন্যায় নদীশাসনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিহত করতে হবে।

দেশব্যাপী উদ্যান, পার্ক, উন্মুক্ত জনচত্বর এবং সবুজবলয় সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকতে হবে। এসব জনসম্পদ ও অঞ্চল ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থী, নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ নগরবাসীকে স্থানীয় সরকারের কর্মতৎপরতায় যুক্ত করতে হবে।

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার সব সিলেবাস এবং পাঠ্যক্রমে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ অসংবেদনশীল কোনো কনটেন্ট এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাকে শিক্ষা ও শ্রেণী কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু ন্যায্যতাবিষয়ক প্রস্তাব :

জলবায়ু পরবির্তনের সংকট ও অভিঘাতকে গুরুত্ব দিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও দায়িত্ব যুক্ত করতে হবে। দেশের ভুক্তভোগী জনগণের সপক্ষে জলবায়ু ন্যায্যতা (ক্লাইমেট জাস্টিস) প্রতিষ্ঠাকে রাষ্ট্রের মৌলিক জলবায়ু-অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

খরা, তীব্র তাপদাহ, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা, পাহাড়ি ঢল, অকাল বন্যা, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ, বজ্রপাতসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সকল আপদ-বিপদকে সুনির্দিষ্টভাবে বিবেচনায় নিয়ে দেশের কৃষিপ্রতিবেশ ভিন্নতায় জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জনবান্ধব কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। জলবায়ু সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় এনে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তিকে (২০১৫) গুরুত্ব দিয়ে জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিযোজন চর্চা ও লোকায়ত জ্ঞানকে স্বীকৃতি দিয়ে জলবায়ু উপযোগী দেশীয় শস্যফসল ও স্থানীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতীয় অভিযোজন পদক্ষেপ ও নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকটাপন্ন গ্রামীণ সংস্কৃৃতি এবং শিল্পকর্ম বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে। এলাকাভিত্তিক অর্ন্তভুক্তিমূলক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

বৈশি^ক প্রশমন উদ্যোগসমূহ প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমানকরণ এবং বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের জলবায়ু-কূটনীতি জোরদার করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনে (কনফারেন্স অব পার্টিস/কপ) রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি দলে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, যুব সমাজ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে।

বহুজাতিক কোম্পানি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠাননির্ভর মিথ্যা জলবায়ু সমাধানগুলোকে কোনোভাবেই প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না এবং কার্বন-বাণিজ্যের মতো বিষয়কে উৎসাহিত করা যাবে না।

‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (২০০৯)’, ‘ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ এবং ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন’সহ জলবায়ু সংশ্লিষ্ট আইন, নথি, নীতি, পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও কর্মসূচিতে জনগণের মতামত, বাস্তবতা, সুপারিশ, উদ্যোগ এবং অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডসহ বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল, অভিযোজন তহবিল এবং অর্থায়নকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং সবক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

জলবায়ু পরির্বনের কারণে পেশার পরিবর্তনশীলতা ও স্থানান্তর এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ুর কারণে জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের জন্য নতুন অভিবাসনস্থল নিরাপদ করতে হবে এবং এসব মানুষের জন্য মর্যাদার কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু-উদ্বাস্তু হয়ে নগর এলাকায় বসবাসরত নগরদরিদ্রদের জন্য নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যকরণে এবং নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানি শক্তির রূপান্তরে জনবান্ধব জ্বালানি রূপান্তর কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। কৃষিজমি-জলাভূমি বিনষ্ট না করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গ্রাম ও নগরের দরিদ্র জনগণের প্রবেশাধিকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে।

[লেখক : গবেষক, পরিবেশ-প্রতিবেশ]

back to top