ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলায় প্রাণোস্পন্দের প্রধান রূপকার হচ্ছে নদী। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে সবুজ তেপান্তরের বুক চিরে শিরা-উপশিরার মতো রুপালি জলস্রোত নিয়ে বয়ে চলছে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ অসংখ্য নদ-নদী। এ দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জীবনবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই নদ-নদী। সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এই নদী শুধু প্রাকৃতিক ক্ষেত্রেই নয়, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারি প্রভাব রেখে চলেছে।
নদ বা নদীর কথা আসলেই আমাদের চোখে ভাসে উন্মুক্ত বিশাল এক জলরাশি কিংবা প্রত্যন্ত গাঁয়ের মাঝে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা জলস্রোত, যা প্রকৃতির টানে অবিরত ছুটে চলেছে সমুদ্রপানে। তবে এতদিন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় ছিল না নদ-নদীর আইনসিদ্ধ এবং সর্বজনস্বীকৃত কোনো সংজ্ঞার্থ। আর যে কারণে ধোঁয়াশা থেকেই যায় নদীর পরিচয়ে। এই ধোঁয়াশার কারণে দেশে নদ-নদী, খাল, বিল, জলাশয় ইত্যাদি নিয়ে সৃষ্টি হতে থাকে নানান আইনগত বিভেদ ও সমস্যা। যার ফলশ্রুতিতে নদী দখল, ভরাট থেকে শুরু করে নদ-নদী এবং জলাশয়সমূহ নানান অপব্যবহারের শিকার হতে থাকে। উদ্ভূত এ সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন। তারা নদ-নদীর একটি সুন্দর, আইনসিদ্ধ এবং সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞার্থ নির্ধারণে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের নদ-নদীর গতি-প্রকৃতি, মরফোলজি, টপোগ্রাফি, সেডিমেন্টেশন, ইত্যাদি বিষয়কে বিশদভাবে বিবেচনা করে এবং বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর-সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে এবং দেশের প্রচলিত আইন ও হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনা করে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সংজ্ঞার্থ প্রকাশ করে। এই সংজ্ঞার্থ নদীর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরতে সাম্যক ভূমিকা পালন করবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এই সংজ্ঞার্থ মতে, ‘নদ বা নদী বলতে পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরনা, ছড়া অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারা হতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়ে যে জলধারা সারাবছর বা বছরের কোনো কোনো সময় দুই তীরের মাঝ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলাধারায় পতিত হয় তাকে বুঝায়। তবে শর্ত থাকে যে, উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় যাই থাকুক না কেন ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, রিভিশনাল সার্ভে ও বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে রেকর্ডে নদ বা নদী হিসেবে পূর্বেই যা উল্লেখ রয়েছে তা নদ বা নদী হিসেবে গণ্য হবে।’ অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে গেলে কোনো নির্দিষ্ট উৎস হতে উৎপন্ন হয়ে যে জলধারা অন্য কোন বড় উৎস বা সমুদ্রে পতিত হয়, তাকেই নদ বা নদী বলে।
তবে কথা থেকে যায়। নদ কী আর নদী কী? দুটোই কি একই নাকি আলাদা? পার্থক্যটা কোথায়? সচরাচরভাবে কথিত আছে নদীর শাখা রয়েছে, কিন্তু নদ শাখাহীন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নদ-নদীর মাঝে কোনো মরফোলজিক্যাল বা টপোগ্রাফিক্যাল পার্থক্য নেই। যেমন ব্রহ্মপুত্র নদ হলেও কিন্তু তার শাখা নদী যমুনা ও শীতলক্ষ্যা। তাহলে মূল পার্থক্যটা কোথায়? নদ ও নদীর সঙ্গে শাখা থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুয়ের মাঝে যা পার্থক্য আছে, তা হলো ব্যাকরণগত। বাংলা ব্যাকরণমতে, বাংলা, হিন্দি, ফারসি ইত্যাদি ভাষার ক্ষেত্রে পুরুষবাচক শব্দ সাধারণত অ-কারান্ত এবং নারীবাচক শব্দ আ-কারান্ত কিংবা ই ও ঈ-কারান্ত হয়। যেমন- গায়ক (অ-কারান্ত)-গায়িকা (আ-কারান্ত, নামের শেষে আ আছে), কিশোর (অ-কারান্ত)-কিশোরী (ঈ-কারান্ত, নামের শেষে ঈ আছে ) তেমনিভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, মানব-মানবী, নদ-নদী ইত্যাদি। তাই যে সব নদীর নাম পুরুষবাচক অর্থাৎ অ-কারান্ত তারা নদ আর যে সব নদীর নাম নারীবাচক অর্থাৎ আ-কারান্ত বা ঈ, ই-কারান্ত তারা নদী। এই কারণে ব্রহ্মপুত্রের কিংবা আত্রাই-এর শাখা নদী থাকলেও এটি নদ।
জন্ম থেকে অদ্যাবধি মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো ভিত্তি এই নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সব নগর-জনপদ। তেমনি ভাবেই পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই নদীমাতৃক বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব হলো নদ-নদী। এ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে জালের মতো বিস্তার করে থাকা এসব নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা দুঃসাধ্যই বটে। বাংলাদেশের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এই পর্যন্ত হয়েছে অনেক গবেষণা এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনে কিছুটা পার্থক্য দেখা গেলেও মোটামুটি কাছাকাছি একটা ফলাফল পাওয়া যায়।
নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন-২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী : সংজ্ঞা ও সংখ্যা’-শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থে দেশের সব জেলা প্রশাসকের পাঠানো তথ্য, মাঠপর্যায়ের সার্ভে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দপ্তর/বিভাগ কর্তৃক প্রেরিত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা করে নদ-নদীর একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ১০০৮টি নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২২,১৫৫ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উল্লেখ করা হয় যে, এই তালিকাই চূড়ান্ত নয়, আরো কিছু নতুন নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ চলমান। নদী রক্ষা কমিশনের এই তালিকাকে বাংলাদেশের নদ-নদীর সরকারি তালিকা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা, যার দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার এবং ক্ষুদ্রতম নদী ময়মনসিংহের গাঙ্গিনা, যার দৈর্ঘ্য মাত্র ০.০৩২ কিলোমিটার বা ৩২ মিটার। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি (২২২টি) নদী প্রবাহিত হচ্ছে ঢাকা বিভাগে। জেলা বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি (৯৭টি) নদী প্রবাহিত হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলায়। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী জরিপ ২০২৩ অনুযায়ী, ৭৫৬টি নদী তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ জরিপে তারা ব্যবহার করেছে ১০ মিটার রেজ্যুলেশনের ২০২৩ সালের সেন্টিনেল-২ স্যাটেলাইট ইমেজ।
এছাড়াও ২০২৩ সালে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি) নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। তারা স্যাটেলাইট ইমেজ, জেলাভিত্তিক তথ্য এবং নদীরক্ষা কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের হিসাব মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে জীবিত নদীর সংখ্যা ৭৫৪টি। তার মাঝে সবচেয়ে বেশি নদী রয়েছে রংপুর বিভাগে ১২৪টি এবং সর্বনি¤œ রয়েছে বরিশাল বিভাগে ৬০টি। তাছাড়া ঢাকা বিভাগে ৯৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৩টি, খুলনা বিভাগে ১১৯টি, সিলেট বিভাগে ৯৫টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০০টি এবং রাজশাহী বিভাগে ৬৫টি নদী বয়ে চলেছে।
মানব সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশে নদী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। নদী বাংলার জনপদকে শুধু সমৃদ্ধই করে চলেছে তা নয়, এই নদ-নদীর অবদানেই বিশ্বের মানচিত্রে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক শান্তির অন্যতম স্পন্দন, কাশফুলের শুভ্রতায় সিক্ত কিংবা সতেজতার প্রাণোচ্ছ্বাস ভরা নদী দিনের পর দিন অক্সিজেনের মতো বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের রূপসী বাংলাকে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে সঠিক নদী শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং জলজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। তবেই নদী ঠিক মায়ের মতোই মমতার ছায়ায় আগলে রাখবে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশকে।
[লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা; তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস রংপুরে কর্মরত]
ফাতেমা জান্নাতুল ফেরদৌস সুরভী
সোমবার, ১৯ আগস্ট ২০২৪
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলায় প্রাণোস্পন্দের প্রধান রূপকার হচ্ছে নদী। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে সবুজ তেপান্তরের বুক চিরে শিরা-উপশিরার মতো রুপালি জলস্রোত নিয়ে বয়ে চলছে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ অসংখ্য নদ-নদী। এ দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জীবনবোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই নদ-নদী। সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এই নদী শুধু প্রাকৃতিক ক্ষেত্রেই নয়, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারি প্রভাব রেখে চলেছে।
নদ বা নদীর কথা আসলেই আমাদের চোখে ভাসে উন্মুক্ত বিশাল এক জলরাশি কিংবা প্রত্যন্ত গাঁয়ের মাঝে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা জলস্রোত, যা প্রকৃতির টানে অবিরত ছুটে চলেছে সমুদ্রপানে। তবে এতদিন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় ছিল না নদ-নদীর আইনসিদ্ধ এবং সর্বজনস্বীকৃত কোনো সংজ্ঞার্থ। আর যে কারণে ধোঁয়াশা থেকেই যায় নদীর পরিচয়ে। এই ধোঁয়াশার কারণে দেশে নদ-নদী, খাল, বিল, জলাশয় ইত্যাদি নিয়ে সৃষ্টি হতে থাকে নানান আইনগত বিভেদ ও সমস্যা। যার ফলশ্রুতিতে নদী দখল, ভরাট থেকে শুরু করে নদ-নদী এবং জলাশয়সমূহ নানান অপব্যবহারের শিকার হতে থাকে। উদ্ভূত এ সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন। তারা নদ-নদীর একটি সুন্দর, আইনসিদ্ধ এবং সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞার্থ নির্ধারণে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের নদ-নদীর গতি-প্রকৃতি, মরফোলজি, টপোগ্রাফি, সেডিমেন্টেশন, ইত্যাদি বিষয়কে বিশদভাবে বিবেচনা করে এবং বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর-সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে এবং দেশের প্রচলিত আইন ও হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনা করে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সংজ্ঞার্থ প্রকাশ করে। এই সংজ্ঞার্থ নদীর প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরতে সাম্যক ভূমিকা পালন করবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এই সংজ্ঞার্থ মতে, ‘নদ বা নদী বলতে পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরনা, ছড়া অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারা হতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়ে যে জলধারা সারাবছর বা বছরের কোনো কোনো সময় দুই তীরের মাঝ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলাধারায় পতিত হয় তাকে বুঝায়। তবে শর্ত থাকে যে, উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় যাই থাকুক না কেন ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, রিভিশনাল সার্ভে ও বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে রেকর্ডে নদ বা নদী হিসেবে পূর্বেই যা উল্লেখ রয়েছে তা নদ বা নদী হিসেবে গণ্য হবে।’ অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলতে গেলে কোনো নির্দিষ্ট উৎস হতে উৎপন্ন হয়ে যে জলধারা অন্য কোন বড় উৎস বা সমুদ্রে পতিত হয়, তাকেই নদ বা নদী বলে।
তবে কথা থেকে যায়। নদ কী আর নদী কী? দুটোই কি একই নাকি আলাদা? পার্থক্যটা কোথায়? সচরাচরভাবে কথিত আছে নদীর শাখা রয়েছে, কিন্তু নদ শাখাহীন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নদ-নদীর মাঝে কোনো মরফোলজিক্যাল বা টপোগ্রাফিক্যাল পার্থক্য নেই। যেমন ব্রহ্মপুত্র নদ হলেও কিন্তু তার শাখা নদী যমুনা ও শীতলক্ষ্যা। তাহলে মূল পার্থক্যটা কোথায়? নদ ও নদীর সঙ্গে শাখা থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। এই দুয়ের মাঝে যা পার্থক্য আছে, তা হলো ব্যাকরণগত। বাংলা ব্যাকরণমতে, বাংলা, হিন্দি, ফারসি ইত্যাদি ভাষার ক্ষেত্রে পুরুষবাচক শব্দ সাধারণত অ-কারান্ত এবং নারীবাচক শব্দ আ-কারান্ত কিংবা ই ও ঈ-কারান্ত হয়। যেমন- গায়ক (অ-কারান্ত)-গায়িকা (আ-কারান্ত, নামের শেষে আ আছে), কিশোর (অ-কারান্ত)-কিশোরী (ঈ-কারান্ত, নামের শেষে ঈ আছে ) তেমনিভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, মানব-মানবী, নদ-নদী ইত্যাদি। তাই যে সব নদীর নাম পুরুষবাচক অর্থাৎ অ-কারান্ত তারা নদ আর যে সব নদীর নাম নারীবাচক অর্থাৎ আ-কারান্ত বা ঈ, ই-কারান্ত তারা নদী। এই কারণে ব্রহ্মপুত্রের কিংবা আত্রাই-এর শাখা নদী থাকলেও এটি নদ।
জন্ম থেকে অদ্যাবধি মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো ভিত্তি এই নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সব নগর-জনপদ। তেমনি ভাবেই পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই নদীমাতৃক বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব হলো নদ-নদী। এ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে জালের মতো বিস্তার করে থাকা এসব নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা দুঃসাধ্যই বটে। বাংলাদেশের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এই পর্যন্ত হয়েছে অনেক গবেষণা এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনে কিছুটা পার্থক্য দেখা গেলেও মোটামুটি কাছাকাছি একটা ফলাফল পাওয়া যায়।
নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন-২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশের নদ-নদী : সংজ্ঞা ও সংখ্যা’-শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থে দেশের সব জেলা প্রশাসকের পাঠানো তথ্য, মাঠপর্যায়ের সার্ভে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দপ্তর/বিভাগ কর্তৃক প্রেরিত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা করে নদ-নদীর একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ১০০৮টি নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২২,১৫৫ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উল্লেখ করা হয় যে, এই তালিকাই চূড়ান্ত নয়, আরো কিছু নতুন নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ চলমান। নদী রক্ষা কমিশনের এই তালিকাকে বাংলাদেশের নদ-নদীর সরকারি তালিকা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা, যার দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার এবং ক্ষুদ্রতম নদী ময়মনসিংহের গাঙ্গিনা, যার দৈর্ঘ্য মাত্র ০.০৩২ কিলোমিটার বা ৩২ মিটার। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি (২২২টি) নদী প্রবাহিত হচ্ছে ঢাকা বিভাগে। জেলা বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি (৯৭টি) নদী প্রবাহিত হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলায়। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদী জরিপ ২০২৩ অনুযায়ী, ৭৫৬টি নদী তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ জরিপে তারা ব্যবহার করেছে ১০ মিটার রেজ্যুলেশনের ২০২৩ সালের সেন্টিনেল-২ স্যাটেলাইট ইমেজ।
এছাড়াও ২০২৩ সালে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি) নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। তারা স্যাটেলাইট ইমেজ, জেলাভিত্তিক তথ্য এবং নদীরক্ষা কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাদের হিসাব মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে জীবিত নদীর সংখ্যা ৭৫৪টি। তার মাঝে সবচেয়ে বেশি নদী রয়েছে রংপুর বিভাগে ১২৪টি এবং সর্বনি¤œ রয়েছে বরিশাল বিভাগে ৬০টি। তাছাড়া ঢাকা বিভাগে ৯৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৩টি, খুলনা বিভাগে ১১৯টি, সিলেট বিভাগে ৯৫টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০০টি এবং রাজশাহী বিভাগে ৬৫টি নদী বয়ে চলেছে।
মানব সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশে নদী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। নদী বাংলার জনপদকে শুধু সমৃদ্ধই করে চলেছে তা নয়, এই নদ-নদীর অবদানেই বিশ্বের মানচিত্রে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক শান্তির অন্যতম স্পন্দন, কাশফুলের শুভ্রতায় সিক্ত কিংবা সতেজতার প্রাণোচ্ছ্বাস ভরা নদী দিনের পর দিন অক্সিজেনের মতো বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের রূপসী বাংলাকে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে মিল রেখে সঠিক নদী শাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং জলজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। তবেই নদী ঠিক মায়ের মতোই মমতার ছায়ায় আগলে রাখবে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশকে।
[লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা; তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস রংপুরে কর্মরত]