মাছুম বিল্লাহ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সব স্তরের ও সব পেশার মানুষের আকাক্সক্ষা আকাশসম। যদিও তাদের পক্ষে সব সমস্যার আশু সমাধান বেশ কঠিন, কারণ এসব সমস্যা একদিন দুদিনে তৈরি হয়নি, একটি বা দুটি জায়গায় তৈরি হয়নি। সমস্যা দীর্ঘদিনের এবং সমস্যা সর্বস্তরে। তাই সরকারকে অগ্রাধিকারভিত্তিক সমাধান বের করতে হবে। সমস্যাগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে দূর করতে হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের পদক্ষেপ আশা করি। কতগুলো সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন এবং করাও যাবে, তারপর হাত দিতে হবে মধ্যমেয়াদি কিছু প্রকল্পে আর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য নির্দেশিকাসহ বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার উপদেশসমূহ রেখে যেতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সর্বাগ্রে যেটি করতে হবে সেটি হচ্ছে কারিকুলাম পরিবর্তন, যেটি একটি গণদাবি। নতুন কারিকুলাম চালুর নামে প্রায় দুটি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় দেড় মিলিয়নের বেশি শিক্ষার্থীদের এবং পুরো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের এক মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে।
বছরের আট মাস চলছে। নতুন কারিকুলামের ওপর লিখিত বইগুলো শিক্ষার্থীরা নাড়াচাড়া করছে এবং বাকি চার মাসের জন্য নতুন বই তৈরি করে বিতরণ করা সম্ভব নয়। নতুন কারিকুলামের ওপর লিখিত প্রাথমিকের সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য শিখনফল থেকে সহজেই প্রশ্ন তৈরি করা সম্ভব; কিন্তু মাধ্যমিকের শিখনফল না থাকায় এবং তার ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক রচিত না হওয়ার কারণে পাঠ্যবই সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য উপযোগী নয়। ফলে পিআই দিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মাধ্যমিকের পিআই এর সংখ্যা কম থাকায় তা দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করাও সম্ভব নয়। কারণ সেখানে ফলাবর্তন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে অধ্যায় শেষে, মাস শেষে প্রদান করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কোন রেকর্ড কিপিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি; যা প্রাথমিকে রাখা হয়েছে। তারপরেও আমাদের এই বই-ই পড়াতে হবে কারণ এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন কোন বই প্রস্তুত করা, ছাপানো ও বিতরণ করা সম্ভব নয়। আবার যে অবাস্তব ও অগোছালো পদ্ধতিতে মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছিল সেটিও সম্ভব নয়। তাই এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই সব বইয়ের কন্টেন্ট থেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন যেমনÑ প্রশ্নোত্তর, মাল্টিপল চয়েস, ম্যাচিং, সত্য/মিথ্যা, ব্যাখ্যা করা, শূন্যস্থান পূরণ, বাক্য সম্পূর্ণকরণসহ বহু ধরনের (যে চ্যাপ্টার ও বিষয়ে যেগুলো প্রযোজ্য সেগুলো দিয়ে) প্রশ্ন তৈরি করে পরীক্ষা নেয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। বিদ্যালয়ের শ্রেণীতে বারবার পরীক্ষা (পাক্ষিক ও মাসিক) নিতে বলতে হবে যেগুলোর উপর ৪০ শতাংশ নম্বর খাকবে। বাকি ৬০ শতাংশের ওপর বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিতে হবে যা হবে পুরোপুরি লিখিত। বার্ষিক পরীক্ষা মাউশি নভেম্বরের শেষের দিকে কিংবা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নেয়ার তারিখ ঘোষণা করতে পারে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে পূর্ববর্তী কারিকুলামের (২০২২ সালের বইয়ের) ওপর তৈরি বইপুস্তক বিশেষ করে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে লিখিত পরীক্ষা পরিচালনা করা হলে বর্তমানের সব ধরনের জটিলতা কমে যাবে; কারণ ওই বইগুলোর কন্টেন্টের ওপর শিক্ষকদের পরিচিতি আছে এবং তারা প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। তবে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমনভাবে তৈরি করার নির্দেশনা দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের নিজের চিন্তা করে লিখতে হয়। তারা সহকারী বা সাহায্যকারী পুস্তকের সাহায্য নিলেও শিক্ষার্থীদের যাতে নিজের চিন্তা করে উত্তর প্রদান করতে হয়, তাদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল যাতে শাণিত হয় প্রশ্নপত্র সেভাবে প্রণয়ন করার জন্য এনসিটিবি নির্দেশনা দিতে পারে। শ্রেণীকার্যক্রমেও জোর দিতে হবে এবং পাক্ষিক ও মাসিক পরীক্ষার নম্বর ও শ্রেণীতে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর শতকরা ৪০ নম্বর থাকা প্রয়োজন। লিখিত পরীক্ষায় ৬০শতাংশ নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদি কাজ শুরু করে দিতে পারে। তারপর এর সাথে শুরু হবে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ; যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী কারিকুলাম কিছুটা সংশোধন করে প্রতিটি বিষয়ে কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ নম্বর হবে পারফরম্যান্স বেজড অর্থাৎ অনেকটাই প্র্যাকটিক্যাল টাইপের আর লিখিত পরীক্ষায় ৭৫-৮০ শতাংশ নম্বর রাখা যেতে পারে। দেখা যায় একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে যাচ্ছেন অথচ জনসম্মুখে কথা বলতে পারছেন না। সেজন্য তাকে যোগাযোগ দক্ষতা ও উপস্থাপন দক্ষতা শিখতে হবে। সেটি শ্রেণীকক্ষে প্র্যাকটিস করানো হবে এবং তার ওপর নম্বর থাকবে। বাস্তব জ্ঞান অর্জন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান যে কোন বিষয়েই এ ধরনের একটি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা থাকবে এবং তাতে নম্বর থাকবে ২০-২৫ শতাংশ। একজন শিক্ষার্থী ভালো গান করেন অথচ তার সার্টিফিকেটের কোথাও তা লেখা থাকেন যদিও এটি একটি অন্যতম গুণ। সেটির জন্য নম্বর থাকবে। সবাই গান করতে পারবেন না, এটিই স্বাভাবিক কিন্তু শ্রেণীর অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ নাচতে পারেন, কেউ ভাল ছবি আঁকতে পারেন, কেউ ভালো নাটক করতে পারেন এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্য নম্বর থাকবে যা ওই ২৫ শতাংশের মধ্যে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকগুলো যথেষ্ট সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের দ্বারা লেখা ও সম্পাদনার কাজটি নিপুণভাবে করতে হবে। এখানে কোনভাবে পরিচিত, বন্ধু-বান্ধব এবং রাজনৈতিকভাবে পরিচিত শিক্ষকদের দিয়ে লেখানো ও সম্পাদন করা ঠিক হবে না। আমরা এত বছর এ ঘটনাগুলোই দেখেছি। এই তিনটি স্তরেই উদার মূল্যায়ন, সহজ প্রশ্ন, খ-িত সিলেবাস, বিতর্কিত কারিকুলাম, যেনতেনভাবে শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়ে গেছে। একজন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাশ করলে তার যা যা অর্জন করার কথা সেগুলো যাতে সে অর্জন করতে পারে। একইভাবে এসএসসি পাস করার পর একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যা আশা করা হয় তা যেন সে প্রদর্শন করতে পারেন। এজন্য শ্রেণীশিক্ষার গুরুত্ব, পরীক্ষার মানসম্মত প্রশ্ন প্রণয়ন, যাকে তাকে দ্বারা পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করানো অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র যথাযথ মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। এসব বিষয়ের যথাযথ মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
উচ্চ মাধ্যমিকের বাকি পরীক্ষাগুলো ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করার কথা ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে; নতুন করে প্রশ্ন তৈরি, ছাপা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ আর তার মাঝে প্রশ্নফাঁসের সত্যতা ও গুজব দুটিই কিন্তু বড় ধরনের থ্রেট। প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখার অনুরোধ করছি।
বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে ভিসি নিয়োগের পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে যে কোন একজনকে রাষ্ট্রপতি/চ্যান্সেলর নিয়োগ প্রদান করেন সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে। বাকিগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। শুধু পার্টি পরিচয়ে তাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি জীবনে একাডেমিক বিষয়ে কী অর্জন করেছেন, কিভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, পড়াশোনা ও গবেষণার সাথে কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা এগুলো না দেখে শুধু পার্টির গুণগান কতটা করতে পারেন তার ওপর নির্ভর করে ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়; যা একটি বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অভিশাপস্বরূপ। এ ধরনের লোকদের ভিসি হওয়া থেকে চিরতরে বন্ধ করতে হবে; আর এ কাজটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে যেতে হবে।
নির্বাচিত দলীয় সরকারের কাছ থেকে আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের নিরপেক্ষতা আশা করতে পারি না। ৪০টির মতো বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিরা ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন, তাদের জায়গাগুলো শর্ত দিয়ে দ্রুত পূরণ করতে হবে, কারণ ১৮ আগস্ট থেকে বিশ^বিদ্যালয়গুলোও খোলা হয়েছে। আর প্রতি জেলায় জেলায় বিশ^বিদ্যালয় করার কোন প্রয়োজন নেই। এতে বিশ^বিদ্যালয়ের মান রক্ষা করা এবং বিশ^বিদ্যালয়ের যে ধারণা সেটি রক্ষা করা যায় না।
আমাদের প্রতিষ্ঠিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে জমি ও ইনফ্রাস্টাকচার যা আছে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে এবং টার্গেট হতে হবে প্রচলিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা। ধানের জমি নষ্ট করে সব জেলার সাথে একটি স্কুল বা কলেজ টাইপের দুই-তিনিট বিল্ডিং স্থাপন করে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের ধারণা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতি থাকবে তবে সেটি হবে একমাত্র আদর্শভিত্তিক। প্রতিটি হলে একটি করে কমিটি বা সংসদ থাকবে যেখানে সব বর্ষের মেধাবী ও কালচারাল মাইন্ডের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকবে। কোন ধরনের রাজনৈতিক পার্টিভিত্তিক সংশ্লিষ্টতা প্রকাশের কোন সূত্র রাখা যাবে না।
[লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজউক কলেজ]
মাছুম বিল্লাহ
মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট ২০২৪
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সব স্তরের ও সব পেশার মানুষের আকাক্সক্ষা আকাশসম। যদিও তাদের পক্ষে সব সমস্যার আশু সমাধান বেশ কঠিন, কারণ এসব সমস্যা একদিন দুদিনে তৈরি হয়নি, একটি বা দুটি জায়গায় তৈরি হয়নি। সমস্যা দীর্ঘদিনের এবং সমস্যা সর্বস্তরে। তাই সরকারকে অগ্রাধিকারভিত্তিক সমাধান বের করতে হবে। সমস্যাগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে দূর করতে হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও আমরা একই ধরনের পদক্ষেপ আশা করি। কতগুলো সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন এবং করাও যাবে, তারপর হাত দিতে হবে মধ্যমেয়াদি কিছু প্রকল্পে আর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য নির্দেশিকাসহ বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার উপদেশসমূহ রেখে যেতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সর্বাগ্রে যেটি করতে হবে সেটি হচ্ছে কারিকুলাম পরিবর্তন, যেটি একটি গণদাবি। নতুন কারিকুলাম চালুর নামে প্রায় দুটি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় দেড় মিলিয়নের বেশি শিক্ষার্থীদের এবং পুরো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের এক মহাসংকটে ফেলে দিয়েছে।
বছরের আট মাস চলছে। নতুন কারিকুলামের ওপর লিখিত বইগুলো শিক্ষার্থীরা নাড়াচাড়া করছে এবং বাকি চার মাসের জন্য নতুন বই তৈরি করে বিতরণ করা সম্ভব নয়। নতুন কারিকুলামের ওপর লিখিত প্রাথমিকের সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য শিখনফল থেকে সহজেই প্রশ্ন তৈরি করা সম্ভব; কিন্তু মাধ্যমিকের শিখনফল না থাকায় এবং তার ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক রচিত না হওয়ার কারণে পাঠ্যবই সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য উপযোগী নয়। ফলে পিআই দিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মাধ্যমিকের পিআই এর সংখ্যা কম থাকায় তা দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করাও সম্ভব নয়। কারণ সেখানে ফলাবর্তন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে অধ্যায় শেষে, মাস শেষে প্রদান করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কোন রেকর্ড কিপিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি; যা প্রাথমিকে রাখা হয়েছে। তারপরেও আমাদের এই বই-ই পড়াতে হবে কারণ এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন কোন বই প্রস্তুত করা, ছাপানো ও বিতরণ করা সম্ভব নয়। আবার যে অবাস্তব ও অগোছালো পদ্ধতিতে মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছিল সেটিও সম্ভব নয়। তাই এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই সব বইয়ের কন্টেন্ট থেকেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন যেমনÑ প্রশ্নোত্তর, মাল্টিপল চয়েস, ম্যাচিং, সত্য/মিথ্যা, ব্যাখ্যা করা, শূন্যস্থান পূরণ, বাক্য সম্পূর্ণকরণসহ বহু ধরনের (যে চ্যাপ্টার ও বিষয়ে যেগুলো প্রযোজ্য সেগুলো দিয়ে) প্রশ্ন তৈরি করে পরীক্ষা নেয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। বিদ্যালয়ের শ্রেণীতে বারবার পরীক্ষা (পাক্ষিক ও মাসিক) নিতে বলতে হবে যেগুলোর উপর ৪০ শতাংশ নম্বর খাকবে। বাকি ৬০ শতাংশের ওপর বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিতে হবে যা হবে পুরোপুরি লিখিত। বার্ষিক পরীক্ষা মাউশি নভেম্বরের শেষের দিকে কিংবা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নেয়ার তারিখ ঘোষণা করতে পারে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে পূর্ববর্তী কারিকুলামের (২০২২ সালের বইয়ের) ওপর তৈরি বইপুস্তক বিশেষ করে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে লিখিত পরীক্ষা পরিচালনা করা হলে বর্তমানের সব ধরনের জটিলতা কমে যাবে; কারণ ওই বইগুলোর কন্টেন্টের ওপর শিক্ষকদের পরিচিতি আছে এবং তারা প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। তবে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমনভাবে তৈরি করার নির্দেশনা দিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের নিজের চিন্তা করে লিখতে হয়। তারা সহকারী বা সাহায্যকারী পুস্তকের সাহায্য নিলেও শিক্ষার্থীদের যাতে নিজের চিন্তা করে উত্তর প্রদান করতে হয়, তাদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল যাতে শাণিত হয় প্রশ্নপত্র সেভাবে প্রণয়ন করার জন্য এনসিটিবি নির্দেশনা দিতে পারে। শ্রেণীকার্যক্রমেও জোর দিতে হবে এবং পাক্ষিক ও মাসিক পরীক্ষার নম্বর ও শ্রেণীতে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর শতকরা ৪০ নম্বর থাকা প্রয়োজন। লিখিত পরীক্ষায় ৬০শতাংশ নম্বর থাকা বাঞ্ছনীয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদি কাজ শুরু করে দিতে পারে। তারপর এর সাথে শুরু হবে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ; যার মাধ্যমে পূর্ববর্তী কারিকুলাম কিছুটা সংশোধন করে প্রতিটি বিষয়ে কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ নম্বর হবে পারফরম্যান্স বেজড অর্থাৎ অনেকটাই প্র্যাকটিক্যাল টাইপের আর লিখিত পরীক্ষায় ৭৫-৮০ শতাংশ নম্বর রাখা যেতে পারে। দেখা যায় একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে যাচ্ছেন অথচ জনসম্মুখে কথা বলতে পারছেন না। সেজন্য তাকে যোগাযোগ দক্ষতা ও উপস্থাপন দক্ষতা শিখতে হবে। সেটি শ্রেণীকক্ষে প্র্যাকটিস করানো হবে এবং তার ওপর নম্বর থাকবে। বাস্তব জ্ঞান অর্জন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান যে কোন বিষয়েই এ ধরনের একটি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা থাকবে এবং তাতে নম্বর থাকবে ২০-২৫ শতাংশ। একজন শিক্ষার্থী ভালো গান করেন অথচ তার সার্টিফিকেটের কোথাও তা লেখা থাকেন যদিও এটি একটি অন্যতম গুণ। সেটির জন্য নম্বর থাকবে। সবাই গান করতে পারবেন না, এটিই স্বাভাবিক কিন্তু শ্রেণীর অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ নাচতে পারেন, কেউ ভাল ছবি আঁকতে পারেন, কেউ ভালো নাটক করতে পারেন এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্য নম্বর থাকবে যা ওই ২৫ শতাংশের মধ্যে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকগুলো যথেষ্ট সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের দ্বারা লেখা ও সম্পাদনার কাজটি নিপুণভাবে করতে হবে। এখানে কোনভাবে পরিচিত, বন্ধু-বান্ধব এবং রাজনৈতিকভাবে পরিচিত শিক্ষকদের দিয়ে লেখানো ও সম্পাদন করা ঠিক হবে না। আমরা এত বছর এ ঘটনাগুলোই দেখেছি। এই তিনটি স্তরেই উদার মূল্যায়ন, সহজ প্রশ্ন, খ-িত সিলেবাস, বিতর্কিত কারিকুলাম, যেনতেনভাবে শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষার মানকে তলানিতে নিয়ে গেছে। একজন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পাশ করলে তার যা যা অর্জন করার কথা সেগুলো যাতে সে অর্জন করতে পারে। একইভাবে এসএসসি পাস করার পর একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যা আশা করা হয় তা যেন সে প্রদর্শন করতে পারেন। এজন্য শ্রেণীশিক্ষার গুরুত্ব, পরীক্ষার মানসম্মত প্রশ্ন প্রণয়ন, যাকে তাকে দ্বারা পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করানো অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র যথাযথ মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। এসব বিষয়ের যথাযথ মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
উচ্চ মাধ্যমিকের বাকি পরীক্ষাগুলো ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করার কথা ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে; নতুন করে প্রশ্ন তৈরি, ছাপা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ আর তার মাঝে প্রশ্নফাঁসের সত্যতা ও গুজব দুটিই কিন্তু বড় ধরনের থ্রেট। প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখার অনুরোধ করছি।
বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে ভিসি নিয়োগের পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে যে কোন একজনকে রাষ্ট্রপতি/চ্যান্সেলর নিয়োগ প্রদান করেন সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে। বাকিগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। শুধু পার্টি পরিচয়ে তাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি জীবনে একাডেমিক বিষয়ে কী অর্জন করেছেন, কিভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, পড়াশোনা ও গবেষণার সাথে কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা এগুলো না দেখে শুধু পার্টির গুণগান কতটা করতে পারেন তার ওপর নির্ভর করে ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়; যা একটি বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অভিশাপস্বরূপ। এ ধরনের লোকদের ভিসি হওয়া থেকে চিরতরে বন্ধ করতে হবে; আর এ কাজটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে যেতে হবে।
নির্বাচিত দলীয় সরকারের কাছ থেকে আমরা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের নিরপেক্ষতা আশা করতে পারি না। ৪০টির মতো বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিরা ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন, তাদের জায়গাগুলো শর্ত দিয়ে দ্রুত পূরণ করতে হবে, কারণ ১৮ আগস্ট থেকে বিশ^বিদ্যালয়গুলোও খোলা হয়েছে। আর প্রতি জেলায় জেলায় বিশ^বিদ্যালয় করার কোন প্রয়োজন নেই। এতে বিশ^বিদ্যালয়ের মান রক্ষা করা এবং বিশ^বিদ্যালয়ের যে ধারণা সেটি রক্ষা করা যায় না।
আমাদের প্রতিষ্ঠিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে জমি ও ইনফ্রাস্টাকচার যা আছে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে এবং টার্গেট হতে হবে প্রচলিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা। ধানের জমি নষ্ট করে সব জেলার সাথে একটি স্কুল বা কলেজ টাইপের দুই-তিনিট বিল্ডিং স্থাপন করে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের ধারণা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতি থাকবে তবে সেটি হবে একমাত্র আদর্শভিত্তিক। প্রতিটি হলে একটি করে কমিটি বা সংসদ থাকবে যেখানে সব বর্ষের মেধাবী ও কালচারাল মাইন্ডের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ থাকবে। কোন ধরনের রাজনৈতিক পার্টিভিত্তিক সংশ্লিষ্টতা প্রকাশের কোন সূত্র রাখা যাবে না।
[লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজউক কলেজ]