alt

উপ-সম্পাদকীয়

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪

দেশ কেবলই এক রাজনৈতিক সংকটকাল অতিক্রম করার পথে। তার মধ্যেই আরেক প্রাকৃতিক সংকট ভর করেছে বন্যা। এখানেও মানুষের কূট-হস্তক্ষেপ যে নেই তা নয়। যেমন প্রতিবেশী দেশেগুলোর মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তির যথাযথ প্রয়োগ না করা।

যাই হোক, দেশের সমগ্র পূর্ব-অঞ্চল অর্থাৎ সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি হয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল এলাকা ভয়াবহ বন্যার শিকার। এই তো মাসখানেক আগে দেশের উত্তরবঙ্গের বিরাট অঞ্চলজুড়ে বন্যা হয়ে গেল। ফলে দাঁড়ানো ফসল পাট, আউশ ধান, তিল, চিনা, শাক-সবজি ও মরিচ ফসলের ক্ষতি হয়ে গেছে অপূরণীয়। এখন যে বৈরী আবহাওয়া তাতে আবারও বন্যা আসতে পারে। কারণ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ চলমান। ফলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে অস্বাভাবিক হারে।

আবহাওয়া দপ্তরের উপাত্ত মোতাবেক গত ১৯ আগস্ট ২০২৪ ফেনীর পরশুরামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩০৪ মিমি, খাগড়াছড়ির রামগড়ে ১৪৫ মিমি এবং কুমিল্লায় ২১০ মিমি। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জে যথাক্রমে ১৩৮ ও ১৬৩ মিমি করে।

হিসাবগুলো পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার। একই সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার বাগফায় ৩৭৫ মিমি, বিলোনিয়ায় ৩২৪ মিমি এবং গোমতী জেলার অমরপুরে ৩০৭ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া দপ্তরের উপাত্ত অনুযায়ী ২১ আগস্ট ২০২৪ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিগত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশের সবজায়গায়ই কমবেশি বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে চাঁদপুর ও কুমিল্লায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০ মিমি-এর বেশি। শ্রীমঙ্গলে এই পরিমাণ ৭৩মিমি।

বন্যার কারণে সবচেয়ে সংকটাপন্ন এলাকা নোয়াখালী এবং ফেনীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৪৪ এবং ৩১২ মিমি। এছাড়াও ময়মনসিংহ ও কুমারখালীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫২ এবং ১১১ মিমি। ২১ আগস্ট থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা০র আবাহাওয়ার পূর্বাভাষে বলা হয়েছে যে দেশব্যাপী হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হবে। মাঝারি বলতে ২৪ ঘন্টায় ১১-২২ মিমি। ভারি এবং অতিভারি বৃষ্টিপাতের জন্য এই পরিমাণ যথাক্রমে ৪৪-৮৮ মিমি এবং ৮৮ মিমি-এর বেশি।

অতএব বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের ভয়াবহ এ বন্যার শুরুটা মৌসুমি অতিবৃষ্টি বা ভারি বৃষ্টিপাত দিয়ে। ২১শে আগস্ট সকালে ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের একটি কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। সেটাও তাদের ভাষায় অতিবৃষ্টি বা ভারি বৃষ্টির কারণে। সেই পানি ফেনী নদী বা মুহুরী নদী দিয়ে নোয়খালী অঞ্চলে প্রবেশের সম্ভাবনা না থাকলেও ফেনীর গতকালের ৩১২ মিমি বৃষ্টিতো ভয়ের কারণ। তবে ডম্বুর বাঁধের পানি গোমতি নদী দিয়ে ভাটিতে মুরাদনগর, দেবিদ্বার, দাউদকান্দি ভাসিয়ে মেঘনায় পড়ছে। তার আগেই এই সমস্ত অঞ্চল বৃষ্টির পানিতে সয়লাব ছিল।

অতএব বাঁধ-খোলা পানি এই এলাকার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে। নদী বিধৌত বাংলাদেশে আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত বন্যা অনেকটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের ভালোর জন্যই প্রতিবছর পরিমিত বন্যা হওয়া দরকার; কিন্তু অস্বাভাবিক হলেই আমরা দুর্গতির শিকার হই। যদি পিছনে ফিরে দেখি। উনিশ শতকে ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫ এবং ১৮৯২ সালে মোট ছয়বার দেশব্যাপী প্রলয়ংকারী বন্যা হয়েছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত এ ধরনের বিপর্যয় দেখা গেছে মোট ১৮ বার। এর মধ্যে মহাবিপর্যয়ের বছর হিসেবে নিকট অতীত অর্থাৎ ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৭ এর কিছু তথ্য আমার নজরে এসেছে। ১৯৭৪ এর বন্যার চেহারা ভয়ানক ছিল; কিন্তু সেই বন্যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করায় আমরা সেটাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখি না। যাই হোক, ১৯৮৮ সালের বন্যা আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দেশের ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের (সারা দেশের ৬০ শতাংশ) বেশি এলাকা পানির নিচে চলে যায়। ৫০ থেকে ১০০ বছরে এ ধরনের বন্যা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। দেশব্যাপী ভারি বর্ষণ এবং একই সময়ে পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনার পানিবৃদ্ধি এই মহাপ্লাবনের কারণ ছিল। একই মাত্রার বন্যা দেখা দেয় ১৯৯৮ সালে। তবে এই বন্যারও স্থায়িত্ব ছিল দুই মাস। ২০০৭ সালের বন্যা হয় সেপ্টেম্বর মাসে। কিছুটা দেরি করে। দেশের প্রায় ৬৩ হাজার বর্গকিলোমিটার (৪২ শতাংশ) এলাকা প্লাবিত হয়।

উপাত্ত-দৃষ্টিতে মনে হয় উনিশ শতকের তুলনায় বিশ শতকের দিকে প্রলয়ংকারী বন্যার সংখ্যা বেড়েছে। কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে সহজেই দায়ী করা যায়। তবে এবারের বন্যার জন্য বিশেষজ্ঞরা পৃথিবীব্যাপী এল নিনো-লা নিনার প্রভাবকেও কিছুটা দায়ি করছেন। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা এল নিনো-লা নিনাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এবারের জানুয়ারির তাপমাত্রা ছিল এ যাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাই এল নিনোর প্রভাব (প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের বর্ধিত তাপমাত্রা যার প্রভাব আমাদের উপমহাদেশে পড়ে) ছিল চরম মাত্রায়। ফলে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি তাপমাত্রার কারণে উপমহাদেশে প্রথমে খরার প্রভাব ছিল বেশি। এল নিনোর পরেই আসে লা নিনা-এর প্রভাব। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলে তাপমাত্রা কমে যায় (শীতলীকরণ প্রক্রিয়া) এবং উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত বাড়তে থাকে। তাই দেশের পূর্বাঞ্চলসহ সারাদেশে বাড়তি বৃষ্টিপাত নিশ্চয়ই লা নিনারই কারণে বলা যায়। এবং এই বাড়তি বৃষ্টিপাতই এবারের বন্যার কারণ বলে অনেকে মনে করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন-এর অধ্যাপক নাভিদ সালেহ তার এক লেখায় ২০২২ সালে প্রকাশিত আইআইটি খড়গপুর ও পুনার আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীদের রেফারেন্স দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে- এই শীতলীকরণের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক থাকতে পারে (দৈনিক সমকাল, ২১ আগস্ট ২০২৪)।

বন্যায় সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিকাংশ অধিবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কৃষি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। কারণ এই বন্যা হঠাৎ করেই এসেছে। পানির গভীরতাও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। ফলে ব্যাপক এলাকার ফসলের মাঠ-ঘাট ডুবে গেছে। বন্যার পানির গভীরতা বেশি হয় এবং পানি নামতে যদি সময় বেশি নেয় তাহলে জলমগ্নসহনশীল ধানের জাতও টিকে থাকতে পারবে না। শাক-সবজির অবস্থা একই রকম হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষিবিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বেঁচে থাকা ধানের চারার যতœ করা জরুরি। পাতায় পলি জমি থাকতে পারে। সেগুলো পানি স্প্রে করে পরিষ্কার করা যেতে পারে। বন্যার পানি যদি মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী হয় তাহলে সাধারণ উফশী ধানের জাত বেঁচে যেতে পারে। তবে জলমগ্ন সহনশীল কিছু জাত যেমন ব্রি-ধান ৫১, ব্রি-ধান ৫২, ব্রি-ধান ৭৯, বিনা ধান ১১ এবং বিনা ধান ১২ দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত জলমগ্ন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে; কিন্তু পানি বেশি ঘোলা হওয়া চলবে না এবং অতিরিক্ত গরমও হওয়া চলবে না। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই সার প্রয়োগ করা যাবে না। পানি নেমে যাওয়ার পর যখন নতুন পাতা গজাতে শুরু করবে তখনই বিঘে প্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া, ৬ কেজি ডিএপি এবং ৮ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এখন ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ প্রায় শুরু।

এ অবস্থায় নতুন করে চারা করে ধান করার সুযোগ নেই। যদি উঁচু বীজতলায় আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে নাবি জাতগুলোর (ব্রি-ধান ২২, ব্রি-ধান ২৩ এবং ব্রি-ধান ৪৬) চারা থাকে তবে সেগুলো ভাদ্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রোপণ করা চলবে। কিন্তু এ অবস্থায় চারা হয়তো পাওয়া যাবে না। তাই আমার পরামর্শ হলো পরবর্তী বছরগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অবশ্যই এ ধরনের জাতগুলো হাতে নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। পরবর্তী বোরো ফসল সময় মতো প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বন্যা-পরবর্তী ফসল অবশ্যই স্বল্পজীবনকালীন হতে হবে। এজন্য সরিষা, মাসকালাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে।

একইভাবে গিমা কলমি, ডাঁটা, পালং শাক ইত্যাদির চাষ করা সম্ভব। ভিটেবাড়ির আঙিনা বা রাস্তার পাশের জায়গাগুলো শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।

চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে অবশ্যই ভালো নেই। তাই তাদের কৃষি-কাজে সহায়তার জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়াও বন্যা উপদ্রুত চাষিদের জন্য পরবর্তী বছর থেকে যদি কৃষিবিমা চালু করা যায় তাহলে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে।

এ ধরনের বিপদ-বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তাই এগুলোকে সহজভাবে নিতে পারলে ভালো। কারণ বন্যা শুধুমাত্র আমাদের ক্ষতিই করে না; উপকারও করে থাকে। যেমন বন্যার পানি আমাদের অপরিচ্ছন্ন এবং দূষিত পরিবেশকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়। পানির সাথে ভেসে আসা কোটি কোটি টন পলি আমাদের জমিকে সমৃদ্ধ করে। পাশাপাশি নদীর মোহনায় নতুন দ্বীপ তৈরি করে। আমাদের জীবনে এগুলোর উপকারিতা কি হিসেব দিয়ে প্রমাণ করা চলে?

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪

দেশ কেবলই এক রাজনৈতিক সংকটকাল অতিক্রম করার পথে। তার মধ্যেই আরেক প্রাকৃতিক সংকট ভর করেছে বন্যা। এখানেও মানুষের কূট-হস্তক্ষেপ যে নেই তা নয়। যেমন প্রতিবেশী দেশেগুলোর মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তির যথাযথ প্রয়োগ না করা।

যাই হোক, দেশের সমগ্র পূর্ব-অঞ্চল অর্থাৎ সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি হয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল এলাকা ভয়াবহ বন্যার শিকার। এই তো মাসখানেক আগে দেশের উত্তরবঙ্গের বিরাট অঞ্চলজুড়ে বন্যা হয়ে গেল। ফলে দাঁড়ানো ফসল পাট, আউশ ধান, তিল, চিনা, শাক-সবজি ও মরিচ ফসলের ক্ষতি হয়ে গেছে অপূরণীয়। এখন যে বৈরী আবহাওয়া তাতে আবারও বন্যা আসতে পারে। কারণ বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ চলমান। ফলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে অস্বাভাবিক হারে।

আবহাওয়া দপ্তরের উপাত্ত মোতাবেক গত ১৯ আগস্ট ২০২৪ ফেনীর পরশুরামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩০৪ মিমি, খাগড়াছড়ির রামগড়ে ১৪৫ মিমি এবং কুমিল্লায় ২১০ মিমি। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জে যথাক্রমে ১৩৮ ও ১৬৩ মিমি করে।

হিসাবগুলো পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার। একই সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার বাগফায় ৩৭৫ মিমি, বিলোনিয়ায় ৩২৪ মিমি এবং গোমতী জেলার অমরপুরে ৩০৭ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া দপ্তরের উপাত্ত অনুযায়ী ২১ আগস্ট ২০২৪ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিগত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশের সবজায়গায়ই কমবেশি বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে চাঁদপুর ও কুমিল্লায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০ মিমি-এর বেশি। শ্রীমঙ্গলে এই পরিমাণ ৭৩মিমি।

বন্যার কারণে সবচেয়ে সংকটাপন্ন এলাকা নোয়াখালী এবং ফেনীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৪৪ এবং ৩১২ মিমি। এছাড়াও ময়মনসিংহ ও কুমারখালীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫২ এবং ১১১ মিমি। ২১ আগস্ট থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা০র আবাহাওয়ার পূর্বাভাষে বলা হয়েছে যে দেশব্যাপী হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হবে। মাঝারি বলতে ২৪ ঘন্টায় ১১-২২ মিমি। ভারি এবং অতিভারি বৃষ্টিপাতের জন্য এই পরিমাণ যথাক্রমে ৪৪-৮৮ মিমি এবং ৮৮ মিমি-এর বেশি।

অতএব বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের ভয়াবহ এ বন্যার শুরুটা মৌসুমি অতিবৃষ্টি বা ভারি বৃষ্টিপাত দিয়ে। ২১শে আগস্ট সকালে ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের একটি কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। সেটাও তাদের ভাষায় অতিবৃষ্টি বা ভারি বৃষ্টির কারণে। সেই পানি ফেনী নদী বা মুহুরী নদী দিয়ে নোয়খালী অঞ্চলে প্রবেশের সম্ভাবনা না থাকলেও ফেনীর গতকালের ৩১২ মিমি বৃষ্টিতো ভয়ের কারণ। তবে ডম্বুর বাঁধের পানি গোমতি নদী দিয়ে ভাটিতে মুরাদনগর, দেবিদ্বার, দাউদকান্দি ভাসিয়ে মেঘনায় পড়ছে। তার আগেই এই সমস্ত অঞ্চল বৃষ্টির পানিতে সয়লাব ছিল।

অতএব বাঁধ-খোলা পানি এই এলাকার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে। নদী বিধৌত বাংলাদেশে আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত বন্যা অনেকটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের ভালোর জন্যই প্রতিবছর পরিমিত বন্যা হওয়া দরকার; কিন্তু অস্বাভাবিক হলেই আমরা দুর্গতির শিকার হই। যদি পিছনে ফিরে দেখি। উনিশ শতকে ১৮৪২, ১৮৫৮, ১৮৭১, ১৮৭৫, ১৮৮৫ এবং ১৮৯২ সালে মোট ছয়বার দেশব্যাপী প্রলয়ংকারী বন্যা হয়েছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত এ ধরনের বিপর্যয় দেখা গেছে মোট ১৮ বার। এর মধ্যে মহাবিপর্যয়ের বছর হিসেবে নিকট অতীত অর্থাৎ ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৭ এর কিছু তথ্য আমার নজরে এসেছে। ১৯৭৪ এর বন্যার চেহারা ভয়ানক ছিল; কিন্তু সেই বন্যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করায় আমরা সেটাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখি না। যাই হোক, ১৯৮৮ সালের বন্যা আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দেশের ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটারের (সারা দেশের ৬০ শতাংশ) বেশি এলাকা পানির নিচে চলে যায়। ৫০ থেকে ১০০ বছরে এ ধরনের বন্যা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। দেশব্যাপী ভারি বর্ষণ এবং একই সময়ে পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনার পানিবৃদ্ধি এই মহাপ্লাবনের কারণ ছিল। একই মাত্রার বন্যা দেখা দেয় ১৯৯৮ সালে। তবে এই বন্যারও স্থায়িত্ব ছিল দুই মাস। ২০০৭ সালের বন্যা হয় সেপ্টেম্বর মাসে। কিছুটা দেরি করে। দেশের প্রায় ৬৩ হাজার বর্গকিলোমিটার (৪২ শতাংশ) এলাকা প্লাবিত হয়।

উপাত্ত-দৃষ্টিতে মনে হয় উনিশ শতকের তুলনায় বিশ শতকের দিকে প্রলয়ংকারী বন্যার সংখ্যা বেড়েছে। কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে সহজেই দায়ী করা যায়। তবে এবারের বন্যার জন্য বিশেষজ্ঞরা পৃথিবীব্যাপী এল নিনো-লা নিনার প্রভাবকেও কিছুটা দায়ি করছেন। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা এল নিনো-লা নিনাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এবারের জানুয়ারির তাপমাত্রা ছিল এ যাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাই এল নিনোর প্রভাব (প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের বর্ধিত তাপমাত্রা যার প্রভাব আমাদের উপমহাদেশে পড়ে) ছিল চরম মাত্রায়। ফলে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি তাপমাত্রার কারণে উপমহাদেশে প্রথমে খরার প্রভাব ছিল বেশি। এল নিনোর পরেই আসে লা নিনা-এর প্রভাব। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলে তাপমাত্রা কমে যায় (শীতলীকরণ প্রক্রিয়া) এবং উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত বাড়তে থাকে। তাই দেশের পূর্বাঞ্চলসহ সারাদেশে বাড়তি বৃষ্টিপাত নিশ্চয়ই লা নিনারই কারণে বলা যায়। এবং এই বাড়তি বৃষ্টিপাতই এবারের বন্যার কারণ বলে অনেকে মনে করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন-এর অধ্যাপক নাভিদ সালেহ তার এক লেখায় ২০২২ সালে প্রকাশিত আইআইটি খড়গপুর ও পুনার আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীদের রেফারেন্স দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন যে- এই শীতলীকরণের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক থাকতে পারে (দৈনিক সমকাল, ২১ আগস্ট ২০২৪)।

বন্যায় সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিকাংশ অধিবাসীদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কৃষি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা। কারণ এই বন্যা হঠাৎ করেই এসেছে। পানির গভীরতাও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। ফলে ব্যাপক এলাকার ফসলের মাঠ-ঘাট ডুবে গেছে। বন্যার পানির গভীরতা বেশি হয় এবং পানি নামতে যদি সময় বেশি নেয় তাহলে জলমগ্নসহনশীল ধানের জাতও টিকে থাকতে পারবে না। শাক-সবজির অবস্থা একই রকম হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষিবিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বেঁচে থাকা ধানের চারার যতœ করা জরুরি। পাতায় পলি জমি থাকতে পারে। সেগুলো পানি স্প্রে করে পরিষ্কার করা যেতে পারে। বন্যার পানি যদি মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী হয় তাহলে সাধারণ উফশী ধানের জাত বেঁচে যেতে পারে। তবে জলমগ্ন সহনশীল কিছু জাত যেমন ব্রি-ধান ৫১, ব্রি-ধান ৫২, ব্রি-ধান ৭৯, বিনা ধান ১১ এবং বিনা ধান ১২ দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত জলমগ্ন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে; কিন্তু পানি বেশি ঘোলা হওয়া চলবে না এবং অতিরিক্ত গরমও হওয়া চলবে না। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই সার প্রয়োগ করা যাবে না। পানি নেমে যাওয়ার পর যখন নতুন পাতা গজাতে শুরু করবে তখনই বিঘে প্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া, ৬ কেজি ডিএপি এবং ৮ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। এখন ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ প্রায় শুরু।

এ অবস্থায় নতুন করে চারা করে ধান করার সুযোগ নেই। যদি উঁচু বীজতলায় আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে নাবি জাতগুলোর (ব্রি-ধান ২২, ব্রি-ধান ২৩ এবং ব্রি-ধান ৪৬) চারা থাকে তবে সেগুলো ভাদ্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রোপণ করা চলবে। কিন্তু এ অবস্থায় চারা হয়তো পাওয়া যাবে না। তাই আমার পরামর্শ হলো পরবর্তী বছরগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অবশ্যই এ ধরনের জাতগুলো হাতে নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। পরবর্তী বোরো ফসল সময় মতো প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বন্যা-পরবর্তী ফসল অবশ্যই স্বল্পজীবনকালীন হতে হবে। এজন্য সরিষা, মাসকালাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে।

একইভাবে গিমা কলমি, ডাঁটা, পালং শাক ইত্যাদির চাষ করা সম্ভব। ভিটেবাড়ির আঙিনা বা রাস্তার পাশের জায়গাগুলো শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।

চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে অবশ্যই ভালো নেই। তাই তাদের কৃষি-কাজে সহায়তার জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়াও বন্যা উপদ্রুত চাষিদের জন্য পরবর্তী বছর থেকে যদি কৃষিবিমা চালু করা যায় তাহলে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে।

এ ধরনের বিপদ-বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তাই এগুলোকে সহজভাবে নিতে পারলে ভালো। কারণ বন্যা শুধুমাত্র আমাদের ক্ষতিই করে না; উপকারও করে থাকে। যেমন বন্যার পানি আমাদের অপরিচ্ছন্ন এবং দূষিত পরিবেশকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়। পানির সাথে ভেসে আসা কোটি কোটি টন পলি আমাদের জমিকে সমৃদ্ধ করে। পাশাপাশি নদীর মোহনায় নতুন দ্বীপ তৈরি করে। আমাদের জীবনে এগুলোর উপকারিতা কি হিসেব দিয়ে প্রমাণ করা চলে?

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top