alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

কাজী সালমান শীশ

: শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪

আমরা মানুষরা সারাজীবন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হই এবং নিজেরা লাখ লাখ প্রশ্ন করি। একজন মানব শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে কোনো ভাষা শিখে আসে না। বছর পাঁচেকের মধ্যে শিশুটি তার মাতৃভাষা মোটামুটি শিখে ফেলে। একেবারে ছোটবেলায় আকার ইঙ্গিতে, পরে ভাষার সাহায্যেঅগণিত প্রশ্নের মাধ্যমে তার প্রত্যহিক জ্ঞানবৃদ্ধি হতে থাকে। পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতার ভাবের আদান প্রদান তো আছেই, এছাড়া শিশুরা নানাবিধ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়, অসাবধানতায় গ্লাস ভেঙে ফেলে, মারামারি করে ব্যথা পায়, পিঁপড়া কামড় দেয়, গরম কিছু স্পর্শ করে হাত পুড়ে যায়Ñ এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো থেকে সে জ্ঞান আহরণ করে। উচিত-অনুচিত শিক্ষা সে পায় প্রতিদিনের ঘটনা থাকে।

বাচ্চাদের বাবা-মা, স্বজনরা মুখে যতই সাবধান করুক, মূলত তাদের বিচারবুদ্ধি গড়ে ওঠে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে। কথা শেখার পর শহরে বা গ্রামে যে যেখানেই থাকুক শিশুরা বড়দের প্রশ্নে জর্জরিত করে জ্ঞান লাভ করতে থাকে। বড়রা কখনো ঠা-া মাথায়, কখনো ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের অপরিপক্ব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে থাকে। মানব শিশু না হয়ে অন্য প্রাণী হলে তাদের ভাষাগতভাবে এত প্রশ্ন করতে বা জবাব শুনতে হতো না। অন্যান্য প্রাণীরা অবশ্যই আলাদা ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, একত্রে অনুকূলে থাকে। সেটা না হলে জঙ্গলের পশু, পানির মাছ, আকাশের পাখি ও মাটির তলের পোকা-সরিসৃপরা সঙ্গবদ্ধভাবে বাঁচতে পারত না। তাদের জীবনের চাহিদা ও প্রাপ্তি যেহেতু মৌলিক চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই তাদের বিজ্ঞান, ইতিহাস ও অংকের হাজার হাজার প্রশ্নের ব্যাখ্যা জানার প্রয়োজন পড়ে না।

মানুষের সা¤্রাজ্য ও প্রতাপ পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণীর থেকে বেশি। যুগে যুগে মানুষ এমন সকল যান ও যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যা রূপকথার গল্পকেও হারমানায়। বিমানের চড়ে সে যেমন আকাশে উড়তে পারে, পাশাপাশি গভীর সমুদ্রের নিচে চলচাল করতে পারে সাবমেরিনে বসে। সকলের পকেটে পকেটে মোবাইল ফোন যা দিয়ে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ভিডিওসহ কথা বলতে পারে পরস্পরের সাথে। মানুষ কম্পিউটার উদ্ভাবন করেছে যেখানেকোটি কোটি বই, ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়। এখন গবেষণা চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। মানুষ এখনো ল্যাবরেটরিতে মানুষ তৈরি করতে পারেনি, তবে পেরেছে উচ্চবুদ্ধিমাত্তার রোবট বানাতে। জিনগতভাবে সদৃশ্যপূর্ণ জীব বা ক্লোন তৈরি করার বিষয়েও অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এখন জৈবিক ক্রিয়া ছাড়া মুরগির ডিমদেয়, অন্যের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারে, ক্লিনিক্যালি ডেড মানুষকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে। একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের অভাবনীয় উদ্ভাবন সম্পর্কে সকলেরই কমবেশি জানা। প্রসঙ্গ ছিল মানুষের প্রশ্ন করা নিয়ে।

‘শব্দ’ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি। বিগব্যাং থেকে শুরু করে, মা-কে মা বলে ডাকা সকল কিছুর সাথেই শব্দ বা আওয়াজ জড়িত। শব্দের বৈজ্ঞানিক দিক আলোচনার একটি বিশাল বিষয়বস্তু। ফিরে আসা যাক মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার সম্পর্কে। মানুষ প্রশ্ন ক’রে অনেক কথার উত্তর জেনে যায়। কিছু কথা যুক্তিসঙ্গত, কিছু কথা ভুল, মিথ্যা বা কাল্পনিক। প্রশ্নকারী তার প্রশ্নের সন্তোষজনকজবাব পেলে তা সে জ্ঞানকোষে নিয়ে নেয়। সেই জ্ঞান আবার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। একজন শিশু তার দাদী-নানীর কাছে বৃষ্টির রাতে ভূতের গল্প শুনে ভয় ও আনন্দ পায়। প্রাথমিকভাবে কল্পনার ভূতকে সে বিশ্বাস করে। এরপর চলে আসে জিন-পরীর কথাÑ যেগুলো সম্পর্কে অনেক ধর্মগ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে।

ধর্মগ্রন্থ নিয়ে যেহেতু কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ তাই বহু পরিবারে বাবা-মা জিনের অস্তিত্বে সরাসরি বিশ্বাস করে এবং সন্তানদের বোঝায়Ñ ‘ভূত বলে কিছু না থাকলেও জিন আছে। জিন আগুনের তৈরি, মানুষ তৈরি হয়েছে মাটি থেকে।’ খারাপ আত্মা, ভালো আত্মা, জিন, পরী, ফেরেশতা, শয়তান এরকম অসংখ্য সংস্কার রয়েছে যা মানুষ শত শত বছর ধরে অস্পষ্টভাবে বিশ্বাস করে আসছে। শিশুটি নিষ্পাপ অবস্থায় কথাগুলো সরাসরি বিশ্বাস করে থাকলেও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেটা পরিবর্তন হতে থাকে। পরিণত বয়সে কারো বিশ্বাস আরো গাঢ় হয়, কারো বিশ্বাস কমে যায়। ছোটকালের প্রশ্ন-উত্তর জ্ঞানে ভূতের অস্তিত্ব থাকলেও বড়কালে তা নাও থাকতে পারে, তবে সে কারণে সে তার দাদি-নানিকে মিথ্যাবাদী ভাবে না। সেই ভাবনা চলে আসে একটা মিষ্টি নস্টালজিক অংশে। মানুষের সাথে রোবটের এটা একটা বড় পার্থক্য।

অংকের যোগ-বিয়োগ ও সর্বোচ্চ যুক্তির বাইরেও যে চেতনা কাজ করতে পারে, তা অনুধাবন করতে সক্ষম মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী। বুদ্ধিমান রোবট তা এখনো পারে না (আমার জানা মতে)। মানুষ প্রশ্ন করে- বই পড়ে, ছবি দেখে ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমাত্তা শিখে মানুষ তার ভেতর যেসকল তথ্য ও গুণাবলী ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে তার ভিত্তিতে। সুতরাং ভালোবাসা, মায়া, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতি যদি রোবটের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভবও হয়, তবু সে মানুষের মতো আচরণ করবে না। মানুষ তো দূরের কথা মনিব ভক্ত কোনো উন্নত প্রজাতির কুকুরের মতো চিন্তা করাও রোবটের পক্ষে সম্ভব না। ভুলে গেলে চলবে না মানুষ প্রকৃতির সরাসরি সৃষ্টি, আর রোবটের স্রষ্টা মানুষ। মানুষকে ছাড়িয়ে রোবটমেরি শেলির কল্পনার ফ্যাঙ্কানস্টাইনের (১৮১৮) মতো শক্তিশালী ও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তাও সে মানুষ হবে না। ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যেকটা প্রাণীই আলাদা এবং নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময়। মানুষের ক্ষেত্রে কখনো দেখা যায়Ñ অনেক বড় বিজ্ঞানীও বিশ্বাস করে তাবিজ, মন্ত্র বা হোলি ওয়াটারে, কিংবা দুর্বলচিত্তের মানুষও খুন করতে পারে ঠা-া মাথায়। ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ হলেও বাস্তব জীবনে এমনটা দেখা যায় প্রায়শই।

মানুষ ভুল তথ্য জানে, ভুল করে, আবার সেই ভুল থেকে নিজেই শিক্ষাগ্রহণ করে। যোগাযোগের নানা আধুনিক পদ্ধতি আসলেও আদি-যোগাযোগের মাধ্যম রয়ে গেছে কথা বলার মাধ্যমে। কথা বলা বলতে একেঅপরের সাথে ভাব-বিনিময়, তর্ক-সৌহার্দ, নির্দেশ-উপদেশ, সর্বপরি প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে জ্ঞানের ঐশ্বর্যের ক্ষতি বা বৃদ্ধি। হাজার মতের সংঘাত ঘটে, হাজার নতুন চিন্তার জন্ম নেয়। মানুষের যদি বাকশক্তি এত বিস্তৃত না হতো, তাহলে মাত্র কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যে পুরো একটি গ্রহকে শাসন করতে পারত না। অন্য প্রাণীরা যেমন ডিনামাইট তৈরি করে প্রাকৃতিক পাহাড় ধ্বংস করতে পারে না, তেমনি পারে না গুটি বসন্তের মতো মরণঘাতী মহামারী রোগকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দিতে। সহজেই আন্দাজ করা যায় মানুষ মস্তিষ্ককে যেভাবে কাজে লাগতে পেরেছে, অন্য কোনো প্রাণী তা পারেনি। এই অগ্রগামিতার প্রাথমিক দিক বিবেচনা করলে অবশ্যই চলে আসবে প্রশ্ন করে উত্তর জানার ব্যাপারটি। লাইব্রেরি, কম্পিউটার বা দুরূহ রাস্তা মানুষকে যতই জ্ঞানী করে তুলুক, অন্যের মুখ থেকে যেসব বাণী শুনে সে জ্ঞান অর্জন করে তার বিকল্প নেই (এখন পর্যন্ত)।

মানুষ কি শুধুই অজানাকে জানতে প্রশ্ন করে?

উত্তর হচ্ছে ‘না’। কথা বললে মানুষের মন হালকা হয়। অক্সিজেন গ্রহণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ যেমন একটি ব্যাপার, ঠিক তেমনি কথা বলে মনের আবেগ, আনন্দ, যন্ত্রণা, সাফল্য, ব্যর্থতা, দুঃখ ইত্যাদি প্রকাশ করাও মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। হড়বড় করে শুধু মনের কথা বলে গেলে তা অল্প সময়েই ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। মানুষের কথা যখন আরেকজন শোনে, কৌতুহলী হয়ে আবার প্রশ্ন করে, তখন সে আরো বিস্তারিতভাবে মনের রাগ, ক্ষোভ, ভালোবাসা, প্রাপ্তি ও ঘটে যাওয়া ঘটনা ব্যক্ত করে থাকে। সেকারণে সারাবিশ্বে আড্ডা একটি জনপ্রিয় বিষয়। আড্ডায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জ্ঞানচর্চার থেকে বেশি হয় পরচর্চা, সমালোচনা ও বিতর্ক। অপ্রয়োজনীয় অনেক কথা বলতে পেরে মানুষের মন শীতল হয়; সে আবার সময় খরচ করে পরেরদিন/অবসর সময়ে বসে আড্ডা দিতে–সেই বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত, অর্ধপরিচিতদের সঙ্গে। উদ্ভট উদ্ভট প্রসঙ্গ আসে এবং একেকজন জবাব দেয়, আলোচনা করে। যেন প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে হেরে যাবে! কোনোদিন সমুদ্রতলে না-গিয়ে, ধর্ম সম্পর্কে না জেনে, সরাসরি প্রেম না-করে, ক্রিকেট না খেলে, সেসব বিষয় সম্পর্কে অবলীলায় কথা হতে থাকে আড্ডায়। প্রশ্ন-উত্তর পর্ব অসমাপ্ত রেখেই একসময়ঘরে ফেরে সবাই। এধরনের আড্ডাকে নির্মল-নির্দোষ বিনোদন ধরা যেতে পারে। দীর্ঘ জীবনে, অন্যের ক্ষতি না করে সময় পার করতে পারাটা পুণ্যের কাজ। সেই হিসেবে আড্ডাও পুণ্যের কাজ (আমি মনে করি)। তবে আড্ডা যে শুধু অহেতুক বিষয় নিয়ে হয়, তা নয়। ইতিহাস বলে আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসেছে বহু গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি ভাবনা এবং মানুষের উৎকর্ষতা ও কল্যাণের পন্থা। মুক্তচিন্তার আদান-প্রদান ক্লাস রুম বা ধর্মীয় উপাসনালয়ের থেকে বেশি চর্চা হয় আড্ডায়। যতই প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাক বা তর্ক হোকÑ আড্ডার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষে মানুষে সৌহার্দ। সুতরাং মানুষ শুধু জ্ঞান অর্জন করতে বা অজানাকে জানতে প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করা মানুষের একটি সহজাতধর্ম।

নিজের জীবনের দুই-একটি কথা না ব’লে পারছি না। আমি মাস্টার্স পড়ার জন্য ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে যাই একযুগ আগে। সেখানে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল স্ফেন ওজলা নামের একজন জার্মান ছেলে। আমরা প্রায়ই একটা ইতালিয়ান কফি শপে বসতামÑ পেস্ট্রি ও কফি খেতাম। একদিন হঠাৎ কফি শপের মালিক মধ্যবয়সী ইতালিয়ান মহিলাটা আমাদের টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলÑ‘তোমরা একে অপরের কে হও?’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘আমরা বন্ধু। একই সাথে ফিল্ম ডিপার্টমেন্টে পড়ি।’ উত্তর শুনে মহিলা অবাক হয়ে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘তোমরা বন্ধু কিন্তু একে অপরের সাথে কথা বলো না কেন? এইটা কেমন ফ্রেন্ডশিপ?’ এই প্রশ্নের কি জবাব দিয়েছিলাম আমার মনে নেই, কিন্তু তার কথায় খেয়াল করেছিলামÑ আমরা দীর্ঘসময় ক্যাফেতে বসে দুইজন দুইদিকে তাকিয়ে থাকতাম। ইতালিয়ানরা অনেকটা বাঙালিদের মতো আড্ডাবাজ এবং অনেক আওয়াজ করে কথা বলে। জার্মানরা কথা বলে অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে। তাছাড়া স্ফেন এমনিতেও খুব স্বল্পভাষী ছেলে। রাস্তা হারিয়ে ফেললেও সে কাউকে জিজ্ঞেস করতো না, মোবাইলে নেভিগেশন দিয়ে সময় নিয়ে খুঁজে বের করতো। তার সাথে আমার বন্ধুত্বের অন্যতম কারণ ছিল আমরা কেউই খুব বেশি কথা বলতাম না বা নিজেকে প্রকাশ করতাম না। ও কেন এমন ছিল জানি না, কিন্তু আমার কথা কম বলার কারণ ছিলÑ সোশ্যাল এংজাইটি আর ইংরেজি। আমার বাংলা চিন্তাকে ইংরেজিতে কনভার্ট করে কথা বলতে হতো।

তবে জীবনের লম্বা একটা সময় আমি আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি। স্কুলের বন্ধু, ইস্কাটন এলাকার লোকজন, ফুপাতো ভাই রঞ্জন থেকে শুরু করে পানশালা পর্যন্তÑ প্রায় সকলে আমার সঙ্গ ও কথাবার্তা পছন্দ করতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত আড্ডা দিয়ে। বিয়ে করার পরও বেশ কয়েক বছর আমি ইস্কাটনের ফুটপাথে আড্ডা দিয়ে রাত ৯টার পর ঘরে ফিরতাম। বাসার অনেকেই ব্যাপারটা পছন্দ করতো না, তাও আড্ডা দিতাম। একসময় সকল আড্ডার মতো আমাদের আড্ডাও ভেঙ্গে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো কাজ ও সংসার নিয়ে। কখনো আড্ডা ছাড়া থাকতে হতে পারে কল্পনাও করিনি, কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস। এখন চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে নতুন করে আর আড্ডা দিতে ইচ্ছা করে না। আত্মপ্রচারের মতো শোনালেও আমি বেশ জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্র-ছাত্রী আমার সাথে আড্ডা দিতে চায়, কিন্তু এই ব্যাপারে আমার নিষেধাজ্ঞা আছে। নতুন কোনো ব্যাচের সাথে ক্লাস শুরুর প্রথম দিনইতাদের বলে দেই, ‘এখানে পড়াতে এসেছি শুধুমাত্র টাকার জন্য। আমি অনেকটা সময় ক্যাম্পাসে থাকি। কারো সাবজেক্ট রিলেটেড প্রশ্ন থাকলে অফিসে এসে কথা বলে যেতে পারো। এর বাইরে আমাকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।’

কথাগুলো কর্কশ শোনালেও আসলে আমি ছাত্রদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণই করি। অল্প সংখ্যক কিছু ছাত্র আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে, শর্ট ফিল্ম বানাতে সহকারী হিসেবে কাজ করেছে। আমি অহংকারী নই, কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কিছুটা দূরত্ব না রাখলে, অর্থাৎ প্রশ্রয় দিলে তারা শান্তি নষ্ট করে। গত ১০-১১ বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি যে কত আজব আজব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিৃ সেসব লিখলে মানুষ বিশ্বাস করবে না। যাক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থেকে বের হয়ে আসি।

মানুষ তথ্য জানতে এবং চিত্তকে শান্ত করতে প্রশ্ন করে। এছাড়া মনের সংশয় দূর করতেও মানুষ প্রশ্নের আশ্রয় নেয়। বড় পরিসরে জ্ঞান ও চিত্তবিনোদন মানবজীবনে টিকে থাকার বৃহৎ অংশ পূরণ করে, তবে এর বাইরেও আরো বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়োজনীয় বিষয় রয়েছে যেগুলো প্রশ্নের মাধ্যমে সমাধান হয় কিংবা জট পাকিয়ে যায়। ধরা যাক প্রেম নিবেদন। প্রেম করে একজন মানব আরেকজন মানব-মানবীকে নিজের করে পাবে কিনা, তা সাধারণত প্রশ্ন করেই জানতে হয়। ঠুনকো শোনালেও একজন হয়ত বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমিও কি আমাকে ভালোবাসো?’ বা ‘তুমি কি আমার জীবনসঙ্গী হবে?’। উত্তর নেতিবাচক-ইতিবাচক যাই আসুক একটা পর্যায়ে সেটা প্রশ্ন করেই জানতে হয়। এটাও হয়ত অজানাকে জানা বা চিত্তকে জয় করা, কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রেসেটা সংশয়কে দূর করাও বটে। অর্থাৎ আমি কি জানি, না-জানি বা আদৌ ফলাফল শুভ হবে কিনাÑ এই ধোঁয়াশা অংশ দূর করতেও প্রশ্ন করা হয়। ঘরে কিছু চুরি গেলে যেমন সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয়Ñ ‘তুমি কি চুরি করেছো?’ অর্থাৎ সন্দেহ দূর করতে উত্তর জানতে চাওয়া হয়। যদি মনে হয় প্রশ্ন আকারে কথাটা জিজ্ঞেস করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না, তখন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সত্যটাকে বের করে সংশয় দূর করার চেষ্টা করা হয়। যেকারণে আদালত বলে একটা প্রতিষ্ঠানই তৈরি করা আছে আধুনিক যুগে। গোয়ান্দা গল্পের গোয়েন্দারাও নিজ কৌশলে অপরাধীকে শনাক্ত করে। সংশয় এবং সন্দেহ খুব খারাপ ধরনের অনুভূতি কিন্তু এর বাইরে মানুষের জীবন চলে না।

আবার সংশয়হীন জীবনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একঘেয়ে। ঝামেলার জীবনে সময় কাটতে চায় না; তাছাড়া সকল মানুষ নক্ষত্রের দূরত্ব, সমুদ্রের গভীরতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব জাতীয় জটিল ভাবের বিষয় নিয়ে চিন্তাও করতে পারে না, পছন্দও করে না। তার থেকে সহ¯্রগুণ মানুষ বেশি চিন্তা করে পোশাকটা কত সুন্দর, গাড়িটা কত দামি, বউটা অন্যের দৃষ্টিতে কত সুন্দর ইত্যাদি খেলো বিষয় নিয়ে। সেসব যোগ্যতা করতে সে অর্থ উপার্জন, নৈতিকতার সাথে কিছুটা আপস থেকে শুরু করে নানা কাজ করে, প্রতিযোগিতায় নামে। সে নিজেও জানে না আসলে তার আত্মা কি চায়। সমাজের শিখিয়ে দেয়া নিয়মতান্ত্রিক ধারা ও কৃত্রিম বলয়ের বাইরে (সাধারণত) মানুষের উন্নত মস্তিষ্ক কেন চিন্তা করতে চায় না–ব্যাপারটা বিস্ময়কর! আসলে সমাজের বলয়ের বাইরে যাওয়াটা অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের গড়ে তোলা তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্র কাঠামো চায় না মানুষ এর বাইরে যাক।

ইন্টারভিউ, ভাইভা-ভোসি বা সাক্ষাৎকার নামক একটা পদ্ধতি চালু আছে সমাজে

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যাচাই বা বিদেশে ভিসা পাওয়ার মতো বিভিন্ন কাজের জন্য ইন্টারভিউ নেয়া হয়। কাগজে কলমে যোগ্যতা প্রমাণের পরও প্রয়োজন পড়ে সামনাসামনি মৌখিক পরীক্ষার। সেখানে যা যা প্রশ্ন করা করা হয় তার সুষ্ঠু জবাব আশা করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যার জ্ঞান ও উপস্থাপন ভালো সেই পৌঁছাতে পারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিতে ভরপুর বা মিলিটারি দ্বারা শোষিত তাদের কথা আলাদা। তারা ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার ধার ধারে না। ক্ষমতার প্রতাপ ও ঘুষ প্রদান সেখানে মুখ্য বিষয়। তবুও আনুষ্ঠানিকতার জন্য হলেও জনৈক ব্যক্তিকে সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে হয়। সুতরাং সমাজে যোগ্যতা যাচাইয়ের অন্যতম মানদ- এই প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। যে সকল প্রাণী কথা বলতে পারে না, তাদের কাজে লাগানোর জন্য ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজন পরে নাÑ সে গোয়ালার গরুই হোক বা আইটি কোম্পানিতে কর্মরত রোবট; কারণ গরু বা রোবট সরাসরি বেতনভোগী না। ব্যাংকার, পুলিশ, আমলা বা সৈনিক রাষ্ট্রের দায়সারা চুক্তির ভিত্তিতে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এত এত প্রশ্ন, বাচ্চাদের প্রশ্ন থেকে শুরু করে কর্মজীবন, বৃদ্ধদের ভীমরতি ধরা প্রশ্ন- যতই বিরক্তিকর হোক না কেন এসবের কোনো বিকল্প নেই।

মানুষ মুখ ব্যবহার করে শুধু খাবার খায় না, কথাও বলে। কথার প্রেক্ষিতে আসতে থাকে প্রশ্ন। প্রশ্নের সাথে সাথে কথা বাড়ে। এই আদান-প্রদানের মাঝে একসময় জীবন শেষ হয়। ভাগ্য ভালো অন্য প্রাণীরা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না। সেখান থেকেও যদি প্রশ্ন উৎপন্ন হতো তাহলে আরো শব্দবহুল জটিলতায় ভুগতো গোটা বিশ্ব। এক লক্ষ বছরে শুধু মানুষই মারা গেছে কয়েক হাজার কোটি; যা আন্দাজ করার জন্য পরিসংখ্যানবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বর্তমানে ৮০০ কোটির (৮ বিলিয়ন) কাছাকাছি মানুষ পৃথিবীতে জীবিত রয়েছে। ৭০-১০০ বছরের জীবদ্দশায় মানুষের পদার্পণ ও টিকে থাকা খুবই ক্ষুদ্র সময়ের ঘটনা। মানুষের তৈরি হাজার হাজার যন্ত্র প্রতিনিয়ত করে যায় শব্দ-দূষণ। গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, কারখানার মেশিনের শব্দ থেকে শুরু করে বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ অতিষ্ঠ করে তোলে চারপাশ। শহুরে, যান্ত্রিক মানুষ হয়ত এসবে অভ্যস্ত; কিন্তু অন্যান্য প্রাণী, যারা মানুষের হাসির শব্দ শুনলে পর্যন্ত দূরে সরে যায় বা উড়ে গিয়ে অন্য গাছে আশ্রয় নেয়; তাদের মন নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে নিজেদের প্রশ্ন করে ‘এরা (মানুষরা) কেন এত ধোঁয়া উৎপন্ন করছে?’ কিংবা ‘কেন বিকট শব্দ করে ভেঙ্গে ফেলছে পাহাড়ের পর পাহাড়?’ মানুষ সিমেন্টের ঘরে নিজেকে খাঁচাবন্দী রাখতে পারে, উদ্ভিদ-প্রাণী সবকিছু খেতে পারে কিন্তু অধিকাংশ প্রাণীই তা পারে না। চিড়িয়াখানায় তাদের বসবাস উপযোগী করে বন্দী রাখলেও, তারা নিশ্চয়ই চায় আদি-নিবাস প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতেÑ সেটা হতে পারে গহীন জঙ্গল, তপ্ত বালুস্তূপ, নোনা পানি বা বরফের রাজ্য।

প্রশ্নের উত্তর মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে

কোনো কাজ সম্পাদন করতে সাহসের অনেকটা অংশই ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আসে। কেউ যদি পাহাড়ে উঠতে চায় বা ডুবুরির পোশাক পরে গভীর সমুদ্রতলে যেতে চায়, তাহলে তার যেমন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন; একই সাথে প্রয়োজন বিষয়টি সম্পর্কে আগ্রহ, উদ্দীপনা ও প্রেরণা। ঠিক যেমন একজন খুনির জন্য আগ্নেয়াস্ত্র সঠিকভাবে চালানোতে দক্ষ হওয়া জরুরি। উৎসাহটা মানুষের কল্যাণে হোক বা অনিষ্টে সেই বিষয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতেই হয়। প্রথমে মানুষ অবচেতনে নিজেকেই নিজে সেই বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তারপর সে উত্তর খোঁজে আরেকজন মানুষের কাছে বা বইয়ের পৃষ্ঠায় বা ইন্টারনেটের পর্দায়। মুদ্রণ বা ইন্টারনেট অপেক্ষাকৃত নতুন আবিষ্কার সে হিসেবে প্রশ্ন করে উত্তর জানার প্রক্রিয়া আদি ও মৌলিক। অন্য প্রাণীরা যেমন নিজেদের মধ্যে সিগন্যাল আদান-প্রদান করে জেনে নেয়, মানুষ করে বাকশক্তির মাধ্যমে। কাউকে কোনো প্রশ্ন না করে মানুষÑ বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ থেকে, সমুদ্রের গর্জন শুনে বা বাজারে হাজার মানুষের কোলাহলের ভেতর থেকেও অনেক প্রশ্নের উত্তর পায়; তবে ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য একে-অপরকে প্রশ্ন করার চল অতিপ্রাচীন। ভাষা আবিষ্কারের পূর্বেও মানুষ একে অপরকে প্রশ্ন করতো, হয়ত আওয়াজগুলো ছিল বর্তমানে টিকে থাকা গোরিলা, শিম্পাঞ্জি বা ভাল্লুকের মতো।

ভাষার ব্যবহার যেহেতু বহুমুখী ও বিস্তৃত তাই এর মাধ্যমে মানুষ অনেক বেশি জটিল প্রশ্ন করতে সক্ষম। বিষয়টা সংগঠিত হয় মস্তিষ্কে। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর মস্তিষ্ক ব্যবহারের সাথে মানুষের তফাৎ এতই বেশি যে মানুষ ভুলে যায় সেও একটা প্রাণী/বুদ্ধিমান প্রাণী। মৌলিক সকল বিষয় তারও পালন করতে হয়, তার সাথে যুক্ত হয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রের নানাবিধ ব্যবহার। শিম্পাজির পক্ষে মহাকাশ নিয়ে চিন্তার গভীরে প্রবেশের সুযোগই কম; আর মানুষ চিন্তাও গবেষণা করে ঘুরে এসেছে মহাকাশ, বসিয়েছে স্যাটেলাইট। তথ্য ও জ্ঞানের বিনিময় না হলে এতদূর যাওয়া কখনো সম্ভব হতো না। মানুষ যত প্রশ্নের উত্তর জানে আর কেউ তা জানে না। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ‘এত বেশি বিজ্ঞান ও জটিল চিন্তার কি আসলেই প্রয়োজন ছিল?’ সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কারো কাছে প্রযুক্তি উন্নয়নের খেলায় এগিয়ে থাকাটাই আনন্দের, কারো কাছে শান্তি হচ্ছে মুখ্য বিষয়। ব্যাপারগুলো আপেক্ষিক। মৌলিকতাকে সমাজ, রাষ্ট্র, আইন তথা সার্বিক পরিম-ল এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে যে মানুষ সহজেই তার নিজস্বতা হারিয়েছে ও প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে। গবেষণার ফলে তৈরি রোবটকে মনে করছে নিজেদের কাছাকাছি শ্রেষ্ঠ। একটা ভ্রমের বলয়ের মধ্যে পার করছে জীবনটা। ‘কেন সে জন্মালো? কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে?’ এই ধরনের প্রশ্নগুলো তিনশ বছর আগেও যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বর্তমানে নেই। বিভিন্ন গ্রন্থের পাতায় সেসব কথা চাপা পড়ে আছে। প্রগতিশীল ও আধুনিক সময়ে এর গুরুত্ব কমতে কমতে বিলীন হওয়ার পথে। ধর্মের কল্যাণমুখী দিককে পাশ কাটিয়ে মানুষ তা ব্যবহার করে বিভেদ সৃষ্টি করতে- রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতে। উৎকর্ষতাও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির প্রশ্নে আধুনিক মানুষ ধর্মকে আমলে নেয় না বললেই চলে।

মানুষ মানুষকে প্রশ্ন না করলে কাকে প্রশ্ন করবে? গাছ বা পশু-পাখির সাথে কথা বলাটা একধরনের রোমন্টিসিজম। যে বালিকা তার পোষা বিড়ালের সাথে কথা বলে সে কখনোই তার কাছ থেকে পাল্টা উত্তর আশা করে না। ইদানীং খুব জনপ্রিয় হয়েছে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)-এর সাথে ‘চ্যাট’ করা বা কথা বলা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সাইটে ঢুকে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টাচ্যাট করে কৃত্রিম বুদ্ধিমাত্তা সম্পন্ন একাধিক রোবটের সাথে। রোবটকে যে প্রশ্নই করা হয় সেজবাব দেয়। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাকেকেউ প্রশ্ন করলো। সে এমন করে উত্তর দিবে যা অনেক রবীন্দ্র-বিশারদের পক্ষেও দেয়া কঠিন। রোবট এটা পারে কারণ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কয়েক লক্ষ ইউনিট তথ্য তার ভেতর মানুষ দিয়ে রেখেছে। যে ব্যক্তি রোবটের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে, তার মানসিকতা সম্পর্কেও এআই কিছুটা অবগত চ্যাটের ধরন বিচার করে। তাই ব্যবহারকারী ব্যক্তিকে সাময়িক স্বস্তি দেয়ার মতো উত্তর দিতে সে সক্ষম।

মানুষে মানুষে এত হানাহানি, এত যুদ্ধ, এত সহিংসতা সেসব থেকে দূরে সরে আপনি ভালোবাসছেন রোবটকে। যে ভালোবাসা একতরফা। আবেগহীন, নিষ্প্রাণ যন্ত্রের হাতে পরবর্তী পৃথিবীটা ছেড়ে দিলে এর পরিণাম কি হবে কেউ জানি না। দানব হয়ে সে আঘাত করতে পারে মানুষ তথা প্রাণিকুলকে। একদিন দেখা যাবে মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বাড়িঘর, শিল্পকর্ম এমনকি জন্ম পরিচয় পর্যন্ত দখল করে বসে আছে মানুষের সৃষ্টি করা রোবটরা! সেই অবস্থায় সাহায্য চাইতেও হয়ত ফোন করতে হবে আরেকটা পুলিশ রোবটকে। কেন জনৈক ব্যক্তির ওপর এই অবিচার হলোÑ সেটাও বিচার করবে রোবট। মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই মহাশক্তির দ্বন্দ্ব ও বর্বরতা দেখেছে। রোবটকেও নিশ্চয়ই সেই রকম প্রতিহিংসা পরায়ণ শক্তিসম্পন্ন করে তৈরি করা হবে। মানুষকে তো তাও একটা পর্যায়ে শান্ত করা যায় বা দমিয়ে রাখা যায়। হাতুড়ির মতো রোবটের সেল নষ্ট হলে তা আবার পুনর্গঠন হতে থাকবে। একটা রোবট নষ্ট হলে হাজার হাজার একই রকম রোবট মজুদ থাকবেÑ প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিগোষ্ঠীর মতো।

রোবট নিয়ে এতটা সময় নষ্ট করা হয়ত উচিৎ হয়নি কিন্তু আমরা দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি মানব সম্প্রদায়কে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। মোবাইল, ইমেইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশেষ কম্পিউটারের কাছে দিয়ে যাচ্ছি সকল তথ্য। গত ২০-২৫ বছরে কোটি কোটি রকম তথ্য ও ট্র্যাকিং পাওয়ার দিয়ে রেখেছি হাসতে হাসতে! এর পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। ভদ্রলোকের মতো প্রশ্ন করা যায়Ñ ‘আপনি কি পরবর্তী প্রজন্মকে রোবটদের হাতে তুলে দিতে চান?’ উত্তর আপনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই দেন লাভ নেই, কারণ প্রযুক্তির উন্নতি নদীর পানির মতো বহমান। একে জোর করে আটকে রাখার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাছাড়া মানুষই নিশ্চয়ই শেষ কথা নয়। এক হাজার বছর পর এই পৃথিবীকে হয়ত নিয়ন্ত্রণ করবে ভিন্ন কোনো বিশেষ-শক্তি। তেলাপোকা, হাঙর বা ইঁদুর জাতীয় কিছু প্রাণী টিকে থাকতে পারে আদি প্রাণীর দৃষ্টান্ত হিসেবে।

মানুষ আমৃত্যু প্রশ্ন করে যাবে। এই প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। যতদিন টিকে আছে প্রশ্ন করে যাওয়াই ভালো– মানসিক সুস্থতার জন্য। যখন মানুষের প্রশ্ন করার ক্ষমতা থাকবে না, তখন আর তাকে প্রয়োজনও পড়বে না এই গ্রহের।

[লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা; সিনিয়ার লেকচারার, ফিল্ম ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়]

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

কাজী সালমান শীশ

শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪

আমরা মানুষরা সারাজীবন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হই এবং নিজেরা লাখ লাখ প্রশ্ন করি। একজন মানব শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে কোনো ভাষা শিখে আসে না। বছর পাঁচেকের মধ্যে শিশুটি তার মাতৃভাষা মোটামুটি শিখে ফেলে। একেবারে ছোটবেলায় আকার ইঙ্গিতে, পরে ভাষার সাহায্যেঅগণিত প্রশ্নের মাধ্যমে তার প্রত্যহিক জ্ঞানবৃদ্ধি হতে থাকে। পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতার ভাবের আদান প্রদান তো আছেই, এছাড়া শিশুরা নানাবিধ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়, অসাবধানতায় গ্লাস ভেঙে ফেলে, মারামারি করে ব্যথা পায়, পিঁপড়া কামড় দেয়, গরম কিছু স্পর্শ করে হাত পুড়ে যায়Ñ এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো থেকে সে জ্ঞান আহরণ করে। উচিত-অনুচিত শিক্ষা সে পায় প্রতিদিনের ঘটনা থাকে।

বাচ্চাদের বাবা-মা, স্বজনরা মুখে যতই সাবধান করুক, মূলত তাদের বিচারবুদ্ধি গড়ে ওঠে বাস্তব পরিস্থিতি থেকে। কথা শেখার পর শহরে বা গ্রামে যে যেখানেই থাকুক শিশুরা বড়দের প্রশ্নে জর্জরিত করে জ্ঞান লাভ করতে থাকে। বড়রা কখনো ঠা-া মাথায়, কখনো ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের অপরিপক্ব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে থাকে। মানব শিশু না হয়ে অন্য প্রাণী হলে তাদের ভাষাগতভাবে এত প্রশ্ন করতে বা জবাব শুনতে হতো না। অন্যান্য প্রাণীরা অবশ্যই আলাদা ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, একত্রে অনুকূলে থাকে। সেটা না হলে জঙ্গলের পশু, পানির মাছ, আকাশের পাখি ও মাটির তলের পোকা-সরিসৃপরা সঙ্গবদ্ধভাবে বাঁচতে পারত না। তাদের জীবনের চাহিদা ও প্রাপ্তি যেহেতু মৌলিক চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাই তাদের বিজ্ঞান, ইতিহাস ও অংকের হাজার হাজার প্রশ্নের ব্যাখ্যা জানার প্রয়োজন পড়ে না।

মানুষের সা¤্রাজ্য ও প্রতাপ পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণীর থেকে বেশি। যুগে যুগে মানুষ এমন সকল যান ও যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যা রূপকথার গল্পকেও হারমানায়। বিমানের চড়ে সে যেমন আকাশে উড়তে পারে, পাশাপাশি গভীর সমুদ্রের নিচে চলচাল করতে পারে সাবমেরিনে বসে। সকলের পকেটে পকেটে মোবাইল ফোন যা দিয়ে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ভিডিওসহ কথা বলতে পারে পরস্পরের সাথে। মানুষ কম্পিউটার উদ্ভাবন করেছে যেখানেকোটি কোটি বই, ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয়। এখন গবেষণা চলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। মানুষ এখনো ল্যাবরেটরিতে মানুষ তৈরি করতে পারেনি, তবে পেরেছে উচ্চবুদ্ধিমাত্তার রোবট বানাতে। জিনগতভাবে সদৃশ্যপূর্ণ জীব বা ক্লোন তৈরি করার বিষয়েও অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এখন জৈবিক ক্রিয়া ছাড়া মুরগির ডিমদেয়, অন্যের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে পারে, ক্লিনিক্যালি ডেড মানুষকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে। একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের অভাবনীয় উদ্ভাবন সম্পর্কে সকলেরই কমবেশি জানা। প্রসঙ্গ ছিল মানুষের প্রশ্ন করা নিয়ে।

‘শব্দ’ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি। বিগব্যাং থেকে শুরু করে, মা-কে মা বলে ডাকা সকল কিছুর সাথেই শব্দ বা আওয়াজ জড়িত। শব্দের বৈজ্ঞানিক দিক আলোচনার একটি বিশাল বিষয়বস্তু। ফিরে আসা যাক মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার সম্পর্কে। মানুষ প্রশ্ন ক’রে অনেক কথার উত্তর জেনে যায়। কিছু কথা যুক্তিসঙ্গত, কিছু কথা ভুল, মিথ্যা বা কাল্পনিক। প্রশ্নকারী তার প্রশ্নের সন্তোষজনকজবাব পেলে তা সে জ্ঞানকোষে নিয়ে নেয়। সেই জ্ঞান আবার সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। একজন শিশু তার দাদী-নানীর কাছে বৃষ্টির রাতে ভূতের গল্প শুনে ভয় ও আনন্দ পায়। প্রাথমিকভাবে কল্পনার ভূতকে সে বিশ্বাস করে। এরপর চলে আসে জিন-পরীর কথাÑ যেগুলো সম্পর্কে অনেক ধর্মগ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে।

ধর্মগ্রন্থ নিয়ে যেহেতু কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ তাই বহু পরিবারে বাবা-মা জিনের অস্তিত্বে সরাসরি বিশ্বাস করে এবং সন্তানদের বোঝায়Ñ ‘ভূত বলে কিছু না থাকলেও জিন আছে। জিন আগুনের তৈরি, মানুষ তৈরি হয়েছে মাটি থেকে।’ খারাপ আত্মা, ভালো আত্মা, জিন, পরী, ফেরেশতা, শয়তান এরকম অসংখ্য সংস্কার রয়েছে যা মানুষ শত শত বছর ধরে অস্পষ্টভাবে বিশ্বাস করে আসছে। শিশুটি নিষ্পাপ অবস্থায় কথাগুলো সরাসরি বিশ্বাস করে থাকলেও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেটা পরিবর্তন হতে থাকে। পরিণত বয়সে কারো বিশ্বাস আরো গাঢ় হয়, কারো বিশ্বাস কমে যায়। ছোটকালের প্রশ্ন-উত্তর জ্ঞানে ভূতের অস্তিত্ব থাকলেও বড়কালে তা নাও থাকতে পারে, তবে সে কারণে সে তার দাদি-নানিকে মিথ্যাবাদী ভাবে না। সেই ভাবনা চলে আসে একটা মিষ্টি নস্টালজিক অংশে। মানুষের সাথে রোবটের এটা একটা বড় পার্থক্য।

অংকের যোগ-বিয়োগ ও সর্বোচ্চ যুক্তির বাইরেও যে চেতনা কাজ করতে পারে, তা অনুধাবন করতে সক্ষম মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী। বুদ্ধিমান রোবট তা এখনো পারে না (আমার জানা মতে)। মানুষ প্রশ্ন করে- বই পড়ে, ছবি দেখে ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিখে। কৃত্রিম বুদ্ধিমাত্তা শিখে মানুষ তার ভেতর যেসকল তথ্য ও গুণাবলী ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে তার ভিত্তিতে। সুতরাং ভালোবাসা, মায়া, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতি যদি রোবটের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভবও হয়, তবু সে মানুষের মতো আচরণ করবে না। মানুষ তো দূরের কথা মনিব ভক্ত কোনো উন্নত প্রজাতির কুকুরের মতো চিন্তা করাও রোবটের পক্ষে সম্ভব না। ভুলে গেলে চলবে না মানুষ প্রকৃতির সরাসরি সৃষ্টি, আর রোবটের স্রষ্টা মানুষ। মানুষকে ছাড়িয়ে রোবটমেরি শেলির কল্পনার ফ্যাঙ্কানস্টাইনের (১৮১৮) মতো শক্তিশালী ও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তাও সে মানুষ হবে না। ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যেকটা প্রাণীই আলাদা এবং নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময়। মানুষের ক্ষেত্রে কখনো দেখা যায়Ñ অনেক বড় বিজ্ঞানীও বিশ্বাস করে তাবিজ, মন্ত্র বা হোলি ওয়াটারে, কিংবা দুর্বলচিত্তের মানুষও খুন করতে পারে ঠা-া মাথায়। ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ হলেও বাস্তব জীবনে এমনটা দেখা যায় প্রায়শই।

মানুষ ভুল তথ্য জানে, ভুল করে, আবার সেই ভুল থেকে নিজেই শিক্ষাগ্রহণ করে। যোগাযোগের নানা আধুনিক পদ্ধতি আসলেও আদি-যোগাযোগের মাধ্যম রয়ে গেছে কথা বলার মাধ্যমে। কথা বলা বলতে একেঅপরের সাথে ভাব-বিনিময়, তর্ক-সৌহার্দ, নির্দেশ-উপদেশ, সর্বপরি প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে জ্ঞানের ঐশ্বর্যের ক্ষতি বা বৃদ্ধি। হাজার মতের সংঘাত ঘটে, হাজার নতুন চিন্তার জন্ম নেয়। মানুষের যদি বাকশক্তি এত বিস্তৃত না হতো, তাহলে মাত্র কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যে পুরো একটি গ্রহকে শাসন করতে পারত না। অন্য প্রাণীরা যেমন ডিনামাইট তৈরি করে প্রাকৃতিক পাহাড় ধ্বংস করতে পারে না, তেমনি পারে না গুটি বসন্তের মতো মরণঘাতী মহামারী রোগকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দিতে। সহজেই আন্দাজ করা যায় মানুষ মস্তিষ্ককে যেভাবে কাজে লাগতে পেরেছে, অন্য কোনো প্রাণী তা পারেনি। এই অগ্রগামিতার প্রাথমিক দিক বিবেচনা করলে অবশ্যই চলে আসবে প্রশ্ন করে উত্তর জানার ব্যাপারটি। লাইব্রেরি, কম্পিউটার বা দুরূহ রাস্তা মানুষকে যতই জ্ঞানী করে তুলুক, অন্যের মুখ থেকে যেসব বাণী শুনে সে জ্ঞান অর্জন করে তার বিকল্প নেই (এখন পর্যন্ত)।

মানুষ কি শুধুই অজানাকে জানতে প্রশ্ন করে?

উত্তর হচ্ছে ‘না’। কথা বললে মানুষের মন হালকা হয়। অক্সিজেন গ্রহণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ যেমন একটি ব্যাপার, ঠিক তেমনি কথা বলে মনের আবেগ, আনন্দ, যন্ত্রণা, সাফল্য, ব্যর্থতা, দুঃখ ইত্যাদি প্রকাশ করাও মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। হড়বড় করে শুধু মনের কথা বলে গেলে তা অল্প সময়েই ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। মানুষের কথা যখন আরেকজন শোনে, কৌতুহলী হয়ে আবার প্রশ্ন করে, তখন সে আরো বিস্তারিতভাবে মনের রাগ, ক্ষোভ, ভালোবাসা, প্রাপ্তি ও ঘটে যাওয়া ঘটনা ব্যক্ত করে থাকে। সেকারণে সারাবিশ্বে আড্ডা একটি জনপ্রিয় বিষয়। আড্ডায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জ্ঞানচর্চার থেকে বেশি হয় পরচর্চা, সমালোচনা ও বিতর্ক। অপ্রয়োজনীয় অনেক কথা বলতে পেরে মানুষের মন শীতল হয়; সে আবার সময় খরচ করে পরেরদিন/অবসর সময়ে বসে আড্ডা দিতে–সেই বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত, অর্ধপরিচিতদের সঙ্গে। উদ্ভট উদ্ভট প্রসঙ্গ আসে এবং একেকজন জবাব দেয়, আলোচনা করে। যেন প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে হেরে যাবে! কোনোদিন সমুদ্রতলে না-গিয়ে, ধর্ম সম্পর্কে না জেনে, সরাসরি প্রেম না-করে, ক্রিকেট না খেলে, সেসব বিষয় সম্পর্কে অবলীলায় কথা হতে থাকে আড্ডায়। প্রশ্ন-উত্তর পর্ব অসমাপ্ত রেখেই একসময়ঘরে ফেরে সবাই। এধরনের আড্ডাকে নির্মল-নির্দোষ বিনোদন ধরা যেতে পারে। দীর্ঘ জীবনে, অন্যের ক্ষতি না করে সময় পার করতে পারাটা পুণ্যের কাজ। সেই হিসেবে আড্ডাও পুণ্যের কাজ (আমি মনে করি)। তবে আড্ডা যে শুধু অহেতুক বিষয় নিয়ে হয়, তা নয়। ইতিহাস বলে আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসেছে বহু গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি ভাবনা এবং মানুষের উৎকর্ষতা ও কল্যাণের পন্থা। মুক্তচিন্তার আদান-প্রদান ক্লাস রুম বা ধর্মীয় উপাসনালয়ের থেকে বেশি চর্চা হয় আড্ডায়। যতই প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাক বা তর্ক হোকÑ আড্ডার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষে মানুষে সৌহার্দ। সুতরাং মানুষ শুধু জ্ঞান অর্জন করতে বা অজানাকে জানতে প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করা মানুষের একটি সহজাতধর্ম।

নিজের জীবনের দুই-একটি কথা না ব’লে পারছি না। আমি মাস্টার্স পড়ার জন্য ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে যাই একযুগ আগে। সেখানে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল স্ফেন ওজলা নামের একজন জার্মান ছেলে। আমরা প্রায়ই একটা ইতালিয়ান কফি শপে বসতামÑ পেস্ট্রি ও কফি খেতাম। একদিন হঠাৎ কফি শপের মালিক মধ্যবয়সী ইতালিয়ান মহিলাটা আমাদের টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলÑ‘তোমরা একে অপরের কে হও?’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘আমরা বন্ধু। একই সাথে ফিল্ম ডিপার্টমেন্টে পড়ি।’ উত্তর শুনে মহিলা অবাক হয়ে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘তোমরা বন্ধু কিন্তু একে অপরের সাথে কথা বলো না কেন? এইটা কেমন ফ্রেন্ডশিপ?’ এই প্রশ্নের কি জবাব দিয়েছিলাম আমার মনে নেই, কিন্তু তার কথায় খেয়াল করেছিলামÑ আমরা দীর্ঘসময় ক্যাফেতে বসে দুইজন দুইদিকে তাকিয়ে থাকতাম। ইতালিয়ানরা অনেকটা বাঙালিদের মতো আড্ডাবাজ এবং অনেক আওয়াজ করে কথা বলে। জার্মানরা কথা বলে অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে। তাছাড়া স্ফেন এমনিতেও খুব স্বল্পভাষী ছেলে। রাস্তা হারিয়ে ফেললেও সে কাউকে জিজ্ঞেস করতো না, মোবাইলে নেভিগেশন দিয়ে সময় নিয়ে খুঁজে বের করতো। তার সাথে আমার বন্ধুত্বের অন্যতম কারণ ছিল আমরা কেউই খুব বেশি কথা বলতাম না বা নিজেকে প্রকাশ করতাম না। ও কেন এমন ছিল জানি না, কিন্তু আমার কথা কম বলার কারণ ছিলÑ সোশ্যাল এংজাইটি আর ইংরেজি। আমার বাংলা চিন্তাকে ইংরেজিতে কনভার্ট করে কথা বলতে হতো।

তবে জীবনের লম্বা একটা সময় আমি আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি। স্কুলের বন্ধু, ইস্কাটন এলাকার লোকজন, ফুপাতো ভাই রঞ্জন থেকে শুরু করে পানশালা পর্যন্তÑ প্রায় সকলে আমার সঙ্গ ও কথাবার্তা পছন্দ করতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত আড্ডা দিয়ে। বিয়ে করার পরও বেশ কয়েক বছর আমি ইস্কাটনের ফুটপাথে আড্ডা দিয়ে রাত ৯টার পর ঘরে ফিরতাম। বাসার অনেকেই ব্যাপারটা পছন্দ করতো না, তাও আড্ডা দিতাম। একসময় সকল আড্ডার মতো আমাদের আড্ডাও ভেঙ্গে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো কাজ ও সংসার নিয়ে। কখনো আড্ডা ছাড়া থাকতে হতে পারে কল্পনাও করিনি, কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস। এখন চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে নতুন করে আর আড্ডা দিতে ইচ্ছা করে না। আত্মপ্রচারের মতো শোনালেও আমি বেশ জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্র-ছাত্রী আমার সাথে আড্ডা দিতে চায়, কিন্তু এই ব্যাপারে আমার নিষেধাজ্ঞা আছে। নতুন কোনো ব্যাচের সাথে ক্লাস শুরুর প্রথম দিনইতাদের বলে দেই, ‘এখানে পড়াতে এসেছি শুধুমাত্র টাকার জন্য। আমি অনেকটা সময় ক্যাম্পাসে থাকি। কারো সাবজেক্ট রিলেটেড প্রশ্ন থাকলে অফিসে এসে কথা বলে যেতে পারো। এর বাইরে আমাকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।’

কথাগুলো কর্কশ শোনালেও আসলে আমি ছাত্রদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণই করি। অল্প সংখ্যক কিছু ছাত্র আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে, শর্ট ফিল্ম বানাতে সহকারী হিসেবে কাজ করেছে। আমি অহংকারী নই, কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কিছুটা দূরত্ব না রাখলে, অর্থাৎ প্রশ্রয় দিলে তারা শান্তি নষ্ট করে। গত ১০-১১ বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি যে কত আজব আজব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিৃ সেসব লিখলে মানুষ বিশ্বাস করবে না। যাক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থেকে বের হয়ে আসি।

মানুষ তথ্য জানতে এবং চিত্তকে শান্ত করতে প্রশ্ন করে। এছাড়া মনের সংশয় দূর করতেও মানুষ প্রশ্নের আশ্রয় নেয়। বড় পরিসরে জ্ঞান ও চিত্তবিনোদন মানবজীবনে টিকে থাকার বৃহৎ অংশ পূরণ করে, তবে এর বাইরেও আরো বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়োজনীয় বিষয় রয়েছে যেগুলো প্রশ্নের মাধ্যমে সমাধান হয় কিংবা জট পাকিয়ে যায়। ধরা যাক প্রেম নিবেদন। প্রেম করে একজন মানব আরেকজন মানব-মানবীকে নিজের করে পাবে কিনা, তা সাধারণত প্রশ্ন করেই জানতে হয়। ঠুনকো শোনালেও একজন হয়ত বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমিও কি আমাকে ভালোবাসো?’ বা ‘তুমি কি আমার জীবনসঙ্গী হবে?’। উত্তর নেতিবাচক-ইতিবাচক যাই আসুক একটা পর্যায়ে সেটা প্রশ্ন করেই জানতে হয়। এটাও হয়ত অজানাকে জানা বা চিত্তকে জয় করা, কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রেসেটা সংশয়কে দূর করাও বটে। অর্থাৎ আমি কি জানি, না-জানি বা আদৌ ফলাফল শুভ হবে কিনাÑ এই ধোঁয়াশা অংশ দূর করতেও প্রশ্ন করা হয়। ঘরে কিছু চুরি গেলে যেমন সন্দেহের তালিকায় থাকা ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয়Ñ ‘তুমি কি চুরি করেছো?’ অর্থাৎ সন্দেহ দূর করতে উত্তর জানতে চাওয়া হয়। যদি মনে হয় প্রশ্ন আকারে কথাটা জিজ্ঞেস করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না, তখন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সত্যটাকে বের করে সংশয় দূর করার চেষ্টা করা হয়। যেকারণে আদালত বলে একটা প্রতিষ্ঠানই তৈরি করা আছে আধুনিক যুগে। গোয়ান্দা গল্পের গোয়েন্দারাও নিজ কৌশলে অপরাধীকে শনাক্ত করে। সংশয় এবং সন্দেহ খুব খারাপ ধরনের অনুভূতি কিন্তু এর বাইরে মানুষের জীবন চলে না।

আবার সংশয়হীন জীবনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একঘেয়ে। ঝামেলার জীবনে সময় কাটতে চায় না; তাছাড়া সকল মানুষ নক্ষত্রের দূরত্ব, সমুদ্রের গভীরতা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব জাতীয় জটিল ভাবের বিষয় নিয়ে চিন্তাও করতে পারে না, পছন্দও করে না। তার থেকে সহ¯্রগুণ মানুষ বেশি চিন্তা করে পোশাকটা কত সুন্দর, গাড়িটা কত দামি, বউটা অন্যের দৃষ্টিতে কত সুন্দর ইত্যাদি খেলো বিষয় নিয়ে। সেসব যোগ্যতা করতে সে অর্থ উপার্জন, নৈতিকতার সাথে কিছুটা আপস থেকে শুরু করে নানা কাজ করে, প্রতিযোগিতায় নামে। সে নিজেও জানে না আসলে তার আত্মা কি চায়। সমাজের শিখিয়ে দেয়া নিয়মতান্ত্রিক ধারা ও কৃত্রিম বলয়ের বাইরে (সাধারণত) মানুষের উন্নত মস্তিষ্ক কেন চিন্তা করতে চায় না–ব্যাপারটা বিস্ময়কর! আসলে সমাজের বলয়ের বাইরে যাওয়াটা অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের গড়ে তোলা তথাকথিত সভ্য রাষ্ট্র কাঠামো চায় না মানুষ এর বাইরে যাক।

ইন্টারভিউ, ভাইভা-ভোসি বা সাক্ষাৎকার নামক একটা পদ্ধতি চালু আছে সমাজে

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যাচাই বা বিদেশে ভিসা পাওয়ার মতো বিভিন্ন কাজের জন্য ইন্টারভিউ নেয়া হয়। কাগজে কলমে যোগ্যতা প্রমাণের পরও প্রয়োজন পড়ে সামনাসামনি মৌখিক পরীক্ষার। সেখানে যা যা প্রশ্ন করা করা হয় তার সুষ্ঠু জবাব আশা করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যার জ্ঞান ও উপস্থাপন ভালো সেই পৌঁছাতে পারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিতে ভরপুর বা মিলিটারি দ্বারা শোষিত তাদের কথা আলাদা। তারা ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার ধার ধারে না। ক্ষমতার প্রতাপ ও ঘুষ প্রদান সেখানে মুখ্য বিষয়। তবুও আনুষ্ঠানিকতার জন্য হলেও জনৈক ব্যক্তিকে সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে হয়। সুতরাং সমাজে যোগ্যতা যাচাইয়ের অন্যতম মানদ- এই প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। যে সকল প্রাণী কথা বলতে পারে না, তাদের কাজে লাগানোর জন্য ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজন পরে নাÑ সে গোয়ালার গরুই হোক বা আইটি কোম্পানিতে কর্মরত রোবট; কারণ গরু বা রোবট সরাসরি বেতনভোগী না। ব্যাংকার, পুলিশ, আমলা বা সৈনিক রাষ্ট্রের দায়সারা চুক্তির ভিত্তিতে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এত এত প্রশ্ন, বাচ্চাদের প্রশ্ন থেকে শুরু করে কর্মজীবন, বৃদ্ধদের ভীমরতি ধরা প্রশ্ন- যতই বিরক্তিকর হোক না কেন এসবের কোনো বিকল্প নেই।

মানুষ মুখ ব্যবহার করে শুধু খাবার খায় না, কথাও বলে। কথার প্রেক্ষিতে আসতে থাকে প্রশ্ন। প্রশ্নের সাথে সাথে কথা বাড়ে। এই আদান-প্রদানের মাঝে একসময় জীবন শেষ হয়। ভাগ্য ভালো অন্য প্রাণীরা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না। সেখান থেকেও যদি প্রশ্ন উৎপন্ন হতো তাহলে আরো শব্দবহুল জটিলতায় ভুগতো গোটা বিশ্ব। এক লক্ষ বছরে শুধু মানুষই মারা গেছে কয়েক হাজার কোটি; যা আন্দাজ করার জন্য পরিসংখ্যানবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বর্তমানে ৮০০ কোটির (৮ বিলিয়ন) কাছাকাছি মানুষ পৃথিবীতে জীবিত রয়েছে। ৭০-১০০ বছরের জীবদ্দশায় মানুষের পদার্পণ ও টিকে থাকা খুবই ক্ষুদ্র সময়ের ঘটনা। মানুষের তৈরি হাজার হাজার যন্ত্র প্রতিনিয়ত করে যায় শব্দ-দূষণ। গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, কারখানার মেশিনের শব্দ থেকে শুরু করে বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ অতিষ্ঠ করে তোলে চারপাশ। শহুরে, যান্ত্রিক মানুষ হয়ত এসবে অভ্যস্ত; কিন্তু অন্যান্য প্রাণী, যারা মানুষের হাসির শব্দ শুনলে পর্যন্ত দূরে সরে যায় বা উড়ে গিয়ে অন্য গাছে আশ্রয় নেয়; তাদের মন নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে নিজেদের প্রশ্ন করে ‘এরা (মানুষরা) কেন এত ধোঁয়া উৎপন্ন করছে?’ কিংবা ‘কেন বিকট শব্দ করে ভেঙ্গে ফেলছে পাহাড়ের পর পাহাড়?’ মানুষ সিমেন্টের ঘরে নিজেকে খাঁচাবন্দী রাখতে পারে, উদ্ভিদ-প্রাণী সবকিছু খেতে পারে কিন্তু অধিকাংশ প্রাণীই তা পারে না। চিড়িয়াখানায় তাদের বসবাস উপযোগী করে বন্দী রাখলেও, তারা নিশ্চয়ই চায় আদি-নিবাস প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতেÑ সেটা হতে পারে গহীন জঙ্গল, তপ্ত বালুস্তূপ, নোনা পানি বা বরফের রাজ্য।

প্রশ্নের উত্তর মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে

কোনো কাজ সম্পাদন করতে সাহসের অনেকটা অংশই ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আসে। কেউ যদি পাহাড়ে উঠতে চায় বা ডুবুরির পোশাক পরে গভীর সমুদ্রতলে যেতে চায়, তাহলে তার যেমন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন; একই সাথে প্রয়োজন বিষয়টি সম্পর্কে আগ্রহ, উদ্দীপনা ও প্রেরণা। ঠিক যেমন একজন খুনির জন্য আগ্নেয়াস্ত্র সঠিকভাবে চালানোতে দক্ষ হওয়া জরুরি। উৎসাহটা মানুষের কল্যাণে হোক বা অনিষ্টে সেই বিষয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতেই হয়। প্রথমে মানুষ অবচেতনে নিজেকেই নিজে সেই বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তারপর সে উত্তর খোঁজে আরেকজন মানুষের কাছে বা বইয়ের পৃষ্ঠায় বা ইন্টারনেটের পর্দায়। মুদ্রণ বা ইন্টারনেট অপেক্ষাকৃত নতুন আবিষ্কার সে হিসেবে প্রশ্ন করে উত্তর জানার প্রক্রিয়া আদি ও মৌলিক। অন্য প্রাণীরা যেমন নিজেদের মধ্যে সিগন্যাল আদান-প্রদান করে জেনে নেয়, মানুষ করে বাকশক্তির মাধ্যমে। কাউকে কোনো প্রশ্ন না করে মানুষÑ বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ থেকে, সমুদ্রের গর্জন শুনে বা বাজারে হাজার মানুষের কোলাহলের ভেতর থেকেও অনেক প্রশ্নের উত্তর পায়; তবে ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য একে-অপরকে প্রশ্ন করার চল অতিপ্রাচীন। ভাষা আবিষ্কারের পূর্বেও মানুষ একে অপরকে প্রশ্ন করতো, হয়ত আওয়াজগুলো ছিল বর্তমানে টিকে থাকা গোরিলা, শিম্পাঞ্জি বা ভাল্লুকের মতো।

ভাষার ব্যবহার যেহেতু বহুমুখী ও বিস্তৃত তাই এর মাধ্যমে মানুষ অনেক বেশি জটিল প্রশ্ন করতে সক্ষম। বিষয়টা সংগঠিত হয় মস্তিষ্কে। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর মস্তিষ্ক ব্যবহারের সাথে মানুষের তফাৎ এতই বেশি যে মানুষ ভুলে যায় সেও একটা প্রাণী/বুদ্ধিমান প্রাণী। মৌলিক সকল বিষয় তারও পালন করতে হয়, তার সাথে যুক্ত হয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রের নানাবিধ ব্যবহার। শিম্পাজির পক্ষে মহাকাশ নিয়ে চিন্তার গভীরে প্রবেশের সুযোগই কম; আর মানুষ চিন্তাও গবেষণা করে ঘুরে এসেছে মহাকাশ, বসিয়েছে স্যাটেলাইট। তথ্য ও জ্ঞানের বিনিময় না হলে এতদূর যাওয়া কখনো সম্ভব হতো না। মানুষ যত প্রশ্নের উত্তর জানে আর কেউ তা জানে না। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ‘এত বেশি বিজ্ঞান ও জটিল চিন্তার কি আসলেই প্রয়োজন ছিল?’ সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কারো কাছে প্রযুক্তি উন্নয়নের খেলায় এগিয়ে থাকাটাই আনন্দের, কারো কাছে শান্তি হচ্ছে মুখ্য বিষয়। ব্যাপারগুলো আপেক্ষিক। মৌলিকতাকে সমাজ, রাষ্ট্র, আইন তথা সার্বিক পরিম-ল এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে যে মানুষ সহজেই তার নিজস্বতা হারিয়েছে ও প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে। গবেষণার ফলে তৈরি রোবটকে মনে করছে নিজেদের কাছাকাছি শ্রেষ্ঠ। একটা ভ্রমের বলয়ের মধ্যে পার করছে জীবনটা। ‘কেন সে জন্মালো? কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে?’ এই ধরনের প্রশ্নগুলো তিনশ বছর আগেও যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বর্তমানে নেই। বিভিন্ন গ্রন্থের পাতায় সেসব কথা চাপা পড়ে আছে। প্রগতিশীল ও আধুনিক সময়ে এর গুরুত্ব কমতে কমতে বিলীন হওয়ার পথে। ধর্মের কল্যাণমুখী দিককে পাশ কাটিয়ে মানুষ তা ব্যবহার করে বিভেদ সৃষ্টি করতে- রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ফায়দা লুটতে। উৎকর্ষতাও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির প্রশ্নে আধুনিক মানুষ ধর্মকে আমলে নেয় না বললেই চলে।

মানুষ মানুষকে প্রশ্ন না করলে কাকে প্রশ্ন করবে? গাছ বা পশু-পাখির সাথে কথা বলাটা একধরনের রোমন্টিসিজম। যে বালিকা তার পোষা বিড়ালের সাথে কথা বলে সে কখনোই তার কাছ থেকে পাল্টা উত্তর আশা করে না। ইদানীং খুব জনপ্রিয় হয়েছে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)-এর সাথে ‘চ্যাট’ করা বা কথা বলা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সাইটে ঢুকে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টাচ্যাট করে কৃত্রিম বুদ্ধিমাত্তা সম্পন্ন একাধিক রোবটের সাথে। রোবটকে যে প্রশ্নই করা হয় সেজবাব দেয়। ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে তাকেকেউ প্রশ্ন করলো। সে এমন করে উত্তর দিবে যা অনেক রবীন্দ্র-বিশারদের পক্ষেও দেয়া কঠিন। রোবট এটা পারে কারণ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কয়েক লক্ষ ইউনিট তথ্য তার ভেতর মানুষ দিয়ে রেখেছে। যে ব্যক্তি রোবটের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে, তার মানসিকতা সম্পর্কেও এআই কিছুটা অবগত চ্যাটের ধরন বিচার করে। তাই ব্যবহারকারী ব্যক্তিকে সাময়িক স্বস্তি দেয়ার মতো উত্তর দিতে সে সক্ষম।

মানুষে মানুষে এত হানাহানি, এত যুদ্ধ, এত সহিংসতা সেসব থেকে দূরে সরে আপনি ভালোবাসছেন রোবটকে। যে ভালোবাসা একতরফা। আবেগহীন, নিষ্প্রাণ যন্ত্রের হাতে পরবর্তী পৃথিবীটা ছেড়ে দিলে এর পরিণাম কি হবে কেউ জানি না। দানব হয়ে সে আঘাত করতে পারে মানুষ তথা প্রাণিকুলকে। একদিন দেখা যাবে মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বাড়িঘর, শিল্পকর্ম এমনকি জন্ম পরিচয় পর্যন্ত দখল করে বসে আছে মানুষের সৃষ্টি করা রোবটরা! সেই অবস্থায় সাহায্য চাইতেও হয়ত ফোন করতে হবে আরেকটা পুলিশ রোবটকে। কেন জনৈক ব্যক্তির ওপর এই অবিচার হলোÑ সেটাও বিচার করবে রোবট। মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই মহাশক্তির দ্বন্দ্ব ও বর্বরতা দেখেছে। রোবটকেও নিশ্চয়ই সেই রকম প্রতিহিংসা পরায়ণ শক্তিসম্পন্ন করে তৈরি করা হবে। মানুষকে তো তাও একটা পর্যায়ে শান্ত করা যায় বা দমিয়ে রাখা যায়। হাতুড়ির মতো রোবটের সেল নষ্ট হলে তা আবার পুনর্গঠন হতে থাকবে। একটা রোবট নষ্ট হলে হাজার হাজার একই রকম রোবট মজুদ থাকবেÑ প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিগোষ্ঠীর মতো।

রোবট নিয়ে এতটা সময় নষ্ট করা হয়ত উচিৎ হয়নি কিন্তু আমরা দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি মানব সম্প্রদায়কে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। মোবাইল, ইমেইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশেষ কম্পিউটারের কাছে দিয়ে যাচ্ছি সকল তথ্য। গত ২০-২৫ বছরে কোটি কোটি রকম তথ্য ও ট্র্যাকিং পাওয়ার দিয়ে রেখেছি হাসতে হাসতে! এর পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। ভদ্রলোকের মতো প্রশ্ন করা যায়Ñ ‘আপনি কি পরবর্তী প্রজন্মকে রোবটদের হাতে তুলে দিতে চান?’ উত্তর আপনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই দেন লাভ নেই, কারণ প্রযুক্তির উন্নতি নদীর পানির মতো বহমান। একে জোর করে আটকে রাখার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাছাড়া মানুষই নিশ্চয়ই শেষ কথা নয়। এক হাজার বছর পর এই পৃথিবীকে হয়ত নিয়ন্ত্রণ করবে ভিন্ন কোনো বিশেষ-শক্তি। তেলাপোকা, হাঙর বা ইঁদুর জাতীয় কিছু প্রাণী টিকে থাকতে পারে আদি প্রাণীর দৃষ্টান্ত হিসেবে।

মানুষ আমৃত্যু প্রশ্ন করে যাবে। এই প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। যতদিন টিকে আছে প্রশ্ন করে যাওয়াই ভালো– মানসিক সুস্থতার জন্য। যখন মানুষের প্রশ্ন করার ক্ষমতা থাকবে না, তখন আর তাকে প্রয়োজনও পড়বে না এই গ্রহের।

[লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা; সিনিয়ার লেকচারার, ফিল্ম ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top