নাজমুল হুদা খান
দেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ ১১ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি। এই বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ২৩ জন, নিখোঁজ অনেক। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় ২৩০টি নদীনদীর নাব্যতা হ্রাস, হিমালয়ের বরফগলা, অতিবৃষ্টি, উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টি, ভারত অংশের বিভিন্ন নদীর বাঁধ খুলে দেয়া এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বন্যা বিপর্যয়। বন্যাকবলিত এসব এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন দেশি বিদেশি এনজিও, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে যার যার মতো উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। অর্থ ও বিভিন্ন সহায়তা নিয়ে হাত বাড়াচ্ছেন সাধারণ জনগণ।
ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানটা এমন স্থানে যে, এতদঞ্চলে বন্যার প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি দুবছর পরপর মাঝারি এবং ৬-৭ বছর অন্তর বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। ১৯৫৪-৯৮ সাল পর্যন্ত তিন যুগে প্রায় ৩২ বার বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে রয়েছে প্রলয়ংকরী বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরের বন্যায় প্রাণহানি ঘটে ৫ লাখ মানুষের। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় প্রায় ১৩ লাখ টন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে দেশজুড়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব বন্যায় দেশের ২০-৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে দেখা যায়। বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, কৃষিপণ্য, মৎস খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সামাজিক সরবরাহ, সেতু-কালভার্টসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। তথাপি দুর্গত এলাকায় চলাচল, উদ্ধার অভিযান, সহায়তা প্রদান, বহু লোকের সমাগম, ত্রাণ কাজে সমন্বয় ইত্যাদির নিরিখে আমাদের কিছু বিষয়ে সংগঠিতভাবে কাজ করলে ত্রাণ তৎপরতা আরও ফলপ্রসূ হতে পারে। ত্রাণসামগ্রী কেনা, ব্যবস্থাপনা এবং বিতরণে অর্থ তহবিল গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও প্রশাসন ছাড়াও ব্যক্তিগত, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, সাংগঠনিকভাবে এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্যোগ পীড়িতদের জন্য তহবিল সংগ্রহের কার্যক্রম অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
স্বেচ্ছাসেবক ও এনজিওদের যথাযথ সমন্বয় বন্যা দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা আরও কার্যকর হতে পারে। ত্রাণ তৎপরতার মধ্যে যাতায়াতের অযোগ্য জায়গা থেকে মানুষকে উদ্ধার, খাদ্য, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহগুলো সুসংগঠিত এবং বিতরণ করা; অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান অন্যতম। স্বেচ্ছাসেবীরা অবকাঠামো পুননির্মাণের কাজেও সহায়তা করে থাকে। বন্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের মানসিক সমর্থন এবং মনোবল বাড়াতেও স্বেচ্ছাসেবীদের যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন দুর্যোগে ব্যাপক পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র ও স্যানিটেশন অবকাঠামোও স্থাপন করে থাকে। প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্যা ত্রাণ তৎপরতা সেল সংগঠিতভাবে এদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করলে সুষ্ঠু ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব।
বন্যাকালীন করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি ও এলাকাভিত্তিক মাইকিংয়ের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে বন্যাকালীন জরুরি প্রয়োজনগুলো প্রচার করা যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, চিকিৎসা সরবরাহ, বা অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।
দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কাজে যুৎসই যানের ব্যবহার, কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ ও সহজ করে তোলে। বন্যায় আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারে যেহেতু পানি পেরিয়েই যেতে হয়, তাই এখানে সাধারণত নৌকাই বেশি ব্যবহৃত হয়। পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে কলা গাছ বা বাঁশের ভেলা কার্যকরী। তবে দ্রুত পৌঁছাতে, বন্যার স্রোতে এবং কম সময়ে বেশিসংখ্যক এলাকার লোকদের উদ্ধার কাজে স্পিডবোট বেশি উপযোগী। হেলিকপ্টারের মাধ্যমেও বিপজ্জনক জায়গা থেকে অনায়াসেই অসহায় মানুষদের তুলে নেয়া যেতে পারে। এলাকাভেদে অন্যান্য যানবাহন ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
মৌলিক ত্রাণ সামগ্রীর পৌঁছানোর বিষয়টি পরিকল্পনায় রাখা জরুরি। বন্যা পরিস্থিতিতে খাদ্য ও পানীয়ের সংকট স্বাভাবিক বিষয়। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে অপচনশীল খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সরবরাহগুলো অবশ্যই স্কুল-কলেজ বা স্থানীয় বহুতল ভবনগুলোর মতো অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানো উচিত।
প্রান্তিক এলাকায় অধিকাংশ পরিবারেরই জীবন-জীবিকার প্রধান উপায় হচ্ছে গবাদিপশু। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের রক্ষার্থে অর্থায়ন কিংবা প্রাণীগুলোর উদ্ধার কাজে সরাসরি যোগদান করা উচিত। এরই ধারাবাহিকতায় পশুর খাদ্য, পশুচিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবার প্রসঙ্গটির দিকেও নজর দেয়া উচিত।
বন্যার পানি কমতে শুরু করলে স্থানীয় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ জরুরি। জলাবদ্ধতা দূর করতে এলাকাভিত্তিক দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পানির পাম্প বসানো যেতে পারে। বন্যা-পরবর্তী বাড়িঘর, পয়োনিষ্কাশনসহ বাড়ির আঙিনা ও আশপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মৃত ও পচা জীবজন্তু মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বন্যায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের মূল অংশ খুলে পাইপের পানিতে ০.০৫ ভাগ ব্লিচিং দ্রবণ ঢেলে, আধা ঘণ্টা পর মূল অংশ পুনঃস্থাপন করে ১৫-২০ মিনিট ধরে চেপে পানি বের করে ফেললেই টিউবওয়েলের পানি পানের উপযোগী হয়ে যাবে। ভূমি ক্ষয়, গাছপালা ধ্বংস এবং পানির উৎস বিনষ্ট ইত্যাদি বন্যা-পরবর্তী দুর্যোগের তাই দীর্ঘমেয়াদি এ কর্মকা-ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বন্যার কারণে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা, পয়ো ও পানি নিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য সংকট, পরিবেশ দূষণ, সাপ ও নানা ধরনের বিষাক্ত প্রাণী ও মশা-মাছির উপদ্রবসহ নানা কারণে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ যথাÑ ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও পেটের পীড়া প্রভৃতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ সময় জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, নানা ধরনের চর্মরোগ, কঞ্জাংটিভাইটিসসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের সিংহভাগই হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় কষ্ট হলেও বন্যার পানি পান পরিহার করতে হবে। সম্ভব হলে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফুটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে ২টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (হ্যালোজেন ট্যাবলেট) আধা ঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে। পচা ও বাসি খাবার গ্রহণ পরিহার করতে হবে, খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই কলেরা বা ডায়রিয়া জীবাণু বহনকারী মাছি বা মশা এসব রোগ ছড়াতে পারবে না। বাসস্থানের আশপাশে মলমূত্র ত্যাগে বিরত থাকতে হবে; এ সময় অবশ্যই সাবান, ছাই বা মাটি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
বন্যাকালে অধিকাংশ সময় পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে শরীরে খোসপাঁচড়া, ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বা স্ক্যাবিস-জাতীয় চর্মরোগ দেখা দিতে পারে, তাই যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। শিশুদের অনেকে সাঁতার না জানার কারণে ও বৃদ্ধরা এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই এদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। এ সময় সাপ ও ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়। সাপ বা ইঁদুর কামড়ালে দ্রুত স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন বা ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরে পানিশূন্যতা কমবে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়াতে পারতপক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। সংযোগ চলাকালে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।
বন্যা মোকাবিলায় বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাথা ঠা-া রেখে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘরবাড়ি ডুবে গেলে নিকটস্থ উঁচু স্থানে/ বাঁধে/ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরের চালে, পাটাতনে বা সুবিধাজনক স্থানে রাখার ব্যবস্থা করুন। টাউট বাটপারদের কথা শুনে শহরে যাবেন না। সম্ভব হলে গবাদি পশু নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে / উঁচু কোন স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করুন। টিউবয়েলের পানি পান করুন। না পাওয়া গেলে ফুটিয়ে/ বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট/ ফিটকিরি ব্যবহার করুন। রোগব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে স্থানীয় মেডিকেল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। ছোট বাচ্চা ও বৃদ্ধদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সরবরাহকারীদের সহায়তা করতে পারেন। বন্যার পানি নেমে গেলে নিজ বাড়িতে ফিরে যান এবং ঘরবাড়ি বসবাসযোগ্য করুন। বন্যা পরবর্তীতে নান অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়, এ বিষয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। তারপরও বেশ কিছু সংকট এখনো রয়ে গেছে। বন্যার পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আরো দ্রুত, আধুনিক ও শক্তিশালী করতে হবে। বন্যা মোকাবিলায় সহায়তাকারী ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীদের পানি নিয়ন্ত্রণ, দুর্গতের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব ও তড়িৎ দক্ষতা অর্জনের মজবুত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা প্রয়োজন। নদী ব্যবস্থাপনা, নদীরক্ষা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, দুর্গতদের পুনর্বাসনসহ সার্বিক বন্যা উত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাধুনিক উন্নত প্রযুক্তি, ধারণা ও উন্নতদেশগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যবহারিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি বন্যাপ্রবণ দেশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ; নদী ও পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বন্যাকে নির্মূল করা না গেলেও তীব্রতা অনেকটাই হ্রাস সম্ভব।
[লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত]
নাজমুল হুদা খান
মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট ২০২৪
দেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জসহ ১১ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি। এই বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ২৩ জন, নিখোঁজ অনেক। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় ২৩০টি নদীনদীর নাব্যতা হ্রাস, হিমালয়ের বরফগলা, অতিবৃষ্টি, উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টি, ভারত অংশের বিভিন্ন নদীর বাঁধ খুলে দেয়া এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বন্যা বিপর্যয়। বন্যাকবলিত এসব এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন দেশি বিদেশি এনজিও, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ে যার যার মতো উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। অর্থ ও বিভিন্ন সহায়তা নিয়ে হাত বাড়াচ্ছেন সাধারণ জনগণ।
ভৌগলিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানটা এমন স্থানে যে, এতদঞ্চলে বন্যার প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি দুবছর পরপর মাঝারি এবং ৬-৭ বছর অন্তর বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। ১৯৫৪-৯৮ সাল পর্যন্ত তিন যুগে প্রায় ৩২ বার বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে রয়েছে প্রলয়ংকরী বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরের বন্যায় প্রাণহানি ঘটে ৫ লাখ মানুষের। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় প্রায় ১৩ লাখ টন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে দেশজুড়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব বন্যায় দেশের ২০-৬০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতে দেখা যায়। বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, কৃষিপণ্য, মৎস খামার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সামাজিক সরবরাহ, সেতু-কালভার্টসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। তথাপি দুর্গত এলাকায় চলাচল, উদ্ধার অভিযান, সহায়তা প্রদান, বহু লোকের সমাগম, ত্রাণ কাজে সমন্বয় ইত্যাদির নিরিখে আমাদের কিছু বিষয়ে সংগঠিতভাবে কাজ করলে ত্রাণ তৎপরতা আরও ফলপ্রসূ হতে পারে। ত্রাণসামগ্রী কেনা, ব্যবস্থাপনা এবং বিতরণে অর্থ তহবিল গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও প্রশাসন ছাড়াও ব্যক্তিগত, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, সাংগঠনিকভাবে এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্যোগ পীড়িতদের জন্য তহবিল সংগ্রহের কার্যক্রম অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
স্বেচ্ছাসেবক ও এনজিওদের যথাযথ সমন্বয় বন্যা দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা আরও কার্যকর হতে পারে। ত্রাণ তৎপরতার মধ্যে যাতায়াতের অযোগ্য জায়গা থেকে মানুষকে উদ্ধার, খাদ্য, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহগুলো সুসংগঠিত এবং বিতরণ করা; অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান অন্যতম। স্বেচ্ছাসেবীরা অবকাঠামো পুননির্মাণের কাজেও সহায়তা করে থাকে। বন্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের মানসিক সমর্থন এবং মনোবল বাড়াতেও স্বেচ্ছাসেবীদের যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন দুর্যোগে ব্যাপক পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র ও স্যানিটেশন অবকাঠামোও স্থাপন করে থাকে। প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত বন্যা ত্রাণ তৎপরতা সেল সংগঠিতভাবে এদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করলে সুষ্ঠু ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব।
বন্যাকালীন করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি ও এলাকাভিত্তিক মাইকিংয়ের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে বন্যাকালীন জরুরি প্রয়োজনগুলো প্রচার করা যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, চিকিৎসা সরবরাহ, বা অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রের বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।
দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কাজে যুৎসই যানের ব্যবহার, কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ ও সহজ করে তোলে। বন্যায় আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারে যেহেতু পানি পেরিয়েই যেতে হয়, তাই এখানে সাধারণত নৌকাই বেশি ব্যবহৃত হয়। পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে কলা গাছ বা বাঁশের ভেলা কার্যকরী। তবে দ্রুত পৌঁছাতে, বন্যার স্রোতে এবং কম সময়ে বেশিসংখ্যক এলাকার লোকদের উদ্ধার কাজে স্পিডবোট বেশি উপযোগী। হেলিকপ্টারের মাধ্যমেও বিপজ্জনক জায়গা থেকে অনায়াসেই অসহায় মানুষদের তুলে নেয়া যেতে পারে। এলাকাভেদে অন্যান্য যানবাহন ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
মৌলিক ত্রাণ সামগ্রীর পৌঁছানোর বিষয়টি পরিকল্পনায় রাখা জরুরি। বন্যা পরিস্থিতিতে খাদ্য ও পানীয়ের সংকট স্বাভাবিক বিষয়। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে অপচনশীল খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণে অগ্রাধিকার দিয়ে এই সরবরাহগুলো অবশ্যই স্কুল-কলেজ বা স্থানীয় বহুতল ভবনগুলোর মতো অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানো উচিত।
প্রান্তিক এলাকায় অধিকাংশ পরিবারেরই জীবন-জীবিকার প্রধান উপায় হচ্ছে গবাদিপশু। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের রক্ষার্থে অর্থায়ন কিংবা প্রাণীগুলোর উদ্ধার কাজে সরাসরি যোগদান করা উচিত। এরই ধারাবাহিকতায় পশুর খাদ্য, পশুচিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবার প্রসঙ্গটির দিকেও নজর দেয়া উচিত।
বন্যার পানি কমতে শুরু করলে স্থানীয় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ জরুরি। জলাবদ্ধতা দূর করতে এলাকাভিত্তিক দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পানির পাম্প বসানো যেতে পারে। বন্যা-পরবর্তী বাড়িঘর, পয়োনিষ্কাশনসহ বাড়ির আঙিনা ও আশপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মৃত ও পচা জীবজন্তু মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। বন্যায় ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলের মূল অংশ খুলে পাইপের পানিতে ০.০৫ ভাগ ব্লিচিং দ্রবণ ঢেলে, আধা ঘণ্টা পর মূল অংশ পুনঃস্থাপন করে ১৫-২০ মিনিট ধরে চেপে পানি বের করে ফেললেই টিউবওয়েলের পানি পানের উপযোগী হয়ে যাবে। ভূমি ক্ষয়, গাছপালা ধ্বংস এবং পানির উৎস বিনষ্ট ইত্যাদি বন্যা-পরবর্তী দুর্যোগের তাই দীর্ঘমেয়াদি এ কর্মকা-ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বন্যার কারণে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা, পয়ো ও পানি নিষ্কাশন এবং সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য সংকট, পরিবেশ দূষণ, সাপ ও নানা ধরনের বিষাক্ত প্রাণী ও মশা-মাছির উপদ্রবসহ নানা কারণে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ যথাÑ ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও পেটের পীড়া প্রভৃতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ সময় জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, নানা ধরনের চর্মরোগ, কঞ্জাংটিভাইটিসসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
বন্যার কারণে সৃষ্ট রোগের সিংহভাগই হয়ে থাকে পানি ও খাবার থেকে। এ সময় কষ্ট হলেও বন্যার পানি পান পরিহার করতে হবে। সম্ভব হলে আধা ঘণ্টা ফুটিয়ে পান করতে হবে, ফুটানো সম্ভব না হলে ১০ লিটার পানিতে ২টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট (হ্যালোজেন ট্যাবলেট) আধা ঘণ্টা মিশিয়ে রাখলেই ওই পানি পানের উপযোগী হবে। পচা ও বাসি খাবার গ্রহণ পরিহার করতে হবে, খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে। তাহলেই কলেরা বা ডায়রিয়া জীবাণু বহনকারী মাছি বা মশা এসব রোগ ছড়াতে পারবে না। বাসস্থানের আশপাশে মলমূত্র ত্যাগে বিরত থাকতে হবে; এ সময় অবশ্যই সাবান, ছাই বা মাটি দিয়ে হাত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
বন্যাকালে অধিকাংশ সময় পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে শরীরে খোসপাঁচড়া, ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বা স্ক্যাবিস-জাতীয় চর্মরোগ দেখা দিতে পারে, তাই যতটা সম্ভব শরীর শুকনো রাখতে হবে। শিশুদের অনেকে সাঁতার না জানার কারণে ও বৃদ্ধরা এ সময় পানিতে ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই এদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। এ সময় সাপ ও ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যায়। বাসস্থানের চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিড রেখে দিলে সাপের উপদ্রব হ্রাস পায়। সাপ বা ইঁদুর কামড়ালে দ্রুত স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্ত রোগীকে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন বা ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরে পানিশূন্যতা কমবে। পাশাপাশি তাদের স্থানীয় মেডিকেল টিম বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়াতে পারতপক্ষে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। সংযোগ চলাকালে বিশেষ সতর্কতা জরুরি।
বন্যা মোকাবিলায় বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাথা ঠা-া রেখে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘরবাড়ি ডুবে গেলে নিকটস্থ উঁচু স্থানে/ বাঁধে/ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরের চালে, পাটাতনে বা সুবিধাজনক স্থানে রাখার ব্যবস্থা করুন। টাউট বাটপারদের কথা শুনে শহরে যাবেন না। সম্ভব হলে গবাদি পশু নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে / উঁচু কোন স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করুন। টিউবয়েলের পানি পান করুন। না পাওয়া গেলে ফুটিয়ে/ বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট/ ফিটকিরি ব্যবহার করুন। রোগব্যাধি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে স্থানীয় মেডিকেল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। ছোট বাচ্চা ও বৃদ্ধদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সরবরাহকারীদের সহায়তা করতে পারেন। বন্যার পানি নেমে গেলে নিজ বাড়িতে ফিরে যান এবং ঘরবাড়ি বসবাসযোগ্য করুন। বন্যা পরবর্তীতে নান অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়, এ বিষয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। তারপরও বেশ কিছু সংকট এখনো রয়ে গেছে। বন্যার পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আরো দ্রুত, আধুনিক ও শক্তিশালী করতে হবে। বন্যা মোকাবিলায় সহায়তাকারী ত্রাণ ও উদ্ধারকর্মীদের পানি নিয়ন্ত্রণ, দুর্গতের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব ও তড়িৎ দক্ষতা অর্জনের মজবুত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা প্রয়োজন। নদী ব্যবস্থাপনা, নদীরক্ষা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, দুর্গতদের পুনর্বাসনসহ সার্বিক বন্যা উত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাধুনিক উন্নত প্রযুক্তি, ধারণা ও উন্নতদেশগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যবহারিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি বন্যাপ্রবণ দেশ। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ; নদী ও পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতা বন্যাকে নির্মূল করা না গেলেও তীব্রতা অনেকটাই হ্রাস সম্ভব।
[লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত]