alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

জিল্লুর রহমান

: শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক ও সর্বোত্তম উপায় নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্তকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্যের প্রয়োজন হয়। তথ্য ও উপাত্তের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়, তবে যে ধরনের তথ্যই হোক সেটা হতে হবে নির্ভুল, নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত।

কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান তথ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ করা হচ্ছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও দেশে আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অর্থনীতির মূল সূচকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। তখন অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বানোয়াটভাবে দেখানোর অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও পরিসংখ্যানগত পার্থক্য বাড়তে থাকে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই কেবল সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের তথ্য পরিসংখ্যান, যা পরিচালিত হত রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে এবং এটি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। ফলে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ধারাবাহিকভাবে বানোয়াট প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো; কিন্তু সামষ্টিক তথ্যের সঙ্গে যার কোনো মিল ছিল না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে বিকৃত ও বানোয়াট পরিসংখ্যানস সরবরাহ করা হয়। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণের কারণেই দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে এসব শুভঙ্করের ফাঁকি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জানা যায়, বিশ্বব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের স্কোর ছিল একশর মধ্যে ৮০; কিন্তু এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সে স্কোর দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় বাংলাদেশ মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে এবং এক্ষেত্রে বিকৃতি ও বানোয়াট পরিসংখ্যান তথ্য তৈরি ও সরবরাহের কারণে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।

জানা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের সব ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে। তৎকালীন বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যগত পার্থক্য বেড়েই চলছিল। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে দেখা গেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও সরকার ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়।

আসলে দেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ পরিসংখ্যানের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব খাতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে। সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিসংখ্যান টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভিত্তি হিসাবে কাজ করে এবং আমাদের পরিবর্তিত বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। পরিসংখ্যানের গুরুত্ব স্থান ও কাল ভেদে সবসময়ই ছিল; কিন্তু এখন আরও অনেক বেড়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। তাছাড়া জাতির উন্নয়ন আর অগ্রগতি যা-ই বলেন, সবকিছুর সঙ্গেই পরিসংখ্যান তথ্য জড়িত। মানুষের সুষম উন্নয়নের জন্যও পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখন বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানের দিক বিবেচনা করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন।

পরিসংখ্যানবিদদের মতে, সব খাতে নির্ভুল পরিসংখ্যানের তথ্য প্রয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। পরিসংখ্যান উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিমাপক। আর্থ-সামাজিক সব কর্মকা-ের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত সঠিক পরিসংখ্যানই কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক, জনমিতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে পরিমাণগত ও গুণগত পরিমাপে পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়োচিত পরিসংখ্যানের ব্যবহার অপরিহার্য।

বাস্তবতার নিরিখে বর্তমান বিশ্বে পরিসংখ্যান এমন একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান, যার ওপর ভিত্তি করে দেশ, জাতি, করপোরেট বিশ্বের যত সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পরিসংখ্যানহীন যেকোনো তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ এমনকি সিদ্ধান্তও এখন একেবারেই অচল। তথ্য-উপাত্তের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে আধুনিক কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য নানা অঙ্গনেও।

তথ্য বিকৃতির পরিণাম সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর মতো ঘটনা কিংবা অন্ধের হাতি দর্শন। তথ্য বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ধারণা দেয়। কিসের ভিত্তিতে দেশ চলবে, এটা বলে দেয় পরিসংখ্যান; কিন্তু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণ করলে দেশকে কোথাও না কোথাও ধাক্কা খেতে হবে। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া রাজস্ব ও রফতানিসহ সব পরিসংখ্যানের মধ্যেই দূষণ ধরা পড়ছে। বিগত পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার সরকার পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে যে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলেন; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, বৈশ্বিক ইতিহাসেও বিরল ও অভূতপূর্ব! ভবিষ্যতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারণী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

[লেখক : ব্যাংকার]

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

আফ্রিকায় হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক?

ঢাকা মহানগর ও বুড়িগঙ্গা

জামাই মেলা : উৎসব, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রঙিন চিত্রপট

হারিয়ে যাওয়া ক্লাস, কঠোর মূল্যায়ন আর প্রশ্নের জটিলতায় নুয়ে পড়া এক প্রজন্ম

বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলুন

চিকিৎসা যেন বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত না হয়

পথশিশু ও বাংলাদেশে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা

মেগা প্রকল্প : প্রশ্ন হওয়া উচিত স্বচ্ছতা নিয়ে

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি

স্মার্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা : উপগ্রহ চিত্র ও ওয়েবসাইটের অপরিহার্যতা

ক্ষমতা ও জনপ্রশাসন : আমলাতন্ত্রের ছায়াতলে আমজনতা

জনসংখ্যা : সম্পদ না সংকট?

ব্রিকসে নতুন ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান

রম্যগদ্য : ‘ল্যাংড়া-লুলা, আতুড়-পাতুড়’

আষাঢ়ী পূর্ণিমা : আত্মশুদ্ধির সাধনায় বুদ্ধের অনন্ত আলো

বদলে যাওয়া মাটিতে সাহসী বীজ : জলবায়ুর বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষির অভিযোজনগাথা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : ‘শিকলে নাহি দিব ধরা’

প্রাচীন যৌধেয় জাতি ও তাদের সাম্যবাদী শাসন

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন

টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে উপগ্রহ চিত্রই চাবিকাঠি

রাবার শিল্প : সংকট, করণীয় ও উত্তরণের দিশা

রম্যগদ্য : দুধ, দই, কলা...

ছবি

কোপার্নিকাস : আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা

টেকসই অর্থনীতির জন্য চাই টেকসই ব্যাংকিং

ডিজিটাল দাসত্ব : মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : আস্থা ভঙ্গ ও জবাবদিহিতার সংকট

আসামি এখন নির্বাচন কমিশন

কোথায় হারাল একান্নবর্তী পরিবার?

এই শান্তি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ?

মেগাসিটি : দারিদ্র্য যখন ‘অবাঞ্ছিত বর্জ্য’

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

জিল্লুর রহমান

শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সিদ্ধান্ত গ্রহণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক ও সর্বোত্তম উপায় নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্তকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্যের প্রয়োজন হয়। তথ্য ও উপাত্তের বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়, তবে যে ধরনের তথ্যই হোক সেটা হতে হবে নির্ভুল, নির্ভরযোগ্য ও বাস্তবসম্মত।

কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান তথ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সন্দেহ করা হচ্ছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও দেশে আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অর্থনীতির মূল সূচকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল। ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। তখন অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বানোয়াটভাবে দেখানোর অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও পরিসংখ্যানগত পার্থক্য বাড়তে থাকে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই কেবল সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের তথ্য পরিসংখ্যান, যা পরিচালিত হত রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে এবং এটি দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। ফলে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ধারাবাহিকভাবে বানোয়াট প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো; কিন্তু সামষ্টিক তথ্যের সঙ্গে যার কোনো মিল ছিল না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে বিকৃত ও বানোয়াট পরিসংখ্যানস সরবরাহ করা হয়। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণের কারণেই দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে এসব শুভঙ্করের ফাঁকি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জানা যায়, বিশ্বব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের স্কোর ছিল একশর মধ্যে ৮০; কিন্তু এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সে স্কোর দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় বাংলাদেশ মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে এবং এক্ষেত্রে বিকৃতি ও বানোয়াট পরিসংখ্যান তথ্য তৈরি ও সরবরাহের কারণে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।

জানা যায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের সব ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে। তৎকালীন বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যগত পার্থক্য বেড়েই চলছিল। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে দেখা গেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও সরকার ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়।

আসলে দেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল ও সময়ানুগ পরিসংখ্যানের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব খাতে পরিসংখ্যানের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে। সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিসংখ্যান টেকসই উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভিত্তি হিসাবে কাজ করে এবং আমাদের পরিবর্তিত বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। পরিসংখ্যানের গুরুত্ব স্থান ও কাল ভেদে সবসময়ই ছিল; কিন্তু এখন আরও অনেক বেড়েছে। কারণ দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি বুঝতে হলে পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। তাছাড়া জাতির উন্নয়ন আর অগ্রগতি যা-ই বলেন, সবকিছুর সঙ্গেই পরিসংখ্যান তথ্য জড়িত। মানুষের সুষম উন্নয়নের জন্যও পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখন বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যানের দিক বিবেচনা করেই উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন।

পরিসংখ্যানবিদদের মতে, সব খাতে নির্ভুল পরিসংখ্যানের তথ্য প্রয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। পরিসংখ্যান উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিমাপক। আর্থ-সামাজিক সব কর্মকা-ের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত সঠিক পরিসংখ্যানই কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক, জনমিতিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রে পরিমাণগত ও গুণগত পরিমাপে পরিসংখ্যানের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সরকারি ও বেসরকারি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেকোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়োচিত পরিসংখ্যানের ব্যবহার অপরিহার্য।

বাস্তবতার নিরিখে বর্তমান বিশ্বে পরিসংখ্যান এমন একটি স্বীকৃত বিজ্ঞান, যার ওপর ভিত্তি করে দেশ, জাতি, করপোরেট বিশ্বের যত সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পরিসংখ্যানহীন যেকোনো তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ এমনকি সিদ্ধান্তও এখন একেবারেই অচল। তথ্য-উপাত্তের প্রচুর ব্যবহার রয়েছে আধুনিক কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য নানা অঙ্গনেও।

তথ্য বিকৃতির পরিণাম সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর মতো ঘটনা কিংবা অন্ধের হাতি দর্শন। তথ্য বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য ধারণা দেয়। কিসের ভিত্তিতে দেশ চলবে, এটা বলে দেয় পরিসংখ্যান; কিন্তু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি-নির্ধারণ করলে দেশকে কোথাও না কোথাও ধাক্কা খেতে হবে। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া রাজস্ব ও রফতানিসহ সব পরিসংখ্যানের মধ্যেই দূষণ ধরা পড়ছে। বিগত পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার সরকার পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে যে কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলেন; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, বৈশ্বিক ইতিহাসেও বিরল ও অভূতপূর্ব! ভবিষ্যতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারণী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

[লেখক : ব্যাংকার]

back to top