alt

উপ-সম্পাদকীয়

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

অরূপরতন চৌধুরী

: শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) এর প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মৃত্যুবার্ষিকী। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিকে ‘ডায়াবেটিক সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অবদান চিরস্মরণীয়। মহান সেই ব্যক্তির আদর্শ ও চিকিৎসাসেবায় প্রয়োগ পদ্ধতির মূল কথা হলোÑ রোগীর সমস্যা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারলে রোগীর আস্থা বাড়বে, চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তি মানসিক শান্তি পাবেন, চিকিৎসক পরোপকারের সামাজিক স্বীকৃতি পাবেন এবং এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উভয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় ও উপলক্ষ তৈরি হবে। দেশে অজ¯্র চিকিৎসক তার সেই নীতি অনুসরণ করেন। তাকে ‘রোল মডেল’ মেনে পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারী রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এই রোগ সারা জীবনের রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় কিন্তু, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার বেশি। আইডিএফ ডায়াবেটিস এটলাস ডায়াবেটিসের বৈশি^ক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়Ñ ২০২১ সালে ৫৩.৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে একজন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪.৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮.৩ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লাখেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশে^র ৬৭ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিসের কারণে, যা বৈশি^ক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯%।

ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি তার ডায়াবেটিসের সুগার লেভেল স্বাভাবিক রাখতে চান তবে তার নিয়মিত ওষুধ (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) ব্যায়াম ও খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে যেমন শৃঙ্খলা বা নিয়মকানুন (ডাক্তারের পরামর্শ ও পথ্যবিদের খাদ্য তালিকা) মেনে চলবেন ঠিক তেমনভাবে তিনি কিন্তু মুখের ভেতরের অংশ যেমনÑ দাঁত, মাড়ি ও জিহ্বার যতœ করবেন। কারণ মুখের ভিতরের দাঁতে, মাড়িতে, জিহ্বার বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ভালো দাঁতের যতœ মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, যাকে ব্লাড সুগারও বলা হয়, যখন খুব বেশি হয় তখন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। ডায়াবেটিস মুখের ভেতরের অনেক অংশের যেমন দাঁত ও মাড়িতে ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের মাড়ির রোগ মুখ গহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যতœ নিলে এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরও খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখকে বা মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে। ডায়বেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারেÑ তরল যা মুখকে ভিজা রাখে। মুখের ভেতরের লালা দাঁতের ক্ষয় রোধ করে খাবারের টুকরো ধুয়ে ফেলে, ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিরোধে এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত অ্যাসিডের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লালায় খনিজ উপাদান রয়েছে যা মুখের টিস্যু রক্ষা করতে এবং দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ, বা দন্তক্ষয় বেশি হয়। ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখ গহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয় তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্লেক নামক নরম আঠালো ফিল্ম তৈরি করে, যা দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয় তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এই সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে।

ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কিভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ অনুসরণ করা প্রয়োজন। যদি ডেন্টিস্টের কাছে যেতে নার্ভাস বোধ করেন, তাহলে ডেন্টিস্ট এবং কর্মীদের ভয় সম্পর্কে বলুন। ডেন্টিস্ট প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসাব্যবস্থা নিতে পারবেন।

তামাক ও ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা, মুখের সমস্যা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু করে তারা পরবর্তীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান, তামাক সেবন করে তবে তাদেরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রিন’ হওয়ার সম্ভাবনা ৫ গুণ বেশি। তাছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’ এর জটিলতা বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়।

অতএব, মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বা মুখের রোগ প্রতিরোধে যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেও মুখের যতœ বা রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করানো জরুরি। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অমর বাণীÑ ‘প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগী যদি তিনটি উ- উরবঃ, উৎঁম, উরংপরঢ়ষরহব অর্থাৎ পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ এবং রক্ত পরীক্ষা ও নিয়মিত ব্যায়াম এই তিনটি নীতিকে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মেনে চলেন তাহলে তারা অবশ্যই স্বাভাবিকের কাছাকাছি, সামাজিকভাবে উপযোগী, সৃজনশীল কাজে সক্ষম ও সম্মানজনক জীবন নির্বাহ করতে পারবেন।’ প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।

[লেখক : প্রফেসর ও সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম]

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

চরের কৃষি ও কৃষকের জীবন

নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নাই

সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করা দরকার

পুলিশ কবে পুলিশ হবে

জীবন ফিরে আসুক বাংলার নদীগুলোতে

কান্দন সরেন হত্যা ও ভূমি বিরোধ কি এড়ানো যেত না

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র: রাষ্ট্র বিনির্মাণে সমস্যা কোথায়?

মানবাধিকার দিবস : মানুষের অধিকার নিয়ে কেন এত কথা?

আমলাতান্ত্রিক স্বচ্ছতা : সংস্কারের পথে নাকি পুনরাবৃত্তি?

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কথা

ছবি

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

দুর্নীতির সর্বগ্রাসী বিস্তার বন্ধ করতে হবে

মা তোর বদনখানি মলিন হলে

ব্যবসায়ী নেতৃত্বশূন্য ই-ক্যাব

মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ে নতুন পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

অরূপরতন চৌধুরী

শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) এর প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মৃত্যুবার্ষিকী। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিকে ‘ডায়াবেটিক সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অবদান চিরস্মরণীয়। মহান সেই ব্যক্তির আদর্শ ও চিকিৎসাসেবায় প্রয়োগ পদ্ধতির মূল কথা হলোÑ রোগীর সমস্যা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারলে রোগীর আস্থা বাড়বে, চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তি মানসিক শান্তি পাবেন, চিকিৎসক পরোপকারের সামাজিক স্বীকৃতি পাবেন এবং এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উভয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় ও উপলক্ষ তৈরি হবে। দেশে অজ¯্র চিকিৎসক তার সেই নীতি অনুসরণ করেন। তাকে ‘রোল মডেল’ মেনে পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

ডায়াবেটিস বর্তমানে একটি মহামারী রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এই রোগ সারা জীবনের রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় কিন্তু, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার বেশি। আইডিএফ ডায়াবেটিস এটলাস ডায়াবেটিসের বৈশি^ক প্রভাব সম্পর্কে সর্বশেষ যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়Ñ ২০২১ সালে ৫৩.৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে একজন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪.৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮.৩ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি ২ জনে ১ জন) জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ১২ লাখেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশে^র ৬৭ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় ডায়াবেটিসের কারণে, যা বৈশি^ক স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৯%।

ডায়াবেটিসের সঙ্গে মুখের স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি তার ডায়াবেটিসের সুগার লেভেল স্বাভাবিক রাখতে চান তবে তার নিয়মিত ওষুধ (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) ব্যায়াম ও খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে যেমন শৃঙ্খলা বা নিয়মকানুন (ডাক্তারের পরামর্শ ও পথ্যবিদের খাদ্য তালিকা) মেনে চলবেন ঠিক তেমনভাবে তিনি কিন্তু মুখের ভেতরের অংশ যেমনÑ দাঁত, মাড়ি ও জিহ্বার যতœ করবেন। কারণ মুখের ভিতরের দাঁতে, মাড়িতে, জিহ্বার বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ভালো দাঁতের যতœ মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, যাকে ব্লাড সুগারও বলা হয়, যখন খুব বেশি হয় তখন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। ডায়াবেটিস মুখের ভেতরের অনেক অংশের যেমন দাঁত ও মাড়িতে ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের মাড়ির রোগ মুখ গহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যতœ নিলে এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরও খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখকে বা মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে। ডায়বেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারেÑ তরল যা মুখকে ভিজা রাখে। মুখের ভেতরের লালা দাঁতের ক্ষয় রোধ করে খাবারের টুকরো ধুয়ে ফেলে, ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিরোধে এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত অ্যাসিডের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লালায় খনিজ উপাদান রয়েছে যা মুখের টিস্যু রক্ষা করতে এবং দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ, বা দন্তক্ষয় বেশি হয়। ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখ গহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয় তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্লেক নামক নরম আঠালো ফিল্ম তৈরি করে, যা দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয় তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এই সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে।

ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কিভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ অনুসরণ করা প্রয়োজন। যদি ডেন্টিস্টের কাছে যেতে নার্ভাস বোধ করেন, তাহলে ডেন্টিস্ট এবং কর্মীদের ভয় সম্পর্কে বলুন। ডেন্টিস্ট প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসাব্যবস্থা নিতে পারবেন।

তামাক ও ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা, মুখের সমস্যা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু করে তারা পরবর্তীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান, তামাক সেবন করে তবে তাদেরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রিন’ হওয়ার সম্ভাবনা ৫ গুণ বেশি। তাছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’ এর জটিলতা বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়।

অতএব, মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বা মুখের রোগ প্রতিরোধে যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেও মুখের যতœ বা রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করানো জরুরি। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অমর বাণীÑ ‘প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগী যদি তিনটি উ- উরবঃ, উৎঁম, উরংপরঢ়ষরহব অর্থাৎ পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ এবং রক্ত পরীক্ষা ও নিয়মিত ব্যায়াম এই তিনটি নীতিকে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মেনে চলেন তাহলে তারা অবশ্যই স্বাভাবিকের কাছাকাছি, সামাজিকভাবে উপযোগী, সৃজনশীল কাজে সক্ষম ও সম্মানজনক জীবন নির্বাহ করতে পারবেন।’ প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।

[লেখক : প্রফেসর ও সম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম]

back to top