alt

উপ-সম্পাদকীয়

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

বশিরুল ইসলাম

: শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল দেশের ১১টি জেলা। ৩১ আগস্ট শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, এখনও দেশের ১১টি জেলায় ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। চলমান বন্যায় দেশের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমির শাক-সবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘরসহ বসতভিটায় পানি ওঠায় গোখাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পশুর অসুখ বিসুখ বেড়ে গেছে। যাদের পুকুরে মাছ ছিল, সেগুলোও ভেসে গেছে। বন্যার সময় অনেক বাড়িঘর পানির নিচে চলে যাওয়ায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে গবাদিপশু বেঁধে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও উঁচু সড়কের উপর বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাদার খাবার খাওয়াতে না পেরে অনেকে কচুরিপানা খাওয়াচ্ছেন। পশুর পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি বিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। ২৪ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা। চলমান বন্যায় প্রাণিসম্পদ- পোল্ট্রি, পশুখাদ্য, মাছ এবং অবকাঠামোর দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে মৎস্য খামারিরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, জলাধার ও খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। এছাড়া প্রায় ৩৭৫ কোটি মাছের পোনা ও পোস্ট লার্ভা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু খাতে এখন পর্যন্ত ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। আকস্মিক বন্যার পানিতে অনেক গবাদিপশু ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক খামারি। বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদায়। প্রাণিসম্পদ খাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খামারিদের জন্য সত্যি খুব কঠিন। তাই তাদের ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান একান্তই দরকার। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপৎকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আরও রয়েছে নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা হতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা পরামর্শ। ইতোমধ্যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা না গেলে এক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও ধান চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমনÑ বিআর৫, বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান ৪৬, ব্রি ধান ৭৫, বিনা ধান ১৭ জাতসমূহ বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না। কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ্য রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানে গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এছাড়া মাসকালাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর মরিচ ও ডাল জাতীয় ফসলের বীজ বোনা যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিনা চাষে গিমাকলমি, লালশাক, ডাঁটা, পালং, পুঁইশাক, ধনে, সরিষা, খেসারি, মাষকালাই আবাদ করা যেতে পারে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে এবং সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। মৎস্য চাষিদের প্রথমে পুকুর বা জলাশয়ের পাড় ভেঙে গেছে সেগুলো দ্রুত মেরামত বা সংস্কার করতে হবে। বন্যার পানির সঙ্গে বিভিন্ন অচাষযোগ্য মাছ যদি প্রবেশ করে, তখন ঘন ঘন জাল টেনে মাছগুলো তুলে ফেলতে হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী পুকুরে পরিমাণমতো চুন এবং লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া বন্যা-পরবর্তী সময়ে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির নানা ধরনের রোগবালাই যেমনÑ গরুর খুরা রোগ, গলাফোলা রোগ, তড়কা, বাদলা, হাঁস-মুরগির রাণীক্ষেত, ছাগল ও ভেড়ার পিপিআর ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। নানা ধরনের পরজীবী বা কৃমির আক্রমণ বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রতিষেধক টিকা প্রদান এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

আগামী রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গমে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে প্রান্তিক কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। কৃষকরা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। রাষ্ট্রের কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতার কারণে কৃষিজমি ও কৃষকরা অবহেলা আর ভোগান্তির মধ্যে আছে। কৃষকরা কী পরিমাণ কষ্ট এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে সেটা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবে না। কৃষকরা উৎপাদন বন্ধ করে দিলে দেশের উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। ব্যবসায়ী, মহাজন সবাই কৃষকদের শোষণ করছে। অবিলম্বে কৃষকদের স্বাস্থ্য বীমার পাশাপাশি কৃষি বিমা চালু করতে হবে। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপ খাত-গবাদিপশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। যেহেতু নিচু এলাকায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে সেহেতু নিচু এলাকার কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সন্দেহ নেই। এ ধরনের বিপদ-বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তাই এগুলোকে সহজভাবে নিতে পারলে ভালো। কারণ বন্যা শুধু আমাদের ক্ষতিই করে না; উপকারও করে থাকে। যেমন বন্যার পানি আমাদের অপরিচ্ছন্ন এবং দূষিত পরিবেশকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়। পানির সঙ্গে ভেসে আসা কোটি কোটি টন পলি আমাদের জমিকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা, সেগুলোর প্রতিটি বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের আরও বেশি সক্রিয়তা দেখাতে হবে বন্যা-পরবর্তী সময়ে। সমাজের সবাইকে তার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আর এ সবকিছু করতে হবে সবাইকে নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে। কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং করাতে হবে। পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে হবে। এ পর্যায়ে কৃষকের সবচেয়ে বেশি দরকার হয় আর্থিক ও মানসিক সাহায্য। তাদের টিকে থাকার জন্য গবাদিপশু পালন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষকদের সাহায্য করবে, তাদেরও আয়কর কমানোসহ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকের জন্য শুধু ত্রাণ যথেষ্ট নয়; বন্যার পরে কৃষককে তার কৃষিকাজের সঙ্গেই যতটা সম্ভব সম্পৃক্ত রাখাটাই আসল। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প উৎস তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। নদী ও খাল-বিল খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ সচল রাখা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়]

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

বশিরুল ইসলাম

শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল দেশের ১১টি জেলা। ৩১ আগস্ট শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, এখনও দেশের ১১টি জেলায় ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। চলমান বন্যায় দেশের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমির শাক-সবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘরসহ বসতভিটায় পানি ওঠায় গোখাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পশুর অসুখ বিসুখ বেড়ে গেছে। যাদের পুকুরে মাছ ছিল, সেগুলোও ভেসে গেছে। বন্যার সময় অনেক বাড়িঘর পানির নিচে চলে যাওয়ায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে গবাদিপশু বেঁধে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও উঁচু সড়কের উপর বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাদার খাবার খাওয়াতে না পেরে অনেকে কচুরিপানা খাওয়াচ্ছেন। পশুর পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি বিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। ২৪ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা। চলমান বন্যায় প্রাণিসম্পদ- পোল্ট্রি, পশুখাদ্য, মাছ এবং অবকাঠামোর দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে মৎস্য খামারিরা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর, জলাধার ও খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯ এবং ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ টন। এছাড়া প্রায় ৩৭৫ কোটি মাছের পোনা ও পোস্ট লার্ভা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু খাতে এখন পর্যন্ত ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। আকস্মিক বন্যার পানিতে অনেক গবাদিপশু ভেসে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক খামারি। বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদায়। প্রাণিসম্পদ খাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খামারিদের জন্য সত্যি খুব কঠিন। তাই তাদের ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান একান্তই দরকার। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপৎকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আরও রয়েছে নাবী জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা হতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা পরামর্শ। ইতোমধ্যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা না গেলে এক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও ধান চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমনÑ বিআর৫, বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান ৪৬, ব্রি ধান ৭৫, বিনা ধান ১৭ জাতসমূহ বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না। কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ্য রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানে গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এছাড়া মাসকালাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর মরিচ ও ডাল জাতীয় ফসলের বীজ বোনা যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে গেলে বিনা চাষে গিমাকলমি, লালশাক, ডাঁটা, পালং, পুঁইশাক, ধনে, সরিষা, খেসারি, মাষকালাই আবাদ করা যেতে পারে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে এবং সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। মৎস্য চাষিদের প্রথমে পুকুর বা জলাশয়ের পাড় ভেঙে গেছে সেগুলো দ্রুত মেরামত বা সংস্কার করতে হবে। বন্যার পানির সঙ্গে বিভিন্ন অচাষযোগ্য মাছ যদি প্রবেশ করে, তখন ঘন ঘন জাল টেনে মাছগুলো তুলে ফেলতে হবে। বন্যার পানি নেমে গেলে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী পুকুরে পরিমাণমতো চুন এবং লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া বন্যা-পরবর্তী সময়ে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির নানা ধরনের রোগবালাই যেমনÑ গরুর খুরা রোগ, গলাফোলা রোগ, তড়কা, বাদলা, হাঁস-মুরগির রাণীক্ষেত, ছাগল ও ভেড়ার পিপিআর ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। নানা ধরনের পরজীবী বা কৃমির আক্রমণ বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সহযোগিতা ও পরামর্শে প্রতিষেধক টিকা প্রদান এবং কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

আগামী রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গমে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে প্রান্তিক কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। কৃষকরা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। রাষ্ট্রের কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতার কারণে কৃষিজমি ও কৃষকরা অবহেলা আর ভোগান্তির মধ্যে আছে। কৃষকরা কী পরিমাণ কষ্ট এবং দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে সেটা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যাবে না। কৃষকরা উৎপাদন বন্ধ করে দিলে দেশের উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। ব্যবসায়ী, মহাজন সবাই কৃষকদের শোষণ করছে। অবিলম্বে কৃষকদের স্বাস্থ্য বীমার পাশাপাশি কৃষি বিমা চালু করতে হবে। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপ খাত-গবাদিপশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। যেহেতু নিচু এলাকায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে সেহেতু নিচু এলাকার কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সন্দেহ নেই। এ ধরনের বিপদ-বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তাই এগুলোকে সহজভাবে নিতে পারলে ভালো। কারণ বন্যা শুধু আমাদের ক্ষতিই করে না; উপকারও করে থাকে। যেমন বন্যার পানি আমাদের অপরিচ্ছন্ন এবং দূষিত পরিবেশকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়। পানির সঙ্গে ভেসে আসা কোটি কোটি টন পলি আমাদের জমিকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা, সেগুলোর প্রতিটি বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের আরও বেশি সক্রিয়তা দেখাতে হবে বন্যা-পরবর্তী সময়ে। সমাজের সবাইকে তার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আর এ সবকিছু করতে হবে সবাইকে নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে। কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং করাতে হবে। পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে হবে। এ পর্যায়ে কৃষকের সবচেয়ে বেশি দরকার হয় আর্থিক ও মানসিক সাহায্য। তাদের টিকে থাকার জন্য গবাদিপশু পালন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষকদের সাহায্য করবে, তাদেরও আয়কর কমানোসহ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকের জন্য শুধু ত্রাণ যথেষ্ট নয়; বন্যার পরে কৃষককে তার কৃষিকাজের সঙ্গেই যতটা সম্ভব সম্পৃক্ত রাখাটাই আসল। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প উৎস তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। নদী ও খাল-বিল খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ সচল রাখা এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়]

back to top