alt

উপ-সম্পাদকীয়

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

সিরাজ প্রামাণিক

: শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পৃথিবীর বহু দেশে পতিতাবৃত্তি কোনো অপরাধ নয়। যেমনÑ বেলজিয়ামে রীতিমতো পার্লামেন্টে আইন পাস করে যৌনকর্মীদের দেয়া হয়েছে যুগান্তকারী কিছু সুযোগ-সুবিধা। এমনকি একটা নির্দিষ্ট সময় পর যৌনকর্মীরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পেনশন পাবেন সরকারের পক্ষ থেকে। শুধু পেনশন নয়, প্রত্যেক যৌনকর্মীর থাকবে স্বাস্থ্যবিষয়ক ইন্স্যুরেন্স, যার আওতায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন। এছাড়া বেকারত্ব ভাতা পাবেন তারা। যৌনকর্মে নামার পর কাজ না পেলে সরকার অর্থ প্রদান করবে। আছে পারিবারিক ভাতাও। নতুন আইন অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটিও আছে যৌনকর্মীদের। যৌনকর্মীদের বেশকিছু অধিকারও দেয়া হয়েছে। খদ্দেরের অধীনে চলে যাওয়ার পরও যৌনকর্মে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন। শাস্তির ভয় ছাড়াই যে কোনো সময় যৌনকর্মে বিঘœ ঘটানোর অধিকার পাবেন যৌনকর্মীরা। যে কোনো সময় কোনো প্রকার পূর্ব নোটিশ ছাড়াই চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবেন। এতে তারা বেকরত্ব ভাতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না।

যৌনকর্মীরা যাতে অন্য কাজে যোগ দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে তাদের পরিচয় সুরক্ষিত রাখার বিধান রয়েছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, যৌনকর্মী যদি ৬ মাসের মধ্যে কোনো খদ্দেরকে ১০ বারের বেশি প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে তাকে নিয়োগকারী এ ব্যাপারে সরকারের সহায়তা চাইতে পারেন। কিন্তু তাকে বরখাস্ত করতে পারবেন না।

আইনটিতে আরও বলা হয়েছে, যে কক্ষে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, সেখানে যৌনকর্মীর জন্য একটি এলার্ম বাটন থাকবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা রাখা হবে।

পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমনÑ দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপতœী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিৎব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রুপজীবা ইত্যাদি। এ পেশায় নিয়োজিতরা নিজদেহ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ নিজদেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন।

জর্জ স্কট তার ‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেনÑ‘পতিতারা হলো সেই সম্প্রদায়ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।’ অক্সফোর্ড ডিকশনারি মতে বেশ্যা হলো একজন নারী যে তার দেহ ভাড়া দেয় যথেচ্ছ যৌন-সংসর্গের জন্য।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, একজন বেশ্যা ভালো প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর মধ্যে পতিতাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বিশিষ্ট প্রতœতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ড. অতুল সুর তার দেবলোকের যৌনজীবন বইয়ের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’।

রোমান ইতিহাস মতে, পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তার ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিত। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী কর্তৃক রচিত ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ শোভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটিতে তিনি লিখেছেন ‘বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন যে নিয়মিত বেশ্যাপাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন। তারা বলেন, নিষিদ্ধ পল্লীতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই ‘বসুমতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। ডা. লুৎফর রহমান তার ‘মহাজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন না-ই থাকত তাহলে তারা অনেক আগেই হরিয়ে যেত।’ প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত যে, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এই সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।

দেহব্যবসা নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতাবিরোধী। এ ব্যবসাটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। পৃথিবীর সব ধর্ম শাস্ত্রে দেহ ব্যবসাকে বড় ধরনের পাপ বলা হয়েছে। দেহব্যবসা জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর বিধায় পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দ-বিধিতে দেহব্যবসাকে সরাসরি অপরাধ বলা না হলেও এ অপরাধটি গণউৎপাতের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এটি দ-বিধির অধীন একটি অপরাধ। তাছাড়া আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর যে কোন কাজ নিষিদ্ধকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। গণিকাবৃত্তি বিষয়ে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে গণিকাবৃত্তি নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

বেশ্যাবৃত্তি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বে-আইনি নয়, কিন্তু ব্যবসার জন্য যৌনতার ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্য ইমমরাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট ১৯৫৬ রচিত হয়েছে এটি রোধ করার জন্য। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো নারী ও শিশুপাচার বা যৌনকর্মে লিপ্ত করার জন্য তাদের সংগ্রহ বন্ধ করা, যাতে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনব্যবসার বলি না হতে হয়।

পৃথিবীর যেসব দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃত সেসব দেশে পতিতাদের নিয়মিত নির্ধারিত সময়অন্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোন পতিতার মধ্যে যৌন সংক্রামক জীবাণু বা ব্যাধি পাওয়া গেলে তাকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হওয়া বা আরোগ্য লাভ না করা পর্যন্ত এ পেশায় পুনরায় ফিরে আসতে দেয়া হয় না।

পৃথিবীর ধর্মমতসমূহের মধ্যে ব্যভিচার, দেহব্যবসা বা যৌনতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান সবচেয়ে কঠোর। একজন ব্যভিচারীর জন্য ইসলামে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে সেটি হলো পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যু কার্যকর। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও আমাদের দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু নেই।

আইনি দিক থেকে জবরদস্তিমূলক শ্রম ও পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর ১৮(২) অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ পাচারের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। আইনটিতে পাচারের জন্য শাস্তি থাকলেও ভিকটিমের পুনর্বাসনের কোনো বিধান নেই। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্র গণিকালয় পতিতাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব বসতিস্থল সাধারণত বেশ্যাপাড়া বা পতিতালয় নামে সুপরিচিত। পতিতারা তাদের পেশার জন্য হলফনামা দিয়ে অনুমতি গ্রহণ করতে পারে।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]

প্রযুক্তির মায়াজালে বন্দি মানুষ

ছবি

এসএম সুলতান : সংস্কৃতি সত্তার সত্যপাঠ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

তরুণ সমাজ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা : সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বগুড়ার তাঁতপল্লী

অটিজম কোনো রোগ নয়

জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কি আইনসম্মত

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কতদিন সহায়তা দেয়া হবে?

বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য বয়সবৈষম্য দূর করুন

আসন্ন বোরো উৎপাদন ও কিছু শঙ্কা

ছবি

আইন পেশার জানা-অজানা কথা

ছবি

ব্যাংক খাতের সংকট

একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি

বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

ব্রি: কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ক্রেতা ঠকে গেলে তার আইনগত প্রতিকার

ঢাকার যানজট : কিছু প্রস্তাব

রম্যগদ্য : দারিদ্র্য যাবে জাদুঘরে

গার্মেন্টস খাতে সংকট

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনায় করুণ দশা

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কী

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার বাড়াতে

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির দুর্বলতা

ইরানের কেন কৌশলগত পরিবর্তন

শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক

রামু ট্র্যাজেডির এক যুগ

প্রত্যাশিত শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত রূপরেখা

ব্যাংক খাতের সংস্কার

শিক্ষার একটি স্থায়ী কমিশন সময়ের দাবি

ছবি

ক্ষমতা এখন ‘মব’-এর হাতে

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বামপন্থির উত্থান

আমন ধানে আগাম ফুল আসার কারণ

উচ্চ ফলনশীল বারি মসুর-৮

কী হবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

রম্যগদ্য : ‘বল করে দুর্বল...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

সিরাজ প্রামাণিক

শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পৃথিবীর বহু দেশে পতিতাবৃত্তি কোনো অপরাধ নয়। যেমনÑ বেলজিয়ামে রীতিমতো পার্লামেন্টে আইন পাস করে যৌনকর্মীদের দেয়া হয়েছে যুগান্তকারী কিছু সুযোগ-সুবিধা। এমনকি একটা নির্দিষ্ট সময় পর যৌনকর্মীরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পেনশন পাবেন সরকারের পক্ষ থেকে। শুধু পেনশন নয়, প্রত্যেক যৌনকর্মীর থাকবে স্বাস্থ্যবিষয়ক ইন্স্যুরেন্স, যার আওতায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন। এছাড়া বেকারত্ব ভাতা পাবেন তারা। যৌনকর্মে নামার পর কাজ না পেলে সরকার অর্থ প্রদান করবে। আছে পারিবারিক ভাতাও। নতুন আইন অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটিও আছে যৌনকর্মীদের। যৌনকর্মীদের বেশকিছু অধিকারও দেয়া হয়েছে। খদ্দেরের অধীনে চলে যাওয়ার পরও যৌনকর্মে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন। শাস্তির ভয় ছাড়াই যে কোনো সময় যৌনকর্মে বিঘœ ঘটানোর অধিকার পাবেন যৌনকর্মীরা। যে কোনো সময় কোনো প্রকার পূর্ব নোটিশ ছাড়াই চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবেন। এতে তারা বেকরত্ব ভাতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না।

যৌনকর্মীরা যাতে অন্য কাজে যোগ দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে তাদের পরিচয় সুরক্ষিত রাখার বিধান রয়েছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, যৌনকর্মী যদি ৬ মাসের মধ্যে কোনো খদ্দেরকে ১০ বারের বেশি প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে তাকে নিয়োগকারী এ ব্যাপারে সরকারের সহায়তা চাইতে পারেন। কিন্তু তাকে বরখাস্ত করতে পারবেন না।

আইনটিতে আরও বলা হয়েছে, যে কক্ষে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, সেখানে যৌনকর্মীর জন্য একটি এলার্ম বাটন থাকবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা রাখা হবে।

পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমনÑ দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপতœী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিৎব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রুপজীবা ইত্যাদি। এ পেশায় নিয়োজিতরা নিজদেহ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ নিজদেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন।

জর্জ স্কট তার ‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেনÑ‘পতিতারা হলো সেই সম্প্রদায়ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।’ অক্সফোর্ড ডিকশনারি মতে বেশ্যা হলো একজন নারী যে তার দেহ ভাড়া দেয় যথেচ্ছ যৌন-সংসর্গের জন্য।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, একজন বেশ্যা ভালো প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর মধ্যে পতিতাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বিশিষ্ট প্রতœতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ড. অতুল সুর তার দেবলোকের যৌনজীবন বইয়ের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’।

রোমান ইতিহাস মতে, পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তার ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিত। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী কর্তৃক রচিত ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ শোভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটিতে তিনি লিখেছেন ‘বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন যে নিয়মিত বেশ্যাপাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন। তারা বলেন, নিষিদ্ধ পল্লীতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই ‘বসুমতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। ডা. লুৎফর রহমান তার ‘মহাজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন না-ই থাকত তাহলে তারা অনেক আগেই হরিয়ে যেত।’ প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত যে, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এই সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।

দেহব্যবসা নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতাবিরোধী। এ ব্যবসাটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। পৃথিবীর সব ধর্ম শাস্ত্রে দেহ ব্যবসাকে বড় ধরনের পাপ বলা হয়েছে। দেহব্যবসা জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর বিধায় পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের দ-বিধিতে দেহব্যবসাকে সরাসরি অপরাধ বলা না হলেও এ অপরাধটি গণউৎপাতের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এটি দ-বিধির অধীন একটি অপরাধ। তাছাড়া আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর যে কোন কাজ নিষিদ্ধকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। গণিকাবৃত্তি বিষয়ে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে গণিকাবৃত্তি নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

বেশ্যাবৃত্তি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বে-আইনি নয়, কিন্তু ব্যবসার জন্য যৌনতার ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্য ইমমরাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট ১৯৫৬ রচিত হয়েছে এটি রোধ করার জন্য। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো নারী ও শিশুপাচার বা যৌনকর্মে লিপ্ত করার জন্য তাদের সংগ্রহ বন্ধ করা, যাতে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনব্যবসার বলি না হতে হয়।

পৃথিবীর যেসব দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃত সেসব দেশে পতিতাদের নিয়মিত নির্ধারিত সময়অন্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোন পতিতার মধ্যে যৌন সংক্রামক জীবাণু বা ব্যাধি পাওয়া গেলে তাকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হওয়া বা আরোগ্য লাভ না করা পর্যন্ত এ পেশায় পুনরায় ফিরে আসতে দেয়া হয় না।

পৃথিবীর ধর্মমতসমূহের মধ্যে ব্যভিচার, দেহব্যবসা বা যৌনতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান সবচেয়ে কঠোর। একজন ব্যভিচারীর জন্য ইসলামে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে সেটি হলো পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যু কার্যকর। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও আমাদের দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু নেই।

আইনি দিক থেকে জবরদস্তিমূলক শ্রম ও পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর ১৮(২) অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ পাচারের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। আইনটিতে পাচারের জন্য শাস্তি থাকলেও ভিকটিমের পুনর্বাসনের কোনো বিধান নেই। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমির বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্র গণিকালয় পতিতাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব বসতিস্থল সাধারণত বেশ্যাপাড়া বা পতিতালয় নামে সুপরিচিত। পতিতারা তাদের পেশার জন্য হলফনামা দিয়ে অনুমতি গ্রহণ করতে পারে।

[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]

back to top