alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘আবার তোরা মানুষ হ’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘নতুন বাংলাদেশ’র অভ্যুদয়ের পর সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে। এই পদত্যাগ মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কয়েকজন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে, যারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসর’। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেহেতু শিক্ষকদের নিপীড়ন করা হয়েছে, তাই এখনও হবে-এমন যুক্তিও দিচ্ছেন অনেকে। অনেকের অভিমত, আওয়ামী লীগ আমলে যারা নির্যাতন করেছে তাদের ওপর প্রতিশোধ রোধ করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলছেন, কোন কোন শিক্ষক তাদের মন্দ আচরণের প্রতিফল পাচ্ছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজনীতির নোংরা খেলাও ছিল। শিক্ষক বিতাড়নের রাজনীতির নোংরা খেলায় অনেক শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব শিক্ষক নিপীড়ন গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা শিক্ষক নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের বাইরে থেকে প্ররোচনা দেয়া হয়েছে, তারা না বুঝে প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে শিক্ষকদের বিতাড়নে অংশ নিয়েছে। কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা যখনই বুঝতে পেরেছে তখনই তারা তাদের বিতাড়িত শিক্ষককে আবার ফেরত এনেছে, শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। শিক্ষক বিতাড়নে স্কুলের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও কাজ করেছে। অনেকে আবার ‘বেত’ উঠিয়ে দেয়াকে দায়ী করেছেন। কিন্তু শাস্তি দিয়ে ‘মানুষ’ করা গেলে তৃতীয় বিশ্বের লোকগুলোর জন্য জেলখানা লাগত না। শাস্তি দিয়ে পড়ালেখা বা নৈতিকতা শেখানোর কথা পশ্চিমের দেশগুলোতে কল্পনাও করা যায় না। উন্নত দেশগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর শারীরিক বা মানসিক কোন ধরনের নির্যাতন করা হয় না; অথচ জাপান, সুইডেন প্রভৃতি দেশের ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব অমায়িক, ভদ্র ও বিনয়ী।

আমি বাংলাদেশ ব্যাংক, ফরিদাবাদ স্কুলে সাত বছর ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম; বাংলাদেশ ব্যাংক, মতিঝিল স্কুলে দুই টার্ম ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলাম এবং টাকশাল স্কুলের পৃষ্ঠপোষক ছিলাম দশ বছর। প্রতিটি স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে এবং সাবজেক্ট ও ক্লাস বরাদ্দ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি দেখেছি। সাধারণত সহকারী প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের সম্পর্ক থাকে সাপে-নেউলে, প্রধান শিক্ষককে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হওয়ার তীব্র বাসনা লক্ষ্য করেছি সহকারী প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে। যে সব সাবজেক্টে ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়ে সেই সব সাবজেক্টে ক্লাস নেয়ার জন্য শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয় এবং এই প্রতিযোগিতা শিক্ষার পরিবেশকে প্রতিনিয়ত কলুষিত করছে। শিক্ষকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছাড়াও জাতীয় রাজনীতিও শিক্ষার পরিবেশ দূষিত করে তুলছে। ছাত্র-শিক্ষকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য দরকার রাজনীতি মুক্ত শিক্ষা পরিবেশ।

আমরা যারা পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে স্কুলে-কলেজে পড়েছি তারা সবাই শিক্ষকের হাতে কমবেশি মার খেয়েছি এবং তা নিয়ে আমাদের কোন আপসোসও নেই। কিন্তু এখন মনে হয়, কোন কোন শিক্ষক ছিলেন নিষ্ঠুর ও নির্দয়। তারা এত নির্দয়ভাবে পেটাতেন যে, রাতে আমাদের জ্বর এসে যেত, মা গায়ে তেল মেখে দিতেন। তখন অশিক্ষিত বাবারা সন্তানকে প্রথমদিন স্কুলে নিয়ে শিক্ষকদের বলতেন, ‘হাড্ডি আমার, মাংস আপনার’। কী নির্মম রীতি! বেত ওঠিয়ে দেয়ার পরও কিছু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের এখনো নির্মমভাবে পেটান। শিক্ষকদের এমন নির্যাতনে অতিষ্ঠ বলেই হয়তো শিক্ষকদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু তা যদি সত্য হয় তাহলে মাদ্রাসা-মক্তবে শিক্ষক নির্যাতনের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীদের ওপর শুধু শারীরিক নির্যাতন হয় না, সেখানে ধর্ষণ আর বলাৎকারের অভিযোগও আছে। কোনো কোনো মাদ্রাসায় এমনও ঘটেছে যে, ছাত্রকে হাত-পা বেঁধে, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে টাঙিয়ে পেটানো হয়েছে। এটা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করা প্রায় অসম্ভব।

যৌন হয়রানি শুধু মাদ্রাসায় নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির অভিনব কৌশল হচ্ছে, ছাত্রীরা শিক্ষকের যৌন প্রস্তাবে সম্মত না হলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির আড়ালে ছাত্ররা যেমন টেন্ডারবাজি করে, তেমনি কিছু শিক্ষকও দুর্নীতিতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অবশ্য বেতন-ভাতাদি বিবেচনায় দেশে শিক্ষকরা অনেকটা অবহেলিত। সরকারি অফিসের একজন করণিকের বেতন-ভাতা স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষকের চেয়ে বেশি। তাই শিক্ষকরা প্রাইভেট বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রাইভেট পড়ানোর মধ্যে কোন অপরাধ নেই, অপরাধ হচ্ছে প্রাইভেট পড়–য়া ছাত্রছাত্রী এবং বাকি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের বৈষম্যমূলক আচরণ। যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের ইঙ্গিতে শুধু প্রশ্ন বলে দেয়া হয় না, পরীক্ষায় বেশি নম্বরও দেয়া হয়। কোন কোন শিক্ষক ক্লাসে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়।

শিক্ষকদের নানাবিধ কুৎসিৎ আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ থাকলেও এবারের মতো জোটবদ্ধ প্রতিবাদ আগে কখনো দেখা যায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সফলতার পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের হুমকির প্রেক্ষিতে ভিসি ও শিক্ষকদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। ভিন্ন আদর্শের শিক্ষকদের মধ্যে ভয়ভীতি এত ভয়াবহ ছিল যে, তারা নিজেরা ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি না হয়ে বাসা থেকে বা গোপন আস্তানা থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের কিছু কাজ ছিল দৃষ্টিকটু, শিক্ষকদের গলায় জুতার মালা পরানো, চড়-থাপ্পড় দিয়ে টেনেহিচড়ে চেয়ার থেকে মাটিতে ফেলে দেয়া, গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা ইত্যাদি। শিক্ষকের যত অপরাধই থাকুক না কেন, এভাবে নাজেহাল হওয়ার চিত্র দেখে অভিভাবকরা বিব্রত। শিক্ষকের সন্তানেরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হত মর্যাদা শত অনুতাপ দিয়েও ঘোচানো যায় না।

১৯২৪ সালে আমার বাবা আবদুর রশীদ মাস্টার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেনী জি এ একাডেমি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করে চাকরি করার কোন আগ্রহ দেখাননি; তিনি ১৯২৬ সালে আমাদের জিএমহাট এলাকায় স্থানীয় জমিদার ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় একটি মাইনর স্কুল (ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জিএমহাট মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু তার শিক্ষক-প্রশিক্ষণ না থাকায় পরবর্তীকালে এক সময় তাকে প্রধান শিক্ষকের পদ তার ছাত্র-শিক্ষকের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু সেই প্রধান শিক্ষককে কখনো বাবার সম্মুখে চেয়ারে বসতে দেখিনি। বাবার প্রায় সমবয়সীরা ছিলেন বাবার ছাত্র, এলাকায় সবাই তাকে মাস্টার কাকা, মাস্টার ভাই, মাস্টার সাহেব ইত্যাদি বিশেষণে সম্বোধন করতেন, ফলে আমাদের বাড়ির নাম হয়ে গেল ‘মাস্টার বাড়ি’। তার অবসরকালীন গ্রামের বাজারে আসার পথে তাকে তার কোন ছাত্র অতিক্রম করে সম্মুখে গিয়েছেন এমন কোন নজির ছিল না। সাইকেল আরোহী ছাত্ররা বাবাকে দেখে বাবার পেছনেই সাইকেল থেকে নেমে যেতেন, সাইকেল ঠেলে ঠেলে বাবার পেছনে পেছনে পথ চলতেন। রাস্তায় চলার পথে কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করলে বাবা চিনতে পারতেন না, কিন্তু কেঁদে দিতেন। তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তার প্রবীণ ছাত্র কবিরাজ কাকা তালগাছের কচি পাতা কেটে নিয়ে নিজ হাতে পাখা করেছেন।

আমরা পাঁচ ভাই, সবাই শিক্ষকতা করেছি। বড় ভাই মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করে বিনা বেতনে বাবার স্কুলেই যোগদান করেন। কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৬৭ সনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পূর্বে দুই বছর ফেনী কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সেজো ভাই জহির উদ্দিন আহমেদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অবসর নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তার ছেলে শামীম আহমেদ জিতু কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারপরের ভাই মুনির উদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, মাঝখানে লিয়েনে ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, এখন ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমিও ১৯৮০ সালে একটি কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। আমার ছেলে তানভীর আহমেদ অর্ণবও কানাডায় ইংরেজি ভাষার একজন শিক্ষক। শিক্ষকের ঘরে জন্ম, শিক্ষকতা এক সময় পেশা ছিল বলেই বোধ হয় কোন শিক্ষকের অপমান, লাঞ্ছনা দেখলে ব্যথিত হই, লজ্জায় মুখ লুকাই।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের বিরাট অর্জন; কিন্তু সেই অর্জনের অনেকটুকুই নষ্ট হয়ে গেল শিক্ষক লাঞ্ছনার মহামারীতে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের আলোকে আলোকিত হোক মানবসমাজ এবং গর্বিত হোক মানবজাতি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র জমা না দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্যে খান আতা তার বিখ্যাত সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ তৈরি করেছিলেন; ‘নতুন স্বাধীনতার’ বীর সেনানীদের নিজ হাতে বিচার তুলে নেয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র সমন্বয়কদেরও খান আতার মতো সোচ্চার হওয়া জরুরি।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]

মানুষের পর কারা হবে বিশ্বজয়ী

স্বাস্থ্য খাতে ফার্মাসিস্টদের অবদান

টেকসই রাষ্ট্রীয় সংস্কারে শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যাহত বিনির্মাণের বিকল্প নাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সামাজিক অর্থায়নের ভূমিকা

বিশ্ব নরসুন্দর দিবস

মধু পূর্ণিমা ও প্রাসঙ্গিক কথা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

ছয়টি কমিশন গঠিত হলো কিন্তু শিক্ষা কোথায়?

বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতা

‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি’

শিক্ষাব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বন্যা পরবর্তী রোগবালাই

রম্যগদ্য : থামব কবে কাইজ্জা-ফ্যাসাদ

প্রসঙ্গ : জাতীয় সংগীত

পানির ব্যবহার, পানির রাজনীতি

রবীন্দ্র ভাবনায় কৃষি এবং আজকের প্রেক্ষাপট

শিক্ষা ব্যবস্থার বিনির্মাণে শিক্ষা প্রশাসনের পুনর্গঠন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

ভোজ্যতেল সংকট মেটাতে পাম চাষের গুরুত্ব

গোপনে ধারণকৃত ভিডিও ও ছবি দিয়ে প্রতারণা

হুন্ডি কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘আবার তোরা মানুষ হ’

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘নতুন বাংলাদেশ’র অভ্যুদয়ের পর সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে। এই পদত্যাগ মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কয়েকজন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে, যারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসর’। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেহেতু শিক্ষকদের নিপীড়ন করা হয়েছে, তাই এখনও হবে-এমন যুক্তিও দিচ্ছেন অনেকে। অনেকের অভিমত, আওয়ামী লীগ আমলে যারা নির্যাতন করেছে তাদের ওপর প্রতিশোধ রোধ করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলছেন, কোন কোন শিক্ষক তাদের মন্দ আচরণের প্রতিফল পাচ্ছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজনীতির নোংরা খেলাও ছিল। শিক্ষক বিতাড়নের রাজনীতির নোংরা খেলায় অনেক শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব শিক্ষক নিপীড়ন গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা শিক্ষক নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের বাইরে থেকে প্ররোচনা দেয়া হয়েছে, তারা না বুঝে প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে শিক্ষকদের বিতাড়নে অংশ নিয়েছে। কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা যখনই বুঝতে পেরেছে তখনই তারা তাদের বিতাড়িত শিক্ষককে আবার ফেরত এনেছে, শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। শিক্ষক বিতাড়নে স্কুলের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও কাজ করেছে। অনেকে আবার ‘বেত’ উঠিয়ে দেয়াকে দায়ী করেছেন। কিন্তু শাস্তি দিয়ে ‘মানুষ’ করা গেলে তৃতীয় বিশ্বের লোকগুলোর জন্য জেলখানা লাগত না। শাস্তি দিয়ে পড়ালেখা বা নৈতিকতা শেখানোর কথা পশ্চিমের দেশগুলোতে কল্পনাও করা যায় না। উন্নত দেশগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর শারীরিক বা মানসিক কোন ধরনের নির্যাতন করা হয় না; অথচ জাপান, সুইডেন প্রভৃতি দেশের ছাত্রছাত্রীরা অসম্ভব অমায়িক, ভদ্র ও বিনয়ী।

আমি বাংলাদেশ ব্যাংক, ফরিদাবাদ স্কুলে সাত বছর ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম; বাংলাদেশ ব্যাংক, মতিঝিল স্কুলে দুই টার্ম ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলাম এবং টাকশাল স্কুলের পৃষ্ঠপোষক ছিলাম দশ বছর। প্রতিটি স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে এবং সাবজেক্ট ও ক্লাস বরাদ্দ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি দেখেছি। সাধারণত সহকারী প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের সম্পর্ক থাকে সাপে-নেউলে, প্রধান শিক্ষককে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হওয়ার তীব্র বাসনা লক্ষ্য করেছি সহকারী প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে। যে সব সাবজেক্টে ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়ে সেই সব সাবজেক্টে ক্লাস নেয়ার জন্য শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয় এবং এই প্রতিযোগিতা শিক্ষার পরিবেশকে প্রতিনিয়ত কলুষিত করছে। শিক্ষকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছাড়াও জাতীয় রাজনীতিও শিক্ষার পরিবেশ দূষিত করে তুলছে। ছাত্র-শিক্ষকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য দরকার রাজনীতি মুক্ত শিক্ষা পরিবেশ।

আমরা যারা পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে স্কুলে-কলেজে পড়েছি তারা সবাই শিক্ষকের হাতে কমবেশি মার খেয়েছি এবং তা নিয়ে আমাদের কোন আপসোসও নেই। কিন্তু এখন মনে হয়, কোন কোন শিক্ষক ছিলেন নিষ্ঠুর ও নির্দয়। তারা এত নির্দয়ভাবে পেটাতেন যে, রাতে আমাদের জ্বর এসে যেত, মা গায়ে তেল মেখে দিতেন। তখন অশিক্ষিত বাবারা সন্তানকে প্রথমদিন স্কুলে নিয়ে শিক্ষকদের বলতেন, ‘হাড্ডি আমার, মাংস আপনার’। কী নির্মম রীতি! বেত ওঠিয়ে দেয়ার পরও কিছু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের এখনো নির্মমভাবে পেটান। শিক্ষকদের এমন নির্যাতনে অতিষ্ঠ বলেই হয়তো শিক্ষকদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু তা যদি সত্য হয় তাহলে মাদ্রাসা-মক্তবে শিক্ষক নির্যাতনের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীদের ওপর শুধু শারীরিক নির্যাতন হয় না, সেখানে ধর্ষণ আর বলাৎকারের অভিযোগও আছে। কোনো কোনো মাদ্রাসায় এমনও ঘটেছে যে, ছাত্রকে হাত-পা বেঁধে, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে টাঙিয়ে পেটানো হয়েছে। এটা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সহ্য করা প্রায় অসম্ভব।

যৌন হয়রানি শুধু মাদ্রাসায় নয়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির অভিনব কৌশল হচ্ছে, ছাত্রীরা শিক্ষকের যৌন প্রস্তাবে সম্মত না হলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির আড়ালে ছাত্ররা যেমন টেন্ডারবাজি করে, তেমনি কিছু শিক্ষকও দুর্নীতিতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অবশ্য বেতন-ভাতাদি বিবেচনায় দেশে শিক্ষকরা অনেকটা অবহেলিত। সরকারি অফিসের একজন করণিকের বেতন-ভাতা স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষকের চেয়ে বেশি। তাই শিক্ষকরা প্রাইভেট বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রাইভেট পড়ানোর মধ্যে কোন অপরাধ নেই, অপরাধ হচ্ছে প্রাইভেট পড়–য়া ছাত্রছাত্রী এবং বাকি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শিক্ষকদের বৈষম্যমূলক আচরণ। যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের ইঙ্গিতে শুধু প্রশ্ন বলে দেয়া হয় না, পরীক্ষায় বেশি নম্বরও দেয়া হয়। কোন কোন শিক্ষক ক্লাসে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হয়।

শিক্ষকদের নানাবিধ কুৎসিৎ আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ থাকলেও এবারের মতো জোটবদ্ধ প্রতিবাদ আগে কখনো দেখা যায়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সফলতার পর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের হুমকির প্রেক্ষিতে ভিসি ও শিক্ষকদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। ভিন্ন আদর্শের শিক্ষকদের মধ্যে ভয়ভীতি এত ভয়াবহ ছিল যে, তারা নিজেরা ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি না হয়ে বাসা থেকে বা গোপন আস্তানা থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের কিছু কাজ ছিল দৃষ্টিকটু, শিক্ষকদের গলায় জুতার মালা পরানো, চড়-থাপ্পড় দিয়ে টেনেহিচড়ে চেয়ার থেকে মাটিতে ফেলে দেয়া, গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা ইত্যাদি। শিক্ষকের যত অপরাধই থাকুক না কেন, এভাবে নাজেহাল হওয়ার চিত্র দেখে অভিভাবকরা বিব্রত। শিক্ষকের সন্তানেরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, হত মর্যাদা শত অনুতাপ দিয়েও ঘোচানো যায় না।

১৯২৪ সালে আমার বাবা আবদুর রশীদ মাস্টার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেনী জি এ একাডেমি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করে চাকরি করার কোন আগ্রহ দেখাননি; তিনি ১৯২৬ সালে আমাদের জিএমহাট এলাকায় স্থানীয় জমিদার ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় একটি মাইনর স্কুল (ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জিএমহাট মাইনর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু তার শিক্ষক-প্রশিক্ষণ না থাকায় পরবর্তীকালে এক সময় তাকে প্রধান শিক্ষকের পদ তার ছাত্র-শিক্ষকের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু সেই প্রধান শিক্ষককে কখনো বাবার সম্মুখে চেয়ারে বসতে দেখিনি। বাবার প্রায় সমবয়সীরা ছিলেন বাবার ছাত্র, এলাকায় সবাই তাকে মাস্টার কাকা, মাস্টার ভাই, মাস্টার সাহেব ইত্যাদি বিশেষণে সম্বোধন করতেন, ফলে আমাদের বাড়ির নাম হয়ে গেল ‘মাস্টার বাড়ি’। তার অবসরকালীন গ্রামের বাজারে আসার পথে তাকে তার কোন ছাত্র অতিক্রম করে সম্মুখে গিয়েছেন এমন কোন নজির ছিল না। সাইকেল আরোহী ছাত্ররা বাবাকে দেখে বাবার পেছনেই সাইকেল থেকে নেমে যেতেন, সাইকেল ঠেলে ঠেলে বাবার পেছনে পেছনে পথ চলতেন। রাস্তায় চলার পথে কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করলে বাবা চিনতে পারতেন না, কিন্তু কেঁদে দিতেন। তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তার প্রবীণ ছাত্র কবিরাজ কাকা তালগাছের কচি পাতা কেটে নিয়ে নিজ হাতে পাখা করেছেন।

আমরা পাঁচ ভাই, সবাই শিক্ষকতা করেছি। বড় ভাই মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করে বিনা বেতনে বাবার স্কুলেই যোগদান করেন। কূটনৈতিক ভাই মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৬৭ সনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পূর্বে দুই বছর ফেনী কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। সেজো ভাই জহির উদ্দিন আহমেদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অবসর নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তার ছেলে শামীম আহমেদ জিতু কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারপরের ভাই মুনির উদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, মাঝখানে লিয়েনে ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, এখন ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমিও ১৯৮০ সালে একটি কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। আমার ছেলে তানভীর আহমেদ অর্ণবও কানাডায় ইংরেজি ভাষার একজন শিক্ষক। শিক্ষকের ঘরে জন্ম, শিক্ষকতা এক সময় পেশা ছিল বলেই বোধ হয় কোন শিক্ষকের অপমান, লাঞ্ছনা দেখলে ব্যথিত হই, লজ্জায় মুখ লুকাই।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের বিরাট অর্জন; কিন্তু সেই অর্জনের অনেকটুকুই নষ্ট হয়ে গেল শিক্ষক লাঞ্ছনার মহামারীতে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের আলোকে আলোকিত হোক মানবসমাজ এবং গর্বিত হোক মানবজাতি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র জমা না দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্যে খান আতা তার বিখ্যাত সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ তৈরি করেছিলেন; ‘নতুন স্বাধীনতার’ বীর সেনানীদের নিজ হাতে বিচার তুলে নেয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র সমন্বয়কদেরও খান আতার মতো সোচ্চার হওয়া জরুরি।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]

back to top